দেশে দেশে রোজার উৎসব
মাহে রমজান আরবী নবম মাসের নাম। চাঁদের আবর্তন দ্বারা যে এক বৎসর গণনা করা হয়,
ফারসি কবি শেখ সাদির মত ভাব-সাগরের ডুবুরি, আধ্যাত্মসমুদ্রের মুক্তা ও বোধের কেন্দ্রবিন্দুতে দৃশ্যমান জগতের আলোছায়া অতিক্রমী অদৃশ্য আলোকভিসারী এক ধ্রুবতারা কবির নাম শিতালং শাহ। শব্দের তারকালোকে জ্যোতির্ময় এক দূরগামী দূরদর্শী ঈগলের মানবিক রূপ কিংবা জাজ্বল্যমান হীরক খন্ডের মতো সমাধৃত। সমকালীন বাংলা সাহিত্যের হালকা পাতলা আঁচলের আড়ালে এক মূল্যবান মুক্তার নাম শিতালং শাহ রহ.। হযরত শাহজালাল শাহপরাণ রহ.সহ ৩৬০ আউলিয়ার পদধ্বনিতে সিলেট হয়ে উঠে যেমন বাংলার আধ্যাত্মিক রাজধানী। তেমনই এপুণ্যভূমির আধ্যাত্মিকতা ও স্বকীয়তা রক্ষায় যুগে যুগে এখানে জন্ম নিয়েছেন অনেক ওলী-আউলিয়া, সুফি সাধক, মরমি কবি সাহিত্যক। বলেছেন তাঁরা নানা চিন্তার কথা, করেছেন অনেক কাজ। লিখনশৈলীতে তাঁরা তুলে ধরেছেন তাওহিদ, রিসালত, আখেরাতসহ সমকালীন ও ভবিষ্যতের অনেক কথা।
তাঁদের রচিত সাহিত্য, কবিতা ও গানে রয়েছে আধ্যাত্মবাদ তথা সূিফবাদের নিদর্শন। সিলেট বিভাগে সূফি ভাবধারার কাব্য রচনায় উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্বের সংখ্যা অনেক। তাদের মধ্যে রয়েছেন গোলাম হোসেন, সৈয়দ মুসা, সৈয়দ সুলতান, সৈয়দ শাহনূর, শাহ আবদুল ওয়াহ্হাব, শিতালং শাহ, শেখ ভানু, হাফিয হাতিম, শাহ আরকুম প্রমুখ। ফকির শিতালং অখন্ডভারতের মরমি কবিতায় প্রত্যেয় সাহস নিয়ে সিলেটের ঐতিহ্যের স্মারক ‘সিলেটি নাগরী হরফে’ কলম ধরেছেন অষ্টাদশ শতাব্দির মাঝামাঝি সময়ের কিছু আগ থেকে। স্বনামে নন্দিত, স্বনির্মিত এ কবির জীবন কামনায় ছিল তীব্র আশ্লেষের ভাষা নির্মাণের অঙ্গিকার। বিষাদ ও বিভ্রমের তীব্র জ্বালা হৃদয়ের মন্দিরায় তুলে নিয়েই এ কবি স্বপ্ন-মানুষ। মরমি কবি শিতালং শাহ। যেভাবেই দেখি শিতালং এক ধরনের বিস্ময়। এক আশ্চর্য ভঙ্গির অবয়ব। এক রহস্যময় ব্যক্তিত্ব। তাঁর রচিত কবিতা বা গানসমূহ অত্যন্ত জনপ্রিয়। সূফীদর্শনের ওপর লিখিত তাঁর গানসমূহ ‘রাগ শিতালঙ্গী’ নামে পরিচিত।
জন্ম ও বংশপরিচয়
শিতালং শাহ বা সুফি শিতালং শাহ। শিতালং ফারসি শব্দ, অর্থ পায়ের গোঁড়ালির গোল হাড়। শিতালং শাহ তাঁর মুর্শিদ প্রদত্ত ফকিরী নাম। প্রকৃত নাম মোহাম্মদ সলিম উল্লাহ। জন্ম ১৮০৬ সালের মে মাসে। (১২০৭-১২৯৬বাংলা) দেশবিভাগ-পূর্ব সিলেটের অন্তর্গত করিমগঞ্জ মহকুমায় বদরপুর থানার খিত্তাশিলচর গ্রামে। তাঁর পিতার নাম মোহাম্মদ জাঁহাবখস, মাতার নাম সুরতজান বিবি। আলিম মিয়া, পিরু মিয়া নামক দ’ু-ভাই এবং নাম উদ্ধার করা যায়নি আরেক ভাইও ছিল তাঁর। তিনি স্বীয় কবিতায় আপন পরিচয় তুলে ধরেছেন এভাবে-
“শিতালং নাম মোর গুনা বেশুমার/ কৃপা যদি করে আল্লাহ করিম গফফার।/ মোহাম্মদ সলিম উরফে দোষ গুণে মাজুর/ জাহাবখশ আলী নাম পিতার মশহুর।/ পরগণা চাপঘাট মোর পয়দায়িশ যেথায়/ শ্রীগৌরি মৌজাতে, শিলচর খিত্তায়।” (ফজলুর রহমান, সিলেটের মরমী সঙ্গীত, পৃষ্ঠা ৩৭)
জনশ্রæতি মোতাবেক জাহাবখস ছিলেন ঢাকার নবাব বংশের লোক। বাণিজ্য উপলক্ষে তিনি এ অঞ্চলে আসেন। নৌকা ডুবিতে তার বাণিজ্য দ্রব্য বিনষ্ট হয়ে যাওয়ার ফলে তিনি খিত্তাশিলচরের জমিদার মীর মাহমুদের বাড়িতে আশ্রয় গ্রহণ করেন। মীর মাহমুদ জাহাবখসের গুণে মুগ্ধ হয়ে তার সঙ্গে নিজ কন্যা সুরতজান বিবির বিয়ে দেন। কিছু দিন পরেই তাদের ঘরে শিতালং শাহের জন্ম হয়। পরবর্তী কালে জমিদার মীর মাহমুদ তার জামাতাকে তারিণীপুরে বেশ কিছু ভুসম্পত্তি দান করেন। ফলে তিনি এখানেই বসতি স্থাপন করে পারিবারিক জীবন যাপন শুরু করেন। জাহাবখসের কনিষ্ঠ পুত্রের অধঃস্থন বংশধর আজও তারিণীপুরে বসবাস করছেন বলে জানা যায়। (সূফি সাধক শিতালং শাহ- সৈয়দ মোস্তফা কামাল, পৃ:৭২)
শিক্ষা-দীক্ষা ঃ শিতালং শাহের লেখাপড় শুরু হয় তারিণীপুর মক্তবে। পরে তিনি উচ্চ শিক্ষা লাভে সিলেট শহর থেক দশ মাইল পুবে গোলাপগঞ্জ উপজেলার ফুলবাড়ী মাদ্রাসায় লেখাপড়া করেন। সেখানে তিনি কোরআন হাদিস শিক্ষাসহ ইসলামি শিক্ষায় উচ্চ শিক্ষা লাভ করেন। সুবিখ্যাত এ মাদ্রাসায় পড়ার সাথে সাথে নিজ প্রচেষ্টায় নাগরীভাষা ও লিপিতে উচ্চ পর্যায়ের জ্ঞান লাভ করেন।
আধ্যাত্মিকতা লাভ ঃ বাংলাদেশের সর্বপ্রাচীন মৌলিক শিক্ষাব্যবস্থা-মাদ্রাসা শিক্ষায় তখন শুধু ইসলামি শিক্ষাই দেয়া হত না, বরং আধ্যাত্মিক জ্ঞানে শিক্ষা দেওয়ার মতো মাকবুল, কামেল আলেম তখন ফুলবাড়ীতে ছিলেন। ফলে শিতালং শাহ মাদ্রাসার প্রধান শিক্ষক ও মুর্শিদ শাহ সুফি আব্দুল ওয়াহহাব চৌধুরী ও অন্য শিক্ষক আব্দুল কাহিরের কাছে আধ্যাত্মিক দীক্ষা গ্রহন করে ধীরে ধীরে তিনি আধ্যাত্মিক ভাবে পারদর্শী হয়ে উঠেন। এ প্রসঙ্গে কবি নিজেই বলেন- ‘শাহ আব্দুল আলী মোর পীর দস্তগীর/ হাশিল মুরাদ ওলী বাতিনে জাহির।/ মুর্শিদে কামিল মোর শাহ আব্দুল ওহাব/ তিনির প্রসাদে হৈল ধিয়ানেতে লাভ।’
গুরু প্রদত্ত শিক্ষা-দীক্ষায় অল্প দিনেই তিনি মানসিক প্রস্তুতি তৈরি করে ইলমে তাসাউফের দারপ্রান্তে পৌছেন। এক পর্যায়ে মুর্শিদের নির্দেশ মোতাবেক শিতালং শাহ লাউড়ের ভুবন পাহাড়ে নির্জন সাধনায় আত্মবিভোর হয়ে কয়েক বছর গোপনে অবস্থান করেন। গোপন সাধনা থেকে ফিরে এসে মুর্শিদের আদেশে দীন-দুঃখি মানুষের মাঝে বিচরণ করে মানব কল্যাণের বাণী প্রচারে আত্মনিয়োগ করেন। ইসলামি মতাদর্শের ভিত্তিতে তিনি আল্লাহর পথে জীবন যাপন করতে সঙ্গীতের মাধ্যমে মানুষকে আহŸান জানান। তার একটি গানে তিনি বলেন- “শিতালং ফকিরে বলে ও মুমিন বৃথা আইলায় দুনিয়ায়/ আল্লাহ আল্লাহ বল ভাই-রে তরাইবানে ইল্লাল্লায়।”
মানব সৃষ্টির ভেদ রহস্য উদঘাটন করে শিতালং শাহ মানুষকে বুঝাতে থাকেন স্রষ্টাই চিরসত্য, তার পরে সত্য কিছুই নয়। তাই সৃষ্টির জন্য উচিত ¯্রষ্টার প্রতি নথ হয়ে থাকা। শিতালং শাহ স্রষ্টার সত্য হওয়ার তাৎপর্যময় বিষয়টি তাঁর স্বরচিত ভাব সঙ্গীতে এভাবে বলেছেন- ‘প্রাণধন কালা- ও কালা অপূর্ব মহিমা তোমার লিলা/ নিশানা নমুনা নাই- সৎ রূপে তোমারে পাই/ আছো তুমি শয়াল জোড়িয়া/ ভাবের ভাবিনি হইয়া-নিজ নামে ডাকি প্রিয়া/ একবার দরশন দিবায়নি কালিয়া-রে।’
সূফি দর্শনে স্বকীয় ভাবনা ও রচনা ঃ সংসার ত্যাগী এ সূফি মুর্শিদের ইজাজত পেয়ে কঠোর সাধনায় মগ্ন হন। ভূবন পাহাড় থেকে লাউড় পাহাড় পর্যন্ত দীর্ঘ বারো বছর সাধনা করে কামালিয়াত হাসিল করেন। সূফি দর্শনের এ কুকিলের মাথায় সর্বদা থাকত বিশ্ব ভাবনা । তাঁর ভাবনার জগৎ কী বিশাল। ভাবনার পৃথিবীতে কেমন বিচরণ ছিল তাঁর। কেমন মগ্নচেতনার মধ্যে ডুবে ছিলেন তিনি। আলো-আঁধারির মতন এক ধরনের রহস্য ঘিরে ছিল তাঁকে। অথবা তিনিই জাগিয়ে রাখতেন রহস্যের পৃথিবী। তিনি দেখতেন। দেখতে দেখতেই চলতেন। চলতে চলতেই আবিস্কার করতেন জীবনের নানা বাঁক। নানা সন্ধি। নানা আটঘাট। যেখানে মানুষেরা কাদে। হাসে। বিমর্ষ হয়। বসে থাকে মৌনতার ভেতর। জাগে উৎসবের আনন্দে। জ্বলে একাকিত্বের দহনে। আশা জাগায় বুকের ভেতর। শেষ থেকে সূচনা কিংবা সমাপ্তি থেকে আরম্ভের ভেতর দিয়েই চলছে পৃথিবী। এগিয়ে যাবে ভবিষ্যতের দিকে। ভবিষ্যতের কথাই বলে যান একজন কবি। যেমন বলেছেন শিতালং শাহ। বিশ্বমানবের আত্ম-উদ্বোধনে কথা ও আত্মার দিকে ফেরার কথা বলতে শিতালং শাহ প্রায় ১২শত পৃষ্ঠার সংঙ্গিত রচনা করেছেন ‘সিলেটী নাগরী’ লিপিতে। তাঁর লিখিত গ্রন্থ- ১. রাগ বাউল ২. কিয়ামত নামা ৩. মুশকিল তরান প্রভৃতি বই কিংবা পান্ডুলিপি নিয়ে দেশের খ্যাতনামা লেখক, গবেষক, কবি ও সাহিত্যিকরা কাজ করেছেন, করছেন এবং করবেন-ই। (সূফি সাধক শিতালং শাহ-পৃ: ৩৩)
সংসার জীবন ও মুরিদ করণ ঃ বারো বছর সাধনায় কাঠিয়ে লাউড় পাহাড় থেকে ফিরে কাঠিগড়ার কারিগর জমিদার আব্দুর রহমান চৌধুরীর বাড়ীতে অবস্থান করেন। কিছুদিন ছন্নছাড়া অবস্থায় দেওরাইল, মাখল, বদরপুর প্রভৃতি অঞ্চলে ঘুরাফেরা করেন। এ সময় তাঁর মুর্শিদ থেকে সংসার, ধর্মপালন ও ধর্ম প্রচারের নির্দেশ আসে। ফলে তিনি বদরপুরের গড়কাপন মৌজার মাজু মিয়াঁর বোনকে বিয়ে করে সাংসারিক জীবন শুরু করেন। ক্রমান্বয়ে শিতালং শাহ‘র জ্ঞান-চরিত্র মাধুর্য-কারামত দেখে অনেক লোক তাঁর কাছে মুরিদ হয় এবং ধীরে ধীরে এ সংখ্যা বাড়তে থাকে। সেখান থেকে পরে তিনি বরাক মোহনা বা সুরমা-কুশিয়ারার সঙ্গম স্থলের পার্শে অবস্থিত গায়বি দিঘীর পশ্চিমের গ্রামে প্রিয় মুরিদ মোহাম্মদ চৌধুরীর অনুরোধে খিত্তে তাশীর চকে একটি বাড়ী তৈরি করে বসবাস করেন। এ বাড়ীতেই তাঁর তিন ছেলে- ইদ্রিছ আলী, মন্তাজ আলী ও মদরীছ আলীর জন্ম হয়। মেয়ে সায়েরা, সিতারা ও জাবেরা বিবিদের জন্ম এখানেই। তাঁর ছোট ছেলে মদরীছ আলীর তিন পুত্র- মাহমুদ আলী, আহমদ আলী ও মৌলানা তৈয়বুর রহমান। (সূফি সাধক শিতালং শাহ- সৈয়দ মোস্তফা কামাল পৃ: ৫৯)
শিতালং ছিলেন কাজের মানুষ। প্রচুর কাজ করতেন। প্রতিদিন অন্তত একটি হলেও আতœাকে ঈমানি চেতনায় সজিব করতেন। নীশিথের শয্যা ত্যাগ, অপরিসীম সাধনা, হাজারো কষ্ট-যাতনা-বেদনা-দোতনা- ডিঙিয়ে নিজের জন্য আবিস্কার করেছেন স্বতন্ত্র এক জগৎ। তৈরি করেছেন আপন বলয়। মগ্নতার প্রবল সাধনা তাঁর সামনে খুলে দিয়েছিল বিশ্বজগতের রহস্য। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে তিনি দেখেছেন সৃষ্টিরহস্যের ভেতর পৃথিবী। সৃষ্টিরহস্য উন্মোচিত হয়েছিল তাঁর হ্রদয়ের কাছে। বলতেন শেষরাতে স্রষ্টার কাছে প্রার্থনার কবিতা। যেমন-‘শিতালং নাম মোর গোনাহ বেশুমার/ কৃপা যদি করে আল্লাহ করিম-গাফ্ফার।/ ভবের মায়ায় মজি কইলাম কত রং ঢং/ বিপাকে ঠেকিয়া কাঁন্দে ফকির শিতালং।’
সূফিবাদ ও শিতালং শাহ ঃ সূফিবাদ বা সূফি দর্শন, আরবি সূফিয়াত বা তাসাওফ শব্দ থেকে এসেছে, এটিকে ইসলামি আধ্যাত্মিক দর্শন বলে। আত্মা সম্পর্কিত আলোচনা এর মুখ্য বিষয়। আত্মার পরিশুদ্ধির মাধ্যমে আল্লাহর সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনই হলো এ দর্শনের মর্মকথা। ¯্রষ্টা ও সৃষ্টির মধ্যে বিদ্যমান সম্পর্ককে আধ্যাত্মিক ধ্যান ও জ্ঞানের মাধ্যমে জানার প্রচেষ্টাকে সূফি দর্শন বলা হয়। এটি খ্রিস্টীয় দশম শতাব্দীতে দ্বীনে ইসলামের অভাবনীয় তাকাযায় আধ্যাত্মিক সুলুক ও অনুশীলন সুসংগঠিতভাবে শুরু হয়। বিখ্যাত আবদাল-গউস-কুতুব-পীর-মুর্শিদরা বিভিন্ন তরিকা প্রতিষ্ঠা করেন। নানাভাবে এর শাখা-প্রশাখা গজিয়ে বর্তমান পৃথিবীতে প্রায় তিন শতাধিক তরীকা বিদ্যমান। এগুলোর মধ্যে চার তরিকা- ১. চিশতিয়া ২. কাদরিয়া ৩. নকশবন্দিয়া ৪. মুজাদ্দেদিয়া তরিকা কিংবা সোহরাওয়ার্দীয়া তরিকা কেবল ইসলামি জীবন ব্যবস্থা, কোরআন-সুন্নাহ এবং ইসলামি ফিকাহের উপর দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত। এ তরিকা খলিফাতুল মুসলিমিন আবুবকর সিদ্দিক রা. ও হযরত আলী রা.‘র মাধ্যমে রাসুল সা. পর্যন্ত এর সিলসিলা (শৃঙ্খলা) অনুসৃত। (ইমাম গাজ্জালি রহ., মিনহাজুল আবেদীন দশম সংস্করণ)
সূফিবাদ আল্লাহর প্রেম এবং ধ্যানের উপর প্রতিষ্ঠিত। মরমিবাদ ও সূফিবাদে ধারণাগত বা বিশ্লেষণাত্মক জ্ঞানের কোনো স্থান নেই। দার্শনিকগণ যেভাবে পরম সত্যকে জানতে চায়, ঠিক তেমনি সূফিগণ সেই পরম সত্যকে মনে প্রাণে উপলব্ধি করতে চান। আল্লাহ প্রেমে বিভোর হয়ে আত্মার পবিত্রতার মাধ্যমে ফানাফিল্লাহ এবং বাকাবিল্লাহ লাভ করত; তাদের কার্যকলাপ সাধারণের জ্ঞানাতীত। দর্শন বিজ্ঞানের জটিল তত্ত¡ সৃষ্টি রহস্যকে যতই জটিলতর করুকনা কেন মানুষের মনে? এর সঠিক ব্যাখ্যা ও জীবন জিজ্ঞাসার আগ্রহ থেকেই মানব মনে উদ্গত হয়েছে সূফিবাদের আত্মদর্শন। আত্মার আনন্দ আবিস্কারের সাধনা শিতালংকে পরিণত করেছে অন্য এক মানুষে। তাঁর মগ্নতা তাকে এনে দিয়েছে ¯্রষ্টার প্রতি নিবেদন। এভাবে তিনি তাঁর মগ্নতার পৃথিবীতে মজেছেন।
যা-ই হোক কর্মের কান্ডটাই দেখে মানুষ। লেখে ইতিহাস। স্মরণ করে মানুষ থেকে মানুষেরা। মানুষের এই যে মর্মভেদী চাঞ্চল্য, একে নির্মাণ করার দায়িত্ব মানুষেরই। এর জন্য সৃষ্টি করে নিতে হয় আপন ভূবন। যাকে বলা যায় নিজস্ব জগৎ। এমনই নিজস্ব জগতের স্রষ্টা ছিলেন সূফি সাধক ফকির শিতালং শাহ। এমনই আনন্দ ছিল তাঁর নিজের ভুবনে। সে ভুবনের বাঁশি বাজাতেন তিনি। কি সুর ছড়াত সে বাঁশির হৃদয়? নাকি বাঁশিই বেজে উঠত তাঁর ভেতর। সে কথাই কি তিনি বলেছেন- ‘কদম তলে বাঁশী বাজাও শুনিতে মধুর/ বিরহিণী হইয়া ঝুরি শুনি মধুর সুর।/ রসিক বন্ধুয়া তুমি গিরি প্রেম ধন / প্রেমভাবে হইয়া মোরে দেও দরশন।/ অন্তরে দগ্ধে প্রাণী প্রেমের অনল/ কামনলে অংগ দেহে না হয় শিতল।/ তর প্রেমভাবে মোর শোষিল পাঞ্জর/ যোগিনীর বেশে ফিরি দেশ দেশান্তর।’
কেরামত : বাঘের পিঠে শিতালং ঃ এক সময় শিতালং শাহ নিগূঢ় সাধনায় আত্মবোলা হয়ে কোন এক জঙ্গলে ধ্যান মগ্ন হয়ে বেশ কয়েক বছর অতিবাহিত করছেন। এদিকে তাঁর মা জননী পুত্রের জন্য ব্যাকুল হয়ে লোক ডেকে পাঠান ফুলবাড়ী মাদ্রাসার শিক্ষক শাহ সুফি আব্দুল ওয়াহহাব চৌধুরী রহ. এর কাছে। শাহ সুফি আব্দুল ওয়াহহাব চৌধুরী রহ. লোক মুখে তাঁর (শিতালং শাহের) মায়ের ব্যাকুলতার কথা শোনে মায়ের পাঠানো লোকদেরকে শিতালং শাহ দুই এক দিনের মধ্যে বাড়ীতে ফিরছেন বলে ফেরত পাঠালেন। পুত্রের জন্য ব্যাকুল মা জননী তাঁর ছেলের আগমন বার্তা শোনে দুধের সর চাউলের পিঠা প্রভৃতি আহার্য্য বস্তু জমিয়ে রাখতে লাগলেন। ঠিক দুই দিন অতিবাহিত হতে না হতে হঠাৎ এক রাত্রে শিতালং শাহ বাঘের পিঠে সওয়ার হয়ে বাড়ীর আঙ্গিনায় এসে ‘মাই গো তুমি কই?’ বলে ডাক দেন। পুত্রের ডাক অনুভব করে মা তাৎক্ষনিক ঘর থেকে বের হয়ে বাঘ দেখে ভয় পেয়ে যান। তখন শিতালং মাকে বলেন- ‘ভয় করনা মা’ এরা আমার পোষা কুকুরের মত। তখন মা
ছেলেকে গলায় জড়িয়ে নেন। অল্প সময়ে পুত্র পেয়ে মায়ের মন শান্ত হলো। এবার শিতালং শাহ মা‘কে বললেন মা‘গো শিক্কায় রাখা পিঠাগুলো, দুধের সর ও জমিয়ে রাখা আহার্য্য বস্তু খাওয়িয়ে আল্লাহর রাস্তায় আমাকে বিদায় দাও। মায়ের গোপন রাখা বস্তু ছেলের কাছে প্রকাশিত হয়ে যাওয়ায়, মা বুঝে নিলেন তার ছেলে আর সাধারণ মানুষের মতো নয়। শিতালং শাহ এখন গুরুর দীক্ষায় আধ্যাত্মিক জ্ঞানী হয়ে গেছেন। মা জননী কিছু সময় ছেলেকে আদর সোহাগ করে আদেশ উপদেশ দিয়ে আল্লাহর হাওলা করে বিদায় দিলেন। এছাড়াও অসংখ্য অলৌকিক ঘটনা তাঁর থেকে প্রকাশিত হয়েছে বলে জনশ্রুতি আছে। (সূফি সাধক শিতালং শাহ- পৃ: ৬০)
শিতালং শাহ‘র ভাবশিষ্য ঃ শিতালং শাহ‘র বিশেষ ক’জন শিষ্য ও ভাব শিষ্য ছিলেন। তম্মধ্যে- তোয়াক্কুল শাহ, ভেলাশাহ, শাহ ইয়াসীন, বদল শাহ, মুনির উদ্দীন উরফে দৈখুরা, ছাবাল আকবর আলী, সৈয়দ শাহ নূর প্রমুখ মরমী কবি ও সূফি সাধকগণ। স্বীয় মুর্শিদ সম্পর্কে তাঁরা বলেন- শিতালং শাহ ছিলেন একজন সূফি সাধক ও স্বভাব কবি। তার জীবন যাপন অত্যন্ত সহজ সরল ছিল। তিনি সর্বাবস্থায় আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল করতেন, শরীয়তের বিধি-নিষেধ অনুসরণে জীবন পরিচালনা করতেন এবং মুরীদদেরকে শরঈ বিধান মেনে চলার নির্দেশ দিতেন। শরঈ বিধান মেনে না চললে এর পরকালীন ভয়াবহ পরিণতির বিষয়েও সতর্ক করতেন। তার রাগসমূহে এসবের নিদর্শন রয়েছে। তার রাগের কয়েকটি কলিতে বলেছেন- ‘এলাহি হায় হায়রে মাবুদ রহমান/ এ দুঃখ সংকটে তুই মুস্কিল আছান/ ভীষণ সংকট দেখি না দেখি উপায়/ ভূমিতে রাখিয়া মাথা কান্দে নছুফায়।/ ভীষণ সংকট আজি ঘটিল আমার/ সংকটে পড়িয়া কান্দি ছত্তার ছত্তার।/ রব্বুল আলম তুই গফুরুর রাহিম/ ঘটিয়াছে আজি মোর মস্কিল আজিম/ বেসমার পাপ মোর অন্তর সায়র/ পাপ ক্ষমা কর মোর কিরপার সাগর।’
এখানে শিতালঙ্গী রাগের কয়েকটি নমুনা উপস্থাপন করা হয়েছে। এগুলো থেকেই শিতালং শাহের পরিচয় অনুধাবন করা সম্ভব। প্রফেসর নন্দলাল শর্মা তার সংকলিত ও সম্পাদিত ‘মরমী কবি শিতালং শাহ’ গ্রন্থে ২৪১টি শিতালং গীতি উল্লেখ করেছেন। শিতালং শাহ বাংলাদেশের সূফি সাহিত্যে সুপরিচিত এক নাম। তিনি আমাদের গৌরব, আমাদের অহংকার। (নন্দলাল শর্মা সম্পাদিত, মরমী কবি শিতালং শাহ, (শিতালং-গীতি সংগ্রহ, গীতি নং ৩৫) বাংলা একাডেমী ঢাকা, প্রকাশকাল : ডিসেম্বর ২০০৫)
পরলোক গমন ঃ শিতালং শাহ তাঁর জনৈক বন্ধুর সাথে ওয়াদা করেছিলেন যে তাঁরা একসাথে হজ্জ্বব্রত পালন করবেন, তাঁর মৃত্যুর বছর খানেক পূর্বে ঐ লোকটি পায়ে হেঁটে হজ্জ্বব্রত পালনের উদ্দেশ্যে মক্কা অভিমুখে রওয়ানা দেন। এ বৎসর-ই শিতালং শাহের ওফাত হয়। তাঁর বন্ধু হজ্জ্ব করতে গিয়ে আরাফাতের ময়দানে শিতালং শাহের সাক্ষাত লাভ করেন এবং উভয়ে একসাথে কাবা ঘর তওয়াফ ও হজ্জ্বব্রত পালন করেন। ফেরার পথে শিতালং শাহ্ তিনির হাতের লাঠিটি বন্ধুকে দিয়ে বলেন লাঠিটি তাঁর নাতী মৌলানা তৈয়বুর রহমান সাহেবের হাতে দিবেন। বন্ধু ঐ লাঠি নিয়ে তাঁর বাড়ীতে এসে শুনতে পান যে তিনি তো বছর খানেক পূর্বে পরলোক গমন করেছেন। ঐলাঠিটি দীর্ঘদিন যাবত মৌলানার হেফাজতে ছিল বলে শোনা যায়। ১২৯৬ বঙ্গাব্দের ১৭ ই অগ্রহায়ণ (১৮৯৯ ইংরেজি সোমবারে এ মহামানব নশ্বর পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে স্রষ্টার সান্নিধ্যে পৌছে যান।
মৌলানা তৈয়বুর রহমান সাহেব শীতালং শাহের বাড়ীর সম্মুখে শীতালঙ্গী মাদ্রাসা নামে একটি মাদ্রাসা স্থাপন করেছিলেন। এ মাদ্রাসার পাশে তাঁর রওজা। জিয়ারতে প্রতি বৎসর হাজার হাজার ভক্ত আশিকান এখানে আসেন।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।