ইভিএম-এ ভোট কেন?
আগামী জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম-এ ১৫০ আসনে ভোট গ্রহণের পরিকল্পনার কথা জানিয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার। কাকতালীয় কিনা জানি না, ১৫০ সংখ্যাটা আমাদের এর আগে চিনিয়েছিলেন রকিবুল
আফতাব চৌধুরী
দেশজুড়ে ৪৬তম স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস উদযাপিত হচ্ছে। স্বাধীনতা মানুষের সর্বাপেক্ষা কাম্য বস্তু। স্বাধীনতা লাভের জন্য বাংলাদেশের জনগণ বহুদিন ধরে আকুল ছিল। বহুদিন ধরে সংগ্রাম করে অবশেষে ১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চ বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করেছে এক রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মাধ্যমে। সেই থেকে প্রতিবছর স্বাধীনতা দিবস মর্যাদাসহকারে উদযাপন করা হয়ে থাকে দেশব্যাপী।
এ দিনটি উদযাপনের বিশেষ তাৎপর্য হলো, স্বদেশপ্রেমে দেশবাসীকে উদ্বুদ্ধ করা। স্বদেশ মানচিত্রের একটি চিহ্নিত অংশ মাত্র। ক্ষুদ্র ভূম-লের এ বিশেষ অংশটি আমাদের জন্মভূমি-পিতৃপিতামহের বাসস্থান। এ দেশের আবহাওয়া, ভাবধারা, সমাজ, সংস্কৃতি আমাদের দেহ-মন পরিপুষ্ট করে। সে জন্য স্বদেশ সবার প্রিয়। এটি যত অনগ্রসর হোক, এর জলবায়ু যত খারাপ হোক, যত দুর্জন মানুষে এটা পরিপূর্ণ হোক তবু স্বদেশ সবার কাছে প্রিয়।
বাল্যকাল থেকে স্বদেশের সঙ্গে আমাদের পরিচয়। প্রথম চলতে শিখি এ দেশের মাটির ওপর। এ দেশের ধুলায় আমাদের অঙ্গ ধূসরিত হয়, এ দেশের বাতাসে আমরা নিঃশ্বাস গ্রহণ করে বেঁচে থাকি। এ দেশের আলো ও আবহাওয়ার মধ্যে আমাদের দেহ গঠিত হয়। এ দেশের সমাজের মধ্যে থেকে আমরা বড় হই। এ দেশের ভাবধারা আমাদের মন গঠন করে। এ দেশের ঐতিহ্য ও সভ্যতা আমাদের মনের সংস্কাররূপে মনে বাসা বাঁধে, এ দেশের গৌরবে আমাদের বক্ষ স্ফীত হয়। এ দেশের কলঙ্কে আমরা অধোবদন হই। এ দেশের দুঃখে আমাদের হৃদয়বীণায় করুণ রাগিণী জাগে। এ দেশের জনসাধারণকে আমরা ভাইয়ের মতো আপন মনে করি। এ দেশের শত্রুদের আমরা শত্রু মনে করি। এত বেশি করে এ দেশের সঙ্গে আমরা জড়িত যে, আমাদের ব্যক্তিগত চরিত্র এ দেশের অধিবাসীর সাধারণ চরিত্র থেকে পৃথক হয় না বস্তুত একই রকম হয়ে পড়ে। আমরা স্বদেশকে ভালোবাসি। এ ভালোবাসার জোরে অগণিত মানুষ একদিন মুক্তি সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ে যুদ্ধ করে এবং দেশকে স্বাধীন করে।
স্বাধীনতার ৪৫ বছর পার করে দিয়েও দেশের সিংহভাগ মানুষ এখনো দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করছেন। দারিদ্র্য লোকের অভাব নেই। দেশে তারা কাজ পায় না, কাজ করলেও যথেষ্ট মজুরি পায় না। শরীরের রক্ত পানি করে এরা পরের সম্পদ গড়ে। দারিদ্র্যের জন্য বর্তমান সমাজ দায়ী।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর কিছু রাজনীতিবিদ ও তাদের সাগরেদ আমলা এবং ঠিকাদাররা উন্নয়নের টাকা একেবারে ঢেঁকিসুদ্ধ গিলে ফেলার কাজে ব্রতী হওয়ায় আজকের সমাজে এ বিরাট দরিদ্রের দল সৃষ্টি হয়েছে। আজ কোনো অঞ্চলের উন্নয়ন খাতে এক টাকা বরাদ্দ হলে মাঝপথে প্রায় বারআনা লোপাট হয়ে যায়, লক্ষ্যস্থলে পৌঁছে মাত্র চারআনা। এ লোপাট করা চৌদ্দআনার ভাগিদাররা বিজয়ের সুখ উপভোগ করছেন যাদের সিংগভাগ হলেন বর্তমান যুগের এক শ্রেণীর রাজনীতিবিদ ও বড় কর্তা। জনগণকে শুষে নেয়া তাদের কাজ। মূলত এদের রং-বেরঙের অট্টালিকাগুলো জনগণের খুনে রাঙা হয়ে উঠেছে। এর নাম স্বাধীনতা? অবশ্য যার স্বাধীনতা, তার স্বাধীনতা। জনগণের তাতে কি? বাস্তবিক এখন জনগণের ব্যক্তি স্বাধীনতার কোনো দাম নেই।
স্বাধীনতার ৪৫ বছর পেরিয়ে গেলেও দুর্নীতি আজ সমাজের পরতে পরতে ছেয়ে গেছে। এর জন্য মূলত আমাদের জনপ্রতিনিধিরাই দায়ী। কথায় বলে, ‘আপনি আচারি ধর্ম পরকে শেখাও।’ এদের বড় একটা অংশ দুর্নীতিবাজ তাই দুর্নীতিতে দেশ আকণ্ঠ নিমজ্জিত হয়েছে এবং উত্তরোত্তর এটি শুধু বৃদ্ধি পাচ্ছে। যতই গলাবাজি করে বলা হোক দুর্নীতি কমছে, আসলে কমছে কি? মাত্র সেদিন হাইকোর্ট থেকে বলা হয়েছে, দুর্নীতি দমন কমিশনে নাকি দুর্নীতি হচ্ছে বেশি। এদের বিচার হওয়া প্রয়োজন। কোনো শাসক দল এর লাগাম ধরায় সচেষ্ট নয়। স্বাধীনতার শর্ত কিন্তু এটি ছিল না। জনপ্রতিনিধিদের চারিত্রিক ধর্ম এটি হওয়ার কথা ছিল না। কথা ছিল না দেশ বা সমাজ পরিচালনা করার অজুহাতে জনগণের মাথায় কাঁঠাল ভেঙে নেতা থেকে পাতি নেতাদের ব্যক্তিগতভাবে কোটি কোটি টাকার স্তূপ গড়ে তোলার! কেননা, আমাদের দেশে পীর, ফকিরেরা স্বেচ্ছায় দারিদ্র্য বরণ করে অকিঞ্চন হয়ে আল্লাহর রাস্তায় জীবন উৎসর্গ করেন। যে জগতে অর্থের মূল এবং পরমার্থ লাভের পথের বাধা উপলব্ধি করে তারা চির দারিদ্র্য বরণ করে আমাদের সম্মানিত ব্যক্তি। সালাম সেসব লোকোত্তর-চরিত্র পুরুষদের যারা অনন্ত ঐশ্বর্য পায়ে ঠেলে মানুষের দুঃখ-দারিদ্র্য দূর করার জন্য দারিদ্র্য বেশ ধারণ করেনÑ পরের জন্য নিজের সুখ-ঐশ্বর্য অকাতরে বিলিয়ে দেন, মানুষের দুঃখে যারা আহার, নিদ্রা, সুখবিলাস ত্যাগ করেন। আগের প্রায় নেতারা ছিলেন এ পদের কিন্তু আজকের জননেতা বা কর্ণধাররা প্রায় সবাই ঠিক এর উল্টো হয়ে পড়েছেন। এরা লোভী, এদের লোভের শেষ নেই। এদের কাছে আজ চিত্ত থেকে বিত্ত বড়। জনগণকে বঞ্চিত করে চারদিকে শুধু ব্যক্তিগত বিত্তবৈভব গড়ে তুলতে তারা ব্যস্ত। পত্র-পত্রিকায় এদের বিরূপ সমালোচনা করা হলে তারা এটি গায়ে মাখেন না। যেন ‘বকো আর ঝকো কানে দিয়েছি তুলো।’ অসংকোচে এর প্রতিবাদ করার সাহস এদের নেই কেননা এরা যে দোষী।
বাস্তুবিক যে অর্থে একদিন হাজার হাজার মানুষ স্বাধীনতার জন্য আত্মবলিদান করেছিলেন, প্রাণ বিসর্জন দিয়েছিলেন তার সিকিভাগ চরিতার্থ আজো হয়ে ওঠেনি। এর মূলে ক্রমবর্ধমান দুর্নীতির বাড়বাড়ন্ত দায়ী। তখন অন্তত বিচারবোধ বলে কিছু ছিল। আজ বিচারের নামে দেশজুড়ে চলছে প্রহসনের পর প্রহসন। এসবের ফাঁকে নামি-দামি মুখোশধারী রাঘববোয়াল অপরাধীরা অনায়াসে পার পেয়ে যাচ্ছেন। শুনেছি, ব্রিটিশ আমলে নাকি কুকুর মারলেও বিচার হতো, শাস্তি হতো, আজ মানুষ মারলেও বিচার হয় না! টাকা আর প্রভাবে শেষ ফয়সালা হয়ে যায়। আজ মানুষে মানুষে দিনরাত হানাহানি। একদিকে কঠোর দারিদ্র্য, ঋণ, অভাব, অন্যদিকে লোভী-স্বার্থবাদীদের ব্যাংকে কোটি কোটি টাকা পাষাণ স্তূপের মতো জমা হয়ে আছে, আরো জমা হচ্ছে। এ অসাম্য, এ ভেদজ্ঞান দূর করতে রাষ্ট্রনায়করা কেউ এগিয়ে আসছেন না। তারা এসকর্ট নিয়ে কোটি টাকার বুলেটপ্রুফ গাড়িতে চলাফেরা করছেন। অন্যদিকে দেশের আমজনতা প্রকাশ্য দিবালোকে সন্ত্রাসীদের হাতে খুন হচ্ছে! তারা স্বাধীনভাবে রাস্তাঘাটে চলাফেরা করতে ভয় পাচ্ছে। এর নাম স্বাধীনতা!
এত বছর পার করে দিয়ে আমাদের দেশের গ্রামাঞ্চলের প্রায় পঞ্চাশ ভাগ মানুষ আজো আমাদের জাতীয় পতাকার মাহাত্ম্য জানে না। অনেকে এটি এখনো চোখে দেখেননি! কেননা, স্বাধীনতা দিবসের দিনে গ্রামাঞ্চলে আজো জাতীয় পতাকা উত্তোলন করার প্রচলন চালু হয়নি। প্রায় প্রতিটি গ্রামেই আজ অন্তত একটি করে প্রাইমারি স্কুল রয়েছে। এসব মহান দিনে শিক্ষকদের এ মহান দায়িত্বটি পালন করার কথা, কিন্তু তারা সবাই এটি পালন করছেন না। কেন করছেন না?Ñ এ প্রশ্ন করার কোনো প্রশাসক আজ আমাদের দেশে নেই। কেননা, প্রশ্ন যারা করবেন, তারা যে ‘সবাই রাজা আমাদের এ রাজার রাজত্বে।’
পরিসর অল্প। অধিক বলার উপায় নেই। তবু রাজতন্ত্রের কথাটি যখন উঠে এলো তখন প্রাসঙ্গিক একটি ঘটনার কথা না বললে নয়। স্বাধীনতার ক’মাস পরে আমার এক সম্পর্কীয় মামা শহরের ছুটি উপলক্ষে এসেছেন গ্রামের বাড়িতে। তিনি বাড়িতে এলে বরাবরের মতো গ্রামবাসী তার কাছে ছুটে এলেন শহর এবং দেশ-বিদেশের নানা গল্প শুনতে। তিনি সবাইকে লক্ষ্য করে বললেন, ‘দেশ স্বাধীন হলো।’ তার এ কথায় গ্রামবাসী চমকে উঠে বলেন, ‘অ্যা! কবে? তাহলে রাজা কে হলেন? শেখ মুজিব বুঝি?’ গ্রামবাসীর এহেন কথায় তার মনে ভাবান্তর হলেও তা তিনি গোপন রেখে জবাব দেন, ‘হ্যাঁ। তাই বটে।’ আমরা তখন যুবক ছিলাম। মামার মুখে এটি শুনে অবাক হয়ে ভেবেছিÑ এক সাগর রক্তের বিনিময়ে যে দেশ স্বাধীন হলো সে বাংলাদেশের শহর থেকে অনতিদূরে একটি গ্রামে সে খবর পৌঁছল বিজয় লাভের ক’মাস পরে। তার চেয়ে বড় কথা হলো, গণতন্ত্রে যে রাজার স্থান নেই সে কথাটি গ্রামবাসী আদৌ জানেন না।
আমরা জানি, স্বাধীনতার অন্যতম শর্ত ছিলÑ সবার জন্য বিনামূল্যে শিক্ষা, খাদ্য, নিরাপত্তা, স্বাস্থ্য ও বাসস্থানের সুবন্দোবস্ত করে দেয়া। কিন্তু এর কোনোটি আজো বাস্তবে রূপায়িত হয়নি। সরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্রে মামুলি সুই-সুতাও টাকা দিয়ে ক্রয় করতে হয়। সরকারি স্কুলগুলো আজ শিক্ষক-শিক্ষিকাদের এক অংশের অবসর বিনোদনের ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। পড়াশোনা খুব একটা হয় না। সরকারি কর্তাব্যক্তি ও বিত্তশালীরা এখন প্রাইভেট স্কুলের হাতে নিজেদের সন্তানদের তুলে দিচ্ছেন। বিভাগীয় কর্তাব্যক্তি ও জনপ্রতিনিধিরা সরকারি শিক্ষার ব্যাপারে উদাসীন। ফলে আমজনতার ছেলেমেয়েরা শিক্ষায় এতটুকু অগ্রসর হতে পারছে না। মোট কথা, স্বাধীনতা পরবর্তী ৪৫ বছরে আমজনতার সর্বগ্রাসী দারিদ্র্য, অন্ধকারাচ্ছন্ন জীবনযাত্রার পরিশেষ পরিস্থিতির এতটুকু উন্নতি ঘটেনি বরং আরো অবনতি ঘটেছে। দেশে আজ যোগ্য ব্যক্তির অভাব নেই কিন্তু আমরা এমন স্বাধীনতা ভোগ করছি যে, যোগ্য ব্যক্তিরা আজ যোগ্য পদে নিযুক্তি পাচ্ছেন না। অযোগ্যরাই এখন যোগ্যদের স্থান দখল করে নিচ্ছে। রাজনীতিতে এখন সৎ, ভালো মানুষের স্থান প্রায় নেই। তাই ঘটা করে প্রতিবছর স্বাধীনতা দিবস উদযাপন করাটা তাৎপর্যহীন হয়ে পড়ছে। এর নামে মাঝপথে জনগণের ঘামে ঝরা টাকার অপচয় হচ্ছে। তাই বোধকরি সঙ্গত কারণে আজ কথা উঠেছে, ‘যার স্বাধীনতা তার স্বাধীনতা-আমজনতার কি?’
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।