Inqilab Logo

বুধবার, ০৩ জুলাই ২০২৪, ১৯ আষাঢ় ১৪৩১, ২৬ যিলহজ ১৪৪৫ হিজরী

টাকা যাচ্ছে, মেধাও পাচার হচ্ছে

প্রসঙ্গ : কর্মমুখী শিক্ষা

হোসাইন আহমদ হেলাল : | প্রকাশের সময় : ১৬ জানুয়ারি, ২০১৮, ১২:০০ এএম


বিদেশমুখী শিক্ষায় উদ্বিগ্ন ইউজিসি : বিজ্ঞান, কারিগরি, প্রযুক্তি, আইসিটিসহ কিছু বিষয়ে পড়াশোনায় কর্মক্ষেত্রে দেশ-বিদেশে ব্যাপক চাহিদা রয়েছে : মানবিকে পড়াশোনার লাগাম টেনে ধরতে হবে : মানোন্নয়নে উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টির সুপারিশ : শিক্ষিত বেকার সংখ্যা বাড়ছে


মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে বিজ্ঞান ও বাণিজ্য বিভাগে শিক্ষার্থীর চেয়ে মানবিকে পড়াশোনা করছে বেশি। উচ্চশিক্ষায় বিজ্ঞান বিভাগে শিক্ষার্থীদের হার প্রতিদিনই কমছে। অপরদিকে, কর্মক্ষেত্রে চাহিদার সমন্বয়ে দেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে সাজানোর উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এ ক্ষেত্রে মানবিকের বিপরীতে বিজ্ঞান বিভাগের ওপর গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। অগ্রাধীকার তালিকায় রয়েছে- বিজ্ঞান, কারিগরি, প্রযুক্তি ও আইসিটি। পড়াশোনায় মানবিকে শিক্ষার্থীর হার বেশি থাকলেও কর্মক্ষেত্রে তাদের সুযোগ অনেক কম। এ কারণে মানবিকে কয়েক লাখ উচ্চশিক্ষিত বেকার জীবন যাপন করছে। অন্যদিকে উচ্চশিক্ষার জন্য মেধাবী শিক্ষার্থীদের দেশত্যাগের বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)। মেধাবী শিক্ষার্থীদের ধরে রাখতে দেশীয় শিক্ষার মানোন্নয়নে উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টির সুপারিশ করেছে কমিশন। ইউজিসির বার্ষিক প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য জানা গেছে। উচ্চশিক্ষা গ্রহণে বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরা বিদেশ যাওয়ায় শিক্ষাক্ষেত্রের সাথে কর্মসংস্থানের বড় ব্যবধান সৃষ্টি হচ্ছে। কারণ দেশের ভেতরে বিজ্ঞান, কারিগরি, প্রযুক্তি, আইসিটির পর্যাপ্ত লোক না থাকায় বিদেশ থেকে কয়েক লাখ লোক উচ্চ বেতনে বাংলাদেশে চাকরি করছেন। এতে করে টাকা-মেধা দুটোই চলে যাচ্ছে বিদেশে। অপরদিকে, বাংলাদেশে শিক্ষিত বেকার সংখ্যা বাড়ছে আশঙ্কাজনক হারে।
জানা গেছে, বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষার শীর্ষ পছন্দ মালয়েশিয়া। একটি সংস্থার প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, প্রতি বছর বাংলাদেশের প্রায় ২৪ হাজার ১১২ জন শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে যাচ্ছে। এর মধ্যে পাঁচ হাজার ২৭১ জন যাচ্ছেন মালয়েশিয়ায়, যুক্তরাজ্যে চার হাজার ৮৬৮ জন, যুক্তরাষ্ট্রে চার হাজার ৫৬৫ জন, অস্ট্রেলিয়ায় তিন হাজার ৯১৫ জন, কানাডায় এক হাজার ৬১৪ জন, জাপানে এক হাজর ৫৪ জন, জার্মানিতে ৯৯৩ জন, ভারতে ৭৭৪ জন, সৌদি আরবে ৭৩২ জন ও ফিনল্যান্ডে যাচ্ছেন ৫৩৫ জন শিক্ষার্থী।
এ বিষয়ে ইউজিসি চেয়ারম্যান প্রফেসর আবদুল মান্নান ইনকিলাবকে বলেন, বাংলাদেশে বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের শাখা, স্টাডি সেন্টার খোলার নীতিমালা আছে। কয়েকটি বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয় আবেদনও করেছিল। এ যাবৎ কাউকে অনুমোদন দেয়া হয়নি। কয়েকটি প্রতিষ্ঠানকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে অনুমোদন দেয়া হলে শিক্ষার্থীদের বিদেশ যাওয়ার প্রবণতা কিছুটা কমত। কেউ কেউ মনে করতে পারে, বিদেশি প্রতিষ্ঠানকে অনুমোদন দিলে দেশের টাকা বিদেশে চলে যাবে। অথচ শিক্ষার্থীরা উচ্চশিক্ষার নামে দেশের বাইরে গিয়ে আরো বেশি টাকা ব্যয় করছে। এটি বন্ধ করার কোনো লক্ষণ দেখছি না। এ ছাড়া যারা চলে যাচ্ছে, তারা আর দেশে ফিরছে না। এতে করে টাকাও যাচ্ছে, মেধাও পাচার হচ্ছে। তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, মালয়েশিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাত, অস্ট্রেলিয়া, ভারত ও শ্রীলঙ্কায় অন্য দেশের বিশ্ববিদ্যালয় শাখা রয়েছে। সেখানে শিক্ষার্থীরা লেখাপড়া করছে। আমাদের দেশের নীতিনির্ধারকগণ এ বিষয়ে চিন্তা করতে পারেন।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র জানান, বিজ্ঞান বিভাগের কারিগরি, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, আইসিটিতে পড়াশোনার জন্য তরুণদের দেশের ভেতরে ও বিদেশে কর্মক্ষেত্রে ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। দেশে এসব বিষয়ে চাহিদার তুলনায় লোক না থাকায় বিদেশ থেকে লাখ লাখ লোক উচ্চ বেতনে বাংলাদেশে কাজ করছেন। এ বিষয়ে সরকার গুরুত্ব দিয়ে শিক্ষাখাতে পরিবর্তন আনার জন্য কাজ শুরু করেছে। মানবিক বিভাগে শিক্ষার্থীদের নিরুৎসাহিত করতে সরকার কারিগরি খাতে বড় পরিবর্তন আনার কথা ভাবছে, এ ছাড়া বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, আইসিটি, টেক্সটাইল, সমুদ্র ও মৎস্য বিজ্ঞান, ওষুধ, জাহাজ নির্মাণ, পারমাণবিক, লেদারসহ বেশ কিছু খাতে শিক্ষাব্যবস্থাকে এগিয়ে নিতে চাচ্ছে, কারিগরি খাতে শিক্ষার উন্নয়নে সরকার ইতোমধ্যে একটি রূপকল্প হাতে নিয়েছে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং আইসিটি খাতে একটি ইনস্টিটিউট করার পরিকল্পনা করছে সরকার। এ ছাড়া সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে টেক্সটাইল, সমুদ্র ও মৎস্য বিজ্ঞান, ওষুধ, জাহাজ নির্মাণ, পারমাণবিক, লেদারসহ বেশ কিছু বিষয়ে বাধ্যতামূলক বিষয় করার চিন্তা করছে সরকার। এক তথ্যে জানা যায়, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষারত মোট শিক্ষার্থীর ১৪ শতাংশই এখন কারিগরিতে অধ্যয়ন করছে। আগামী ২০২০ সালের মধ্যে তা ২০ শতাংশে এবং ২০৩০ সালের মধ্যে তা ৩০ শতাংশে উন্নীত করতে সরকার কাজ করছে। দীর্ঘ মেয়াদে ৬০ শতাংশে উন্নীত করার পরিকল্পনা রয়েছে। নতুন ২৩ জেলায় একটি করে সরকারি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট স্থাপন, প্রতিটি উপজেলায় একটি করে টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজ স্থাপন করার পরিকল্পনা রয়েছে। চলতি বছর এ কাজ শুরু হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। কারিগরি শিক্ষার মান বৃদ্ধির জন্য ইতোমধ্যে সিঙ্গাপুর থেকে এক হাজার ৫৭০ জন শিক্ষককে প্রশিক্ষণ দিয়ে আনা হয়েছে। চীন থেকে ৫৮১ জনকে প্রশিক্ষণ দেয়ার প্রক্রিয়া চলছে। ২০২৬ সালের মধ্যে দেশের বিভিন্ন স্থানে সরকার আরো ৪০টি সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় করার চিন্তা করছে সরকার। এ ছাড়া মানসম্মত শিক্ষক, গবেষক ও শিক্ষার্থী তৈরিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক বিশ্বমানের একটি গবেষণা কেন্দ্র স্থাপন করার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। সেখানে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি প্রদান করা হবে। গবেষক ও প্রশিক্ষক সৃষ্টি করা হবে। ২০১৭ সালে উচ্চ মাধ্যমিক পরিক্ষায় মানবিক বিভাগে অংশ নেয় চার লাখ ৮৭ হাজার। আর বিজ্ঞান বিভাগে মাত্র দুই লাখ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিভাবক মো. আবুল কাসেম বলেন, বাংলাদেশের সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে লেখাপড়ার চেয়ে রাজনৈতিক চর্চা বেশি হয়। আর বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়ার চেয়ে ফ্যাশনেবল ও আড্ডা বেশি হয়। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রির মান নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যায়ন শেষ করার পরও নেই চাকরির নিশ্চয়তা। মেধা যতই ভালো হোক, তাতে কোনো কাজে আসে না। দলীয় বিবেচনাই বড় মেধা।
এ বিষয়ে ইউজিসির চেয়ারম্যান বলেছেন, বিদেশে সব বিশ্ববিদ্যালয়ের মান ভালো তা বলা যাবে না। সার্টিফিকেট বাণিজ্যের দোকানও রয়েছে। প্রচুর অর্থ ব্যয় করেও প্রকৃত শিক্ষা পাওয়া যায় না। দেশ ছেড়ে ঐসব প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হয়ে প্রতারিত হওয়ার ঘটনাও রয়েছে।
প্রফেসর আব্দুল মান্নান আরো বলেন, উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে যাওয়া দোষের কিছু নয়। তবে সেই যাওয়ার মধ্যে যৌক্তিক কারণ তো থাকতে হবে। প্রতি বছর বহু শিক্ষার্থী বিভিন্ন ধরনের বৃত্তি অথবা সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্থিক সহায়তা নিয়ে বিদেশ যাচ্ছে। তারা পড়াশোনার পাশাপাশি গবেষণা করছে। কেউ কেউ দেশে ফিরে এলেও বেশির ভাগই থেকে যাচ্ছে ওই দেশে।
মেধাবীদের বিদেশমুখী হওয়ার কারণ জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক সৈয়দা তাহমিনা আখতার ইনকিলাবকে বলেন, দেশের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো চেষ্টা করছে কাক্সিক্ষত মানে পৌঁছাতে। কিন্তু দুর্বলতা রয়েছে। তবে গেøাবাল স্ট্যান্ডার্ড এডুকেশনের জন্য এখনো আমাদের সামর্থ্যবানরা চলে যাচ্ছে বিদেশে। কারণ বাংলাদেশি শিক্ষার্থীরা পড়াশোনার পাশাপাশি উপার্জনের বড় একটি সুযোগ পাচ্ছে।
শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বলেছেন, চীন, জাপান, জার্মান, অস্ট্রেলিয়া, কোরিয়া ও সিঙ্গাপুরসহ প্রতিটি উন্নত দেশের দিকে তাকালে দেখা যাবে, তাদের প্রত্যেকের কারিগরি শিক্ষার এনরোলমেন্ট হার ৬০ শতাংশেরও বেশি। আমাদের দেশে কারিগরি শিক্ষার হার অনেক পিছিয়ে ছিল। ২০০৯ সালের আগে কারিগরি শিক্ষার হার ছিল ১ শতাংশের নিচে। বর্তমান সরকারের আমলে ১৪ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা এ বিষয়ে ইনকিলাবকে বলেন, আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে কর্মসংস্থানের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে সাজানোর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণের জন্য সরকারের পরিকল্পনা এটি তারই অংশ। এটি বাস্তবায়ন হলে দেশের আর্থ-সামাজিক খাতে ব্যাপক পরিবর্তন আসবে। বিদেশ থেকে বর্তমানে উচ্চ পারিশ্রমিক দিয়ে বিশেষজ্ঞ আনতে হচ্ছে তা আর আনার প্রয়োজন হবে না। জাতীয় রিজার্ভ আরো মজবুত হবে।
এদিকে শিক্ষিত বেকার সংখ্যা বাড়ছে আশঙ্কাজনকভাবে। এক পরিসংখ্যানে জানা যায়, বাংলাদেশের জনশক্তি প্রয়োজনের তুলনায় তেমন দক্ষ না হওয়ায় অধিকাংশ কর্মক্ষেত্রে প্রবাসী শ্রমিকদের ব্যবহার করা হচ্ছে। যাদের জন্য বছরে ব্যয় হচ্ছে তিন থেকে পাঁচ কোটি বিলিয়ন ডলার। ১৫ বছরের উপরে অর্থনৈতিকভাবে কর্মক্ষম জনশক্তি ছয় কোটি সাত লাখ। এ শ্রম শক্তির মধ্যে পাঁচ কোটি ৮০ লাখ বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত। পরিবারের মধ্যে কাজ করেন কিন্তু মজুরি পান না এমন মানুষের সংখ্যা এক কোটি ১১ লাখ।
এ বিষয়ে শিক্ষা, শ্রম ও প্রবাসী মন্ত্রণালয়কে জরুরি ভিত্তিতে উদ্যোগ নেয়ার দাবি করেছেন বিশেষজ্ঞ মহল।



 

Show all comments
  • কামরুজ্জামান ১৬ জানুয়ারি, ২০১৮, ১:৩০ এএম says : 0
    মেধা ও অর্থ বাঁচাতে প্রয়োজন একটি সুষ্ঠ পরিকল্পনা ও তার বাস্তবায়ন
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: টাকা যাচ্ছে
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ