Inqilab Logo

রোববার ১৭ নভেম্বর ২০২৪, ০২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৪ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

জমজমাট জাটকা ব্যবসা

যাত্রাবাড়ীতে মাধব ও কানু বাবু-কাওরানবাজারে আ’লীগ নেতার সিন্ডিকেট

প্রকাশের সময় : ২৫ মার্চ, ২০১৬, ১২:০০ এএম | আপডেট : ১২:৪২ পিএম, ২৫ মার্চ, ২০১৬

নূরুল ইসলাম : বিক্রয় নিষিদ্ধ, তবে রাজধানীর সব বাজারেই পাওয়া যায় ইলিশের পোনা বা জাটকা। রাজধানীর কাওরানবাজার ও যাত্রাবাড়ী মাছের পাইকারী আড়তে জাটকা প্রকাশ্যেই বিক্রি হয়। জাটকা নিধন ও বিক্রি বন্ধে আইন আছে, প্রয়োগ নেই। বাংলাদেশ কোস্ট গার্ডের অভিযানে মাঝে মধ্যে জাটকা উদ্ধার হয়। এর বাইরে প্রশাসন একেবারে নীরবই বলা যায়। মৎস্য অধিদপ্তরের একজন কর্মকর্তা জানান, প্রতিবছর অক্টোবর মাসে সাধারণত সর্বোচ্চসংখ্যক ইলিশ ডিম ছাড়ে। রেণু পোনা বড় হয়ে এপ্রিল-মে নাগাদ পূর্ণাঙ্গ ইলিশে পরিণত হয়। এ জন্য নভেম্বরের প্রথম দিন থেকে পরের বছর মে মাসের শেষ দিন পর্যন্ত ১০ ইঞ্চির ছোট ইলিশ অর্থাৎ জাটকা ধরা, মজুত ও পরিবহন সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। আর এ আদেশ অমান্যকারীদের দুই বছরের কারাদন্ডেরও বিধান রয়েছে। এ ছাড়া নভেম্বর থেকে মে পর্যন্ত সাত মাস জাটকা ধরা বন্ধ রাখতে মৎস্য অধিদপ্তর জেলেদের মাসে ৪০ কেজি করে চাল ও অনেক জেলের বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে থাকে।
রাজধানীর পাইকারী বাজার যাত্রাবাড়ী ও কাওরানবাজারে প্রকাশ্যেই পাইকারী জাটকা বিক্রি হয়। খুচরা বিক্রেতারা সেগুলো রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার বাজার এবং ফেরি করে পাড়া-মহল্লায় বিক্রি করে। যাত্রাবাড়ীতে একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট থানা পুলিশকে ম্যানেজ করে প্রতিদিনই কয়েক হাজার কেজি জাটকা বিক্রি করছে। যাত্রাবাড়ী পাইকারী মার্কেটের মাছ ব্যবসায়ীদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, পাইকারী মার্কেটের আল্লাহর দান, ঢাকা বাজার ও মায়ের দোয়া আড়তে প্রতিদিন কয়েক হাজার কেজি জাটকা বিক্রি হচ্ছে। দেশের দক্ষিণাঞ্চলসহ মেঘনা ও পদ্মা নদী থেকে অবৈধভাবে ধরা ইলিশের পোনা (জাটকা) বিশেষ গাড়িতে (ট্রাক ও মিনি ট্রাক) করে সরাসরি চলে আসে যাত্রাবাড়ী আড়তে। অবৈধ এ জাটকার ব্যবসার সাথে জড়িত মাধব বাবু ও কানু বাবু নামে দুই পাইকারী ব্যবসায়ী। এ দুজনকে সহযোগীতা করে পুলিশের সোর্স শাজাহান ও দিলা। জানা গেছে, চাঁদপুর ও কুমিল্লা অঞ্চলে শুধুমাত্র জাটকা নিধনের জন্য কয়েকটা চক্র আছে। এদের সাথে মাধব বাবু ও কানু বাবুর সরাসরি যোগাযোগ আছে। এরা জাটকার জন্য অগ্রিম বিনিয়োগ করে থাকে। কতিপয় অভাবী জেলের হাতে অগ্রিম টাকা তুলে দিয়ে এরা খুব অল্প মূল্যে জাটকা ক্রয় করে থাকে। রাতের অন্ধকারে সেই জাটকা ট্রাক ও মিনি ট্রাকে করে বিশেষ ব্যবস্থায় ঢাকায় আনা হয়। সস্তা জাটকার দাম হয়ে যায় কমপক্ষে তিনগুন। সাত সকালে যাত্রাবাড়ীর মাছের পাইকারী আড়তে হাঁকডাক করে সেই নিষিদ্ধ জাটকা বিক্রি করে মাধব ও কানু বাবুর লোকজন। একজন পাইকারী বিক্রেতা জানান, নদীতে জাটকা ধরার পর তা ৬০ থেকে ৭০ টাকা কেজি দরে কেনা হয়। ঢাকায় আনার পর সেই জাটকাই দেড়শ টাকা দরে পাইকারী বিক্রি হয়। পহেলা বৈশাককে সামনে রেখেএখন দু’শ টাকা হয়েছে। খুচরা বিক্রেতারা এই জাটকাই আড়াইশ’ টাকা দরে বিক্রি করে। পাইকারী বিক্রেতারা জানান, রাজধানীর বাজারগুলো ছাড়াও এক শ্রেণির ব্যবসায়ী ফেরি করে জাটকা বিক্রি করে। তারা বাসা বাড়িতে গিয়ে মহিলাদের কাছে চড়া দামে এগুলো বিক্রি করে। কোনো কোনো বিক্রেতা জাটকাকে চাপিলা বলে বিক্রি করে। সূত্র জানায়, যাত্রাবাড়ী থানা পুলিশের সামনেই নিষিদ্ধ জাটকা বিক্রি হলেও পুলিশ তা দেখেও না দেখার ভান করে। আলাপকালে কয়েকজন মাছ ব্যবসায়ী জানান, জাটকা বিক্রির জন্য মাধব বাবুরা থানা পুলিশকে প্রতিদিন ২০ হাজার টাকা করে দেয়। এ ছাড়া স্থানীয় প্রভাবশালী সরকারদলীয় নেতাও মাধব বাবুদের কাছে থেকে মোটা অংকের টাকা পান। টাকা দিতে হয় যাত্রাবাড়ী থানার ওসির বডিগার্ড ও গাড়িচালককে। জানতে চাইলে যাত্রাবাড়ী থানার ওসি আনিসুর রহমান বলেন, জাটকা ধরা মৎস্য বিভাগের কাজ। তারা মাঝে মাঝে অভিযান চালায়। পুলিশকে ম্যানেজ করে জাটকা বিক্রির অভিযোগ অস্বীকার করে তিনি বলেন, যারা অবৈধ কাজ করে তারা নিজেদের আড়াল করার জন্য ওসব বলেই থাকে।
কাওরানবাজারেও একইভাবে পুলিশকে ম্যানেজ করে জাটকা বিক্রি হয়। মাছ ব্যবসায়ী সমিতির প্রভাবশালী এক নেতার সিন্ডিকেট জাটকা ব্যবসার সাথে জড়িত বলে মাছ ব্যবসায়ীরা জানান। এজন্য তেজগাঁও থানা পুলিশকেও একইভাবে টাকা দিতে হয়। কেরামত নামে একজন খুচরা বিক্রেতা জানান, দাম কম হওয়ায় ছোট ইলিশের প্রতি নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণির ক্রেতাদের আগ্রহ বেশি। তাই কেজিতে অনায়াসে ৩০ থেকে ৫০ টাকা লাভ করা যায়। জাটকা কেনো বিক্রি করেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটাতে লাভ বেশি তাই। জাটকা চোকেনা দন্ডনীয় অপরাধ, এটা জানেন কি না- এমন প্রশ্নের জবাবে বলেন, তা জানি। কিন্তু আইন থাকলেও তো তা কেউ মানছে না। তাই আমরাও মানি না। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দেশের দক্ষিণাঞ্চলসহ চাঁদপুরের নদীতে দিনদুপুরে কারেন্ট জাল ব্যবহার করে জাটকা ধরছেন জেলেরা। পরে তা বিভিন্ন পথে পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে এবং কখনও বা পুলিশকে ম্যানেজ করে আসছে রাজধানীতে। আর এ ক্ষেত্রে প্রশাসনের ভূমিকা অনেকটাই শিথিল।
এ বিষয়ে মৎস্য অধিদপ্তরের একজন কর্মকর্তা বলেন, জটকা নিধন বন্ধে অভিযান পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয়সংখ্যক আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য পাওয়া যায় না। আর এ সুবিধাই নিচ্ছে অসাধুচক্র ও জেলেরা।
এদিকে, গত মঙ্গলবার রাত সাড়ে ৩টার দিকে বুড়িগঙ্গা নদীতে অভিযান চালিয়ে ২৮০ কেজি জাটকা জব্দ করেছে বাংলাদেশ কোস্ট গার্ড। পাগলা স্টেশনের কমান্ডার লেফটেন্যান্ট কমান্ডার সায়ীদ এম কাসেদ জানান, গোপন সংবাদের ভিত্তিতে বুড়িগঙ্গা নদীতে ‘এম ভি পটুয়াখালী-৩’ লঞ্চে অভিযান চালানো হয়। এ সময় লঞ্চটি থেকে ২৮০ কেজি জাটকা উদ্ধার করা হয়। যার আনুমানিক মূল্য ৮৪ হাজার টাকা। তবে অভিযানের সময় লঞ্চের মালিককে পাওয়া যায়নি। তিনি জানান, পরে জাটকাগুলো নারায়ণগঞ্জ জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মর্জিনা বেগমের উপস্থিতিতে বিভিন্ন মাদ্রাসা, এতিমখানা ও গরীব-দুস্থদের মধ্যে বিতরণ করা হয়।

 



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: জমজমাট জাটকা ব্যবসা

২৫ মার্চ, ২০১৬
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ