Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

অদ্ভুত শহর ঢাকা

পৃথিবীর সর্বোচ্চ ব্যয় সর্বনিম্ন সেবা

প্রকাশের সময় : ২৫ মার্চ, ২০১৬, ১২:০০ এএম

স্টালিন সরকার : পৃথিবীর যেসব শহরে নাগরিকের সর্বোচ্চ খরচে জীবন যাপন করতে হয় তার মধ্যে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা অন্যতম। অথচ রাষ্ট্র নাগরিকদের সুবিধা দেয় সর্বনিম্ন। এমনকি এই ঢাকা শহরের মানুষের ভোট দেয়ার অধিকার পর্যন্ত কেড়ে নেয়া হয়েছে। অধিক অর্থ খরচ করেও নাগরিকদের পদে পদে ভোগান্তি পোহাতে হয়; যানজট, বায়ু দূষণ-শব্দ দূষণে যাপন করতে হয় দুর্বিষহ জীবন। নাগরিক সুবিধা ও উন্নয়ন কার্যত রাস্তা খোঁড়াখুড়ি, গর্ত, যত্রতত্র ময়লা আবর্জনা, ঢাকনাবিহনী ম্যানহোল আর চোখ ধাঁধানো কয়েকটি ওভার ব্রীজের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। এক কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে ৫ মিনিটও লাগতে পারে আবার এক/দেড় ঘটনাও লেগে যেতে পারে। আবার রাস্তায় বাস, রিক্সা ও সিএনজির জন্য দাঁড়ালে অতিরিক্ত ভাড়া দিয়েও ১০ মিনিটে পেতে পারেন আবার যানবাহন পেতে নাগরিককে এক ঘন্টাও লেগে যেতে পারে। ঘর থেকে বের হয়ে আইন শৃংখলার অবনতির কারণে বাড়ি ফেরার অনিশ্চয়তায় থাকে বাড়তি আতঙ্ক। অথচ অতি সাধারণ জীবন যাপন করতে হলেও খরচ করতে হয় বিশ্বের নাগকির সুবিধার শীর্ষে থাকা কানাডার মন্ট্রিল শহরের সমান অর্থ। এই হলো ঢাকা শহর! শুধু কি তাই; নাগরিকের নিরাপত্তা নিশ্চিতের শহর হিসেবে পরিচিত কানাডার টরন্টো নগরের বসবাসকারী নাগরিককে খরচ করতে হয় ঢাকার নাগরিকের চেয়েও কম। অথচ তারা সব সুযোগ সুবিধা ভোগ করেন। এমনকি আমেরিকার পাশের মেক্সিকো সিটি, ক্লিভল্যান্ড ও ইস্তাম্বুলের মতো তিলোত্তমা শহরের নাগরিকের জীবনযাত্রার ব্যয় ঢাকার চেয়ে কম। এ চিত্র ফুটে উঠেছে ব্রিটিশ ম্যাগাজিন দ্য ইকোনমিস্ট-এর ইনটেলিজেন্স ইউনিটের সমীক্ষায়। ওই পত্রিকা বিশ্বের ১৩৩টি শহরের নাগরিকের জীবনমান ও খবচের ওপর এক সমীক্ষা করে। সেখানে এ চিত্র পাওয়া যায়। সমীক্ষায় দেখা যায়, পৃথিবীর সবচেয়ে ব্যয়বহুল শহর হচ্ছে সিঙ্গাপুর। এ তালিকায় ঢাকার অবস্থান ৭১। অথচ ভারতে বেঙ্গালুর ও মুম্বাই শহর দুনিয়ার ১৩২ ও ১৩৩। অর্থাৎ বিশ্বের সবচেয়ে যে শহরের জমির মূল্য বেশি তার অন্যতম মুম্বাইয়ে নাগরিকের চেয়ে ঢাকা নাগরিক জীবনযাত্রায় খরব অনেক বেশি।
এক অদ্ভুত শহর এই ঢাকা।
নিত্যদিন নির্ধারিত সময়ে গন্তব্য স্থলে পৌঁছানো সম্ভব হয় না। সরকার গণপরিবহনের ভাড়া নির্ধারন করে দিয়েছে অথচ কোনো পরিবহনের চাকা নির্ধারিত ভাড়ায় চলে না। এমনকি পণ্যমূল্যও উঠানামা করে সকাল বিকেল। শহরের রাস্তায় নামলে আপনি কখন গণপরিবহন পাবেন, এর নিশ্চয়তা নেই। দীর্ঘ অপেক্ষার পর বাস-রিক্সা পেলেও যে নিরাপদে সময়মতো গন্তব্যে পৌঁছাতে পারবেন সে নিশ্চয়তা নেই। নির্ধারিত আয় ও নিম্ন আয়ের গরিব মানুষের জন্য তো এ শহর অসহনীয়। গ্যাস-বিদ্যুৎ-পানি সহ যাবতীয় পণ্যের বিল নিয়মিত পরিশোধ করতে চাইলেও পারবেন না। নানা ঝামেলা পোহাতেই হবে। নয়তো ঘুষ-উপরি দিতে হবেই। শহরের প্রায় অর্ধেক মানুষ বসবাস করে বস্তিতে। নর্দমার পাশে, রাস্তা ও রেললাইনের পাশে বস্তির ঝুপড়িতে থাকেন লাখ লাখ মানুষ। সে ঝুপড়ির ভাড়া আবার বাংলাদেশের যেকোনো জেলা শহরের দুই রুমের বাড়ির সমান। জেলা শহরে বসবাসরতদের সব সুবিধা নিশ্চিত হলেও ঢাকার শহরের ঝুপড়িতে না আছে পানির ব্যবস্থা, না আছে উন্নত শৌচাগার। বিদ্যুৎ বিল দিতে হয় অথচ সে অর্থ রাষ্ট্রীয় কোষাগারে যায় না। ঘর নিচু হওয়ায় চৈত্র-বৈশাখে প্রচÐ গরম হয়ে ওঠে। তাই রেললাইনের পাশের বস্তিতে যারা থাকেন তাদের দিনের বেশির ভাগ সময়ই রেললাইনে বসে কাটাতে হয়। ট্রেন এলে দিতে হয় ছুট। আর অন্যান্য বস্তিতে যারা থাকেন তাদের পথে ঘাটে দিনের বেশি সময় অতিবাহিত করতে হয়। ঢাকা শহরের ভিতরেই যেন মধ্যপ্রাচ্য থেকে যাওয়া ইউরোপীয় কোনো দেশের শরণার্থী শিবির!
এই ঢাকা শহরের যানজটের কারণে প্রতিদিন কত মানুষের কত শ্রমঘণ্টা নষ্ট হয় তার হিসাব নেই। প্রেসিডেন্ট প্রধানমন্ত্রী এমনকি পুলিশ মন্ত্রীও কোনো রাস্তা দিয়ে গেলে সে রাস্তা বন্ধ রাখা হয় দীর্ঘক্ষণ। যানজটে গাড়িতে প্রতিদিন কোটি কোটি টাকার তেল পোড়ে। পরিবেশ দূষণ ও যানজটে বসে থাকতে থাকতে মানুষ নানা রোগে আক্রান্ত হয়, আবার তার জন্য তাকে চিকিৎসকের কাছে ছুটতে হয় ওই যানজট ঠেলেই। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে চলে গেছে কোনো কিছুর ওপরই সরকারের নিয়ন্ত্রণ নেই। জনগণের ভোট ছাড়াই দুজন মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন তারা নিত্যদিন আস্ফালন করেন। টিভির খবরের জন্য ক্যামেরা পোজ দেন। মুক্তবাজার অর্থনীতিতে পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় সবকিছুই বাজারভিত্তিক। ফলে বাজারেও নৈরাজ্যকর অবস্থা। এই শহরের বাড়িভাড়া, দোকানভাড়া, রিকশাভাড়া থেকে শুরু করে সবকিছুই নির্ধারিত হচ্ছে সেবাদাতা-মালিকদের ইচ্ছামাফিক। এখানে ক্রেতার কোনো ভূমিকা নেই; ভাাড়টের কোনো ইচ্ছা নেই, সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। স্কুল-কলেজ কর্তৃপক্ষ যে বেতন ভাতা ও ভর্তি ফি নিধারণ করবে সেটাই দিতে বাধ্য গার্জেনরা। বাড়িওয়ালা যে ভাড়া নির্ধারণ করবেন, ভাড়াটেকে সেটাই দিতে হবে। দর-কষাকষি চলবে নেই। একমুখী সরকার ব্যবস্থার কারণে মানুষ ঢাকামুখী। যার জন্য এ শহরে ভাড়াটের সংখ্যা এত বেশি যে বাড়িওয়ালাদের কোনো কিছুর তোয়াক্কা করতে হয় না। এখন গোদের ওপর বিষফোঁড়া হয়ে দেখা দিয়েছে মেট্রাপলিটন পুলিশ। আইন শৃংখলা রক্ষার নামে ভাড়াটেদের নাম ঠিকানা ও ব্যক্তিগত পরিচিতি ফরমের মাধ্যমে থানায় বাধ্যতামূলক জমা দেয়ার নির্দেশনা দেয়ায় বাড়িওয়ালারা আরো ভাড়া বাড়িয়ে দিয়ে সে সুবিধা নিচ্ছে। নাগরিক সুবিধার জন্য শহরে হলুদ টেক্সি নামানো হয়েছে। সে টেক্সির ভাড়া মধ্যবিত্তের নাগালের বাইরে। রিকশার ক্ষেত্রে একই অবস্থা। অটোরিকশা ও গণপরিবহনের ভাড়া সরকার নির্ধারণ করে দিলেও কেউ তোয়াক্কা করে না। ড্রাইভারের কারণে দুর্ঘটনায় মানুষ মারা গেলে মন্ত্রী মিছিল করেন ঘাতকের পক্ষে। গরু-ছাগল চেনা আইনে ড্রাইভিং লাইন্সেস দেয়ার রেওয়াজ চালু করা হয়েছে। ট্রেনের টিকেট যাত্রীরা পাচ্ছে না; অথচ সিট খালিই চলছে ট্রেন। সর্বত্র নিজেদের ইচ্ছামতো ভাড়া আদায় করা হয় নাগরিকের কাছ থেকে।
নিত্যপণ্যের বাজারের অবস্থা আরো খারাপ। যারা নির্ধারিত বেতনে চাকরি করেন; তাদের অবস্থা দুর্বিষহ। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, নির্ধারিত বেতনের চাকরিজীবীদের অনেকেই জীবনযাত্রা পাল্টে ফেলেছেন। দুই রুমের বদলে এক ভাড়া নিচ্ছেন, কেউ পরিবারকে ঢাকায় রাখতে ব্যর্থ হয়ে গ্রামে পাঠিয়ে দিয়ে মেস বাড়িতে উঠছেন। খাদ্য তালিকায়ও একই অবস্থা। আগে এক কেজি মাছ কিনলে এখন আধা কেজি কিনছেন; গোশত খাওয়া বন্ধ করেছেন, সবজি-খাওয়া কমিয়ে দিয়েছেন। ঘুষ দুর্নীতি ও চাঁদাবাজ তথা বাড়তি আয় ছাড়া ইলিশ কিনতে পারেন এমন লোকের সংখ্যা খুবই কম। ফল-ফলাদি খাওয়া সীমিত আয়ের পরিবারগুলোতে বিলাসিতা হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। বিভিন্ন শ্রেণীর নাগরিকদের সবচেয়ে বড় ট্র্যাজেডি হলো মাসের শুরুতেই আয়ের একটা বড় অংশ বাড়িভাড়া দেয়া। অতঃপর হিসেব কষে মাস পার করতে হয়। অর্থ কষ্টে চুলায় নিয়মিত আগুন না জ্বললেও ঘরে আগুন জ্বলে; সংসার ভেঙ্গে যায়। নানা অজুহাতে বাসা ভাড়া বাড়ে; অথচ মাসের পর মাস বছরের পর বছর থাকার পরও বাড়িওয়ালা চাইলে ভাড়াটেকে উঠিয়ে দিতে পারেন যে কোনো সময়। অথচ পৃথিবীর অন্য কোনো বড় শহরে এটা সম্ভব নয়। সেখানে এ বিষয়ক আইনের কার্যকারিতা আছে এবং সরকার ও সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলো বেশ কঠোর। কয়েক বছরে ঢাকা নগরে জমির দাম চক্রাবৃদ্ধিহারে এত বেড়েছে যে সাধারণের পক্ষে জমি কিনে বাড়ি করা অসম্ভব। আবার গৃহঋণের সুদ এত বেশি তা নিতে গেলেও মাঝারি গোছের মধ্যবিত্তদের ২০-২৫ বছর চাকরি করে তার প্রস্তুতি নিতে হয়। আবার সে অধিক সুধে সে ঋণ নিতেও বড় অংকের অর্থ ঘুষ দিতে হয়। যার কারণে সরকারি চাকুরেদের মধ্যে ঘুষ-দুর্নীতির প্রবণতা বেড়ে গেছে। এমনকি বিয়ের বাজারেও ‘বর কত টাকা উপরি পায়’ সেটাও প্রাধান্য পেতে শুরু করেছে। অথচ বিশ্বের উন্নত দেশ আমেরিকার ওয়াশিংটন, বৃটেনের লÐন, অস্ট্রেলিয়ার সিডিনি, সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাইয়ের মতো শহরেও ৩০ বছরের মেয়াদে সামান্য সুদে গৃহঋণ পাওয়া যায়। আমেরিকায় যে কোনো চাকরি করলেই তিনি বাড়ি ক্রয়ে ঋণ নিতে পাবেন। ওই সব দেশের বড় বড় শহরে এলাকাভেদে বাড়িভাড়াও নির্ধারণ করা আছে। বাড়িওয়ালা চাইলে ইচ্ছামতো ভাড়াও নিতে পারেন না, নিলে সিটি কাউন্সিলের কাছে নালিশ করা যায়। ঢাকা সিটি করপোরেশনেরও তেমন একটি তালিকা আছে; কিন্তু সেটা ‘কাজির গরু কেতাবে আছে গোয়ালে নেই’ প্রবাদের মতোই। ক্ষমতাসীনরা শুধু চাপাবাজি করেই টিকে রয়েছে। এই শহরে সবচেয়ে বেশি খবর খাদ্যে। নি¤œবিত্ত, মধ্যবিত্ত, সীমিত আয়ের মানুষ নিজেদের মতো করে জীবন ধারণের জন্য খাবার মেনু তৈরি করেন। অথচ এ শহরে পাঁচ তারকা হোটেলে একটি বিফ স্টেক ৮-১০ হাজার টাকায় নাকি বিক্রি হয়। ফুটপাতে যে গেঞ্জি ২শ টাকায় পাওয়া যায় সেই গেঞ্জি বড় মার্কেটে ২’হাজার টাকায় বিক্রী হয়।
অদ্ভুত এই শহর ঢাকা। বায়ু দূষণ-শব্দ দূষণের মাত্রাজ্ঞান নেই। আবাসিক এলাকায় বাণিজ্যিক ভবন, বাণিজ্যিক এলাকায় মার্কেট, আবার বাণিজ্যিক এলাকায় মানুষের বসবাস। এক বিল্ডিংএ ৩/৪টি বিশ্ববিদ্যালয়, দখল দূষণ চলছেই। ভ্রæক্ষেপ নেই কারো। কেউ সমৃদ্ধ জীবন যাপনে অভ্যস্ত কেউ শুধুই বেঁচে থাকতে জীবন যাপন করছেন। উচ্চবিত্তের বিরুদ্ধে আইন অসহায় হওয়ায় অনেকক্ষেত্রে তাদের নাগরিক সুবিধার তেমন প্রয়োজন পড়ে না। কিন্তু সাধারণ নাগরিকের সামান্য সুযোগ সুবিধার প্রয়োজন। অথচ সেটা ছাড়াই পৃথিবীর যে কোনো দেশের বড় শহরের চেয়ে বেশি অর্থ খরচ করেন; অথচ নাগরিক সেবা পান যৎসামান্যই।

 



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: অদ্ভুত শহর ঢাকা

২৫ মার্চ, ২০১৬
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ