পটুয়াখালীর যুবক ক্বারী সাইয়্যেদ মুসতানজিদ বিল্লাহ রব্বানীর কোরআন তেলাওয়াতে মুগ্ধ যুক্তরাষ্ট্রবাসী
ইসলামি সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিকাশে বাংলাদেশের অবদান অনস্বীকার্য। এদেশে ইসলামি সংস্কৃতি চর্চার ইতিহাস অনেক প্রাচীন।
স্টালিন সরকার : ‘১৫শ শতকের প্রথম দিকেই পর্তুগিজ বণিকরা এ উপমহাদেশে বাণিজ্য করতে আসে। অতঃপর আর্মেনীয়, গ্রিক ও ইংরেজরা আসে বাণিজ্যে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির রবার্ট ক্লাইভ ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে মীর জাফরকে হাত করে নবাব সিরাজ-উদ-দৌল্লাকে পরাজিত করে।’ বাসে উঠতেই কথাগুলো কানে এলো। পেছনের সিটে বসে বোঝা গেল হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নিরাপত্তার দায়িত্ব ব্রিটিশ কোম্পানি ‘রেডলাইন’-এর হাতে তুলে দেয়ার চুক্তি নিয়েই যাত্রীদের মধ্যে কথাবার্তা হচ্ছে। এক যাত্রী বললেন, ভাই, বাংলাদেশের প্রবেশপথ হিসেবে পরিচিত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ব্রিটিশ কোম্পানির হাতে তুলে দেয়ায় কি আমাদের সম্মান বাড়বে? তার পাশের সিটের যাত্রীর জবাবÑএছাড়া উপায় কী? ঢাকার বিমানবন্দর নিরাপদ নয়, এ নিয়ে কয়েকটি দেশ তাদের বার্তা দেয় সরকারকে। সরকার একের পর এক রেড অ্যালার্ট জারি করে। ‘আন্তর্জাতিক মানদ-ে’ নিরাপত্তা ঘাটতি থাকায় শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে সরাসরি পণ্য পরিবহনে যুক্তরাজ্য ৮ মার্চ সাময়িক নিষেধাজ্ঞা জারি করে। শুধু তাই নয়, ৩১ মার্চ ব্রিটেনের কর্মপরিকল্পনা মতো নিরাপত্তা নিশ্চিত না হলে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের যুক্তরাজ্যগামী সরাসরি ফ্লাইটের ওপর নিষেধাজ্ঞার ইঙ্গিত দেয়। এ নিয়ে দুই দেশের উচ্চপর্যায়ে বৈঠকের পর যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন ৮ মার্চ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে এ ব্যাপারে চিঠি পাঠান। বিমানবন্দরের নিরাপত্তা উন্নয়নে বাংলাদেশের নেয়া বিভিন্ন পদক্ষেপ, ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা ও অঙ্গীকার তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৪ মার্চ ডেভিড ক্যামেরনকে চিঠির জবাব দেন। ওই চিঠিতে দুই দেশের ঐতিহাসিক বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বিবেচনায় নিয়ে নিষেধাজ্ঞার সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার অনুরোধ জানান। তাতেও মন গলেনি ইংরেজদের। অতঃপর ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি ব্রিটিশ কোম্পানিকেই বিমানবন্দরের নিরাপত্তার দায়িত্ব দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। ব্রিটেনের বেসরকারি নিরাপত্তা কোম্পানি রেডলাইনকে বিমানবন্দরের নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব দেয়ার সিদ্ধান্ত এবং চুক্তিনামায় সই করা হয়। রেডলাইন কোম্পানির সঙ্গে দুই বছর বিমানবন্দরের নিরাপত্তায় ৭৩ কোটি ৯৮ লাখ টাকায় রফাদফা হয়। তবে তারা সেখানে কর্মরত কর্মীদের প্রশিক্ষণ দেবে বলেও জানায়। ভদ্রলোক বলেই যাচ্ছেন। তাকে থামালো বাসের কন্ডাক্টরÑস্যার, ভাড়া দেন? পকেটে হাত দিলেন ভদ্রলোক।
বাস এগিয়ে চলছে। সামনের সারির এক বৃদ্ধ (সম্ভবত গ্রাম থেকে এসেছেন) এতক্ষণ উসখুস করছিলেন। এতক্ষণে তিনি যেন ফ্লোর পেলেন। তিনি বলতে শুরু করলেন, ‘আপনারা কি নবাব সিরাজ-উদ-দৌল্লার ইতিহাস পড়েছেন? সিনেমা দেখেছেন? ইংরেজ ব্যাবসায়ীদের ইস্ট ই-িয়া কোম্পানি পানিপথে পর্তুগিজ বণিকদের পথ ধরে ভারতবর্ষে ব্যবসা করতে এসেছিল। তারা সরকারকে কর না দেয়ায় তাদের বিরুদ্ধে বিক্ষুব্ধ হন নবাব সিরাজ-উদ-দৌল্লা। কাশিমবাজারে ব্যবসায়িক কুঠির নির্মাণ করে সেখানেই ভারতবর্ষ দখলের ষড়যন্ত্র করেন। ১৭৫৭ সালের পলাশীর প্রান্তরে নবাব সিরাজ-উদ-দৌল্লার পরাজয় হলে ইংরেজরা পৌনে দুইশ বছর দেশ শাসন করে। ওই যুদ্ধে ইংরেজ সৈন্যদের পরাজয় ছিল নিশ্চিত, কিন্তু রবার্ট ক্লাইভ নবাবের সবচেয়ে কাছের মানুষ মীর জাফরকে ভাড়া করেছিলেন। মীর জাফরের সঙ্গে ছিল রায় দুর্লভ, ইয়ার লতিফ, জগৎ শেঠ, মাহতাব চাঁদ, উমিচাঁদ, মহারাজা স্বরূপচাঁদ, মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র, রায়দুর্লভ, ঘষেটি বেগম, রাজা রায় বল্লভ, নন্দকুমার গং। যুদ্ধের সময় সিরাজের বাহিনীর প্রধান সেনাপতি ছিলেন মীর জাফর। তিনিই যুদ্ধে নেতৃত্ব দেন। বিশ্বাসঘাতক মীর জাফর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ক্লাইভের সঙ্গে গোপন আঁতাত করায় যুদ্ধের সময় তিনি (মীর জাফর), রায় দুর্লভ ও ইয়ার লতিফ ঠায় দাঁড়িয়ে থাকেন। তারপরও ইংরেজ সৈন্যরা পিছু হটে এবং পরাজয়ের দাড়প্রান্তে যাওয়ার সময় মীর জাফর প্রধান সেনাপতি হিসেবে নবাব সিরাজকে সৈন্যদের বিশ্রামের প্রস্তাব দেন। বিশ্বাসঘাতক মীর জাফরের চালাকি বুঝতে অক্ষম বালক নবাব প্রস্তাব মেনে নিলে ইংরেজরা নবাবকে পরাজিত করে। তারপরের ইতিহাস সবার জানা। পৌনে দুইশ বছর তারা ভারতবর্ষ শাসন করে। ১৯৪৭ সালে ইংরেজরা এই উপমহাদেশকে ভারত-পাকিস্তান ভাগ করে দিয়ে চলে যেতে বাধ্য হয়।’ বৃদ্ধের কথা থামতে না থামতেই পাশে বসা এক তরুণ মুখের ছিপি খুলে দিলেন। সবাইকে জিজ্ঞেস করেন, ‘আপনারা কি গত সপ্তাহের ভারতের দৈনিক যুগশঙ্খ পত্রিকা পড়েছেন? ওই পত্রিকায় রিপোর্ট বের হয়েছে, পৌনে তিনশ বছর পর ‘মসনদে’ বসেছেন মীর জাফরের বংশধর। সেখানে লিখেছে, স্বাধীন ভারতের সর্বোচ্চ আদালত আগেই মীর জাফরের বংশধর সৈয়দ মুহাম্মদ আব্বাস আলি মির্জাকে মুর্শিদাবাদের নবাব খেতাবের অধিকারী বলে ঘোষণা করেছিল। কিন্তু একটি মামলার কাঁটা বিঁধে ছিল কলকাতা হাইকোর্টে। গত সাপ্তাহে সেই মামলা খারিজ করে দিয়ে কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি দেবাংশু বসাক মুর্শিদাবাদের মসনদে নিষ্কণ্টক করে দিয়েছেন মীর জাফরের বংশধরকে। এখন কেবল খেতাবই নয়, নবাব পরিবারের বিপুল স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তির মালিকানাও পেয়ে গেছেন সৈয়দ আব্বাস আলি মির্জা। মীর জাফরের বংশধর আব্বাস আলি মির্জার আইনজীবী আদালতকে জানান, ১৯৬৯ সালে কলকাতায় মারা যান মুর্শিদাবাদের শেষ নবাব ওয়াসিফ আলি শাহ মির্জা। তিনি মারা যাওয়ার পরে তার দুই ভাই ফতেয়ার আলি মির্জা এবং কাজিম আলি মির্জার জমিদারি সম্পত্তি নিয়ে মামলা শুরু হয়। ওয়াসিফের পুত্র এক ইহুদি কন্যাকে বিয়ে করায় নবাবি ওয়ারিশ স্বত্ব হারান। ১৯৯৬ সালে মারা যান ফতেয়াব আলি মির্জা। ওয়াসিফ আলি মির্জার পুত্র হিসাবে নিজেকে দাবি করে আসরে অবতীর্ণ হন জনৈক সাজিদ আলি মির্জা। মামলা চলে ওয়াসিফ আলি মির্জার নাতি আব্বাস আলি মির্জা এবং সাজিদ আলি মির্জার মধ্যে। আব্বাসের বাবা সৈয়দ সাদেক আলি মির্জা ওয়াসফিয়ের পুত্র। এই মামলাটি গড়ায় কলকাতা হাইকোর্ট থেকে সুপ্রিম কোর্টে। ২০০৫ সালে মারা যান সাজিদ আলি মির্জা। এর পরে সেই মামলা চালাতে থাকেন তার স্ত্রী আফসান মির্জা। ২০১৪ সালের আগস্ট মাসে সুপ্রিম কোর্টের ডিভিশন বেঞ্চ জানিয়ে দেন, মুর্শিদাবাদের নবাব উপাধি পাওয়ার যোগ্য সৈয়দ আব্বাস আলি মির্জা। কেননা, সাজিদ আলি মির্জা নিজের সঙ্গে নবাব ওয়াসিফ আলি মির্জার রক্তের সম্পর্ক প্রমাণ করতে পারেননি। ২০১৪ সালে সাজিদ আলি মির্জার স্ত্রী আফসান মির্জা কলকাতা হাইকোর্টে আবেদন করেন। সে রায়েই মীর জাফরের বংশধরদের মুর্শিদাবাদের জমিদারি সম্পত্তি বুঝিয়ে দেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন কোলকাতা সুপ্রিম কোর্ট। সাবধান! ভারতে মীর জাফরের বংশধর...।
মীর জাফরের বংশধরদের আবির্ভাব সম্পর্কে তরুণের বক্তব্য সবাই মনোযোগ দিয়ে শুনছিলেন। হঠাৎ পেছনের সিটের একজন খেঁকিয়ে ওঠেন। ‘রাখেন মিয়া ভারতের মুর্শিদাবাদে মীর জাফরের বংশধরদের সম্পদ ফিরে পাওয়ার কথা! নিজেদের কথা ভাবেন। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে দেশ স্বাধীন করেছি। স্বাধীন দেশে একটি বিমানবন্দরের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারি না আমরা? ইংরেজদের নিরাপত্তার দায়িত্ব দেয়া গর্বের না লজ্জার? স্বাধীন দেশের প্রবেশদ্বার-খ্যাত বিমানবন্দর এখন ইংরেজদের নিয়ন্ত্রণে যাবে। অন্য এক যাত্রী থামিয়ে দিয়ে বললেন, ‘রেডলাইন’ তো ব্রিটেনের বেসরকারি কোম্পানি। তারা এভাবেই বিভিন্ন দেশে নিরাপত্তা দেয়ার ভাড়া খাটে। কথা শুনে রাগত স্বরে পেছনের সিটের যাত্রী বলেন, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিও বেসরকারি ছিল এবং তারা এ উপমহাদেশে এসেছিল ব্যবসা করতে। তারপর তারা পৌনে দুইশ বছর দেশ শাসন করেছে। ব্রিটেনে কার্গো জাহাজে পণ্য পাঠানো এবং যাত্রীবাহী বিমানের চলাচল নির্বিঘেœর জন্য আজ ব্রিটেনের প্রতিষ্ঠানকে শাহজালাল বিমানবন্দরের নিরাপত্তার দায়িত্ব দিলেন। কাল আমেরিকা বলবে, চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দর নিরাপদ নয়। তোমরা ওই বন্দরকে নিরাপদ করো, না হলে গার্মেন্টস পণ্য নেব না। ওই বন্দর থেকে কোনো জাহাজ আমেরিকার বন্দরে ভিড়তে পারবে না। অতঃপর একসময় প্রস্তাব দেবে চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দরের নিরাপত্তার দায়িত্ব আমেরিকার বেসরকারি কোনো সিকিউরিটি কোম্পানিকে দিলে পণ্য পাঠাতে পারবে, পাশাপাশি জিএসপি সুবিধা পাবে। তাহলে? আমেরিকা তো অনেক দিন থেকে আমাদের সদুদ্রে নৌঘাঁটি করার টার্গেট করেছে। তাহলে কি দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব থাকে? কী কন মিয়ারা? মাথা নেড়ে নেড়ে সায় দিলেন অন্য যাত্রীরা। যে যাত্রীকে চুপ থাকতে বলা হয়, তিনি আবার গলার স্বর বাড়িয়ে দেন। বলেন, ‘আমাদের বিভিন্ন বাহিনী জাতিসংঘের হয়ে বিশ্বের দেশে দেশে নিরাপত্তা-শান্তি নিশ্চিত করছে। অথচ বিমানবন্দরে খাল কেটে কুমির আনা হচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো পড়ে দেখুন, এ নিয়ে কী বলছে সাধারণ মানুষ।’ এতক্ষণ যাত্রীদের কথা শুনছিলেন এক মহিলা। হঠাৎ তিনি বলেন, শাহজালাল বিমানবন্দরের পর বিদেশীরা আর কোনটা চায় সেটা দেখেন। ততক্ষণে বাস গুলিস্তান এসে গেছে। কন্ডাক্টর চিৎকার করছেন, গুলিস্তান নামেন, নামেন, গাড়ি ঘুরবে। অগত্যা নামতে হলো...।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।