Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ইসলামে যা নিন্দনীয় ও নিষিদ্ধ

মুনশি মুহাম্মদ উবাইদুল্লাহ | প্রকাশের সময় : ২১ ডিসেম্বর, ২০১৭, ১২:০০ এএম

কোরআনে কারিমের আলোকে নিন্দা ও নিষেধাজ্ঞা :
ইসলামে ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করার ব্যাপারে কঠোর নিষেধাজ্ঞা এসেছে। কোরআনে কারিমে এ সম্বন্ধে বহু দলিল রয়েছে। যেমন-
১. এরশাদ হচ্ছে-‘কিতাবধারী হে! নিজেদের ধর্ম নিয়ে অযথা বাড়াবাড়ি কোরো না। আর (ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করে) তোমাদের আগে যারা নিজেরা পথভ্রষ্ট হয়ে ও অন্যদেরকে পথভ্রষ্ট করে সহজ সরল পথচ্যুত হয়েছে, তাদের পথ অবলম্বন কোরো না।’ (সুরা মায়িদা : ৭৭)।
২. এরশাদ হচ্ছে-‘হে কিতাবধারীরা! তোমরা তোমাদের ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়িতে লিপ্ত হয়ো না। আর আল্লাহ সম্বন্ধে যথাযথ বলো।’ (সুরা নিসা : ১৭১)। আয়াতদুটিতে ইহুদি-খৃস্টানদেরকে নিজেদের ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করতে নিষেধ করা হয়েছে। কেননা এরা আল্লাহর নির্ধারিত সীমারেখা সর্বদা ভেঙে ধর্মে বাড়াবাড়ি করার মাধ্যমে নিজেদের ধর্ম বিকৃত করে ফেলতো। ইহুদিরা হজরত উজায়ের (আ.)-কে এবং খৃস্টানরা হজরত ঈসা (আ.)-কে খোদাপুত্র সাব্যস্ত করেছিলো। মুফাসসিরে কোরআন হজরত আল্লামা কুরতুবি (রহ.) বলেন-‘ইহুদিরা হজরত ঈসা (আ.)-এর সম্বন্ধে বাড়াবাড়ির শিকার হয়েছে। তারা তার শ্রদ্ধেয়া মা হজরত মারইয়াম (আ.)-এর ওপর মিত্থারোপ করে থাকে। পক্ষান্তরে খৃস্টানরাও হজরত ঈসা (আ.)-কে নিয়ে বাড়াবাড়ি করেছে। তারা তাকে খোদা সাব্যস্ত করতো। সুতরাং দুটো দলই ইফরাত ও তাফরিত তথা কমবেশি করে বাড়াবাড়ির শিকার হয়েছে। যা মস্ত বড় গোনাহ ও কুফুরি।’ (তাফসিরে কুরতুবি : ৬/২১)।
৩. এরশাদ হচ্ছে-‘(হে রাসুল!) আপনাকে দীনের পথে যেভাবে অবিচল থাকবার নির্দেশ দেয়া হয়েছে, আপনি সেভাবে অটল থাকুন। যারা তওবা করে আপনার সঙ্গে রয়েছে এবং ধর্মের বেষ্টনি থেকে বিন্দুমাত্রও দূরে সরে যায়নি, তারাও অবিচল থাকুক। নিঃসন্দেহে আল্লাহতায়ালা তোমাদের সমস্ত কর্ম পর্যবেক্ষণ করেন। যারা জুলুম করে, তাদের পথে আকৃষ্ট হয়ো না। তোমরা তাদের প্রতি ঝুঁকিও না। না হয় তোমাদেরকে জাহান্নামের আগুন স্পর্শ করবে। আল্লাহ ছাড়া তোমাদের কোনো বন্ধু নেই। আর তোমাদেরকে তখন কোনো সাহায্যও করা হবে না।’ (সুরা হুদ : ১১২-১১৩)। উল্লিখিত আয়াতদুটির প্রথম আয়াতে রাসুল (সা.) ও গোটা মুসলিমজাতিকে দুটি নির্দেশ দেয়া হয়েছে-১. দীনের ওপর অটল অবিচল থাকো। আল্লামা জমখশারি (রহ.) আয়াতটির ব্যাখ্যায় বলেন-‘তুমি সত্যের পথে তেমনিভাবে অটল থাকো, যেভাবে তোমায় নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এর থেকে সামান্যও কমবেশি কোরো না।’ (তাফসিরে কাশশাফ : ২/৪৩২)। ২. ধর্মের বেষ্টনি থেকে বেরিয়ো না। আয়াতে উল্লিখিত ‘তুগইয়ান’ শব্দটিও সীমাতিক্রম করার অর্থে ব্যবহৃত। এটাই ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করার সমার্থবোধক অর্থ বহন করে। মুফাসসিরে কোরআন আল্লামা আবু সাঈদ (রহ.) আয়াতটির ব্যাখ্যায় বলেন-‘কমবেশি করে শরিয়ত নির্ধারিত সীমারেখা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ো না। কেননা কমবেশি-দুটোর ফলই নিন্দনীয়।’ (ইরশাদুল আকলুস সালিম : ৩/৩৯৪)। আল্লামা জমখশারি (রহ.) বলেন-‘আল্লাহর সীমারেখা থেকে বেরিয়ো না।’ (তাফসিরে কাশশাফ : ২/৪৩২)।
দ্বিতীয় আয়াতে সীমাতিক্রমকারীদের পথে পরিচালিত না হবার নির্দেশ, আর তাদের পথের প্রতি আকৃষ্ট হবার জন্য জাহান্নামের ভয় দেখানো হয়েছে। মুফাসসিরে কোরআন হজরত আল্লামা শাব্বির আহমদ উসমানি (রহ.) বলেন- ‘এবং যারা কুফুরি, ইত্যাদি থেকে তওবা করে আপনার সঙ্গী হয়ে আল্লাহতায়ালার প্রতি ধাবিত হয়েছে, তাদের উচিত আল্লাহর নির্দেশিত পথে সদা অটল অবিচল থাকা। আকিদা-বিশ্বাস, দাওয়াত-তাবলিগ, ইবাদতবন্দেগি, লেনদেন-প্রতিটা কাজেই কমবেশি করা থেকে বিরত থেকে মধ্যমপন্থা ও সহজ সরলপন্থার দৃঢ় পথ পাড়ি দেয়া। কোনো বিষয়ে সীমাতিক্রম করে শরিয়ত নির্ধারিত সীমা থেকে বের না হওয়া। স্মরণ রেখো, আল্লাহতায়ালা তোমাদের প্রতিটা কাজ পর্যবেক্ষণ করেন।’ আর দ্বিতীয় আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন-‘আয়াতে সীমাতিক্রম করা থেকে নিষেধ করা হয়েছে। তাই যারা সীমাতিক্রমকারী, তাদের প্রতি তোমরা বিন্দুমাত্র আকৃষ্ট হয়ো না। তাদের কাজে শামিল হওয়া, তাদের সঙ্গ অবলম্বন করা, তাদের কাজের প্রতি সম্মান-শ্রদ্ধা প্রদর্শন করা, তাদের কাজের প্রশংসা করা, বাধ্য হলেও উপমা দেয়া-প্রতিটা বিষয়ে তাদের থেকে বিরত থাকো। তাদের কাজে যোগ দেবার ফলে না জানি জাহান্নামের আগত আগুন তোমাদেরকে পেঁচিয়ে ধরে। ফের আল্লাহতায়ালা ছাড়া তোমাদের কারোর জন্য কোনো সাহায্যকারীও কিন্তু মিলবে না। আর আল্লাহর পক্ষ থেকেও তোমাদের জন্য কোনো সাহায্য পৌঁছুবে না।’ (ফাওয়াদে তর্জমায়ে শাইখুল হিন্দ : ৩১০)। আয়াতদুটিতে নির্দেশিত দৃঢ় থাকা, আর সীমাতিক্রম না করার অর্থ মূলত একটা অপরটার জোরালো নির্দেশস্বরূপ। কেননা দৃঢ় থাকার মানে হলো ধর্মের ওপর সঠিক পন্থায় অবিচল থাকা। যা বাড়াবাড়ি ছাড়াই সম্ভব। সেজন্য ধর্মের গন্ডি থেকে বাইরে না যাওয়াটা আবশ্যক হয়ে পড়ে। মুফাসসিরে কোরআন হজরত মাওলানা মুফতি মুহাম্মদ শফি (রহ.) এই কথাটিই আরও সুস্পষ্টভাবে বিস্তারিত লিখেছেন-‘আয়াতে রাসুল (সা.) ও মুসলিমউম্মাহকে প্রতিটা কাজে প্রতিটা অবস্থায় দীনের ওপর অটল থাকার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। অবিচল থাকা কথাটি তো বেশ ছোট। কিন্তু এটি একটি বিশাল বড় অর্থ বহন করে। তা হলো-আকাইদ, ইবাদত, লেনদেন, চারিত্রিক, সামাজিক, জীবিকা উপার্জন-সমস্ত বিষয়ে মানুষকে আল্লাহর নির্ধারিত সীমারেখার মাঝে তার দেখানো সরল পথ সত্য ও সুন্দরের দিশা দেয়। তাই এর মধ্য হতে কোনো একটি বিষয়েও কোনো কাজে বা অবস্থায় যদি কেউ কোনো একদিকে ধাবিত হয় কিংবা কমবেশি করে, তাহলে অবিচলতা অবশিষ্ট থাকে না। আর আয়াতে তুগইয়ান শব্দটি সীমালঙ্ঘন করার অর্থে ব্যবহৃত। যা অবিচল থাকার বিপরীতার্থক শব্দ। আয়াতে অবিচল থাকার নির্দেশক ও ইতিবাচক দৃষ্টিকোণ থেকে প্রকাশিত হওয়ার অর্থই কেবল উল্লিখিত হয়নি, বরং তার নেতিবাচক নিষিদ্ধতাকেও সুস্পষ্টভাবে বয়ান করা হয়েছে। তা হলো আকাইদ, ইবাদত, লেনদেন, চারিত্রিক-সব বিষয়ে আল্লাহ ও তার রাসুল (সা.)-এর নির্ধারিত সীমারেখা থেকে বাইরে বেরিয়ে প’ড়ো না। কারণ এটা সমস্ত বিপর্যয় ও ইহ-পরকালীন নষ্টের মূল।’ (মাআরিফুল কোরআন : ৪/৬৭০-৬৭২)।
৪. এরশাদ হচ্ছে-‘এটি আল্লাহর নির্ধারিত সীমারেখা। সুতরাং তা অতিক্রম কোরো না। যারা অতিক্রম করে, তারা-ই প্রকৃত জালেম (সীমালঙ্ঘনকারী)।’ (সুরা বাকারা : ২২৯)।
এই আয়াতেও ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করা ও ধর্মের সীমারেখা থেকে বাইরে বেরোনো থেকে নিষেধ করা হয়েছে। যারা ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করে, তাদেরকেই জালেম সাব্যস্ত করা হয়েছে। ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করার নিন্দা ও খারাপ দিক নিয়ে জানার জন্য এতোটুকুনই যথেষ্ট।
হাদিস শরিফের আলোকে নিন্দা ও নিষেধাজ্ঞা
ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করার বিরুদ্ধে হাদিস শরিফেও এসেছে চরম নিন্দা ও নিষেধাজ্ঞা। যেমন-১. এরশাদ হচ্ছে-‘লোকসকল! তোমরা ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করা থেকে দূরে থাকো। কেননা তোমাদের আগে বহু জাতি ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করার কারণেই ধ্বংস হয়ে গেছে।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ : ৩০২৯, মুসনাদে আহমদ : ৩২৪৮, আল মুজামুল কাবির : ১৫১৪০, আসসুন্নাতু লিইবনে আবি আসিম : ৯৮)। কথাটি রাসুল (সা.) একটি বিশেষ মুহূর্তে বলেছিলেন। সেটি ছিলো হজের মৌসুমের কাহিনি। জামারাত নামক পাথরের ওপর পাথর নিক্ষেপ করবার জন্য রাসুল (সা.) হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) অথবা তার ভাই ফজল ইবনে আব্বাস (রা.)-কে নির্দেশ দিলেন-‘পাথর বাছাই করে নাও।’ তিনি মধ্যম ধরনের পাথর নির্বাচন করে আনলেন। রাসুল (সা.) বললেন-‘এমনটাই হওয়া চাই। এ ধরনের পাথর জামারাতের ওপর নিক্ষেপ করো।’ তারপর রাসুল (সা.) বললেন-‘ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করা থেকে বিরত থাকো। কেননা তোমাদের আগে বহু লোককে এই কাজটাই ধ্বংস করে দিয়েছে।’ এর দ্বারা বোঝা যায়, পাথর নিক্ষেপ করার ক্ষেত্রেও রাসুল (সা.)-এর সুন্নত পরিত্যাগ করা এবং বেশ বড় কিংবা বেশ ছোট পাথর নিক্ষেপ করাও ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করার মাঝে গণ্য।
২. রাসুল (সা.) তিনবার বললেন-‘খবরদার! ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়িকারীরা কিন্তু ধ্বংস হয়ে গেছে।’ (সহিহ মুসলিম : ৬৯৫৫, সুনানে আবি দাউদ : ৪৬১০, মুসনাদে আহমদ : ৩৬৫৫, মুসনাদে বাজ্জার : ১৮৭৮, মুসনাদে আবি ইয়া’লা : ৫০০৪, আল মুজামুল কাবির : ১০২১৭, শরহুস সুন্নাহ : ৩৩৯৬)।
সহিহ মুসলিমের ব্যাখ্যাকার হজরত আল্লামা নববি (রহ.) ‘আল মিনহাজ’গ্রন্থে এবং আল্লামা জালালুদ্দিন সুয়ুতি (রহ.) সহিহ মুসলিমের ভূমিকায় উল্লিখিত হাদিসের ব্যাখ্যায় বলেন-‘যারা ধর্মের বিষয়াবলিতে ও কাজকর্মে গভীরতা তালাশ কিংবা খুব বেশি কঠোরতা অবলম্বন করে এবং একসময় সীমাতিক্রম করে ফেলে, তারাই মূলত ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়িকারী।’ (শরহে মুসলিম লিন নববি : ৮/২২১, দিবাজে শরহে মুসলিম : ৬/৩৪)।
৩. এরশাদ হচ্ছে-‘নিজেদের ওপর এমন কঠোরতা কোরো না, যাতে তোমাদের ওপরই কঠোরতা করতে হয়। কেননা একটি স¤প্রদায় নিজেদের ওপর কঠোরতা করার ফলে আল্লাহতায়ালাও তাদের ওপর কঠোরতা আরোপ করেছিলেন। এসব তাদেরই অবশিষ্ট স্মৃতিচিহ্ন।’ (সুনানে আবি দাউদ : ৪৯০৬, মুসনাদে আবি ইয়া’লা : ৩৬৯৪)।
হাদিসে নিষিদ্ধ এই কঠোরতাও একধরনের ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি। এ থেকে আমাদের প্রিয় সর্দার রাসুল (সা.) নিষেধ করেছেন। আর এসবকে ইহুদি-খৃস্টান পাদ্রীদের কর্ম হিসেবে সাব্যস্ত করা হয়েছে।
৪. এরশাদ হচ্ছে-‘নিজেদের ওপর কঠোরতা অবলম্বন কোরো না। কেননা তোমাদের আগে বহু লোক ধ্বংস হয়েছে এসবের কারণে। আর তোমরা তাদের অবশিষ্ট লোকদেরকে পথভ্রষ্ট ও দ্বিধাদ্বন্দে পাবে।’ (শুআবুল ইমান : ৩৬০১, আল মুজামুল কাবির : ৫৪১৮, আল মুজামুল ওয়াসিত : ৩০৭৮, মুজামুস সাহাবা : ২০০১)।
হাদিসটির সারাংশ হলো, নিজেদের ওপর কঠোর কাজের মাধ্যমে কঠোরতা অবলম্বন কোরো না। যেমন আজীবন লাগাতার রোজা রাখা; রাতভর ইবাদত করা; আল্লাহর ইবাদত করতে এবং স্ত্রীর হক আদায় করার ক্ষেত্রে যেনো কোনো দুর্বলতা না আসে, সেজন্য নারীদের থেকে ভিন্ন থাকা। কেননা এমন যারা করে, তাদের ওপর রাব্বুল আলামিন কঠোরতা আরোপ করেন। অর্থাৎ এমন ইবাদত ফরজ করে দেন, যা আদায় করতে অক্ষম হয়ে বিপদে পড়তে হয়। যেমন বনীইসরাইলের একটি দল এ ধরনের কঠোরতা অবলম্বন করতে আরম্ভ করলো (যেমন ইবাদতে কঠোরতা অবলম্বন এবং অনর্থক গণিতবিদ্যা, অতিমাত্রার চেষ্টা-সাধনা করেছিলো), তখন আল্লাহতায়ালা তাদের জন্য এই অনুসরণগুলি শক্ত করে দিলেন। (আল মিরকাত শরহে মিশকাত : ১/৩৮৮, আল মিরআত শরহে মিশকাত : ১/৬৬৯)।
৫. হজরত আয়েশা (রা.)-সূত্রে বর্ণিত। একবার তার কাছে একজন নারী বসেছিলো। তখন রাসুল (সা.) ঘরে এলেন। জিজ্ঞেস করলেন-‘নারীটি কে?’ হজরত আয়েশা (রা.) বললেন-‘ইনি অমুক নারী। ইনি নিজের অধিক নামাজ আদায় করার ব্যাপারে আলোচনা করছেন।’ রাসুল (সা.) বললেন-‘তাকে তার পথে ছেড়ে দাও। যতোদূর সম্ভব, তোমার দায়িত্ব এতোটুকুনই। আল্লাহতায়ালা প্রতিদান দেয়া থেকে বিমুখ হবেন না, যতোক্ষণ পর্যন্ত তুমি বিমুখ না হও।’ (সহিহ বোখারি : ৪৩, সহিহ মুসলিম : ১৮৭০, রিয়াদুস সালিহিন : ১১৫)।
৬. এরশাদ হচ্ছে-‘নিঃসন্দেহে আল্লাহতায়ালা কিছু জিনিস ফরজ করে দিয়েছেন। তোমরা তা বিনাশ কোরো না। তিনি কিছু জিনিস হারামও করেছেন। তোমরা তা লঙ্ঘন কোরো না। তিনি ধর্মের সীমা নির্ধারণ করে দিয়েছেন। তোমরা তা অতিক্রম কোরো না। কিছু বিষয়ে চুপ থাকতে বলেছেন। তোমরা সে ব্যাপারে তালাশ করতে যেও না।’ (সুনানে দারা কুতনি : ৪৩৯৬, আল মুজামুল কাবির : ১৮০৩৫, সুনানে বায়হাকি : ১৯৫০৯, মুসনাদে শামিয়িন : ৩৪৯২)।
হাদিসে আল্লাহর নির্ধারিত ফরজকে বিনাশ না করতে, তার নিষেধ করা হারাম কাজে লিপ্ত না হয়ে তার নিষেধাজ্ঞা পালন করতে, তার নির্ধারিত সীমারেখা অতিক্রম না করতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এর নামই অবিচলতা। যা ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করবার উল্টো (সরল) পথ।
৭. এরশাদ হচ্ছে-‘নিঃসন্দেহে ধর্ম অতি সহজ। যারাই ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি বা কঠোরতা অবলম্বন করে, তাদের ওপরই ধর্মটা বাড়াবাড়ি-পর্যায়ের মনে হয়। তাই ভারসাম্য ও মধ্যমপন্থা অবলম্বন করো। যতোদূর সম্ভব, ততোদূর করো। প্রতিদানের সুসংবাদ গ্রহণ করো। সন্ধ্যে-ভোরের শেষাংশে ইবাদত করে সাহায্য প্রার্থনা করো।’ (সহিহ বোখারি : ৩৯, সুনানে নাসাই : ৫০৩৪, সুনানে বায়হাকি : ৪৯২৯, শরহুস সুন্নাহ : ৯৩৫)।
হাদিসটির ব্যাখ্যায় উলামায়ে কেরাম বলেন-‘ধর্ম সহজ হবার পরও ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করে যে ব্যক্তি ধর্মে কঠোরতা অবলম্বন করে, সে পরাজয় বরণ করবে। ধর্ম বিজয়ী হবে। তাই এ ধরনের কঠোরতা ও বাড়াবাড়ি অবলম্বন না করা চাই।’ হাদিসের অন্যান্য ব্যাখ্যাকারগণ বলেন-‘সন্ধ্যে-ভোর ও রাতের শেষাংশ দ্বারা প্রফুল্লের সময় উদ্দেশ্য। এর দ্বারা বোঝা যায়, ইবাদত এমন সময় আদায় করা চাই, যখন মানুষের উদ্দমতা থাকে। যাতে ইবাদতের আসল উপলব্ধি অনুভূত হয়। হাদিসে রাসুল (সা.) ইবাদতকারীকে একজন মুসাফিরের সঙ্গে উপমা দিয়েছেন। তার শরীরে যেমন উদ্দমতা থাকলে সে সফরে বেরোতে পারে, তেমনিভাবে প্রফুল্ল থাকলে ইবাদতকারীও মন লাগিয়ে নামাজে মশগুল থাকতে পারে। না হয় উদ্দমতা না থাকলে মুসাফির যেমন দিনরাত লাগাতার সফরের কারণে অসুস্থ ও দুর্বল হয়ে পড়ে, তেমনিভাবে ইবাদতকারীও। ফলে তার সময়গুলি একদম বিফলে যায়।’ (শরহে ইবনে বুতাল লিল বোখারি : ১/৯৬, উমদাতুল কারি : ২/১০২, ফয়জুল কাদির : ২/৪১৭)।
৮. হজরত আবু বারজা আসলামি (রা.) থেকে বর্ণিত। একবার তিনি বাইরে এলেন। রাসুল (সা.)-কেও সে পথে আসতে দেখলেন। ভাবলেন হয়তো কোনো প্রয়োজনে কোথাও যাচ্ছেন তিনি। সেজন্য রাসুল (সা.)-কে এড়িয়ে গেলেন। কিন্তু রাসুল (সা.) তাকে ডাকলেন। তার হাত ধরে নিজের সঙ্গে নিয়ে চললেন। পাশে এক লোককে নামাজ পড়তে দেখলেন। যে অধিক রুকু-সেজদা করছিলো। রাসুল (সা.) বললেন-‘তোমার উচিত মধ্যমপন্থা অবলম্বন করা। কেননা ধর্ম নিয়ে যে-ই বাড়াবাড়ি বা কঠোরতা অবলম্বন করে, ধর্ম তার ওপর বিজয়ী হয়। এভাবে তিনবার বললেন কথাটি।’ (মুসনাদে আহমদ : ১৯৮০১, সহিহ ইবনে খোজায়মা : ১১৭৯, সুনানে বায়হাকি : ৪৯৩০)।
৯. হজরত আনাস (রা.) বলেন-রাসুল (সা.) মসজিদে ঢুকলেন। দুটো রশি দু’দিকে ঝুলে রয়েছে দেখলেন। জানতে চাইলেন-‘রশিটি কার?’ লোকেরা বললো-‘হজরত যয়নব (রা.)-এর। ইবাদত করতে করতে যখন তিনি ক্লান্ত হয়ে পড়েন, তখন উদ্দমতা সৃষ্টি করতে এতে ঝুলে পড়েন।’ রাসুল (সা.) বললেন-‘এখনই খুলে ফেলো। তোমাদের মাঝে যদি কেউ নামাজ পড়ে, সে যেনো নিজের উদ্দমতা থাকতে ও সহজিয়া আদলে পড়ে। যখন ক্লান্ত হয়ে পড়ে, তখন যেনো শুয়ে পড়ে।’ (সহিহ বোখারি : ১১৫০, সুনানে বায়হাকি : ৪৯২৭, আল মুজামুল ওয়াসিত : ৮৮৯০)।
১০. এরশাদ হচ্ছে-‘যখন তোমাদের মাঝে কেউ নামাজ পড়তে পড়তে তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়ে, ঘুম দূর না হয়ে যাওয়া পর্যন্ত সে যেনো শুয়ে থাকে। কেননা যখন কেউ ঘুম অবস্থায় নামাজ পড়ে, তখন তার হুশ ঠিক না থাকায় কে জানে সে ক্ষমাপ্রার্থনার বদলে নিজেকে গালি দিয়ে বসে কিনা।’ (সহিহ বোখারি : ২১২, সহিহ মুসলিম : ১৮৭১, মুয়াত্তায়ে ইমাম মালিক রহ. : ২৫৭, সুনানে আবি দাউদ : ১৩১২, সুনানে ইবনে মাজাহ : ১৩৭০, মুসনাদে আহমদ : ২৪৩৩২, সহিহ ইবনে খোজায়মা : ৯০৭, সুনানে বায়হাকি : ৪৯১৫)।
১১. হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বর্ণনা করেন, একবার রাসুল (সা.) ভাষণ দিচ্ছিলেন। তখন এক লোককে দেখলেন দাঁড়িয়ে থাকতে। রাসুল (সা.) কারণ জানতে চাইলেন। সাহাবায়ে কেরাম (রা.) বললেন-‘ইনি আবু ইসরাইল। ইনি রোদে দাঁড়িয়ে থাকবেন, বসবেন না; কোনো বস্তুর ছায়া গ্রহণ করবেন না; কারোর সঙ্গে কথা বলবেন না; এমনকি নফল রোজাও রাখবেন বলে মানত করেছেন।’ রাসুল (সা.) বললেন-‘তাকে আদেশ করো, যেনো সে কথা বলে, ছায়া গ্রহণ করে, বসে, আর রোজার মানত পূর্ণ করে।’ (সহিহ বোখারি : ৬৭০৪, সুনানে আবি দাউদ : ৩৩০২, সুনানে ইবনে মাজাহ : ২১৩৬)।
১২. হজরত আনাস (রা.)-সূত্রে বর্ণিত। রাসুল (সা.) একজন বৃদ্ধ লোকের পাশ কেটে যাচ্ছিলেন। যে তার দুই ছেলের সাহায্যে পথ চলছিলো। রাসুল (সা.) জিজ্ঞেস করলেন-‘এর এই অবস্থা কেনো?’ বলা হলো-‘লোকটি বাইতুল্লাহ শরিফ অবধি পায়ে হেঁটে যাবার মানত করেছে।’ রাসুল (সা.) বললেন-‘আল্লাহতায়ালা এই বৃদ্ধের নিজেকে কষ্ট দেয়া থেকে বিমুখ।’ এরপর রাসুল (সা.) তাকে আরোহীর ওপর চড়ে বসতে নির্দেশ দিলেন। (সহিহ বোখারি : ১৮৬৫, সহিহ মুসলিম : ৪৩৩৬, সুনানে আবি দাউদ : ৩৩০৩, সুনানে তিরমিজি : ১৫৩৭, সুনানে নাসাই : ৩৮৫২, মুসনাদে আহমদ : ১২০৫৭, সহিহ ইবনে খোজায়মা : ৩০৪৪)। (চলবে)



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ