ডিসেম্বর : আমাদের গৌরব ও গর্বের মাস
ডিসেম্বর আমাদের বিজয়ের মাস। আমাদের গৌরবের এবং গর্বের মাস। একটি গর্বিত জাতি হিসেবে সগর্বে মাথা
মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে একান্তভাবে সম্পৃক্ত যে জীবন তার অতীত কাহিনীও কি কম সমৃদ্ধ? তা না হলে ২০১০-এর ডিসেম্বরে এসে কেন মনে পড়বে সেই শীর্ণকায় কিশোরের কথা, ক্লাস ফাইভের ছাত্র। ১৯৪৫ সালের ‘রশীদ আলীর মুক্তি চাই’ সেøাগান দিতে দিতে ১০-১২ মাইল মিছিল করে বহু দূরে অজানা গৃহস্থ বাড়িতে রাত্রিযাপন হবে যার ললাট লিখন। সে কী আমি? তারপর ১৯৪৮, ১৯৫২, ১৯৫৪, ১৯৫৫’র বছরগুলোতে বিভিন্ন আন্দোলনে অংশগ্রহণ। অবশেষে এলো যথার্থ যুদ্ধÑ বাঁচা-মরার লড়াই! চট্টগ্রামে শিল্পী-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবী প্রতিরোধ সংঘ প্রতিষ্ঠা, বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে টেলিফোন নিয়ে বসে সিগন্যালিংয়ের দায়িত্ব পালন, পরে রাউজান, রাঙ্গুনিয়া, রামগড়, আগরতলা, নরসিংগড়, কলকাতা, দিল্লি, বৈরুত, দামেস্ক, আলেপ্পো ঘুরে এসে মুক্তিযুদ্ধের মিশন নিয়ে প্যারিস যাওয়ার পথে কলকাতা প্রত্যাবর্তন। ‘রাষ্ট্রবিহীন ব্যক্তির একটা পরিচিতিপত্র ভারতের বিদেশ মন্ত্রণালয়ের অফিস থেকে সংগ্রহ করতে হবে। আমাদের প্রধানমন্ত্রীর সচিব ড. ফারুক আজিজ খান এ ব্যাপারে আমাকে সাহায্য করছিলেন। খুবই স্মার্ট একজন কমবয়সী বাঙালি মহিলার অফিসে গিয়ে বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন করে এলাম। নভেম্বরের শেষ সপ্তাহ। দিল্লি থেকে ফরাসি লমোঁদ পত্রিকার বিশেষ প্রতিনিধি কলকাতা এসে কয়েক জায়গায় ফোন করে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করল। দুপুরে পার্ক হোটেলে মধ্যাহ্ন ভোজনের আমন্ত্রণ। একথা- সেকথার পর অভিন্দন জানিয়ে বলল ‘এরপর তো দেখা হবে ঢাকায়। জানো কি, যুদ্ধ শুরু হয়ে গিয়েছে’। আশ্চর্য! সীমান্তে সামান্য সংঘর্ষ ছাড়া সেদিনের সংবাদপত্র তো এ ধরনের ইঙ্গিতবহ কোনো কিছু চোখে পড়েনি। কিন্তু ফরাসি বন্ধু যথার্থ খবরই পেয়ে গেছে তার ইনফরমার মারফত। ১ ডিসেম্বর প্রীতিশ নন্দী ও রিনার বাড়িতে সস্ত্রীক নৈশভোজনের নিমন্ত্রণ। দিল্লি থেকে আগত ড. লোকনাথ ভট্টাচার্য ও কলকাতার রাজনীতিবিদ ডা. গণি আরো কয়েকজনের সাথে ছিলেন সেখানে। গল্পগুজবে অনেক রাত হয়ে গেল। ডা. গণি একটা ট্যাক্সি ডেকে আমাদের তাতে তুলে দিলেন। টুকে রাখলেন ট্যাক্সির নম্বর। গোবরা রোডে কবরস্থানের পাশে তেতলা বাড়িটির দেড়তলায় গাড়ি রাখার গ্যারেজের ওপর ছোট একটি কক্ষ আমাদের বিশেষ বাসগৃহ। নিচের তলায় থাকেন সস্ত্রীক অধ্যাপক সৈয়দ আলী আহসান, দুই পুত্র, জ্যেষ্ঠ কন্যা ও জামাতা, তাদের দুই ছেলেমেয়ে, ভাগ্নে, শ্যালক ও বহুকালের এক আশ্রিতা চম্পা খালা। পাশের ফ্লাটে অস্থায়ী রাষ্ট্রপ্রধান সৈয়দ নজরুল ইসলামের মুখ্য সচিব ও তার স্ত্রী (ফজলে হাসান আবেদের কাজিন), দোতলায় প্রফেসর মুশাররফ (অর্থনীতিবিদ) ও তার বিদেশি স্ত্রী। তেতলায় পুলিশের বড় কর্তা আবদুুল খালেক সাহেব ও তার পরিবার।
রাত দুটোর পর আমার স্ত্রী শরীর খারাপের আলামত দেখা গেল। নিচে গিয়ে শাশুড়ি-মামণিকে কবর দিতেই তিনি ‘হায় হায়’ করে উঠলেন। সবাই বিছানা ছেড়ে উঠে পড়ল। সাবেক বাড়িওয়ালা দারোয়ানের বদৌলতে টেলিফোন ব্যবহার করা সম্ভব হলো। ভাগ্যিস, আগেভাগে বলা-কওয়া ছিল। ড. আনিসুজ্জামান নিজেই বলে রেখেছিলেন। তবু সসঙ্কোচে তার আত্মীয় বাড়িতে এই গভীর রাতে ফোন করলে দেখা গেল তারা এখনো ঘুমুননি। আনিস ভাই দ্রæত গাড়ি নিয়ে এলেন এবং আমাদের পার্কভিউ নার্সিং হোমে পৌঁছে দিলেন। এই নার্সিং হোমের প্রধান কর্ত্রী বিলাতি ডিগ্রিধারী ডা. আনোয়ারা খাতুন। এক অসাধারণ ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মহিলা ও দক্ষ চিকিৎসক। তার কথা আমাকে জানিয়েছিলেন রামকৃষ্ণ মিশনের ফরিদপুর নিবাসী এক কর্মী। প্রথমবার স্ত্রী নাসরিনকে নিয়ে আমি ডা. আনোয়ারার চেম্বারে গিয়ে অবাক হয়ে যাই। ছোট্ট কামরা কিন্তু একটা দেয়ালজুড়ে বিরাট এক ছবি, যে ছবি আমরা ক্ষুদ্রাকারে দেখেছি সাময়িকপত্রেÑ রবীন্দ্রনাথ এসেছেন শেরে বাংলার বাসভবনে। সামনে অতিথির জন্য অনেক আঙুর ও অন্যান্য ফলমূল। সাদা-কালো ছবি কিন্তু খুবই তাৎপর্যবহ। যা হোক, স্ত্রীকে রেখে আমরা শেষ রাতে বাসায় ফিরলাম। সকালে গিয়ে পৌঁছুতে প্রায় ৯টা বেজে গেল। ইতোমধ্যে মা ও শিশুপুত্র রৌদ্রোজ্জ্বল একটি কক্ষে শুয়ে আছে।
নার্সিংহোমের ব্যবস্থাপনা, খাওয়া-দাওয়া ছিল খুবই চমৎকার। সুসাহিত্যিক আবু সাঈয়ীদ আইউব ও গৌরী আইউবের একমাত্র পুত্রসন্তান পূষণ। সে নামেই নবজাতককে ডাকতে আমাদের ভালো লাগলো। শুনেছি আইউব সন্তান পূষণ মুম্বাই থাকে এখন এবং সে একজন অ্যাপ্লাইড ফিজিসিস্ট। আমাদের ছেলে পূষণ ঢাকায় আছে একই ডিগ্রি নিয়ে।
বৈরুতে যে আরব সাংবাদিক বাংলাদেশ মিশন প্রতিষ্ঠাকালীন মোল্লা জালালও আমাকে সহায়তাদান করেছে এবং ১৯৭১-এর সেপ্টেম্বরে আমার ইংরেজিতে শেখা ঝটঋঋঊজওঘএ ঐটগগঅঘওঞণ ইঅঘএখঅউঊঝঐ
আরবীতে অনুবাদ করে পুস্তিকাকারে ছাপিয়ে কয়েক হাজার কপি বিলির ব্যবস্থা করেছিল। সেই নাবিল বারাদে’র ‘নাবিল’ নামটিও ধার নিলাম ছেলেটির আসল নামের জন্য। সে হলো নাবিল শাহ কোরেশী, আমাদের প্রথম সন্তান!
এদিকে ৩ ডিসেম্বর ইন্দিরা গান্ধী কলকাতায় এসে জনসভায় ভাষণ দেবেন। মহাহুলুস্থুল, কী হবে, কী হতে যাচ্ছে? কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর বক্তৃতায় কেউ তেমন খুশি হতে পারল না। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যে খবর শোনা গেল পাকিস্তান-ভারত আক্রমণ করেছে। প্রকাশ্য যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল। ভারতে জরুরি অবস্থা ঘোষিত হলো, কলকাতার রাস্তা হয়ে গেল বাতিহীন। পার্ক এভিনিউ থেকে মাইকেলের কবর পেরিয়ে গোবরা রোডের দীর্ঘপথ আমাকে এক নিñিদ্র অন্ধকারে অতিক্রম করতে হলো কয়েকদিন।
দু’দিন যুদ্ধ চলার পর ভারত বাংলাদেশকে দিলো আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি। আরো দু’দিন পর ভুটানও তাই করল। এতে জনমনে ভয়ানক আলোড়ন দেখা দিলো। সবাই খুশি। বিভিন্ন ফ্রন্টে তখন মারাত্মক লড়াই চলছে। নিউইয়র্কে জাতিসংঘে চলছে বাকযুদ্ধ। মুক্তিবাহিনী সংঘবদ্ধ হয়ে ঢাকার দিকে এগোতে থাকে। বিজয় আসন্ন। খÐযুদ্ধ চলছে চারদিকে। ভারতীয় বিমান বোমা ফেলছে ঢাকায়। কিন্তু কইÑ পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী তো আত্মসমর্পণ করছে না?
অবশেষে জানা গেল, ১৬ ডিসেম্বর বিকেলে মুক্তিযুদ্ধের মিশন আপাতত সমাপ্তি লাভের শুভলক্ষণ এসে গেছে। রমনা রেসকোর্সে আত্মসমর্পণের আয়োজন চলছে। বাংলাদেশ মিশনজুড়ে মহাহুলুস্থুল। চারদিক থেকে শরণার্থী আর স্থানীয় উৎসাহীদের হৈ-চৈতে সেখানে অবস্থান কঠিন হয়ে পড়ল। চারদিকে অস্ত্রবাজি ফুটতে লাগল। একপর্যায়ে অসুস্থ বোধ করে আমি বাসায় ফিরে এলাম। শুয়ে বসে রাস্তা দিয়ে সাধারণ মানুষের উল্লাস শুনতে পাচ্ছি। এর মধ্যে কেউ কেউ সত্বর ঢাকা যাওয়ার ঘোষণা দিচ্ছে, ঢাকায় ব্যবসা করবে, চাকরি করবেÑ কত কিছু! পরদিন সকালে নিউমার্কেটের কাছে দে’জ মেডিক্যাল সেন্টারে ওষুধপত্র কিনতে গেলে শুনি : ‘কী দাদা! কবে শাখা খুলছেন ঢাকায়’? আর সঙ্গে নানা উচ্ছ¡াসময় বাক্য বিনিময়! মনে হলো, এ কী ধরনের পরিস্থিতি! পরদিন সকালে অধ্যাপক সৈয়দ আলী আহসানসহ যোধপুর পার্কে অন্নদা শংকর রায়ের বাড়িতে গেলাম। মিসেস নীলা রায় অভ্যর্থনা জানিয়ে আমাদের বৈঠকখানায় বসালেন। এ কথা সে কথার পর বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের প্রশ্নটিও উঠল। আমরা কি সত্বর পশ্চিমবঙ্গের বা ভারতের অধীনস্থ হয়ে পড়ব? ঠিক অতো খোলামেলা না হলেও চারদিকে অবস্থাদৃষ্টে সৈয়দ আলী আহসান বিষয়টি সম্পর্কে তার আশঙ্কার প্রকাশ ঘটালেন। কিন্তু প্রাজ্ঞ অন্নদা শংকর অত্যন্ত যৌক্তিক ভঙ্গিতে মতামত জানালেনÑ ভারতের নিজস্ব সমস্যা, পশ্চিমবঙ্গে শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর বহির্ভারত বা বিশ্বমুখী ধ্যান-ধারণা নিয়ে বাংলাদেশের ক্ষুদ্র গÐিতে আবদ্ধ হতে চাইবে না। এখন যা হচ্ছে তা সাময়িক। কিছুটা আশ্বস্ত হয়ে আমরা সেদিন বাসায় ফিরলাম।
কিন্তু ১৮ তারিখ সংবাদপত্রে ঢাকায় বুদ্ধিজীবী নিধনযজ্ঞের খবর জেনে আমরা অনেকেই বাকরুদ্ধ হয়ে অশ্রæপাত করতে থাকলাম। অবশ্য ১৬ তারিখ থেকে মাঝে মাঝে এটা হচ্ছে। কার আত্মীয়-স্বজন কোথায় জীবিত আছে? বঙ্গবন্ধু কি জীবিতাবস্থায় ফিরে আসবেন আমাদের কাছে? মাথায় ও মনে এ সব দুশ্চিন্তা নিয়ে বিজয়ের পরিপ্রেক্ষিতে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের জন্য একটা কথিকা লিখতে বসলাম। বন্ধু বেলাল মোহাম্মদের অনুরোধ উপেক্ষা করা যাবে না।
লেখক : অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ও সাবেক মহাপরিচালক
বাংলা একাডেমি
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।