ডিসেম্বর : আমাদের গৌরব ও গর্বের মাস
ডিসেম্বর আমাদের বিজয়ের মাস। আমাদের গৌরবের এবং গর্বের মাস। একটি গর্বিত জাতি হিসেবে সগর্বে মাথা
অনুবাদ : হোসেন মাহমুদ
একটা বড় পাথরের উপর বসে সিগারেট ধরিয়ে পকেট থেকে মোবাইল বের করে আলী। একটু পরই চেঁচিয়ে ওঠে সেÑ
ঃ মিসাম, দেখ্ দেখ্, আমার ফেসবুক পোস্টটাতে অসংখ্য লাইক পড়েছে। সিগারেটটা ধর। আমি আরো লাইক পাওয়ার কৌশল তোকে দেখাচ্ছি।’
ঃ তোর কি মাথা খারাপ! কেউ যদি আমাকে সিগারেট হাতে দেখে ফেলে তখন?
ঃ আরে দেখ না! আমি আমার নিজের স্ট্যাটাসে রি-লাইক দিয়েছি। আমার বন্ধুদের টাইম লাইনে তা আবার দেখা যাবে। যে বোকা প্রথমবার এটা এড়িয়ে গেছে সে এখন এটা লাইক করতে বাধ্য হবে।
ঃ ওয়াও! এ কৌশল তুই কোথায় শিখলি?
ঃ আরে বুঝলি না, আমি এ যুগের আইনস্টাইন।
ঃ দরকার নেই বোঝার। এখন চল ফেরা যাক। আমার মনে হচ্ছে, নেকড়েগুলো গর্জন করতে শুরু করেছে, শিগগিরই তারা দল বেঁধে বেরিয়ে আসবে। তোর কি গত বছরের কথা মনে নেই?
এ সময় কেন জানি না, গত বছরের কথা মনে পড়ছিল আমার। ভারতীয় সৈন্যরা তাদের চরদের কাছে খবর পেয়েছিল। সোপিয়ানের একটি গ্রামে স্বাধীনতাকামী যোদ্ধাদের একটি গ্রæপকে ঘিরে ফেলেছিল তারা। আট ঘণ্টা লড়াই চলে। ছয়জন যোদ্ধার কাউকেই বাঁচতে দেয়নি ভারতীয় সৈন্যরা।
আমরা পাহাড়ের নীচে হাঁটছিলাম। হাসছিলাম, গান গাইছিলাম। কখনো কোথাও পাথরের উপর একটু বসছিলাম। কথা বলছিলাম। আমি ও আলী, আমার সমবয়সী চাচাতো ভাই। তারপর আমরা যখন আমাদের শহরে ফিরে এলাম, তখন দিনের শেষ। পৃথিবীর এ অংশে সূর্য তখন রাতের মতো বিদায় নিচ্ছিল। আমরা দেখতে পেলাম, কয়েক হাজার মানুষ শহর চত্বরে জড়ো হয়েছে। তাদের সবাই গলা ফাটিয়ে চিৎকার করছে, ‘হাম কেয়া চাহতেÑ আজাদি’ (আমরা কি চাই- আজাদি)। তাদের গর্জন আকাশে-বাতাসে অনুরণিত হচ্ছিল। এর কারণ বুঝতে দেরী হলো না। খুনি ভারতীয় সৈন্যদের সাথে বন্দুকযুদ্ধে কোনো স্বাধীনতাকামী যোদ্ধা নিহত হলে তখনি এরকম প্রতিক্রিয়া হয়। সারা কাশ্মিরই তো আজ এক রণাঙ্গন। কয়েক লাখ ভারতীয় সৈন্য অস্ত্রের ট্রিগারে আঙুল রেখে রাস্তায় রাস্তায়, অলিতে-গলিতে টহল দিচ্ছে। কাশ্মিরের স্বাধীনতার জন্য লড়াই করছে তরুণ যোদ্ধারা। এ সব যোদ্ধা কোনো অভিযানে যায় নিজেদের জীবন দেয়ার জন্যই। তারা অভিযানে গেলেই শত শত ভারতীয় সৈন্য তাদের ঘিরে ফেলে। কয়েক ঘণ্টা ধরে বন্দুক লড়াই চলে। যেভাবেই হোক, যত সময়ই লাগুক, রক্তপিপাসু ভারতীয় সৈন্যরা হত্যা করে তাদের। বুঝতে পারছি, আবার কাশ্মিরের কোনো বা কয়েকজন সন্তান দেশের জন্য প্রাণ দিয়েছে। আমরা সেখানে ছুটে গেলাম। দেখলাম, ভারতীয় সৈন্যরা একজনকে হত্যা করেছে। পরিচয় জানতে পারলাম নিহতের।
২. ছেলেটি স্কুলে আমার সহপাঠী ছিল। সাথে সাথে আমার মনে পড়ে যায় কিন্ডারগার্টেনে পড়ার সময় টিচার ম্যাম একদিন তাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, তোমার জীবনের লক্ষ্য কি? সে জবাব দিয়েছিলÑ ম্যাম! আমি একজন ডাক্তার হতে চাই। এক বছর আগে সে ছেলেটি নিখোঁজ হয়। আমার সাথে তার আর কোনোদিন দেখা হয়নি। পরে নিশ্চিত খবর পাওয়া যায় যে, সে স্বাধীনতাকামী যোদ্ধাদের সাথে যোগ দিয়েছে। আমরা দু’জন মসজিদের দিকে দৌড়াই। ফিরে আসি দু’টি কোদাল হাতে নিয়ে।
আরে আমার পরিচয়ই আপনাদের দেয়া হয়নি এতক্ষণ। আমার নাম সিসাম, বাবার নাম হাফিজ, তিনি জীবিত নেই। আমার মা বলেন, ’৯০-এর দশকে বাবা সীমান্ত পেরিয়ে ওপারে চলে গিয়েছিলেন। আর ফিরে আসেননি তিনি। আমাদের পারিবারিক পেশা হলো কবর খোঁড়া। শুধু কবর খোঁড়াই নয়, সেই সাথে দাফন করাও। কোনো লাশ দাফনের দরকার হলেই আমাদের জানানো হয়। তখন আমরা আমাদের কাজ করি।
আমার বয়স ২৪ বছর। এ বয়সে আমি ২০০ কবর খনন করেছি। তার মধ্যে এক শ’ই ছিল কাশ্মিরের স্বাধীনতাকামী যোদ্ধাদের। যা হোক, আমরা দু’জন কবর খুঁড়তে শুরু করলাম। একেকটি কবর খুঁড়তে ঘণ্টাখানেক সময় লাগে। আবেগময় পরিবেশে শহীদের লাশ দাফন সম্পন্ন হলো। শান্তিপূর্ণভাবে মাটির কোলে চিরদিনের মতো শায়িত হলো সে। একজন মাওলানা আল্লাহর প্রশংসা করে নিহত এ লাল গোলাপটিকে বেহেশত নসীব করার জন্য প্রার্থনা করলেন।
সহিংসতা কখনোই আমার পছন্দ নয়। একজন পেশাদার কবর খনক হয়েও আমি কখনোই লাশ দেখতে চাই না। যখনি আমি কোনো মৃত মানুষকে দেখি, যখন দেখি চারজন মানুষ কাঁধের খাটিয়াতে একটি মৃতদেহ বয়ে আনছে, তখনি আমার মেরুদÐ দিয়ে শীতল স্রোত বয়ে যায়। আমি ভেবে পাই না যে, লোকটি তারই মতো আরেকটি লোককে হত্যা করে তার অন্তর কি দিয়ে গড়া। যে একটি প্রাণকে এ পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত করতে পারে, সে কি মানুষ? তার হৃদয়ে কি দয়ামায়া নেই? সে কি বিশে^ কারো ভালোবাসা পায়নি? কাউকে ভালোবাসেনি? এসব প্রশ্ন সবসময় আমাকে তাড়িত করে।
একদিন আমাদের শহরে বৃষ্টি হচ্ছিল। চারদিক নীরব, সব কিছু যেন থেমে আছে। দুপুর বেলা বৃষ্টি বন্ধ হলে আমরা মাঠে গেলাম বাড়ির ভেড়াগুলোর জন্য ঘাস কাটতে। সময়টি এমন যে দিনের বেলাতেও চলাফেরা করা বিপজ্জনক। কয়েক মাস ধরেই কাশ্মিরে স্বাধীনতার লড়াই জোরদার হয়ে উঠেছিল। বহু তরুণ ও শিক্ষিত যুবক স্বাধীনতা যোদ্ধাদের খাতায় নাম লেখাচ্ছিল।
আমরা একটা বিরাট গাছ থেকে পাতা ভরা ছোট ছোট ডাল কাটছিলাম। এ সময় থেমে থেমে হাসির শব্দ বাতাসে ভেসে আসছিল। হাসির উৎস সন্ধানে চারদিকে ঘুরে ফিরছিল আমার চোখ। তখনি দেখলাম ছয়-সাত জনের একটি দল আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে। আমরা আমাদের সাথে আনা প্লাস্টিক ব্যাগে ডালগুলোর পাতা ভরতে থাকলাম।
এরা কাশ্মিরের স্বাধীনতাকামী যোদ্ধা। ভারত সরকার তাদের বলে জঙ্গি বা সন্ত্রাসী। আমি আগেও এরকম যোদ্ধাদের দেখেছি। আরে আশ্চর্য! এ দলটিতে একাধিক মেয়েও আছে দেখছি। প্রত্যেকের কাঁধ থেকে ঝুলছে একে-৪৭। হতবুদ্ধি হয়ে দাঁড়িয়ে আছি। দলের একটি মেয়ে যোদ্ধার চুল ছোট করে ছাঁটা, নীল চোখ, জিন্স পরা।
মেয়েদের একজন সাথের এক যোদ্ধাকে জিজ্ঞেস করেনÑ
ঃ রাজা ভাই! গাছের ডাল কাটছে, এরা কারা?
রাজা নামের স্বাধীনতাকামী যোদ্ধাটি আমাকে ডাকলেন। তিনি বোধ হয় দলের নেতা। এ জায়গা ও আশপাশের খবর জিজ্ঞেস করলেন। আমি মুখ খুললামÑ
ঃ স্যার...
তিনি থামিয়ে দিলেন আমাকেÑ
ঃ আমি তোমার স্যার নই।
থতমত খেয়ে বললামÑ
ঃ আমরা পাশের গ্রামের লোক। প্রায়ই আমাদের পশুগুলোর খাবার সংগ্রহ করতে এখানে আসি আমরা।
ঃ ঠিক আছে, তোমরা তোমাদের কাজ করো। তবে বেশিক্ষণ এখানে থেকো না। ঘাস-পাতা সংগ্রহ শেষ করে বাড়ি চলে যাও।
দলনেতার সাথে কথা বলতে আমার আগ্রহ ছিল না। আমার চোখ বারবার চলে যাচ্ছিল তার পেছনে থাকা স্বাধীনতাকামী নারী যোদ্ধাটির দিকে। তার চেহারা থেকে যেন শক্তি ও সাহস বিচ্ছুরিত হচ্ছিল। আলো ছড়াচ্ছিলেন তিনি। আমার ভেতরটা সে আলোয় আলোকিত হয়ে উঠছিল। আমি তার মুখ থেকে চোখ সরাতে পারছিলাম না। তিনি আমাকে সম্পূর্ণ বিমোহিত করে ফেলেছিলেন। আমি বারবার তার চোখের দিকে চাইছিলাম। এ সময় আমাকে ওই স্থান ত্যাগ করতে ইশারা করলেন তিনি। তাই আর সেখানে থাকা হলো না। মেয়ে যোদ্ধাটি তার ডান হাতে একটি সুন্দর বালা পরেছিলেন। আমার সারা হৃদয়জুড়ে তখন মধুর মুগ্ধতার আবেশ। আমি তার সাথে আবার দেখা হওয়ার স্বপ্ন দেখতে থাকি।
৩. হঠাৎ বিকট আওয়াজ হয়। তারপর দরজায় কে যেন সজোরে আঘাত করতে থাকে। তাকিয়ে দেখি, ঘড়িতে রাত তিনটা বাজে। এ সময় আলী আমার নাম ধরে ডাকতে থাকে। তাড়াতাড়ি উঠে দরজা খুলে দিতেই সে বলেÑ
ঃ সিসাম, পাশের গ্রামে স্বাধীনতাকামী যোদ্ধাদের সাথে ভারতীয় সৈন্যদের লড়াই চলছে। জলদি কাপড় পরে নে। গ্রামের সবাই সেখানে যাচ্ছে। তাদের বাঁচাতে হবে।
যত দ্রæত সম্ভব জামা-কাপড় পরে আলীর সাথে রওনা হলাম। কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরী হয়ে গিয়েছিল। ভারতীয় সৈন্যরা তাদের হত্যাযজ্ঞ শেষ করে চলে যাওয়ার জন্য গাড়িতে উঠছিল। তাদের অভিব্যক্তিতে বীরত্ব ও সাফল্যের উদ্ভাস। এদিকে লাশগুলো ঘিরে শুরু হয়েছে স্বজনদের মর্মভেদী আহাজারি। মনে হচ্ছিল, সারা কাশ্মির তাদের সাথে কাঁদছে তার সন্তানদের জন্য।
সেই নিশুতি রাতে আমি ফিরে এসে দৌড়ে গেলাম মসজিদে। দু’টি কোদাল নিয়ে ফিরে এলাম। এবার আমাদের সাতটি কবর খুঁড়তে বলা হলো। তিন বছর আগে আমি একসাথে ছয়টি কবর খুঁড়েছিলাম। আলীকে ডাকলাম। তারপর কবর খুঁড়তে শুরু করলাম দু’জন।
কবর খোঁড়ার সময় দুই বৃদ্ধ ব্যক্তির মধ্যকার কথা কানে আসে। তাদের একজন বলছিলেনÑ
ঃ আহা! আমাদের সোনার ছেলেমেয়েগুলো কিভাবে যে প্রাণ দিচ্ছে দখলদারদের কবল থেকে কাশ্মিরকে মুক্ত করার জন্য। কে জানে আমাদের আর কত রক্ত দিতে হবে
দ্বিতীয় বৃদ্ধ বলেনÑ
ঃ কাশ্মিরজুড়ে রয়েছে অসংখ্য চর। ব্রিটিশদের মতো ভারতও এখানে চর তৈরি করে রেখেছে। এ চরদেরই কেউ স্বাধীনতামী যোদ্ধাদের গোপন অবস্থানের খবর ভারতীয় সৈন্যদের কাছে পৌঁছে দেয়। সাাথে সাথে ছুটে আসে রক্তলোভী হায়েনার দল। ঘিরে ফেলে তাদের। শুরু হয় লড়াই। হিংস্র ভারতীয় সৈন্যরা কোনো স্বাধীনতাকামী যোদ্ধাকে বাঁচতে দেয় না। এটা তাদের নির্মূল কৌশল। এখানেও তাই হয়েছে। এ গ্রæপে দু’জন স্বাধীনতাকামী নারী যোদ্ধাও ছিল। শহীদ হয়েছে সবাই।
তার কথাগুলো আমার সমস্ত সত্তাকে কাঁপিয়ে দিলো। আমি নিজেকে জিজ্ঞেস করলামÑ
ঃ সে মেয়ে যোদ্ধাও কি শহীদ হয়েছে? আমি কি করে তাকে কবর দেবো?
মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগেই তো তাকে দেখলাম। সে কি করে মারা যেতে পারে?
কবর খুঁড়তে খুঁড়তে এ প্রশ্নটি আমার মাথায় অবিশ্রান্তভাবে ঘুরপাক খেতে থাকে।
* গল্পটির লেখক মুনাওয়ার হুসাইন কাশ্মির বিশ^বিদ্যালয়ে সাংবাদিকতায় এমএ পড়ছেন। ১৯১৬ সালে ‘কাশ্মির লিট’ (জ¦লন্ত কাশ্মির) নামক একটি অনলাইন ম্যাগাজিনে তার এ গল্পটি প্রকাশিত হয়। গল্পটির ইংরেজি নাম ‘দি ডুমড গ্রেভডিগার।’
লেখক : সাহিত্যিক, সাংবাদিক, অনুবাদক
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।