Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ইসলামের দৃষ্টিতে পবিত্র জশনে জুলুছ

আলহাজ্ব মাওলানা শাহ্ জালাল আহমদ আখঞ্জী | প্রকাশের সময় : ৭ ডিসেম্বর, ২০১৭, ১২:০০ এএম

প্রকাশ থাকে যে, মীলাদ শরীফের বা জন্মবৃত্তান্তের প্রাক্কালে প্রিয়নবীজির তা’জিমার্থে দাঁড়িয়ে কেয়াম করা শরীয়তের দৃষ্টিতে সুন্নাত ও মুস্তাহাব, উল্লেখ্য যে, বর্তমান যুগের কিছু সংখ্যক নবীবৈরী মনোভাব পোষণকারী উলামায়ে “ছু” মিলাদ শরীফ ও কিয়াম কে বিদয়াত ও নাজায়েজ এবং খ্রীষ্টানীয় অনুষ্ঠান, হিন্দুদের কানাইয়া নামক দেবতার পুঁজার নামান্তর বলে বিত্তিহীন ফত্ওয়া দিয়ে মুসলিম সমাজে মতানৈক্য সৃষ্টির পায়তারা চালাচ্ছে। এজন্য শরীয়তের দৃষ্টিতে ইহার সুস্পষ্ট সমাধান আবশ্যক মনে করছি। প্রথমে “জশন’ শব্দটি থেকে শুরু করছি জশন অর্থ খুশী ও আনন্দ (লোগাতে কেশুয়ারী)। জুলুছ শব্দটি জলছা শব্দের বহুবচন, জলছা, শব্দের অর্থ হল বসা বা উপবেশন ( গিয়াছুল্লুগাত)। নামাজ যেমন আল্লাহর জিকিরের জলছা একই স্থানে বসে দাঁড়িয়ে আদায় করা হয় এবং হজ্ব আল্লাহর জিকিরের জুলুছ বা মিছিল, যা এক বৈঠকে সম্পন্ন করা যায় না, বরং ঘুরে ঘুরে আদায় করতে হয়। সবাই প্লেনে উঠার পূর্ব থেকেই “লাব্বাইকা, আল্লাহুম্মা লাব্বাইক, লাব্বাইকা লাশরীকালাকা লাব্বাইক, ইন্নালহামদা ওয়াননিয়মাতা লাকা ওয়াল মুলক- লা শরীকালাক” বলে সম্মিলিত মিছিল সহকারে শ্লোগান দিতে দিতে হাজির হতে হয়, মাওলার সান্নিধ্যে। “ছুবুতে ক্বেত্য়ী” কালামুল্লাহ শরীফ থেকে প্রমান পাওয়া যায় যে, তাবুতে ছাকিনা ফিরিস্তাগণ জুলুছ বা মিছিল সহকারে এসে ছিলেন, ইহাতে স্পষ্ট ভাবে প্রতীয়মান হলো যে, জুলুছ (মিছিল) শোভাযাত্র অর্থে ও ব্যবহৃত হয়ে থাকে।
আবার “ঈদ” শব্দের অর্থ খুশী বা আনন্দ উদ্যাপন করা এবং মিলাদুন্নবী (দঃ) অর্থ হলো নূরনবী রাহমাতুল্লিল আলামীন (দঃ) এর জন্ম বৃত্তান্তের বর্ণনা ও তদ সম্বলিত ঘটনাবলী আলোচনা কারা।
সুতরাং জশনে জুলুছে ঈদ-এ মিলাদুন্নবী (দঃ) কথাটির সার্বিক অর্থ এরূপ হবে যে, প্রিয়নবী (দঃ) এর শুভাগমন উপলক্ষে মিছিল সহকারে আনন্দ প্রকাশ করা। ইহা শরীয়ত সম্মত অনুষ্ঠান এবং আল্লাহ ও তাঁর প্রিয়নবী (দঃ) এর সন্তোষ্টি অর্জনের উত্তম ব্যবস্থা।
মুসলিম শরীফের ২য় খন্ড হাদীসুল ‘হিজরাত’ অধ্যায়ে হযরত বারবাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে, রাসুলে পাক (দঃ) যখন মক্কা শরীফ ত্যাগ করত! মদীনা শরীফে দাখিল হলেন, তখন মদীনা শরেিফর নারী-পুরুষ ঘরের ছাদে উঠলেন, কঁচিকাঁচারা ও গোলামগন মদীনার অলিতে গলীতে জুলুছ সহকারে ছড়িয়ে পড়েন, সকলের মুখে তখন এ শ্লোগান উচ্চারিত হচ্ছিল, ইয়া মুহাম্মাদু ইয়ারাছুলাল্লাহ (দঃ)। এতে স্পষ্ট প্রতীয়মান হল যে, ছাহাবায়ে কেরামগণও হুজুর (দঃ) এর শুভাগমনে মিছিল সহকারে ইয়া-রাছুলাল্লাহ্ ধ্বনীতে আকাশ বাতাস মুখরিত করে তুলে ছিলেন। এজন্যেই আমরা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের অনুসারীগণ প্রতি বছর ১২‘ই রবিউল আউয়াল ছাহাবায়ে কেরাম (রাঃ) এর অনুসরণ পূর্বক পবিত্র ঈদ-এ মিলাদুন্নবী (দঃ) এর খুশীতে বিভোর হয়ে মিছিল সহকারে আনন্দ উদ্যাপন করে থাকি এবং ইয়া-রাছুলাল্লাহ, ইয়া-হাবীবাল্লাহ (দঃ) ধ্বনী দিয়ে শুকরিয়া আদায় করি। মহান আল্লাহ তা’য়ালা কোরানে পাকে তাঁর বান্দাহ্গণের প্রতি খুশী উদ্যাপনের নির্দেশ পূর্বক এরশাদ করেছেন, “কুল বিফাদ্লিল্লাহী ওয়া-বিরাহ্মাতিহী ফাবিজালিকা ফাল ইয়াফরাহু” হে নবী (দঃ) আপনি উম্মতগনকে বলে দিন, আল্লাহর ফজল, দয়া এবং তাঁর রাহমাত/ করুনা প্রাপ্তিতে তারা যেন খুশী উদ্যাপন করে। প্রিয়নবী (দঃ) যে আল্লাহর ফজল, রাহ্মাত। উভয়ই, কালামে পাক তার প্রমাণ বহন করছে। যেমন এরশাদ হচ্ছে- “লাক্বাদ মান্নাল্লাহু আলাল মু’মিনিনা ইজ বা’য়াছা ফিহিম রাছুলা” অর্থাৎ নিশ্চয়ই আল্লাহ পাক মুমিনদের উপর বড়ই অনুগ্রহ বা দয়া করেছেন যে, তাদের মধ্যে একজন সম্মানীত রাছুল পাঠিয়েছেন। সুতরাং তাঁর (দঃ) আগমনের দিনে ও মাসে শরীয়ত সমর্থিত রীতি অনুযায়ী জশনে জুলুছে ঈদ-এ মিলাদুন্নবী (দঃ) উদ্যাপন করা কালামে পাকের নির্দেশের অন্তর্ভুক্ত বিধায়, নিঃসন্দেহে এ জাতীয় ধর্মীয় অনুষ্ঠান জায়েজ। দেওবন্দি মৌলানা হোছাইন আহমদ মদনী ছাহেব বলেছেন যে, খবীছ ওয়াহাবীর দল রাসুলে পাক (দঃ) জন্মের মূল আলোচনা করাটাই বিদাত ও খারাপ বলে, যেমন (খবীছ ওয়াহাবীগণ) তারা নবীজির শরীয়াতের বিদ্যা ছাড়া আর কোন বিদ্যা নেই বলে এবং নবীজিকে যে কোন ভাবে ইয়া-রাছুলাল্লাহ বলে সম্বোধন করাকে শিরীক ও রাসুলের রওজা পাকের জিয়ারতের নিয়্যতে ভ্রমণ (ছফর) করাকে হারাম বলে, নবী ও আউলিয়ায়ে কেরামের ওছিলা নিয়ে আল্লাহর নিকট কিছু চাওয়াও শিরীক বলে এবং নবীগণ ইন্তেকালের পর অন্যান্য সাধারণ মানুষের মত হয়ে যান বলে ধারণা রাখে। ওয়াহাবীরা নিজেদের দলের মানুষ ব্যতিত অন্য সবাইকে কাফের বলে। মুসলমানগণকে হত্যা করা, তাদের মাল লুট করা, বাড়ীতে আগুন দেয়া, তাদের মাহ্ফিলে গোলযোগ সৃষ্টি করা ইত্যাদি ওয়াজিব মনে করে। (আশশিহাবুচ্ছাকিব কিতাবের ৪৩-৬৭ পৃষ্ঠা)। মৌঃ রশিদ আহমদ গাঙ্গুহী লিখছেন যে, মিলাদ মাহফিল করা যদিও কোন শরীয়াত বিরোধী কাজ নয় কিন্তু এতে তৎপর হয়ে ডাকা ডাকির কারণে এ যুগে মিলাদ মাহফিল জায়েজ নয়, ওরছ মাহফিল এমনি ভাবে না জায়েজ। অনেক দিন আগে মোবাহ ছিল, আবার কোন সময় নিষেধ হয়ে গেছে। ওরছ মিলাদ মাহ্ফিল ও এখন নাজায়েজ হয়ে গেছে। (ফতুয়ায়ে রশিদিয়ার ৪১১ পৃষ্ঠা)। মৌঃ রশিদ আহমদ সহ দেওবন্দ মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা হতে প্রায় বড় আলেমদের পীর, হাজী ইমদাদুল্লাহ মোহাজিরে মক্কী (রহঃ) তাঁর পুস্তিকা (যা মৌঃ থানবীর হাতে লিখা) ফয়ছলায়ে হাফত মাছায়েল তৃতীয় পৃষ্ঠায় মিলাদ ও কিয়ামের যে মীমাংশা তিনি দিয়েছেন, তার সারাংশ পাঠকবৃন্দের অনুধাবনের জন্য তুলে ধরা হল। মিলাদ ও কেয়াম মুস্তাহাব ও মুস্তাহছান এবং ইহ ও পরলৌকিক কল্যাণ ও সমৃদ্ধির জন্য এটি পাথেয়। কিন্তু মিলাদ মাহফিলে কেয়াম করাকে ফরজ ওয়াজিব মনে করা যেমন বিদআত, আবার হারাম ও নিষিদ্ধ বলে বিশ্বাস করাটাও বিদআত। আমার নীতি এই যে, আমি মিলাদের মাহফিলে অংশ গ্রহণ করি।
বরং বরকত ও অনুগ্রহের বাহন মনে করি এবং প্রতি বৎসর মিলাদ মাহফিলের আয়োজন করি, কিয়াম করতে আনন্দ পাই। তাই যে সব ভাইয়েরা নিজেকে দেওবন্দি বলে দাবি করেন তারা যেন হাজী ইমদাদুল্লাহ্ মোহাজিরে মক্কী (রহঃ) এর অনুসরণপূর্বক নিজেকে সুন্নী মুসলমান হিসেবে গড়ে তুলেন।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ