Inqilab Logo

শক্রবার ০৯ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ কার্তিক ১৪৩১, ০৬ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

উম্মাতের বুদ্ধিজীবীদের দায়িত্ব

মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান | প্রকাশের সময় : ৩০ নভেম্বর, ২০১৭, ১২:০০ এএম

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
কুরআন সুন্নাহ’র নস বর্তমান থাকা অবস্থায় ইমামগণের আলোকে বিধান নির্ণয় না করা। বিধান নির্ণয়কারীকে মাযহাবের নীতিমালা ও তার শাখা-প্রশাখা সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গ দক্ষতা থাকতে হবে। বিধান নির্ণয়কারীকে ব্যাপকার্থে উসূলে ফিকহ ও বিশেষভাবে কিয়াস বিষয়ে জ্ঞানবান হতে হবে। বিধান নির্ণয়কারীকে মাযহাবী উসূলের সাথে ফুরুয়ের সংযোগ স্থাপন ও উৎস অবগত হওয়ার যোগ্যতাসম্পন্ন হতে হবে, যাকে উসূলবিদগণ স্বভাবজাত ফকীহ নামে অভিহিত করেছেন। উদ্ভূত বিষয়ের বিধান নির্ণয়ের সাথে সংশ্লিষ্ট প্রতিবন্ধকতা ও ফিকহী শাখা-প্রশাখার পার্থক্য সম্পর্কে দক্ষ হতে হবে। ইমামগণের মতামত যা আলিমগণের নিকট গ্রহণযোগ্য উৎসে বর্ণিত হয়েছে তার ভিত্তিতে বিধান নির্ণয়। ফকীহগণ তাদের তাখরীজের ভিত্তিতে এর বিধান নির্ণয়ের ব্যাপারে মতভেদ করেছেন। একদল গবেষক জুয়ার সাথে তুলনা করে ও গারাবের সাদৃশ্যতার কারণে একে হারাম বলেছেন। অন্যদিকে একদল একে তাবারুর সাথে তুলনা করে বা আকীলা চুক্তির ভিত্তিতে বৈধ বলেছে।
এ আধুনিক বিষয়টির বিধান বর্ণনা করতে যেয়ে বর্তমান যুগের আলিমগণ তাদের তাখরীজের ভিন্নতার কারণে মতভেদ করেছেন। কেউ কেউ গ্রন্থকে উৎপন্নদ্রব্য (চৎড়ফঁপঃ) বিবেচনা করে গ্রন্থস্বত্ব সংরক্ষিত রাখা বৈধ বলেছেন। আবার কেউ কেউ ইসলামী জ্ঞান-বিজ্ঞান একটি নির্দিষ্ট গন্ডিতে আবদ্ধ হয়ে যায় বিধায় গ্রন্থস্বত্ব সংরক্ষণ বৈধ নয় বলেছেন।
মাকাসিদে শরীআহ’র শরীয়ত প্রণেতার উদ্দেশ্য-এর ভিত্তিতে বিধান নির্ণয়ন মাকাসিদে শরীআহ প্রাচীন ও আধুনিক উভয় যুগের আলিমগণের নিকট অতি পরিচিত একটি পরিভাষা। কিন্তু পূর্ববর্তী আলিমগণ এর কোন সংজ্ঞা প্রদান করেননি। এমনকি ইমাম শাতেবীও না, যিনি এ বিষয় সর্বপ্রথম গ্রন্থ রচনা করেন। এক কথায় বান্দার দুনিয়া ও আখিরাতের কল্যাণ বাস্তবায়নের জন্য শরীয়াত প্রণেতা আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে সাধারণ ও বিশেষ যে উদ্দেশ্য গ্রহণ করেছেন তাকে বলা হয় মাকাসিদে শরীআহ। এ পরিভাষাটি বুঝানোর জন্য অন্যান্য কিছু শব্দও ব্যবহৃত হয়। যেমন- মাসলাহা, হিকমাহ, ইল্লাত ইত্যাদি
যেসব কল্যাণ সংরক্ষণের জন্য ইসলামী আইন প্রণীত হয়েছে সে দৃষ্টিতে মাকাসিদে তিন প্রকার: ক. অত্যাবশ্যকীয়, খ. প্রয়োজনীয় (পরিপূরক), গ. উন্নতিবাচক। মর্যাদাগত দিক থেকে দুই প্রকার: ক. মৌলিক খ. সম্পূরক ইসলামী বিধান অন্তর্ভুক্তির দিক থেকে তিন প্রকার: ক. সাধারণ উদ্দেশ্য (সামগ্রিক) খ. বিশেষ উদ্দেশ্য (অধ্যায় ভিত্তিক) গ. গৌণ উদ্দেশ্য (নির্দিষ্ট বিষয়)। মাকাসিদে শরীআহ’র ভিত্তিতে বিধান নির্ণয়ের ক্ষেত্রে করণীয়- প্রথমত: মাকাসিদে শরীআহ’র পূর্ণাঙ্গ জ্ঞান অর্জন।
ইমাম শাতিবী শরঈ বিধান উদ্ভাবক বা মুজতাহিদের জন্য দু’টি শর্ত প্রদান করেছেন। তিনি বলেন, যে ব্যক্তি দু’টি বৈশিষ্ট্য অর্জন করবেন তিনি ইজতিহাদের যোগ্য হবেন। একটি হল, পূর্ণভাবে মাকাসিদে শরীআহ অনুধাবন এবং অন্যটি হল, উক্ত অনুধাবনের ভিত্তিতে বিধান উদ্ভাবন।
দ্বিতীয়ত: ইস্তিকরা অর্থাৎ শরীয়াতের নস, বিধিবিধান, কারণ (ইল্লাত) ইত্যাদি সম্পর্কে অনুসন্ধ্যান। আদেশ- নিষেধের কারণ। কল্যাণ- অকল্যাণের বিশ্লেষণ।
তৃতীয়ত: মাকাসিদে শরীআহ’র চারটি শর্ত: ক. কল্যাণের বিষয় অকাট্য হবে। এ কারণে পালকপুত্র প্রথা ইসলাম রহিত করেছে। খ. প্রকাশ্যমান হবে। যেমন- বিবাহের উদ্দেশ্য বংশ রক্ষা করা। গ. দু’টি বিষয়কে সংযুক্ত করা হলেও উদ্দেশ্য একটি হতে হবে। যেমন- মদ হারাম হওয়া ও এর সাথে সাথে শাস্তি নির্ধারণ করার উদ্দেশ্য একটিই তা হল, বুদ্ধির সংরক্ষণ। ঘ. ব্যাপক, সামগ্রিক ও শাশ্বত হওয়া।
চতুর্থত: এ কথা অনস্বীকার্য যে, মহান আল্লাহ তাঁর বান্দার কল্যাণেই শরীয়াত প্রবর্তন করেছেন। এই কল্যাণের কাজই হল শরীয়াতের উদ্দেশ্য সংরক্ষণ করা। ইমাম রাযী বলেন, কল্যাণ-অকল্যাণ বিবেচনায় মানুষের কর্মকান্ড ছয় ধরণের হয়ে থাকে- ১. যাতে শুধু কল্যাণ রয়েছে। অকল্যাণ বলতে কিছু নেই। এ কাজটি শরীয়াত সম্মত হওয়া নিশ্চিত। ২. যাতে কল্যাণ-অকল্যাণ উভয়ই রয়েছে। তবে কল্যাণ অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত। এটিও শরীয়াত সম্মত হওয়া উচিৎ। কেননা সামান্য অকল্যাণের জন্য অনেক কল্যাণ পরিত্যাগ করা দূষণীয়। ৩. যাতে কল্যাণ- অকল্যাণ সমান। এটি একটি নিরর্থক কাজ। যা শরীয়াত সম্মত না হওয়াই বাঞ্ছনীয়। ৪. যাতে কল্যাণ- অকল্যাণ কোনটিই নেই। এটিও একটি নিরর্থক কাজ। অতএব তাও শরীয়াত সম্মত হতে পারে না। ৫. এককভাবে অকল্যাণ নিহিত। নিশ্চিতভাবে এটি শরীয়াত সম্মত হবে না। ৬. যাতে কল্যাণ-অকল্যাণ উভয়ই রয়েছে তবে অকল্যাণই অগ্রগণ্য। এটিও শরীয়ত সম্মত না হওয়া বাঞ্ছনীয়। কেননা অকল্যাণ দূরীভূত করা আবশ্যক।
১ম, কল্যাণ অত্যাবশ্যক হওয়া। ২য়, কল্যাণ সামগ্রিক হওয়া, গৌণ না হওয়া। ৩য়, কল্যাণ অকাট্য হওয়া, ধারণাপ্রসূত না হওয়া। ইমাম শাতেবী মাসালিহে মুরাসালাহর ভিত্তিতে আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে তিনটি শর্ত প্রদান করেছেন-
১. কল্যাণ চিন্তা ও শরীয়ত প্রণেতার উদ্দেশ্যের সাথে সামঞ্জস্য বিধান করা। শরীয়াতের কোন মূলনীতি বা কোন দলীলের সাথে এটা সাংঘর্ষিক হবে না। ২. সত্তাগতভাবে বিষয়টি জ্ঞান-বিবেকসম্মত হওয়া। কোন জ্ঞানী ব্যক্তির সামনে যখন সেটা উপস্থাপিত হবে তখন সাধারণ বিবেক-বুদ্ধি যেন তাকে সমর্থন করে। ৩. তা গ্রহণের ক্ষেত্রে শর্ত হল, এর দ্বারা যেন নিশ্চিত কোন সংকটের অবসান হয় এবং যদি এটা গ্রহণ করা না হয় তবে মানুষের চরম সংকটের সম্মুখীন হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
পঞ্চমত: মাকাসিদ সংক্রান্ত কায়িদার মূলনীতি ও প্রয়োগ আল-আশবাহ ওয়ান নাযায়ের ও অন্যান্য উসূলে ফিকহের গ্রন্থসমূহে মাকাসিদ সংক্রান্ত বিভিন্ন ফিকহী কায়িদা উল্লেখ করা হয়েছে। মাকাসিদের মাধ্যমে সা¤প্রতিক বিষয়ের বিধান নির্ণয়ে আগ্রহী গবেষককে যার প্রতি দৃষ্টি প্রদান করা একান্ত কর্তব্য।
ইসলাম একটি গতিশীল জীবনব্যবস্থা। মানুষের জীবনের নতুন নতুন বিষয়ে ইসলামী বিধান নির্ণয়ের পদ্ধতি তাই এ ব্যবস্থায় বিদ্যমান। মহানবী সা. এর সময়ে মহান আল্লাহর কুরআন অবতীর্ণের মাধ্যমে উদ্ভূত পরিস্থিতির বিধান জানিয়ে দিতেন অথবা রাসূল সা. নিজ ইজতিহাদের মাধ্যমে তার সমাধান করতেন। কোন কোন ক্ষেত্রে তিনি সাহাবীগণের সাথে পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতেন। বর্তমান সময়ে রিসালাতের ধারা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় উপরোক্ত পদ্ধতিগুলোর অবর্তমানে কীভাবে সা¤প্রতিক বিষয়ের ইসলামী বিধান নির্ণয় করা যায়।
উপরোক্ত তথ্য-উপাত্তের মূল্যায়ন করে আমরা নিম্নোক্ত ফলাফল অর্জন করতে পারি- যুগ পরিক্রমায় মানুষের জীবনযাত্রার উন্নয়নে ইসলামের গতিশীলতা স্থবির হয় না। যেসব নতুন নতুন আবিস্কার বা সমস্যার কোন ইসলামী সমাধান নেই তাকে আমরা সা¤প্রতিক বিষয় হিসেবে সংজ্ঞায়িত করতে পারি। ইসলামের গতিশীল প্রমাণ, মুসলমানদের সমস্যা দূরীকরণ, ইজতিহাদের ধারা চলমান রাখাসহ বিভিন্ন কারণে সা¤প্রতিক বিষয়ের ইসলামী বিধান নির্ণয়ের গবেষণা করা প্রয়োজন। সা¤প্রতিক বিষয়ের ইসলামী বিধান নির্ণয়ের ক্ষেত্রে একজন গবেষককে গবেষণার পূর্বে বিষয়টি অনুধাবন ও এ সংশ্লিষ্ট খুঁটিনাটি বিষয় এবং জীবনের সাথে এর ঘনিষ্ঠতা সম্পর্কে ভালভাবে অবগত হতে হবে। এ বিষয়ে গবেষণার সময়ে একটি নির্দিষ্ট নীতিমালা অনুসরণ করতে হবে। শরীআহ অভিযোজন মানুষের নিত্যনতুন সমস্যার সমাধানে এক যুগান্তকারী ভূমিকা রাখতে পারে। কেননা এর মাধ্যমে মানুষের জন্য অকল্যাণকর নয় এমন বিষয়কে বৈধতা দেয়ার প্রয়াস চালানো হয়। আধুনিক সমস্যার সমাধানের সবচেয়ে উত্তম পদ্ধতি শরঈ দলীল। এর মাধ্যমে সমস্যার সমাধান দেয়া হলে অন্য কোন পদ্ধতি অবলম্বন করার প্রয়োজন হয় না। শরঈ দলীলের ভিত্তিতে আধুনিক বিষয়ের সমাধান না হলে দ্বিতীয়ত আমাদেরকে দৃষ্টি দিতে হবে ফিকহী কায়িদার উপর। ফিকহী কায়িদা মূলত শরঈ দলীল থেকে ফিকহবিদগণের গবেষনালব্ধ নীতিমালা, যা প্রত্যেক যুগের আলিমগণ প্রয়োগ করেছেন। শরঈ দলীল ও ফিকহী কায়িদার অবর্তমানে আধুনিক বিষয়ের বিধান নির্ণয়ের জন্য আমাদেরকে মাযহাবের নীতিমালার আশ্রয় নিতে হবে। মাযহাবের ইমামগণের গবেষণালব্ধ বিধানের সাদৃশ্য বিধান সমজাতীয় বিষয়ের উপর প্রয়োগ করা যেতে পারে। সর্বশেষ আমরা মাকাসিদে শরীআহ’র মাধ্যমে বিধান নির্ণয়ের পন্থা অবলম্বন করতে পারি। তবে এক্ষেত্রে অবশ্যই মাকাসিদ সংক্রান্ত খুঁটিনাটি বিষয়ে গবেষকের পূর্ণ দক্ষতা থাকতে হবে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ