Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

গার্মেন্টসে অনেক সুযোগ হাতছাড়া

শিল্পোদ্যোক্তাদের অনৈক্যও বাধা : ক্রেতারা চায় আরো বৈচিত্র্য : সঙ্কটের মাঝেও আছে সম্ভাবনা

প্রকাশের সময় : ২৩ জানুয়ারি, ২০১৬, ১২:০০ এএম

শফিউল আলম : চীন, ভিয়েতনাম, ভারত, কম্বোডিয়া, ইন্দোনেশিয়া এমনকি অধুনা মিয়ানমারের মতো দেশ বাংলাদেশের গার্মেন্টস পণ্যসামগ্রীর প্রতিযোগী হয়ে আছে। দেশের রফতানিমুখী গার্মেন্টস শিল্পখাতে জিইয়ে আছে এবং বাড়ছে হরেক সমস্যা, সীমাবদ্ধতা ও প্রতিবন্ধক। তবে সমস্যা-সংকটের তুলনায় গার্মেন্টস শিল্পের বিকাশে এবং রফতানি বাজার পরিধি বাড়ানোর ক্ষেত্রে অনেক সুযোগ-সম্ভাবনা রয়েছে। সুযোগ থাকলেও সমন্বিত উদ্যোগের অভাবে তা হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে গার্মেন্টস শিল্পপল্লী গড়ে তোলার মতো উপযোগী বিশেষায়িত শিল্প জোনের অভাব রয়েছে। রয়েছে মাঝারি সারির সুদক্ষ ব্যবস্থাপনায় (মিডল ম্যানেজমেন্ট) পর্যাপ্ত দেশীয় লোকবল। অভাব রয়েছে বিশেষায়িত প্রশিক্ষণকেন্দ্রের। তাছাড়া গার্মেন্টস শিল্পোদ্যোক্তাদের নিজেদের অনৈক্যও শিল্পের বিকাশে অন্যতম বাধা। রফতানিমুখী এই গার্মেন্টসের জন্মস্থান চট্টগ্রামে (১৯৭৮ সাল) এই শিল্পখাত জৌলুস হারিয়ে বর্তমান ক্ষয়িষ্ণু বেহালদশাই তার জ্বলন্ত উদাহরণ। তাছাড়া গার্মেন্টস পণ্যের বিদেশী ক্রেতারা সবসময়ই মুখিয়ে থাকে উৎপাদিত পোশাক সামগ্রীর মাঝে আরও বৈচিত্র্য, সময়ের হাত ধরে আরও নজরকাড়া ফ্যাশন। গার্মেন্টস শিল্পখাতের গবেষণা ও উদ্যোক্তাদের সংশ্লিষ্ট সূত্র থেকে এসব কথা জানা যায়।
বিজিএমইএ নেতারাই স্বীকার করেন, নানামুখী সংকটের সাথে সাথে শিল্পোদোক্তাদের মাঝে বিভেদ-অনৈক্যের কারণে গার্মেন্টসের পীঠস্থান চট্টগ্রামেই গার্মেন্টস খাত এখন হুমকির সম্মুখীন। গত এক দশকেরও কম সময়ের মধ্যে চট্টগ্রামে ৭শ’ ১৬টি গার্মেন্টস কারখানার মধ্যে ৩শ’ ১৬টি বন্ধ হয়ে গেছে। একর্ড ও এলায়েন্সের হস্তক্ষেপে অবশিষ্ট ৪শ’টির মধ্যে অনেক কারখানাই বন্ধ হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। চট্টগ্রামে এ শিল্পের জন্য অন্তত ২শ’ একর ভূমির সমন্বয়ে বিশেষায়িত অঞ্চল স্থাপন করা জরুরী প্রয়োজন। তাহলেই বন্ধ হয়ে যাওয়া কারখানাগুলো পুনরুজ্জীবনের মাধ্যমে বার্ষিক ৫০ বিলিয়ন ডলার রফতানি লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা সম্ভব হবে। অবশ্য চট্টগ্রামের গার্মেন্টস শিল্পোদ্যোক্তারা বন্দরনগরীর কালুরঘাটে গার্মেন্টস শিল্পজোন করার লক্ষ্যে গত ৩ জানুয়ারি বিজিএমইএর ব্যানারে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের সঙ্গে একটি ভূমির চুক্তি সম্পাদন করেছেন। যদিও বিজিএমইএ নেতারা মনে করছেন, চট্টগ্রামে গার্মেন্টস শিল্প স্থাপনের স্থান সংকট দূরীভূত করে সঠিক অবস্থানে নিয়ে যেতে হলে এ অঞ্চলে কালুরঘাট ছাড়া আরও ৩/৪টি বিশেষায়িত শিল্পজোন অনতিবিলম্বে গড়ে তোলা অত্যাবশ্যক। প্রধান সমুদ্রবন্দরের অবস্থান ও অন্যান্য অবকাঠামো সুবিধার কারণে চট্টগ্রামে গার্মেন্টস বেশ ক’টি শিল্পজোন গড়ে তোলার আবশ্যকতার দিকটি এখন সামনে চলে এসেছে। জাতীয় অর্থনৈতিক স্বার্থে একে ত্বরান্বিত করতে হবে। বন্দরের দক্ষতাও আরও বাড়ানো প্রয়োজন।  
গ্লোবাল ম্যানেজম্যান্ট কনসালটিং প্রতিষ্ঠান ‘ম্যাককিনসে এন্ড কোম্পানি’র গবেষণা সূত্র বলছে, সমস্যার তুলনায় বাংলাদেশের রফতানিমুখী গার্মেন্টস শিল্পখাতে সোনালী সম্ভাবনার পাল্লা ভারী। বিভিন্ন বাধা-বিপত্তি, সমস্যা ও সীমাবদ্ধতা কার্যকর মোকাবিলা করা সম্ভব হলে দেশের গার্মেন্টস খাত থেকে রফতানি আয় আগামী ৫ বছরে দ্বিগুণ এবং ১০ বছরে তিনগুণ উন্নীত হওয়ার অবারিত সুযোগ রয়েছে। এ খাতে রফতানি আয় আগামী ১০ বছরে ৪২ এমনকি ৫০ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হতে পারে। চীনের পর বাংলাদেশকেই পোশাকের রফতানিকারক উপযুক্ত দেশ হিসেবে উল্লেখ করে বলা হয়েছে, ক্রেতাদের আমদানি উৎসের সোপান এখন চীনমুখী না হয়ে বাংলাদেশ অভিমুখী। ইউরোপ-আমেরিকার বড় বড় ক্রেতারা বাংলাদেশকেই পোশাক সোর্সিংয়ে সর্বোত্তম ঠিকানা হিসেবে বিবেচনা করে। চীন বিভিন্ন কারণে বিদেশী ক্রেতাদের কাছে গ্রহণযোগ্যতা হারাচ্ছে। বাংলাদেশে ইতোমধ্যে ৫ হাজার পোশাক কারখানা প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। সেখানে কর্মরত রয়েছে ৩৬ লাখ পোশাক কর্মী। এর বিপরীতে পোশাকশিল্পের অন্যতম দেশ ইন্দোনেশিয়ায় রয়েছে ২ হাজার ৪৫০টি কারখানা। ভিয়েতনামে ২ হাজার এবং কম্বোডিয়ায় ২৬০টি কারখানা। সবচেয়ে বড় কথা হলো, বাংলাদেশে উৎপাদিত পোশাকের দর অনেক প্রতিযোগিতামূলক এবং বেশ সহজলভ্য।  
অপর গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘নেইলসেন কোম্পানি (বাংলাদেশ) লিমিটেডে’র জরিপ মতে, বাংলাদেশের জাতীয় অর্থনীতির প্রাণ গার্মেন্টস শিল্প তার দুর্দমনীয় যাত্রা অব্যাহত রেখেছে। পোশাকখাতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে দেশের ৪ কোটিরও অধিক লোক নির্ভরশীল। ব্যাংক ও বীমা খাতে এই শিল্পের জোগান ১০৯০ কোটি  টাকা ও  ১৭০ কোটি টাকা। শিপিং খাতে অবদান ১৯৬০ কোটি টাকা। পরিবহন খাতে অবদান ৮৩০ কোটি টাকা। এ শিল্প থেকে স্ট্যাম্প, লাইসেন্স নবায়ন ফি প্রভৃতি বাবদ সরকারের আয় ১৮০ কোটি টাকা। এ শিল্পে প্রত্যক্ষ কর হিসেবে সরকার ৫৫২ কোটি টাকা আয় করেছে। সেবাখাতে পোশাক শিল্পের অবদান ১১০ কোটি টাকা, প্রকৌশল খাতে ৪৩১ কোটি টাকা, বিদ্যুৎ বিল বাবদ ৪৪১ কোটি টাকা, গ্যাস ও ওয়াসা খাতে ১১১ কোটি টাকা, তথ্য-প্রযুক্তি খাতে ২৯৬ কোটি টাকা, আবাসন খাতে ৭৮৫ কোটি টাকা এবং হোটেলস ও পর্যটন খাতে ১৩৯ কোটি টাকা। ফলে গার্মেন্টস শিল্প জাতীয় অর্থনীতির প্রাণপ্রবাহ।  
ম্যাককিনসে রিপোর্টে জানানো হয়, ভিনদেশী ক্রেতারা বাংলাদেশ থেকে আরও অনেক বেশি ফ্যাশন্যবল বা বৈচিত্র্যপূর্ণ এবং জমকালো ধরনের পোশাক কিনতে চায়। এ ক্ষেত্রে পারদর্শী ও সক্ষম হতে হলে বাংলাদেশের পোশাক প্রস্তুতকারকদের দক্ষতা আরও শাণিত হতে হবে। সুদক্ষ শ্রমিক সরবরাহের বিষয়টিও নিশ্চিত থাকা চাই। কারখানাগুলোর উৎপাদনশীলতার উন্নয়ন অপরিহার্য। বাংলাদেশ যদি তার পোশাক শিল্পখাতে প্রবৃদ্ধির সুযোগ-সম্ভাবনাকে ২০২০ সাল নাগাদ ৩ গুণ করতে চায় তাহলে বাংলাদেশের পোশাক প্রস্তুতকারকদের গড় উৎপাদনশীলতা ভারতের সমপর্যায়ে নিয়ে যেতে হবে। ভারতের পোশাক কারখানার উৎপাদনশীলতা রেটিং ৯২, যেখানে বাংলাদেশের ৭৭। ম্যাককিনসের জরিপে গার্মেন্টস খাতের ব্যাপক অর্থনৈতিক সম্ভাবনা কাজে লাগাতে কিছু বাধা অতিক্রমের ব্যাপারে জোর তাগিদ দিয়ে বলা হয়, চ্যালেঞ্জগুলো উত্তীর্ণ হতে পারলে বাংলাদেশের এ শিল্প লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে সক্ষম হবে। এসব বাধা ও চ্যালেঞ্জ হচ্ছে মূলত অবকাঠামো সুযোগ-সুবিধা অতিক্রমের দিক, কম্প­ায়েন্স শর্তাবলী পরিপূরণ, মানব সম্পদের ক্ষেত্রে অধিকতর দক্ষতা, সক্ষমতা অর্জন, কাঁচামাল জোগান সুবিধা সহজীকরণ এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা।  
এতে মানব সম্পদ সম্পর্কে বলা হয়, গার্মেন্টস শিল্পে প্রয়োজন আরও ৩৫ লাখ বেশি সংখ্যক শ্রমিক এবং মাঝারি সারির ব্যবস্থাপনায় দক্ষ মানব সম্পদ। অথচ দেশের গার্মেন্টস শিল্পে এখনই পর্যাপ্ত দক্ষ মানব সম্পদের মারাত্মক ঘাটতি রয়েছে। স্থানীয় মেধার অভাবে গার্মেন্টস প্রতিষ্ঠানগুলোকে বিদেশ থেকে ‘মিডল ম্যানেজমেন্ট’ (মাঝারি সারির ব্যবস্থাপনায় দক্ষ লোক) আমদানি করতে হয়। সাংস্কৃতিক ভিন্নতার কারণে এই বিদেশী মিডল ম্যানেজমেন্ট বিভিন্ন ক্ষেত্রে সমস্যার সৃষ্টি করছে। দেশে টেকনিক্যাল স্কিলের জন্য বিদ্যামান ইনস্টিটিউটের সংখ্যা খুবই অপ্রতুল। শ্রমিকরা স্বল্প শিক্ষিত হওয়ার কারণে দেশের পোশাক কারখানাগুলোর দক্ষতার হার অনেক কম। ২০২০ সালের মধ্যে পোশাক রফতানি আয়ে প্রবৃদ্ধির জন্য এই শিল্পে ৬০ লাখেরও বেশি শ্রমিক প্রয়োজন হবে। বাংলাদেশের পোশাক কারখানাগুলোর বেশিরভাগই ঢাকা, চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ ও ঢাকা আশপাশে অবস্থিত। শ্রমিক স্বল্পতা নিরসনকল্পে এ শিল্পের ভৌগোলিক বিস্তার প্রয়োজন।



 

Show all comments
  • MD:ALL-YOUSUF ৩০ ডিসেম্বর, ২০১৬, ৯:০২ এএম says : 0
    আমি গার্মেন্টসে কাজ করতে চাই ।
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: গার্মেন্টসে অনেক সুযোগ হাতছাড়া
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ