Inqilab Logo

শনিবার ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৬ আশ্বিন ১৪৩১, ১৭ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬ হিজরী

অনেক প্রাপ্তিতেও হতাশার ছাপ

কাউন্সিল নিয়ে বিএনপি নেতা-কর্মীদের বিশ্লেষণ

প্রকাশের সময় : ২১ মার্চ, ২০১৬, ১২:০০ এএম

আফজাল বারী : ছয় বছর পর অনুষ্ঠিত হলো বিপর্যস্ত বিএনপির ষষ্ঠ কাউন্সিল। সফল কাউন্সিলের জন্য সংশ্লিষ্ট সবাইকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া। এবারের কাউন্সিলে বাস্তবতার আলোকে সাংগঠনিক কাঠামো শক্তিশালী করতে গঠনতন্ত্রেও ব্যাপক পরিবর্তন এনেছেন। ক্ষমতা প্রাপ্ত হলে রাষ্ট্রকাঠামো এবং সরকার পরিচালনার ধরন কেমন হবে- তিনবার রাষ্ট্র পরিচালনার লব্ধ অভিজ্ঞতা থেকে সে ভিশন-২০৩০ ঘোষণা করেছেন বেগম খালেদা জিয়া। এই কাউন্সিলে অর্জন কী, প্রত্যাশা কেমন ছিলো প্রাপ্তিই বা কতোটুকু-তার চুলচেরা বিচার-বিশ্লেষণ করছেন বিএনপি নেতাকর্মীরা। কেন্দ্র থেকে তৃণমূলের নেতাকর্মীরা ইনকিলাবের সাথে তাদের বিশ্লেষণের চিত্র তুলে ধরেছেন। বলেছেন, পরিবর্তনের এই কাউন্সিলে তাদের প্রাপ্তি অনেক কিন্তু তাতে ছাপ পড়েছে হতাশারও।
বিধ্বস্ত অবস্থার মধ্যে ব্যাপক শো-ডাউন করে কাউন্সিল সম্পন্ন করায় বিএনপিতে যেমন চাঙ্গাভাব আছে তেমনি দীর্ঘদিনের মহাসচিবের শূন্য পদে নতুন নামের ঘোষণা না আসায় হাতাশাও আছে। কাউন্সিলে পূর্ণ কমিটির ঘোষণা না দিলেও অন্তত মহাসচিবের নাম ঘোষণা করা হবে এমনই ভেবেছিল দলের নেতাকর্মীরা। এই পদে ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের নাম ঘোষণা করতে কাউন্সিলে এসেছিল অনেক সুপারিশও। কিন্তু দলের প্রভাবশালী মহলে মহাসচিব নির্ধারণ নিয়ে মতানৈক্য দেখা দেয়ায় এই পদে নাম ঘোষণা করতে আরো বিলম্ব হবে বলে জানা গেছে। ইনকিলাবের সাথে আলাপকালে কাউন্সিলর ছাড়াও তৃণমূল নেতাকর্মীদের প্রশ্ন এই ভারমুক্তি আর কতো কাল?
কাউন্সিলের পরদিন রোববার দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীরা জানান, শোডাউনের দিক থেকে প্রত্যাশার চেয়ে বেশী অর্জন থাকায় কাউন্সিল নিয়ে তারা সন্তুষ্ট। তাদের মতে, হামলা-মামলা নির্যাতনের কারণে সারাদেশে বিএনপির সাংগঠনিক অবস্থা একেবারে ভেঙ্গে পড়েছে। এরপরেও ১০দিন আগেও কাউন্সিল হবে কিনা এমন অনিশ্চয়তা থাকা সত্ত্বেও দেশব্যাপী এই কাউন্সিলে ব্যাপক সাড়া পড়েছে। লাখ লাখ নেতাকর্মী যোগ দেওয়ার মাধ্যমে ঘুরে দাঁড়ানোর আভাসও দিয়েছে। তবে তাদের হতাশা হচ্ছে, বিলম্ব। পুরোপুরি ঘুরে দাঁড়াতে নেতা নির্বাচনে বিলম্ব করা আর মেনে নিতে পারছেন না তারা। বিশেষ করে মহাসচিব পদে নাম ঘোষণা আরো বিলম্ব করা আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত বলেও মন্তব্য তাদের।
শনিবার কাউন্সিল শেষে ইঞ্জিনিয়ার ইনস্টিটিউটশন চত্বর থেকে থেকে বের হয়ে কাউন্সিলর শাহ নেওয়াজ আলী ইনকিলাবকে জানান, সময়ের কাজ সময়ে না করার কারণে বিএনপিকে এরই মধ্যে অনেক খেসারত দিতে হয়েছে। আন্দোলনের বন্ধ ও শুরু করার সিদ্ধান্ত সময়োচিত ছিলোনা। সঙ্গত কারণে তা ব্যর্থ হয়েছে। এখন কাউন্সিলের মাধ্যমে ঘুরে দাঁড়ানোর যে আভাস পাওয়া গেছে, এই পর্যায়ে মহাসচিব নির্ধারণ করা ছিল সময়ের দাবি। কিন্তু তা হয়নি। তবে আর দেরি করাও ঠিক হবেনা বলেও মনে করেন এই কাউন্সিলর।
কাউন্সিলের দ্বিতীয় পর্বে শীর্ষ নেতার উপস্থিতিতে ‘রুদ্ধদ্বার’ আলোচনায় ১৪ জন কাউন্সিলর বক্তব্য রাখেন। সকল বক্তরাই চেয়ারপার্সন ও সিনিয়র ভাইস-চেয়ারম্যান হিসেবে বেগম খালেদা জিয়ার ও তারেক রহমান পুন:নির্বাচত হওয়ায় ধন্যবাদ জানান। একই সঙ্গে করেছেন দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে ভারমুক্ত করার।
অধিবেশনে ঠাকুরগাঁও জেলা বিএনপিসাধারণ সম্পাদক তৈমুর রহমান বলেন, দলে এতো সিদ্ধান্তহীনতা কেন। ভারপ্রাপ্ত নিয়ে আর কতোদিন টানবো। যোগ্যতা থাকলে মির্জা ফখরুলকে মহাসচিব করুন। নইলে অন্য কাউকে মহাসচিব নিয়োগ দেন।

বিএনপির সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক ও খুলনা মাহনগর বিএনপির সভাপতি নজরুল ইসলাম মঞ্জু কাউন্সিল প্রসঙ্গে গতকাল ইনকিলাবকে বলেন, বিএনপি চেয়ারপার্সনের বক্তব্যে দেশ, জাতি, সাধারণ জনগণ এবং দলীয় নেতাকর্মীদের জন্য অনেক সুখবর আছে। অনুপস্থিত সুশাসন, গণতন্ত্র, অপ্রতিরোধ্য গতির দুর্নীতির বিষয়ে বিএনপি কী করতে চায় তা উল্লেখ করেছেন। রাষ্ট্রীয় কাঠামো পরিবর্তন, প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা বন্টনসহ সরকার গঠন করলে কীভাবে তা পরিচালনা করতে চান সে অঙ্গীকার ও প্রত্যাশার কথা বলেছেন বেগম খালেদা জিয়া। অপরদিকে দলে সৎ যোগ্য এবং রাজনীতির পরীক্ষায় উত্তীর্ণ নেতার সমন্বয়ে নেতৃত্ব গঠন করবেন। যোগ্য নেতৃত্ব দিয়ে আগামীর আন্দোলন পরিচালিত হবে জনগণের অধিকার ফিরিয়ে আনা হবে। তাই প্রাপ্তির পাল্লা অবশ্যই ভারী।
সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক (চট্টগ্রাম) লায়ন আসলাম চৌধুরী কাউন্সিলের অর্জন সম্পর্কে বলেন, তৃণমূল নেতাকর্মী এসেছে, অবশ্যই আমরা উজ্জীবিত। দীর্ঘদিন নেতাকর্মীরা বিচ্ছিন্ন থাকার কারণে হয়তো অনেইে মনে করেছে দল হিসেবে বিএনপি ধ্বংস হয়ে গেছে। কিন্তু কাউন্সিলে দেখা গেছে বিএনপি এখনো সংগঠন অনেক শক্তিশালীই আছে। প্রত্যাশা পূরণ হয়রি বলতে গেলে মহাসচিবের ঘোষণাটি আসলে তৃণমূল নেতাকর্মীরা হয়তো আরো বেশি খুশি হতো। তবে নেত্রী বলেছেন, আরো বৃহত্তর পরিসরে দলকে সংগঠিত করে কমিটি দেয়া হবে তাতে আমরা আশান্বিত হয়েছি।
বিএনপির বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক সম্পাদক আ ন হ আক্তার হোসেন ইনকিলাবকে বলেন, একটি সফল কাউন্সিল। দীর্ঘদিন ধরে কাউন্সিল হয়না। নেত্রী তার বক্তব্যে বিএনপির একটি নতুন নির্দেশনা দিয়েছেন, বিএনপি ভবিষ্যতে ক্ষমতায় গেলে সরকার গঠন ও কীভাবে পরিচালনা করা হবে,ক্ষমতা বন্টন, স্থানীয় সরকার পরিচালনাসহ বেশ কিছুর দিক নির্দেশনা রয়েছে। দলীয় গঠনতন্ত্রেও নতুনত্ব আছে। এক নেতার এক পদ বিধান করায় অনেক নেতার স্থান হবে তাতে সংগঠন আরো শক্তিশালী হবে বলে তিনি মনে করেন।
যুবদলের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক গোলাম রব্বানী ইনকিলাবকে বলেন, কাউন্সিলের মাধ্যমে নিঃসন্দেহে বিএনপি তার সাংগঠনিক ভীত ও ঐক্যের বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে নেতাকর্মীরা পরস্পরের সঙ্গে মত বিনিময় করতে পারছিলো না, কাউন্সিলে তৃণমূলের সমস্যার কথা নেত্রীর কাছে তুলে ধরেছেন। নেত্রীও আমলে নিয়েছে। একদিকে সমালোচকরা দেখতে পেয়েছে বিএনপি কবরস্থ হয়নি। এখনো হাজার হাজার নেতা আছে। অন্যদিকে হতাশাগ্রস্ত নেতারাও কর্মীদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ দেখে প্রাণশক্তি পেয়েছে।
তিনি বলেন, জঙ্গি, দুর্নীতিসহ সুশাসন প্রসঙ্গ নিয়ে সমালোচনকরা দেশ-বিদেশে বিএনপির বিরুদ্ধে প্রপাগান্ডা করে আসছিলো। কাউন্সিলে বেগম খালেদা জিয়া সে অবস্থানের গ্রহণযোগ্য ব্যখ্যা দিয়েছেন। দলের ভিশন কী তা স্পষ্ট করেছেন। এক নেতার এক পদ বাস্তবায়নের ফলে দলে অনেক যোগ্য নেতার স্থান হবে। সংগঠন প্রভাবমুক্ত হবে। আমরা মনে করি দীর্ঘ দিনে মির্জা ফখরুল ইসলাম দলের সকল দিক থেকে অভিজ্ঞতা নিয়েছে। কাউন্সিলে তাকে ভারমুক্তির ঘোষণা এলে ষোলকলা পূর্ণ হতো।
জিয়া পরিষদ সভাপতি ও মাগুরা বিএনপির সভাপতি কবির মুরাদ ইনকিলাবকে বলেন, অপ্রতিরোধ্য নির্যাতন-নিপীড়নে বিএনপি বিপর্যস্ত হয়েছিলো তা অস্বীকার করার উপায় নেই। কাউন্সিলের মাধ্যমে নেতাকর্মীরা আবার শাণিত হলো। দীর্ঘদিনের হতাশা কেটে গেলো এই কাউন্সিলেই।
তিনি জানান, ইনডোর মিটিংয়ে অনেকেই দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিবকে ভারমুক্ত করাসহ দ্রুত কমিটি ঘোষণা দেবার দাবি তোলেছেন। একই সাথে কেউ কেউ বলেছেন, দলের ১/১১-এর বেঈমান আছে, গত আন্দোলনের বেঈমান আছেন এখনো তারা সক্রিয় তাই সময় নিয়ে সলিড নেতাদের দিয়ে কমিটি দেয়ার জন্য চেয়ারপার্সনকে সর্বময় ক্ষমতা দেয়া হয়েছে।
ছাত্রদলের সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক সঞ্জয় দে রিপন কাউন্সিলের মূল্যায়ন করে বলেন, দেশ-বিদেশে প্রপাগান্ডা ছিলো বিএনপি সাংগঠনিকভাবে দুর্বল হয়ে গেছে, কাঠামো ভেঙ্গে পড়েছে। বাস্তবতা হলো কাউন্সিলের জন্য ঢাকায় যারা এসেছিলেন তারা সবাই নেতা। প্রতিজনে হাজার নেতাকর্মীর অভিভাবক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। এই অসংখ্যা নেতৃত্বের মিলনমেলায় প্রমাণিত হয়েছে বিএনপি সাংগঠনিকভাবে অনেক শক্তিশালী ছিলো আছে। ভবিষ্যতে গঠিত নেতৃত্ব দিয়ে গণদাবির আন্দোলনসহ সরকার পতনের আন্দোলনে সফল হওয়া সম্ভব।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে মহাসচিব করার সিদ্ধান্ত প্রায় চূড়ান্তই ছিল। দলের চেয়ারপার্সন এবং সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যানের গ্রীন সিগনালও ছিল তার পক্ষে। কিন্তু সম্পতি দলের একটি প্রভাবশালী একটি অংশ মির্জা আলমগীরের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছে। আর এই অংশের নেতৃত্বে আছেন দলের স্থায়ী কমিটি দুই নেতা। তারা বিভিন্ন যুক্তি দেখিয়ে মির্জা আলমগীরের নাম ঘোষণা থেকে হ্ইাকমান্ডকে এখন পর্যন্ত বিরত রেখেছেন। এছাড়া কাউন্সিল প্রস্তুতিতে সুকৌশলে এই অংশটি মির্জা আলমগীরকে খুব বেশী সক্রিয় হতে দেয়নি।



 

Show all comments
  • বিপ্লব ২১ মার্চ, ২০১৬, ১১:৫৮ এএম says : 0
    দ্রুত তাকে ভারমুক্ত করা হোক।
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: অনেক প্রাপ্তিতেও হতাশার ছাপ
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ