পটুয়াখালীর যুবক ক্বারী সাইয়্যেদ মুসতানজিদ বিল্লাহ রব্বানীর কোরআন তেলাওয়াতে মুগ্ধ যুক্তরাষ্ট্রবাসী
ইসলামি সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিকাশে বাংলাদেশের অবদান অনস্বীকার্য। এদেশে ইসলামি সংস্কৃতি চর্চার ইতিহাস অনেক প্রাচীন।
প্রকৃতির বিচিত্র খেয়ালের এক অনিঃশেষ ও দুর্ভাগ্যের শিকারের নাম ‘হিজড়া’।
শারীরিক এবং মানসিকভাবে সুস্থ একদল মানুষ। তারপরেও তাদেরকে জীবনধারণের জন্য হাত পাততে হয় অন্যের কাছে। নতুবা উৎসবে নাচগান করে বেঁচে থাকার লড়াইটা চালিয়ে যেতে হয়। কারণ, সমাজের কেউই তাদেরকে কাজ দেন না। জন্মদোষ একটাই, তারা হিজড়া। সমাজের নানামুখী নেতিবাচক মনোভাবে অবহেলিত ও বঞ্চিত এই জনগোষ্ঠী। সমাজের পিছিয়ে পড়া শুরু পারিবারিকভাবেই লাঞ্ছিত হওয়ার মধ্যে দিয়ে। হিজড়াদের স্কুল, কলেজসহ সমাজের কোন ক্ষেত্রেই আশানুরূপ সম্মান জোটে না। প্রতি পদে পদেই অবহেলা। আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, অনেক বাবা-মা রয়েছেন যারা অন্য ছেলেমেয়েদের সাথে স্বাভাবিক আচরণ করলেও হিজড়া সন্তানদের সাথে করেন না। ভাই-বোনদের নানা রকম সমালোচনার মুখে চরম দুঃখে, কষ্টে তারা একদিন ঘর ছেড়ে পা বাড়ায় অজানার উদ্দেশ্যে। শুরু তার জীবন সংগ্রাম। ঘাটে ঘাটে লাঞ্ছনা, অপমান আর নির্যাতন সহ্য করতে করতে একদিন বিদ্রোহী হয়ে ওঠে। যোগ দেন হিজড়া সম্প্রদায়ের সাথে। জীবন বাঁচানোর তাগিদে দোকানে-দোকানে চাঁদা তুলে, নাচ-গান করে ও বিকৃত যৌনাচারে লিপ্ত হয়ে অর্থ উপার্জন করেন।
সমাজ বিজ্ঞানীদের ভাষায়, হিজড়ার শাব্দিক অর্থ একজন অক্ষম ক্লীব, নপুংসক বা ধ্বজভঙ্গ। বাংলাদেশ তথা বিভিন্ন দেশের হিজড়াদের মতে তারা জন্মগতভাবেই একাধারে স্ত্রী ও পুংলিঙ্গ সংবলিত (বা উভয় লিঙ্গ) প্রাণী। তবে প্রতিটি লিঙ্গেই অস্পষ্ট ও অনির্দিষ্ট। এদের ভেতর কেউ কেউ অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে স্ত্রী অথবা পুরুষ রূপে আত্মপ্রকাশ করে। এভাবে আমাদের দেশের অনেকেই স্ত্রী অথবা পুরুষ লিঙ্গ ধারণ করে বসবাস করছে। সমাজ ব্যবস্থায় এই অবহেলিত শ্রেণিটিকে ‘হিজড়া’ বলে ডাকা হয়। হিজড়াদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, হিজড়া শব্দকে তারা অভিশাপ বা গালি হিসেবে মনে করেন। আসলে তারা হচ্ছেন, ট্রান্সজেন্ডার (তৃতীয় লিঙ্গ)। প্রকৃতির নিয়তিতেই এরা স্বাভাবিক মানুষের পরিবর্তে হিজড়ায় রূপান্তরিত হয়। ঠিক যেমনটি ঘটে থাকে একজন প্রতিবন্ধীর ক্ষেত্রে। প্রতিবন্ধীদের জন্য ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তুলতে এবং তাদেরকে সমাজের মূলস্রোতের অন্তর্ভুক্ত করতে নানারকম সরকারি-বেসরকারি আন্দোলন ও পদক্ষেপ গ্রহণ করা হলেও হিজড়াদের কল্যাণে এরকম কোনো কর্মসূচি নেই বললেই চলে। সমাজ থেকে একপ্রকার নির্বাসিত এই শ্রেণিটি তাই বিকৃত মানসিকতা নিয়ে গড়ে ওঠে। পেটের তাগিদে জড়িয়ে পড়ে নানারকম অপরাধমূলক কার্যক্রমে। অথচ মানুষ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে এসব হিজড়াদের সামাজিক অধিকারগুলো নিশ্চিত করতে পারলে তারাও সমাজে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারতো।
জানা গেছে, পৃথিবীতে দুই ধরনের হিজড়া রয়েছে। পুরুষের মতো শারীরিক গঠন আর মানসিকভাবে নারীর স্বভাব, তাদেরকে অকুয়া বলা হয়। এছাড়া, অন্য প্রকৃতির যারা তাদেরকে জেনেনা বলা হয়। অকুয়া ও জেনেনা জাতীয় হিজড়া প্রকৃতির সৃষ্টি। এছাড়া মানুষের হাতে সৃষ্ট বা ক্যাসট্রেটেড পুরুষদের বলা হয় চিন্নি।
রাজধানী ঢাকার একাধিক হিজড়াদের ডেরায় (বাসস্থান) আলাপচারিতায় হিজড়াদের নানা কষ্টের কথা উঠে আসে। দুঃখে কষ্টে অনেক সময়েই বলে থাকেন-‘কোথা কবে রই ঘর জন ছেড়ে ঘুরি পথ পানে। খুঁজে ফিরি ধুঁকে ধুঁকে জীবনের মানে। তোমাদের মত আমরা যদিও নই, তবুও মানুষ।’
মৌসুমী নামে এক হিজড়া জানান, ছোট বেলায় আমার বাবা-মা আমাকে ছেলেদের মতো করে বড় করতে থাকে। কিন্তু আমি সব সময় ছেলেদেরকে এড়িয়ে চলতাম। মেয়েদের সাথেই মিশতে পছন্দ করতাম। একটু বড় হওয়ার পর বুঝতে পারলাম আমি অন্যান্য ছেলেমেয়েদের থেকে আলাদা। আমি হিজড়া। ব্যাপারটি বুঝতে পেরে বাবা-মা, ভাই বোন আমাকে এড়িয়ে চলতে শুরু করলো। পরবর্তীতে বাধ্য হয়েই পরিবার ত্যাগ করলাম। যোগ দিলাম হিজড়া সম্প্রদায়ের সাথে। মৌসুমী জানান, জীবন বাঁচানোর তাগিদে বাধ্য হয়ে এমন কোন খারাপ কাজ নেই করিনি। তবে আমার এগুলো করতে ভালো লাগে না। সরকার যদি ট্রাফিক পুলিশসহ দেশের যেকোন সেক্টরে কাজে লাগায় তবে আনন্দের সাথে করবো। এমনটাই জানালেন সবিতা, নীলিমা এবং শিরিনরা।
বিশেষজ্ঞদের মতে, হিজড়াদের ‘তৃতীয় লিঙ্গ’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। পাশাপাশি তাদের প্রয়োজন নাগরিক অধিকার সুনিশ্চিত করা। তাহলেই এ জনগোষ্ঠী বোঝা নয় সম্পদে রূপান্তরিত হবে। একই সঙ্গে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রে হিজড়া জনগোষ্ঠীকে নিয়ে যে নেতিবাচক মনোভাব, তার পরিবর্তন ঘটাও জরুরি বলে মনে করেন তারা। তাদের মতে, হিজড়াদের চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করতে হলে সবার আগে প্রয়োজন দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন। এছাড়া সরকারি উদ্যোগে তাদের জন্য বিশেষায়িত হাসপাতাল নির্মাণ দরকার বলে মনে করেন তারা। সমাজ বিশ্লেষকদের মতে, সরকারি স্বীকৃতি আর বাড়তি সুবিধার পাশাপাশি সামাজিকভাবে হিজড়াদের গ্রহণের মানসিকতা গড়ে ওঠা প্রয়োজন।
জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক বলেন, সংবিধান অনুযায়ী দেশের সব মানুষ সমান। তবে বাস্তবতা প্রতিবন্ধকতামূলক। ব্যাপক প্রচারণা চালিয়ে হিজড়াদের সম্পর্কে মানুষের মধ্যে যে ভুল ধারণা, তা দূর করতে হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক প্রফেসর মেহতাব খানম বলেন, হিজড়া জনগোষ্ঠীর মনোজগৎ সম্পর্কে সাধারণ মানুষের স্পষ্ট ধারণা নেই। পরিবারে বাবা-মাসহ অন্যরা এদের মানসিক নির্যাতন করছেন। তাই আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টানো জরুরি। পাশাপাশি একজন মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকার অধিকার তার আছে এবং তাকে সেটা দিতে হবে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক (এইডস, এসটিডি প্রোগ্রাম) তড়িৎ কুমার সাহা বলেন, হিজড়া জনগোষ্ঠীর সেবা পেতে যে ভোগান্তি, তার মূলে আছে এই জনগোষ্ঠী সম্পর্কে হাসপাতালসহ বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মরতদের অজ্ঞতা ও গোঁড়ামি। এই জনগোষ্ঠীও যে মানুষ এবং অন্যান্যদের মতো তাদেরও সবকিছু পাওয়ার অধিকার রয়েছে সে বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধিতে গুরুত্বারোপ করেন তিনি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক চিকিৎসক ইনকিলাবকে বলেন, হিজড়া জনগোষ্ঠীকে সমাজের মূল স্রোতধারায় সম্পৃক্ত হতে হলে রাষ্ট্রীয় আইনকানুন পরিবর্তনের পাশাপাশি তাদের নিজেদেরও মন মানসিকতার পরিবর্তন ঘটাতে হবে। হিজড়া জনগোষ্ঠীকে তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার বিষয়টিকে ফ্লাইওভারের সঙ্গে তুলনা করে তিনি বলেন, ফ্লাইওভার তৈরি হয়েছে, কিন্তু সংযুক্ত সড়কগুলো তৈরি না হওয়ায় তা কোনো কাজে লাগছে না। চিকিৎসা কারিকুলামে হিজড়া জনগোষ্ঠীর অধিকারের বিষয়টি সম্পৃক্ত করার সুপারিশ করেন তিনি।
দেশের হিজড়া জনগোষ্ঠীর জন্য কোনও কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা নেই। সমাজে তারা অবহেলিত। এ কারণেই তারা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছে বলে দাবি করেন উত্তরা এলাকার হিজড়া জনগোষ্ঠী প্রধান আপন। তার দাবি, সমাজে হিজড়াদের জন্য কাজের সুযোগ তৈরি করতে পারলে তারা স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যাবে।
শিক্ষাবিদ ও গবেষক শামসুদ্দীন শিশির বলেছেন, হিজড়াদের প্রতি মানবিক আচরণ করতে পরিবার ও সমাজের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন জরুরী। হিজড়াদের পরিবারের সদস্যদের কাছে, সমাজের কাছে তিনি অনুরোধ জানানÑ এদের অবহেলা, অনাদরে বাসা থেকে, সমাজ থেকে বের করে দেবেন না। এরা আমাদের সন্তান, সমাজের সন্তান। এদের সাথে ভাল ব্যবহার করুন। পাশাপাশি একটি সুন্দর সমাজ গড়ে তুলতে সমাজের মূলস্রোতে ফিরিয়ে আনার আহ্বান জানান তিনি।
ইসলামী চিন্তাবিদদের মতে, সমাজে হিজড়াদের নিয়ে নানা অবহেলা ও কটূক্তি করা হলেও হিজড়া সম্প্রদায়ও আল্লাহতায়ালার সৃষ্টি। তারাও আশরাফুল মাখলুকাত তথা সৃষ্টির সেরা জীব। প্রতিবন্ধী মানুষের যেমন শারীরিক ত্রুটি থাকে, এটি তেমন একটি ত্রুটি। তবে এ ত্রুটির কারণে তাদের মনুষ্য সমাজ থেকে বের করে দেওয়া যাবে না। তাদের প্রতি ঘৃণা নয়- ভালোবাসা ও স্নেহ দরকার। তাদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করা, খারাপ মন্তব্য করা মারাত্মক গোনাহের কাজ। এমনিতেই যেকোনো মুসলমানকে গালি দেওয়া পাপ- তেমনি তাদেরও গালি দেওয়া পাপ। কোনো মুসলমানকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা যেমন পাপ- তাদেরকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা এর চেয়ে কম পাপ নয় বরং আরও বেশি পাপ। কারণ তাদের এ দুর্বলতার কারণে তাদের ঠাট্টা করার মানে হলো- আল্লাহতায়ালার সৃষ্টিকে ঠাট্টা করা।
হিজড়াদের নিয়ে কাজ করা সংগঠন বন্ধু সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার সোসাইটি (বিএসডব্লিউএস)’র পিআর ও কমিউনিকেশন স্পেশালিস্ট রুহুল আমিন রবিন বলেন, আমরা হিজড়াদের জীবনমান উন্নয়নে কাজ করে করে যাচ্ছি। তিনি দেশের আপামর জনসাধারণকে হিজড়াদের পাশে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান। তবে সর্বপ্রথম সরকারকেই তাদের জীবনমান উন্নয়নে এগিয়ে আসতে হবে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
সমাজবিজ্ঞানী প্রফেসর জিনাত হুদা ওয়াহিদ বলেন, তারা যদি নিজেদের মেধা, মনন ও যোগ্যতায় সমাজের মূলধারায় মিশে যেতে পারেন, মানবতার জায়গাটিতে একটি বড় পরিবর্তন আসবে।
সমাজসেবা অধিদফতরের মহাপরিচালক গাজী মোহাম্মদ নুরুল কবির বলেন, কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা তৈরি হলেই, ক্ষমতায়নের জায়গাটিও তৈরি হবে। ক্ষমতায়ন নিশ্চিত হলেই তারা সমাজের মূলধারার সঙ্গে মিশে যেতে পারবেন।
ট্রাফিক পুলিশসহ অন্যান্য সরকারি চাকরিতে হিজড়াদের নিয়োগের ঘোষণা এসেছে সরকারের পক্ষ থেকে। এখনো তা কাগজে-কলমে সীমাবদ্ধ। যদিও এ ধরনের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন হলে হয়তো, রাতারাতি কোন পরিবর্তন আনবে না। তবে ধীরে ধীরে সমাজে পরিবর্তন আসবে বলে মনে করেন সমাজবিজ্ঞানীরা।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।