Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

বার্মা-আরাকানে প্রাথমিক যুগেই ইসলামের আলো পৌঁছে যায়

কে. এস. সিদ্দিকী | প্রকাশের সময় : ১৭ নভেম্বর, ২০১৭, ১২:০০ এএম

সত্য উদ্ভাসিত হয়েছে। মিয়ানমারের অংসান সুচির সরকার ও বৌদ্ধ সামরিক বাহিনীর মিথ্যাচার আর্ন্তজাতিকভাবে অকাট্যরূপে প্রমাণিত হয়েছে। প্রভাবশালী মিডিয়া বিবিসি বাংলার অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে সত্য ও বাস্তব তথ্য প্রচারের মাধ্যমে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষের ভিত্তিহীন দাবি খÐন করা হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে, অংসান সুচি এবং মিয়ানমারের বৌদ্ধরা দাবি করছেন যে, রোহিঙ্গা মুসলিমরা আরাকানের নাগরিক নয় তারা বাঙালি। অথচ, ইতিহাস তা বলে না। ইতিহাসে দেখা যায়, মুসলমানরাই এক সময় মিয়ানমার শাসন করেছেন, ওই দেশ বিনির্মাণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। ১১ নভেম্বর বিবিসি প্রচারিত প্রতিবেদনটির বরাত দিয়ে দৈনিক ইনকিলাব ১২ নভেম্বর রিপোর্টটি প্রকাশ করে।
রিপোর্টের শিরোনাম ছিল, ‘বিবিসির প্রতিবেদনে মোগল স¤্রাট জাফরের কবর আবিষ্কার: মিয়ানমার বিনির্মাণে রোহিঙ্গাদের অবদান’। বিগত আড়াই মাস দৈনিক ইনকিলাব মিয়ানমার কর্তৃক রোহিঙ্গা নিধন, উচ্ছেদ, বিতাড়নের বিষয়ে নানা পর্যায়ে অজস্র লেখা প্রকাশ অব্যাহত রাখলেও বিবিসির আলোচ্য প্রতিবেদনটি আন্তর্জাতিকভাবে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ এবং মিয়ানমারের বৌদ্ধ শাসকদের মিথ্যাচারের উপযুক্ত জবাব। প্রতিবেদনে যেসব ঐতিহাসিক তথ্যের অবতারণা করা হয়েছে তার কোনটি সুচি ও বৌদ্ধরা অস্বীকার করবেন? রোহিঙ্গারা সাবেক আরাকানের বৈধ নাগরিক, ওদের এ নাগরিকত্ব অবৈধভাবে হরণ, নিধন, হত্যা এবং উচ্ছেদ অভিযানের মাধ্যমে বাংলাদেশের দিকে ঠেলে দিয়ে এখানে মানবিক সমস্যা তৈরি করাও আন্তর্জাতিক অপরাধ। এবারের রোহিঙ্গা উচ্ছেদ অভিযানসহ বিগত কয়েক দশকে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ আরো বিভিন্ন উচ্ছেদ-বিতাড়ন অভিযান চালিয়ে লাখ লাখ রোহিঙ্গা মুসলমানকে বাংলাদেশের দিকে ঠেলে দিয়েছে। তাদেরকে ফেরত নেয়ার প্রতিশ্রæতি দিয়েও বারবার অঙ্গীকার ভঙ্গ করেছে। একটি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রবেশকারী বর্তমান ও সাবেক রোহিঙ্গাদের সংখ্যা ১২ লক্ষাধিক। বাংলাদেশ মানবিক কারণে এ বিশাল সংখ্যক রোহিঙ্গার আশ্রয় দিয়ে বিরাট বোঝা মাথায় নিয়েছে এবং আন্তর্জাতিকভাবে প্রশংসা লাভ করেছে। ভাসানচরে তাদেরকে পুনর্বাসিত করার ঘোষণাও প্রচার করা হয়েছে। ভাসানচরের আশেপাশের জনপদসমূহ সেখানে আশ্রিত এ বিশাল গোষ্ঠীর প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হবে না তা নিশ্চিত করে বলা কঠিন। ওখানে আইনশৃংখলা পরিস্থিতির অবনতির ঘটবে না এবং নানা রকমের প্রতিকূলতা দেখা দেবে না, তাও নিশ্চিত করে বলা যাবে না। অতএব, মিয়ানমার কর্তৃপক্ষের ওপর চাপ সৃষ্টির জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে দ্রæত কার্যকার পদক্ষেপ নিতে হবে। যাতে মিয়ানমারের শাসকরা তাদের নাগরিক রোহিঙ্গাদের দেশে ফিরিয়ে নিতে বাধ্য হয়। তা নাহলে ভাসানচরই তাদের স্থায়ী আবাসভূমিতে পরিণত হয়ে যাবে, যা হতে দেয়া যাবে না। বিষয়টির ঐতিহাসিক বিভিন্নদিক রয়েছে যা নি¤œরূপ:
রাসূলুল্লাহ (স.) এর ওফাতের ৮ বছরের মধ্যেই অর্থাৎ সপ্তম ও অষ্টম শতকে আবরদের ব্যবসা-বাণিজ্য, ইসলাম প্রচার এবং বিজয়ের এক বিরাট ধারা চালু হয়ে যায়। মালয় ও পূর্ব ভারতীয় দ্বীপমালার মসলাজাত দ্রব্যাদির ব্যবসা তাদের অধিকারে আসে এবং আরব নাবিকরা পূর্ব-পশ্চিম সমুদ্রগুলির যেন মালিক হয়ে যায়। আরবরা ভারতবর্ষে প্রথম ইসলামী রাষ্ট্র গঠন করেন ৭১১ খ্রিস্টাব্দে। সেনাপতি মোহাম্মদ ইবনে কাশেম আরব ব্যবসায়ীদের হেনস্থার প্রতিশোধ গ্রহণের উদ্দেশ্যে সিন্দুতে অভিযান পরিচালনা করেন এবং সিন্ধু রাজ দাহিরকে হত্যা করে সিন্ধু জয় করেন। অতঃপর রাজপুত হিন্দু রাজাদের অনুগত করেন। ভারত মহাসাগরের তীরবর্তী এলাকাসমূহে আরব ব্যবসায়ীরা স্থানে স্থানে বসতি স্থাপন করে এবং ৭৮৮ খ্রিস্টাব্দে তারা আরাকানে গিয়ে বসবাস গড়ে তোলে।
বাগদাদের খেলাফত আমলে আরবদের ব্যবসার প্রসার ঘটে। আরবরা পারস্য উপসাগর, মিসর, মাদাগাস্কার, জাঞ্জিবার, ভারতবর্ষ, বার্মা, লংকা, মালদ্বীপ, লক্ষাদ্বীপ, স›দ্বীপ, মালয় এবং চীন প্রভৃতি দেশ ও অঞ্চলে তাদের ব্যবসায়িক কেন্দ্র স্থাপন করে এবং এই সুবাদে তারা নানা স্থানে গিয়ে বসবাস করতে থাকে। ১২০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত আবরদের ব্যবসা বাণিজ্য উন্নতির দিকে থাকলে খ্রিস্টান ও মুসলমানদের মধ্যে বায়তুল মোকাদ্দাস (জেরুজালেম)-কে কেন্দ্র করে ক্রুসেড যুদ্ধ শুরু হয়ে যায় এবং শেষ পর্যন্ত মুসলমানদের বিজয় সূচিত হয়। এ কারণে আরবদের ব্যবসা-বাণিজ্য কিছুকালের জন্য দুর্বল হয়ে পড়েছিল। কিন্তু এরপর ১৬০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত দক্ষিণপূর্ব এশিয়ায় তাদের ব্যবসা-বাণিজ্য যথারীতি পূর্বের মত চাঙ্গা হয়ে উঠে। বার্থেমা ও অন্যান্য ইউরোপীয় পর্যটকদের মতে, কালিকাট শহরে (মালাবারে) ১৫ হাজার আরব ‘মুর’ বসবাস করত এবং সূরত, গোলকুন্ডা, কুচীন, মছলি পট্টম, স›দ্বীপ, চট্টগ্রাম প্রভৃতি এলাকায় অসংখ্য মুসলমান বাস করত। তাছাড়া লংকার (সিংহল) তিন লাখ পঞ্চাশ হাজার মুসলিম অধিবাসীদের মধ্যে ছিল তিন লাখ সিংহলী মুর (আরব), ৩৫ হাজার ইন্ডিয়ান মুর এবং ১৫ হাজার সিংহলী। এভাবে বার্মার রাজন্যবর্গ, তেলায়েন ও আরাকানের সা¤্রাজ্য যুগে অসংখ্য আরব (মুর) বণিক, জঙ্গী সিপাহী আরাকানসহ বিভিন্ন শহরে বসবাস করতে থাকে।
চীনের ইতিহাস থেকে জানা যায়, আরব বণিকরা দক্ষিণ চীন পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছিল। হুজুর (স.) এর নবুওয়াত-রেসালাত প্রাপ্তির পর ৫০ বছরের মধ্যেই আরব থেকে চীনের কেন্টিন শহর পর্যন্ত সমুদ্র তীরবর্তী এলাকায় নানাস্থানে বহু মসজিদ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। আরও জানা যায় যে, দশম শতকের পূর্বে আসাম থেকে মালয় পর্যন্ত সমুদ্র তীরে বহু অভিনব মসজিদ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, যেগুলি ‘বদর মোকাম’ বা ‘বদরমকাল’ নামে পরিচিত ছিল। সারকথা এই যে, বার্মা ও আরাকানে আরবরা একই সাথে বসবাস করতে থাকে এবং আরাকানী মুসলিম পরিবারগুলির ঐতিহ্য হতেও একথা প্রমাণিত হয় যে, সাহাবায়ে কেরামের আমলেই আরাকানে ইসলাম প্রচারিত হয়েছিল। তার আগে বার্মায় আরবদের বসবাস করার ঐতিহাসিক প্রমাণ পাওয়া যায় না। রোহিঙ্গা বা রোওয়ানিয়া সম্পর্কে বিভিন্ন মনোজ্ঞ বিবরণ পাওয়া যায়। আরাকানী মুর (আরব)গণই রোহিঙ্গা নামে পরিচিতি লাভ করে। কেননা আরবরা আরাকানকে ‘রাহমা’ নামে আখ্যায়িত করত। তাদের ভাষায় আরাকানী মুসলমানগণ রাহমী নামে পরিচিত। এর কারণ হিসেবে একটি ঘটনার উল্লেখ করা হয়ে থাকে যে, ৭৮৮ খ্রিস্টাব্দে রাজা মহাতিংচন্দ্র ধনাবদি আরাকানের রাজা হওয়ার পর দিশাই শহরকে তার রাজধানী করেন এবং রামরী শহর প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি ২২ বছর পর্যন্ত অত্যন্ত ন্যায় নীতির সাথে রাজত্ব করেন। তার রাজত্বকালে রামরী দ্বীপে বহু জাহাজ ধ্বংস হয়ে যায় এবং জাহাজের নাবিকরা ছিল মুসলমান আরব (মুর), তাদেরকে আরাকানে এনে বিভিন্ন এলাকায় আবাদ করা হয়েছিল। এসব আরব বণিক সিন্ধু বিজয়ের ৭৭ বছর পর আরাকানে বসবাস করতে থাকে এবং তারা এখানকার রমণীদেরকে বিয়ে করে। তাদের সন্তানদিকেই রোওয়ান্নিয়া অথবা রোওয়াংগিয়া কিংবা রেহমী বলা হয়। বলা হয়ে থাকে যে, কাইয়িম নামক স্থানে ১৭শ’ ঘরবাড়ি এই রোওয়াংগাদের ছিল। তারা সাধারণত পেশা হিসেবে ব্যবসা-বাণিজ্যকে অবলম্বন করেছিল। বিভিন্ন এলাকা জুড়ে তাদের বসতি ছিল। দক্ষিণ আরাকানেও বহুলোক বসতি স্থাপন করেছিল এবং বহুলোক ক্রমান্বয়ে বার্মা ও চট্টগ্রামে গিয়ে বাস করতে থাকে। কেননা বার্মার রাজন্যবর্গের অত্যাচার-নির্যাতনে তারা অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছিল। রামু ও কক্সবাজার ইত্যাদি এলাকায় ১৮শ’ শতকে গিয়ে তারা বসতি স্থাপন করে। এসব এলাকার লোক এখনও রোওয়াংগা নামে সুপরিচিত। আকিয়াবের বাসেরা বা বসরা নাম হতে প্রমাণিত হয় যে, বসরার বণিকদের বার্মা-আরাকানের সাথে ব্যবসায়িক সম্পর্ক কায়েম ছিল। কাজেই আরাকানে প্রাথমিক যুগেই ইসলাম প্রচারিত হয়েছিল।
আরাকানী ভাষায় যেসব মুসলমান ‘রাহমী’ নামে পরিচিত তাদের সম্পর্কে বিখ্যাত পর্যটকদের বর্ণনাও রয়েছে। ৮৪৪-৪৮ খ্রিস্টাব্দে আরব পর্যটক ইবনে খোরদাজবে বসরা থেকে এসেছিলেন। তিনি আরাকান সম্পর্কে এক চমৎকার তথ্য পরিবেশন করেন। তার বর্ণনা থেকে জানা যায় যে, ‘রাহমা’ (লোয়ার বার্মা) এর রাজা পঞ্চাশ হাজার হাতীর মালিক ছিলেন এবং সেখানে মুসলমান ও মোসাব্বর পাওয়া যায়। অপর একজন আরব পর্যটক সুলাইমান পারস্য উপসাগরীয় এলাকা থেকে (৮৫১ খ্রিস্টাব্দে) এসেছিলেন। তার বর্ণনায় রয়েছে, ‘রাহমা’ (লোয়ার বার্মা) এর রাজা তত নাম করা নয়, তবে তার সৈন্য সংখ্যা বিল্লুরা, গুজরাট ও তেকিন অপেক্ষা অধিক। কথিত আছে যে, রাজা যখন যুদ্ধ ক্ষেত্রে গমন করেন, তখন তার সঙ্গে থাকে পঞ্চাশ হাজার হাতী এবং তিনি শরৎকালেই যুদ্ধ করেন। কেননা তার হস্তীকুল পিপাসা সহ্য করতে পারে না এবং তার বাহিনীতে ১০-১৫ হাজারের ধোপা কাজ করে। (চলবে)



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: বার্মা-আরাকান
আরও পড়ুন