Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

রাসূলুল্লাহ (সা:)-এর নবুওতের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য

এ. কে. এম. ফজলুর রহমান মুন্শী | প্রকাশের সময় : ১৬ নভেম্বর, ২০১৭, ১২:০০ এএম

আল্লাহপাকের পছন্দনীয় ও মনোনীত জীবন বিধানকে বাস্তব ক্ষেত্রে প্রয়োগ করার পথ নির্দেশনা ও শিক্ষাদানের জন্য যুগে যুগে বহু নবী এবং রাসূল পৃথিবীতে আগমন করেছিলেন। কিন্তুু আম্বিয়ায়ে কেরামের আগমনের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যকে কাব্যের ভাষায় এবং সুললিত বর্ণনা বিন্যাসের দ্বারা যেভাবেই ব্যক্ত করা হোক না কেন, বর্তমান নিবন্ধে আমরা ঐ সকল উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যকে তুলে ধরতে প্রয়াস পাব, যা রাসূলুল্লাহ (সা:)-এর জবান মোবারক হতে প্রকাশ পেয়েছিল। আসল দাবী হচ্ছে তা-ই, যা দাবীদারের জবান হতে প্রকাশ পায়। সাক্ষীর দ্বারা সে উদ্দেশ্য কখনো পরিপূর্ণ হয় না। আল- কুরআনে ইরশাদ হচ্ছে, “স্মরণ কর, তোমার প্রতিপালক আদম সন্তানদের পৃষ্ঠদেশ হতে তার বংশধরকে বের করেন এবং তাদের সম্বন্ধে স্বীকারোক্তি গ্রহণ করেন এবং বলেন, ‘আমি কি তোমাদের প্রতিপালক নই?” তারা বলে নিশ্চয়ই, আমরা সাক্ষী রইলাম।” (এই স্বীকৃতি গ্রহণ) এ জন্য যে, তোমরা যেন, কিয়ামতের দিন না বল, আমরা তো এ বিষয়ে অনবহিত ছিলাম।” (সূরা আ’রাফ: রুকু-২২) এ জন্য আম্বিয়াদের আগমনের সর্বপ্রথম উদ্দেশ্য হচ্ছে ভুলে যাওয়া সেই অবিনশ্বর দিনের অঙ্গীকারকে স্মরণ করিয়ে দেয়া এবং সে অঙ্গীকার মোতাবেক আনুগত্য ও প্রাণোৎসর্গের পথ গ্রহণ করা। এ কারণে জীবন চলার প্রতিটি ক্ষেত্রে সেই অবিনশ্বর দিনের অঙ্গীকারের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়া দরকার। এতে করে রাসূলের আগমন সম্পর্কিত একটি উদ্দেশ্য এভাবে পরিপূর্ণতা লাভ করে যে, ‘তাঁর অস্তিত্ব বা সত্তা বনী আদমের জন্য চূড়ান্ত ও পরিপূর্ণ দলীল।’ এরপর যেন আদম সন্তানেরা এই ওজর পেশ করতে না পারে।-“আমাদের কাছে কোন সত্ত¡া সেই অঙ্গীকারের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়ার জন্য আগমন করেনি।” আল-কুরআনে ঘোষণা করা হচ্ছে, “সুসংবাদবাহী ও সাবধানকারী বহু রাসূল প্রেরণ করেছি। যাতে রাসূলের (আমার) পর আল্লাহর বিরুদ্ধে মানুষের কোন অভিযোগ না থাকে এবং আল্লাহ পরাক্রমশালী প্রজ্ঞাময়।” (সূরা নিসা : রুকু-২৩)।
এই তাজকীর বা স্মরণ করিয়ে দেয়ার পর রাসূলগণের অন্যতম দায়িত্ব ও কর্তব্য হচ্ছে, ‘হেদায়েত’ এবং পথ প্রদর্শন করা। এই হেদায়েত মূলত : আল্লাহ পাকের ‘হাদী’ বা পথ প্রদশক গুণের বহি:প্রকাশ মাত্র। এ জন্য আল-কুরআনের অপর এক আয়াতে নবী এবং রাসূলের জন্য হাদী বা হেদায়েতকারী শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। ইরশাদ হচ্ছে, “প্রত্যেক কাওমের জন্যই একজন হাদী বা পথ প্রদর্শক আগমন করেছেন। (সূরা রাআ’দ : রুকু-১)
সূরা শু’রাতে ইরশাদ হচ্ছে, “এবং নিশ্চয়ই তুমি সোজা রাস্তার দিকে পথ প্রদর্শন করছ।” (সূরা শু’রা”: রুকু-৫) তাছাড়া সূরা আম্বিয়াতে কয়েকজন পয়গম্বরের কথা উল্লেখ করে ইরশাদ করা হয়েছে, “এবং আমি এই পয়গাম্বরগণকে এমন পথ নির্দেশক করে প্রেরণ করেছি, যাঁরা আমার নির্দেশ মোতাবেক হেদায়েত করছেন।” (সূরা আম্বিয়া : রুকু-৫) অনুরূপভাবে যে সকল আসমানী কিতাব তাঁদেরকে দেয়া হয়েছিল, সেগুলোকে বারবার ‘হেদায়েত’ এবং কখনো কখনো ‘নূর’ও ‘আলোকরশ্মি’শব্দ দ্বারা বিশেষিত করা হয়েছে।
এই হেদায়েত এবং পথ প্রদর্শনের দ্বিতীয় মর্ম হচ্ছে এই যে, তাঁরা আল্লাহর বান্দাহকে বাতিল ও পথভ্রষ্টতার অন্ধকার হতে বের করে সত্যের আলোকজ্জ্বল পথে নিয়ে আসেন। মানুষ যখন ভ্রান্ত ধ্যান-ধারণা, নিরর্থক চিন্তা-ভাবনা এবং অর্থহীন ভেজালপূর্ণ কর্মকাÐে আবদ্ধ হয়ে সহজাত উপদেশ ও দুরদর্শিতা এবং আত্মিক পরিচয়ের নূর হতে বঞ্চিত হয়ে নিরাশ হয়ে যায়, তখন আম্বিয়ায়ে কেরাম এ সকল অন্ধদেরকে হাত ধরে অন্ধকার হতে আলোর পথে নিয়ে আসেন এবং তাদেরকে সন্দেহের পরিবর্তে দৃঢ়বিশ্বাস, অজ্ঞতার পরিবর্তে জ্ঞান, মিথ্যা ও বাতিলের পরিবর্তে ন্যায় ও সত্য এবং অন্ধকারের পরিবর্তে নূর বা আলোদান করেন। আল-কুরআনে তাই ঘোষণা করা হয়েছে-“সেই আল্লাহ, যিনি স্বীয় সুষ্পষ্ট নিদর্শনাবলী বান্দাহদের নিকট অবতীর্ণ করেন, যেন তোমাদেরকে অন্ধকার হতে আলোর পথে নিয়ে আসতে পারেন।” (সূরা হাদীদ : রুকু-১)
এই পৃথিবীর নাজাত ও মুক্তি শুধু কেবল মধ্যম পন্থাতেই অর্জিত হতে পারে। যখন মানুষের মানসিক পরিবর্তনের মত মানবদেহের সৃষ্ট উপাদানরাজিতে কম ও বেশীর প্রকোপ দেখা দেয়, তখন অবশ্যই পৃথিবীর বুকে অশান্তি নেমে আসতে বাধ্য। মানব সমাজে এবং বিভিন্ন বংশ পরস্পরায় এই সমতা বা মধ্যম পন্থার পরিবেশ বজায় না থাকলে উভয় পাল্লার ওজন সমান থাকবে না। সুদূর নীলাকাশ হতে শুরু করে পৃথিবীর প্রতিটি বালুকণা পর্যন্ত মধ্যম পন্থার পাল্লাতে পরিমিত অবস্থায় আছে। রসায়ন ও মহাকাশ বিজ্ঞানীরা এই সমতার ব্যাপ্তিকে সচক্ষে অবলোকন করতে পারেন এবং আশ্চর্য হয়ে বলতে বাধ্য হন যে, কোথাও এক বিন্দু কম- বেশীর অবকাশ নেই যেভাবে এই বস্তুময় জগতের সর্বত্র এহেন বিস্ময়কর সমতার পাল্লা বিরাজমান, ঠিক তেমনি রূহানী বা আত্মিক এবং আখলাকী দুনিয়ায়ও এই মধ্যম পন্থার সমতা থাকা নেহায়েত দরকার। বিশ্বাস সংক্রান্ত হোক চাই ইবাদত, চারিত্রিক হোক বা বৈষয়িক সর্বত্রই এই সমতার নামই হচ্ছে সত্য, ন্যায় এবং ইনসাফ। আল-কুরআনে ঘোষণা করা হয়েছে-“এবং তিনিই আকাশকে সমুন্নত করেছেন এবং মানদন্ড স্থাপন করেছেন যাতে তোমরা ভারসাম্য লংঘন না কর; তোমরা ওজনের ন্যায্যমান প্রতিষ্ঠিত কর এবং ওজনে কম করো না। (সূরা আররাহমান : রুকু-১)
এই ওজনের সমতা ও ভারসাম্য সর্বাবস্থায় পৃথিবীর প্রতিটি বালুকণার মধ্যে এবং এর প্রতিটি স্পন্দন ও ক্রিয়াকর্মে প্রকৃতির ¯্রষ্টা পরিমিতভাবে কায়েম রেখেছেন। এই সমতা ও ওজনের ভারসাম্যতা রাসূলগণের মাধ্যমে আগত শরীয়তের দাঁড়িপাল্লা মোতাবেক ইচ্ছাশক্তিসম্পন্ন মানুষের প্রতিটি পদক্ষেপে একই স্পন্দনে হওয়া চাই। ইচ্ছাশক্তিহীন পৃথিবীর দাঁড়িপাল্লাকে বলা হয় প্রাকৃতিক আইন এবং ইচ্ছা-শক্তিসম্পন্ন পৃথিবীর মানুষের দাঁড়িপাল্লার নাম হচ্ছে শরীয়তের আইন। ইচ্ছাশক্তিহীন পৃথিবীর সার্বিক ন্যায়ানুগ ইনসাফ ঐশী প্রাকৃতিক দাঁড়িপাল্লার মাধ্যমে পরিচালিত হচ্ছে। এই দাঁড়িপাল্লার মাঝে ন্যূনতম বেশ-কম দেখা দিলে পৃথিবীর শৃংখলা বিনষ্ট হয়ে যাবে। অনুরূপভাবে মানবিক দুনিয়ার শান্তি, নিরাপত্তা, স্বস্তি ও স্থিতিশীলতার নিয়মতান্ত্রিকতা শরীয়তের দাঁড়িপাল্লার দ্বারা কায়েম থাকে। অন্যথায় এখানেও অনিয়ম ও বিশৃংখলা দেখা দিতে বাধ্য। এ জন্যই আল-কুরআনে ঘোষণা করা হয়েছে-“নিশ্চয়ই আমি আমার রাসূলগণকে স্পষ্ট প্রমাণসহ প্রেরণ করেছি এবং তাদের সঙ্গে দিয়েছি ন্যায়নীতি যাতে মানুষ সুবিচার প্রতিষ্ঠা করে।” (সূরা হাদীদ : রুকু-৩)
আম্বিয়াগণের প্রেরণের এই উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যমাত্রাকে মানুষ শরীয়তের দাঁড়িপাল্লা মোতাবেক ইনসাফ ও সমতাকে কায়েম রাখলে, তা এই বর্তমান বিশ্বের নিয়মতান্ত্রিকতায় শান্তি ও নিরাপত্তার পথ সুগম করে তুলবে। আজ ইউরোপের অংশীবাদী ধ্বনী, বিশ্বের প্রতিটি স্থানে অনুরণিত হচ্ছে। এমনকি রাসূলগণের গুরুত্ব ও তাঁদের শিক্ষার প্রয়োজনীয়তার উপর নানারকম সন্দেহ, বিশ্বাস ভঙ্গের কুটিল জালবিস্তার করা হচ্ছে, কিন্তুু খেয়াল ও কল্পনা-বিলাসের প্রতি নজর না করে ব্যবহারিক দিক হতে দুনিয়ার এক একটি মহাদেশ ও প্রতিটি আবাদীর জরীপ করা হলে দেখতে পাবে, আজ বিশ্বের যেখানেই সততার আলো, ন্যায় ও ইনসাফের কিরণ ঝলমল করে আলো বিতরণ করছে, তা এই নবুওতের উদিত সূর্যের আলোরই বিচ্ছুরিত কণাবিশেষ।
কেউ দ্বীনদার হোক চাই বেদ্বীন, সুস্থ বিশ্বাসের অধিকারী হোক চাই বদ আকীদা বা অবিশ্বাসী, গ্রীসের দার্শনিক হোক চাই আফ্রিকার মূর্খ, ইউরোপের সুসভ্য হোক, চাই মরুভূমির অসভ্য হোক, রোমান হোক চাই সাধারণ হোক, ঈসা (আ:)-এর অনুসারী হোক, চাই মূসা (আ:)-এর অনুসারী হোক, মূর্তিপূজারী হোক বা একত্ববাদী হোক, অগ্নি উপাসক হোক চাই হিন্দু হোক, মুসলিম হোক চাই অমুসলিম হোক, শহরবাসী হোক চাই গ্রামবাসী হোক, হিমালয়ের চূড়ায় বসবাসকারী হোক বা মৃত্তিকা গর্তে বসবাস করুক, যেখানে যে অবস্থায়ই থাকুক, সে যদি আল্লাহর নামের শ্রেষ্ঠত্ব সম্পর্কে ওয়াকেফহাল হয়, পাপ ও পুণ্যের প্রভেদ সম্বন্ধে সচেতন হয়, তাহলে সে আল্লাহর রাসূলগণ এবং আল্লাহর পয়গাম্বরগণ ছাড়া কোন শিক্ষকের প্রচেষ্টার প্রতি কৃতজ্ঞ থাকবেনা। আজ যেখানেই সত্য ও ন্যায়ের অস্তিত্ব বিদ্যমান আছে, তা কোনই গ্রীক দার্শনিক, ইউরোপীয় অধ্যাপকের শিক্ষা ও লেখনি এবং বক্তৃতা ও ভাষণের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয়নি। বরং তা হচ্ছে আম্বিয়ায়ে কেরামের প্রত্যক্ষ ও অপ্রত্যক্ষ শিক্ষার শুভফল মাত্র। আজ বিশ্বজোড়া অপসংস্কৃতির সয়লাবযতই বেশী হোক না কেন, তবুও পুণ্য, ন্যায়, ইহসান, সহমর্মিতা, ন্যায়ানুবর্তিতা, সচ্চরিত্রতার শিক্ষার প্রচার ও প্রসার ঐ সকল লোকদের কণ্ঠেই প্রচারিত হচ্ছে, যারা রাসূল এবং পয়গাম্বরদের যথার্থ অনুসারী।
আর যারা অংশীবাদী, অবিশ্বাসী, তারা নিজেদের অজান্তে যে সকল ভালো কাজ করে, এর মাঝেও পয়গাম্বরদের শিক্ষার পরশ পাওয়া যায়। তাই যে সকল লোক বুদ্ধিবৃত্তির দিক দিয়ে পয়গাম্বরদের অস্বীকারকারী, তারাও ব্যবহারিক জীবনে পয়গাম্বরদের কর্মকান্ডকে স্বীকার করতে বাধ্য। এ জন্য আম্বিয়াদের অস্তিত্ব সারা দুনিয়ার জন্য রহমতস্বরূপ। আল-কুরআনে আসমানী কিতাবসমূহকে বার বার রহমত ও হেদায়েত বলা হয়েছে এবং এ ঘোষণাও দেয়া হয়েছে যে, এগুলোকে রহমত ও পথ প্রদর্শনের জন্যই প্রেরণ করা হয়েছে। এর দ্বারা নবুওতের মূল লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্যই বিশ্লেষণ করা হয়েছে। এজন্য রাসূলুল্লাহ (সা:)-এর পবিত্র সত্ত¡াকে সারা দুনিয়ার রহমতের উৎস হিসাবে প্রতিপন্ন করা হয়েছিল। ইরশাদ হচ্ছে- “আমি তোমাকে (হে মুহাম্মদ)! সারা দুনিয়ার জন্য রহমতস্বরূপ প্রেরণ করেছি।” (সূরা আম্বিয়া : রুকু-৭)
সাহায্য ও সহানুভূতি : আম্বিয়া আলাইহিমুস সালাম যে উদ্দেশ্য নিয়ে আগমন করেন এর সামনে যত বড় মুশকিলই আসুক না কেন, যত বৃহৎ বালার সম্মুখীন হোক না কেন, যত বড় কষ্ট ও আঘাতের মোকাবেলা করা হোক না কেন, পরিশেষে সে উদ্দেশ্য অবশ্যই পরিপূর্ণতা লাভ করে। পয়গাম্বরদের সীরাত তাঁদের আহŸানের তারিখ, স্বয়ং তাদের এই দাবীর উপর সত্য সাক্ষী হয়ে আছে। আল-কুরআন ঘোষণা করেছে, “এবং আমার বাক্য স্বীয় বান্দাহ রাসূলদের জন্য পূর্বাহ্নেই স্থিরিকৃত হয়ে আছে যে, অবশ্যই তাঁকে সাহায্য দেয়া হবে এবং আমাদের সৈন্যরাই বিজয়ী হয়।” (সূরা সাফফাত : রুকু-৫)
শুধু কেবল এই দুনিয়াতেই নয়, বরং হাশরের দিনও তাদের এবং ঈমানদারদের কামিয়াবী হবে। আল-কুরআনে ঘোষণা করা হয়েছে, “নিশ্চয় আমি আমার রাসূলদেরকেও মুমিনদেরকে পার্থিব জীবনে এবং যেদিন সাক্ষীগণ দন্ডায়মান হবে সাহায্য করব। যেদিন সীমা লংঘনকারীদের ওজর-আপত্তি কোন কাজে আসবে না, তাদের জন্য রয়েছে অভিসম্পাত এবং তাদের জন্য রয়েছে নিকৃষ্ট আবাস। (সূরা নহল : রুকু-৬)
পয়গাম্বরদের উপর কখনো এমন কঠিন সময়ও আপতিত হয় যে, যখন তাঁরা স্বীয় কাওমের হেদায়েত গ্রহণ হতে সম্পূর্ণরূপে নিরাশ হয়ে যায়। এমনকি আশার আলোর কোন সম্ভাবনাই দেখা যায় না। অপরদিকে আল্লাহর আযাব দেরীতে আসার কারণে অবিশ্বাসীরা মনে করতে থাকে যে, তাদেরকে মিথ্যা আযাবের ধমক দেয়া হয়েছিল। এমন সময় হঠাৎ করে আশার দ্বার উন্মুক্ত হয়ে যায় এবং আল্লাহর সাহায্য ও সহানুভূতির প্রচ্ছায়ার আগমন ত্বরান্বিত হয়ে পড়ে। এতেকরে পুণ্যবান লোকদের অন্তরকে সত্য গ্রহণের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হয়, এবং অবিশ্বাসীদের উপর কোন না কোন আযাব আপতিত হয়ে তাদের মূলোৎপাটন করে দেয়। আল-কুরআনে ঘোষণা করা হয়েছে, “এমনকি যখন পয়গাম্বরগণ স্বীয় কাওমের ঈমান গ্রহণ হতে নিরাশ হয়ে পড়েন এবং অবিশ্বাসীরা মনে করতে থাকে যে, তাদের কাছে মিথ্যা কথা বলা হয়েছে, তখনই আমার সাহায্য এসে যায়।” (সূরা ইউসুফ : রুকু-১২)
আল্লাহর এই সাহায্য ও হেফাজতের আহŸান যারা পরিপূর্ণভাবে বিশ্বাস করে তারা এ পথে সকল প্রকার মুসীবতকে বরণ করে নেয় এবং স্বীয় মস্তককে হাতের মুঠোয় পুরে চলাফেরা করে, তারা বিরুদ্ধবাদীদের সৈন্য-সামন্ত ও সমরাস্ত্রের সমূহের ভয়-ভীতি সত্তে¡ও নিজেদের উপর অর্পিত দাওয়াত ও তাবলীগের দায়িত্ব হতে কখনো পিছ পা হয় না এবং কোন মূল্যেই তারা বিরুদ্ধবাদীদের সাথে আপোষ করতে সম্মত হয় না। বিরুদ্ধবাদী অবিশ্বাসীরা প্রথমাবস্থায় তাদের বাহ্যিক দুর্বলতা ও সহায়হীনতা দেখে মনে করতে থাকে যে, তারাত এমনিতেই পরাজিত। কিন্তুু আল্লাহ পাক তাদের এই ভ্রান্ত ধারণা ছিন্ন করে ঘোষণা করেন,” “সুতারাং কখনো এই ধারণা করো না যে, আল্লাহ পাক রাসূলদের সাথে ওয়াদা ভঙ্গ করবেন।” (সূরা ইব্রাহীম : রুকু-৭) সৃষ্টির বহুপূর্বেই এই কানুন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যে, সত্যের আহŸানকারীগণই পরিণামে বিজয় লাভ করবে। আল-কুরআনে ঘোষণা করা হয়েছে, “আল্লাহ লিখে রেখেছেন যে, আমি এবং আমার রাসূলই বিজয়ী হব।” (সূরা মুজাদালাহ: রুকু-৩)
কিতাব ও হিকমতের শিক্ষা :
উপরে বর্ণিত চারটি আয়াতের সামান্য শাব্দিক পরিবর্তনসহ নিম্নলিখিত আয়াতে ঘোষণা করা হয়েছে, “সে রাসূল তাদেরকে (মুর্খদেরকে) আল্লাহর আয়াতসমূহ শোনান এবং তাদেরকে কিতাব ও হেকমত শিক্ষা দেন।” (সূরা জুময়া : রুকু-১১) এই আয়াতগুলোর মাঝে রাসূলুল্লাহ (সা:)-এর তিনটি কাজের কথা উল্লেখ আছে। (১) আল্লাহর আয়াতসমূহ পাঠ করা এবং তা অন্যান্যদের শোনানো। (২) তাদেরকে শেরেক এবং অসচ্ছরিত্রতার অপবিত্রতা হতে পাক-সাফ করা এবং পবিত্র করা। (৩) তাদেরকে কিতাব ও হেকমত শিক্ষা দেওয়া।
এ প্রসঙ্গে প্রশ্ন হচ্ছে এই যে, ১ম ও ৩য় আয়াতের অর্থ-মর্ম এক নাকি দুই। যদি একই অর্থবোধক হয়, তাহলে অনর্থক দু’বার উল্লেখ করা দরকারইবা কি? আর যদি দুটি পৃথক পৃথক অর্থ ও মর্ম জ্ঞাপক হয়, তাহলে সূ² দৃষ্টিশক্তি সম্পন্নদের নজরে অবশ্যই কিছুটা পার্থক্য থাকবে। রাসূলের পৃথক মর্যাদা যদি অহী দ্বারা শ্রæত আয়াতসমূহ পাঠ করে অন্যান্যদেরকে শোনানো হয়, তাহলে এখানেই তাঁর তাবলীগের দায়িত্ব শেষ হয়ে যায়। এমতাবস্থায় তাঁর তৃতীয় দায়িত্ব শাব্দিক তিলাওয়াতের অধিক কিতাব ও হেকমতের শিক্ষাকে কিভাবে সাব্যস্ত করা যাবে?
একথা সুস্পষ্ট যে, তালিমের অর্থ কিতাব তেলাওয়াত হতে অধিক কিছু। বিশেষ করে তালিম শব্দটি যদি তিলাওয়াতের পরে আসে, তাহলে শব্দাবলী শুনিয়ে দিলেই তিলাওয়াতের দায়িত্ব আদায় হয়ে যেত। কিন্তুু এক্ষেত্রে মূল তালিমের দায়িত্ব বাকীই থেকে যেত। কিতাবের তালিম ও শিক্ষার অর্থ শুধু তিলাওয়াতের মত শব্দাবলী শুনিয়ে দেয়া, পড়ে দেয়া ও অন্যকে স্মরণ করিয়ে দেয়াই নয়। সর্ব প্রথম রাসূলুল্লাহ (সা:)-এর যে কাজ ছিল, তা হলো এর জটিল অর্থসমূহ অনুধাবন করা, অস্পষ্ট ও সংক্ষিপ্ত অর্থগুলোকে বুঝানো এবং স্বীয় জবান ও আমলের দ্বারা এগুলোর ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করা। কিতাব ও হেকমতের শিক্ষা বলতে তা-ই বোঝানো হয়ে থাকে। আর এটা ছিল তাঁর দ্বিতীয় অথবা তৃতয়ী দায়িত্ব। এবং এটা ছিল ঐ শিক্ষা যার কথা এই আয়াতসমূহে বার বার উল্লেখ করা হয়েছে।
এখন যেহেতু এই অর্থ ও মর্ম ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করাও তাঁর দায়িত্ব ও কর্তব্যের অন্তর্ভুক্ত, সেহেতু তাঁর পয়গাম্বরসূলভ ব্যাখ্যা বিশ্লেষণও ধর্মেরই অংশ হিসেবে পরিগণিত হবে। আর এগুলো পালন করাও উম্মতের উপর আবশ্যক বলে পরিগণিত হবে। তাই রাসূলুল্লাহ (সা:)-এর এই মৌখিক ও ব্যবহারিক ব্যাখ্যা বিশ্লেষণকে সাহাবায়ে কেরাম এবং তাবেঈনগণ নিজেদের কাজ ও বর্ণনার দ্বারা সংরক্ষণ করেছেন। আর এগুলোর সংরক্ষিত সংকলনকেই হাদীস ও সুনান নামে অভিহিত করা হয়।
এই বিস্তৃত আলোচনার পর হেকমতের ঐ সকল অর্থের দিকে পুনরায় নজর করুন, যা অভিধানকার ও কুরআন বিশেষজ্ঞগণ বর্ণনা করেছেন। তাহলে আপনার বিশ্বাস হবে যে, তা একই হাকীকতের বিভিন্ন ব্যাখ্যা এবং একই অর্থের বিভিন্ন বিশ্লেষণ মাত্র। রাসূলুল্লাহ (সা:)-এর কার্যাবলী, কর্মকান্ডের সমষ্টি যেগুলোকে ব্যবহারিক অর্থে ‘আহাদীস’ ও ‘সুনান’ বলা হয়। এগুলো মূলত : কিতাবে ইলাহীর ব্যবহারিক জবানী বিশ্লেষণ মাত্র। তাছাড়া কিতাবে ইলাহী ও অহীয়ে রব্বানীর ফলশ্রুতিও তা-ই। আহাদীস ও সুনানে নববীর প্রজ্ঞাপূর্ণ হেকমতকে ইমাম শাফেয়ী এভাবে ব্যক্ত করেছেন, “রাসূলুল্লাহ (সা:)-এর সুন্নাত ও হেকমত হচ্ছে এই যে, যা কিছু আল্লাহ পাকের তরফ হতে রাসূলুল্লাহ (সা:)-এর পবিত্র অন্তরে ঢেলে দেয়া হয়েছে।”
ইমাম মুজাহিদ এই অর্থকে এভাবে তুলে ধরেছেন, “হেকমত হচ্ছে কুরআন অনুধাবনের নাম।” অপর কথায় এভাবে বলা যায় যে, “কুরআনের অর্থ ও মর্মের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণকে সুন্নত বলা হয়। এই অর্থকে ইমাম মালেক, আবু রজীন এবং ইবনে যায়েদ প্রমুখ দ্বিতীয় শতাব্দীর বিশেষজ্ঞগণ এভাবে ব্যক্ত করেছেন যে, “হেকমত হচ্ছে, ‘মারেফাতে দ্বীন’ ও ধর্ম সংক্রান্ত মনীষা। তা মূলত : এলমে দ্বীন যাকে রাসূলুল্লাহ (সা:) বর্ণনা করেছেন এবং হেকমত ঐ নূরের নাম যা আল্লাহ পাক কোনও অন্তরে সৃষ্টি করেন এবং তাকে সমুজ্জল করে দেন।”
আলোচনার সারমর্ম হচ্ছে এই যে, আসল হেকমতে নব্বী (সা:) হচ্ছে নূরে নুবওত ও ইলহামী মারেফাত। যাকে আল্লাহ পাক রাসূলুল্লাহ (সা:)-এর পবিত্র সীনা মোবারকে আমানত রেখেছিলেন। আর যেহেতু সুনাম ও বাক্যাবলী তাঁর আমানতকৃত হেকমতে নববীর ফসল ও শুভফল। এ জন্য এগুলোকেও হেকমত নামে অভিহিত করা যায়। এই বিশ্লেষণের মাধ্যমে বুঝা যায় যে, কোন কোন আলেম ও ইমামগণ হেকমতের বিশ্লেষণ আসল অর্থের প্রতি গুরুত্ব প্রদান করেছেন এবং কেউ দ্বিতীয় অর্থকে প্রাধান্য দিয়েছেন। বস্তুুত: উভয় শ্রেণীই সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত আছেন।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ
function like(cid) { var xmlhttp; if (window.XMLHttpRequest) {// code for IE7+, Firefox, Chrome, Opera, Safari xmlhttp=new XMLHttpRequest(); } else {// code for IE6, IE5 xmlhttp=new ActiveXObject("Microsoft.XMLHTTP"); } xmlhttp.onreadystatechange=function() { if (xmlhttp.readyState==4 && xmlhttp.status==200) { var divname = "clike_"+cid; //alert(xmlhttp.responseText); document.getElementById(divname).innerHTML=xmlhttp.responseText; } } var url = "https://old.dailyinqilab.com/api/insert_comment_like.php?cid="+cid; xmlhttp.open("GET",url,true); xmlhttp.send(); } function dislike(cid) { var xmlhttp; if (window.XMLHttpRequest) {// code for IE7+, Firefox, Chrome, Opera, Safari xmlhttp=new XMLHttpRequest(); } else {// code for IE6, IE5 xmlhttp=new ActiveXObject("Microsoft.XMLHTTP"); } xmlhttp.onreadystatechange=function() { if (xmlhttp.readyState==4 && xmlhttp.status==200) { var divname = "cdislike_"+cid; document.getElementById(divname).innerHTML=xmlhttp.responseText; } } var url = "https://old.dailyinqilab.com/api/insert_comment_dislike.php?cid="+cid; xmlhttp.open("GET",url,true); xmlhttp.send(); } function rlike(rid) { //alert(rid); var xmlhttp; if (window.XMLHttpRequest) {// code for IE7+, Firefox, Chrome, Opera, Safari xmlhttp=new XMLHttpRequest(); } else {// code for IE6, IE5 xmlhttp=new ActiveXObject("Microsoft.XMLHTTP"); } xmlhttp.onreadystatechange=function() { if (xmlhttp.readyState==4 && xmlhttp.status==200) { var divname = "rlike_"+rid; //alert(xmlhttp.responseText); document.getElementById(divname).innerHTML=xmlhttp.responseText; } } var url = "https://old.dailyinqilab.com/api/insert_reply_like.php?rid="+rid; //alert(url); xmlhttp.open("GET",url,true); xmlhttp.send(); } function rdislike(rid){ var xmlhttp; if (window.XMLHttpRequest) {// code for IE7+, Firefox, Chrome, Opera, Safari xmlhttp=new XMLHttpRequest(); } else {// code for IE6, IE5 xmlhttp=new ActiveXObject("Microsoft.XMLHTTP"); } xmlhttp.onreadystatechange=function() { if (xmlhttp.readyState==4 && xmlhttp.status==200) { var divname = "rdislike_"+rid; //alert(xmlhttp.responseText); document.getElementById(divname).innerHTML=xmlhttp.responseText; } } var url = "https://old.dailyinqilab.com/api/insert_reply_dislike.php?rid="+rid; xmlhttp.open("GET",url,true); xmlhttp.send(); } function nclike(nid){ var xmlhttp; if (window.XMLHttpRequest) {// code for IE7+, Firefox, Chrome, Opera, Safari xmlhttp=new XMLHttpRequest(); } else {// code for IE6, IE5 xmlhttp=new ActiveXObject("Microsoft.XMLHTTP"); } xmlhttp.onreadystatechange=function() { if (xmlhttp.readyState==4 && xmlhttp.status==200) { var divname = "nlike"; document.getElementById(divname).innerHTML=xmlhttp.responseText; } } var url = "https://old.dailyinqilab.com//api/insert_news_comment_like.php?nid="+nid; xmlhttp.open("GET",url,true); xmlhttp.send(); } $("#ar_news_content img").each(function() { var imageCaption = $(this).attr("alt"); if (imageCaption != '') { var imgWidth = $(this).width(); var imgHeight = $(this).height(); var position = $(this).position(); var positionTop = (position.top + imgHeight - 26) /*$("" + imageCaption + "").css({ "position": "absolute", "top": positionTop + "px", "left": "0", "width": imgWidth + "px" }).insertAfter(this); */ $("" + imageCaption + "").css({ "margin-bottom": "10px" }).insertAfter(this); } }); -->