দেশে দেশে রোজার উৎসব
মাহে রমজান আরবী নবম মাসের নাম। চাঁদের আবর্তন দ্বারা যে এক বৎসর গণনা করা হয়,
সন্তান খোদার তরফ থেকে মা-বাবার জন্য এক স্পেশাল নেয়ামত। পৃথিবীর সব মা-বাবারা সন্তানকে ভালোবাসেন। হর হামেশা স্নেহের চাদর দিয়ে আবৃত করে রাখেন। সন্তানের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের জন্য যার পর নাই কষ্ট করেন। সব গøানি হাসি মুখে বরণ করে থাকেন মা-বাবারা। সন্তানের আকাশসম চাওয়া-পাওয়া পূরণেও তারা হাড় ভাঙ্গা পরিশ্রম করতে দ্বিদ্বাবোধ করেন না। অলটাইম সন্তানের মুখে হাসি দেখতে চান প্রত্যেক মা-বাবারা। তবে বিবেকের চেয়ে আবেগের মাত্রা যখন বেড়ে যায়, তখনই তাদের আদুরে সন্তান মা-বাবার জন্য কান্নার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ননীর পুতুল নয়, সোনার মানুষ যেন হয় প্রতিটি সন্তান। তাই এ ক্ষেত্রে যুগান্তকারী পদক্ষেপ গ্রহণে প্রত্যেক মা-বাবাদের এগিয়ে আসা প্রয়োজন।
স্বভাবগতভাবে শিশুরা ইসলামী স্বভাবের ওপরই জন্ম নেয়। কিন্তু বাবা মা বা পরিবারের সদস্যরা যদি ইসলাম থেকে বিচ্যুত থাকে, অনৈসলামী ধ্যান-ধারণা ও চাল-চলনের অধিকারী হয়ে থাকে, তবে শিশু সন্তানরা তাদের সেই ধ্যান-ধারণা ও চাল-চলনে অভ্যস্থ হয়ে ওঠে। পক্ষান্তরে বাবা মা এবং পরিবারের সদস্যরা যদি ঈমানের অনুসারী হয়, আল্লাহর পথের পথিক হয়, তাহলে তাঁদের সন্তানরা তাদের থেকে ঈমান এবং ইসলামি শিক্ষাই লাভ করবে। সন্তান ঈমানের পথেই তাদের অনুসরণ করবে এমন বাবা মাকেই আল-কোরআন সুসংবাদ দিচ্ছে ‘যারা ঈমান এনেছে আর তাদের সন্তানরাও ঈমানের সাথে তাদের পদাঙ্ক অনুসরণ করেছে, আমি তাদের সেসব সন্তানকে (জান্নাতে) তাদের সাথে একত্র করে দেবো আর তাদের আমলের কোনো কমতি আমি করবো না।’ (সূরাহ্ আত্ তূর, ২১)
সুতরাং বাবা-মাকে অন্যান্য দায়িত্ব কর্তব্য পালনের সাথে সাথে সন্তানের আমল-আকিদা ও নৈতিক চরিত্র গঠনের প্রতি সর্বশেষ নজর দিতে হবে। কাজেই পিতা-মাতাকে সন্তানের ব্যাপারে হুঁশিয়ার হতে হবে। কেননা, সন্তান-সন্ততি আল্লাহর পক্ষ থেকে পরীক্ষা। যেমন-কুরআনে ইরশাদ হচ্ছে, ‘তোমরা জেনে রাখ, তোমাদের ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি ফেতনা বিশেষ। আর কেবল আল্লাহর নিকটই বিরাট পুরস্কার রয়েছে।’ (৮নং সূরাহ্ আল আনফাল, ২৮) কাজেই সন্তানদের মানুষ করার ব্যাপারে পিতা-মাতাকে অত্যন্ত সতর্ক হতে হবে। মুসলিম পরিবারে পিতাই প্রধান অভিভাবক। তাই পরিবারের সকল দায়-দায়িত্ব অভিভাবক হিসেবে তাঁর ওপরই ন্যস্ত! মূলত: মুসলিম পরিবার পিতার ভূমিকা সর্বাধিক কঠিন ও দীর্ঘমেয়াদি।
১. আযান ধ্বনি শোনানো : শিশু ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর পরই শিশুর ডান কানে আযান ও বাম কানে ইকামত ধ্বনি শোনান। অর্থাৎ আল্লাহর প্রভুত্ব ও সার্বভৌমত্বের কথা স্মরণ করিয়ে দিতে হবে। হাদীসে এসেছে, হযরত আবু রাফে রা. বলেন, ফাতেমা রা. যখন হুসাইন রা. কে প্রসব করলেন, তখন নবী কারীম সা. কে তাঁর কানে আযান শোনাতে আমি দেখেছি। (মুসতাদরাকে হাকিম ৪৮২৭)
২. নাম রাখা ও আকীকা করানো : সন্তান জন্মের পর ১ম কিংবা ৭ম দিবসে ইসলাম সম্মত নাম নির্বাচিত করা ও সামর্থ অনুযায়ী আকীকা করা। ছেলে সন্তানের সময়মতো খাৎনা করানো। এ মর্মে মহানবী সা. এর ঘোষণা , ‘প্রত্যেক নবজাত শিশু তার আকিকার নিকট বন্দি, তার জন্মের সপ্তম দিনে তার নামে পশু জবাই করতে হবে, তার মাথার চুল মুন্ডন করা হবে এবং নাম রাখতে হবে।’ (ইবনে মাজাহ্ হাঃ ৩১৬৫) আর আকীকার নিয়ম হলো ছেলে শিশুর জন্য দুটো ছাগল এবং মেয়ে শিশুর জন্য একটি ছাগল জবাই দ্বারাই যথেষ্ট হবে।
৩. পরিচর্যা ও লালন-পালন : হৃদয় নিংড়ানো ঐকান্তিক দরদ, ভালোবাসা ও স্নেহ মমতার কোমল পরশে সন্তানদেরকে অতি যত্ম সহকারে প্রতিপালন করা। এ মর্মে আল্লাহর ঘোষণা-‘সন্তান ও জননীর ভরণ- পোষণের ভার পিতার ওপরই ন্যস্ত।’ (২নং সূরাহ্ আল বাক্বারাহ্, ২৩৩) সন্তানের অধিকার হচ্ছে, অন্ন-বস্ত্র ও তার বাসস্থানের ব্যবস্থা করা। বিশেষ করে যতদিন না সে নিজে রোজগারের সমর্থ হবে। আর এটা না করলে গুনাহগার হবে। নবী কারীম সা. বলেন, ‘যাদের ভরণ-পোষণের দায়িত্ব কারো ওপর ন্যস্ত থাকে। সে যদি তা যথাযথভাবে পালন না করে তাদের ধ্বংস করে, তাহলে এতেই তার বড় গুনাহ হবে।’ (সুনান নাসায়ী) অপর এক হাদীসে নবী কারীম সা. বলেন, ‘ব্যক্তি যে অর্থ ব্যয় করে, তার মধ্য সবচেয়ে উত্তম হচ্ছে সেটি যা সে ব্যয় করে তার পরিবারবর্গের জন্য।’ (সহীহ মুসলিম ৯৯৪)
৪. জীবনের নিরাপত্তা ও বিকাশ : শিশুসন্তান মহান আল্লাহর বিশেষ নেয়ামত এবং তাঁর পক্ষ হতে পিতা-মাতার নিকট বড় আমানত। তাই সন্তানের জীবনের নিরাপত্তা, চিকিৎসা, রোগ মুক্ত রাখা, স্বাস্থ্যবানরূপে গড়ে তোলা এবং জীবনের উন্নতি ও বিকাশকল্পে পিতাকে যথোপযুক্ত দায়িত্ব পালন করতে হবে।
৫. শিক্ষা-প্রশিক্ষণ দান : সুসন্তান হচ্ছে- জান্নাত বাগিচার পুষ্পতুল্য। শিশুরাই হচ্ছে উম্মাহর প্রস্ফূটিত ফুল- মানবতার ভবিষ্যৎ। সুতরাং সন্তানের সুশিক্ষাই মুসলিম পিতার সর্বপ্রধান কর্তব্য। “কারো সন্তান জন্মগ্রহণ করলে তার জন্য একটি উত্তম নাম রাখবে ও আদব-কায়দা শিক্ষা দেবে। (বায়হাকী ৮২৯৯) পিতা সন্তানকে সুশিক্ষা দেয়ার চেয়ে উত্তম কোনো দান করতে পারে না। (তিরমিযী হাঃ ১৯৫২) সাত বছর বয়স হলে তোমরা সন্তানকে সালাতের আদেশ কর। দশ বছর বয়সে প্রয়োজনে শাস্তি দিয়ে সালাত আদায় করাও এবং তাদের বিছানা পৃথক করে দাও। (আবূ দাঊদ হাঃ ৪৯৫) আল্লাহর নবী সা. আরো বলেন: তোমাদের সন্তানদের সম্মান কর এবং তাদের ভালো স্বভাব চরিত্র শিক্ষা দাও। (ইবনু মাজাহ ৩৬৭১)
৬. বিবাহ দেওয়া : সন্তান প্রাপ্তবয়স্ক হলে পিতা তার বিবাহের ব্যবস্থা করবেন। এ প্রসঙ্গে মহানবী সা. বলেন- “সন্তান প্রাপ্ত বয়সে উপণিত হলে বিবাহ দিবে, অন্যথায় কোন পাপে লিপ্ত হলে পিতা দায়ী হবে।”
৭. বিধাবা বা তালাকপ্রাপ্ত কন্যাকে সাদরে গ্রহণ : কোন কারণে কন্যা যদি স্বামী কর্তৃক পরিত্যক্তা হয় কিংবা বিধবা বা অসহায় অবস্থায় পড়ে তাকে সাদরে গ্রহণ করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা-আশ্রয় ও ভরণ-পোষণ করবেন। এ প্রসঙ্গে হাদীসে এসেছে যে, “কন্যা যদি তোমার নিকট অসহায় হয়ে ফিরে আসে তবে তার জন্য খরচ করাই তোমার জন্য সর্বশ্রেষ্ঠ সদকা।” (ইবনে মাজাহ)
৮. সন্তানের কল্যাণ কামনা করা : পিতা সর্বদা সন্তানের কল্যাণকামী হবেন এবং তাদের সৎপথে চালাবেন। তাদের জন্য দুআ করবেন। মহানবী সা. এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘তোমার সন্তানদের প্রতি কখনো বদ দু‘আ করো না।’ (সহীহ মুসলিম৩০০৯) মহান আল্লাহ শিক্ষা দিয়েছেন, ‘হে প্রভু! তুমি আমাকে ও আমার সন্তানদেরকে নামায প্রতিষ্ঠাকারী বানাও। প্রভু দুআ কবুল কর।’ (১৪নং সূরা ইব্রাহীম,৪০)
৯. আদব-কায়দা ও সৌজন্য শিক্ষা : সন্তানকে সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার জন্য সন্তানকে প্রথম থেকে আদব-কায়দা ও শিষ্টাচার শিক্ষা দেওয়া ও মা-বাবার কর্তব্য। মহানবী সা. বলেছেন: “সন্তানকে সুশিক্ষা বা আদব-আখলাক শিক্ষা দান করাই সন্তানের জন্য শ্রেষ্ঠ উপহার।”
১০. ধর্মের পথে পরিচালনা : সন্তানকে ধর্মেন পথে, সৎ, সুন্দর ও ন্যায়ের পথে পরিচালনা করা পিতার অন্যতম কর্তব্য। লুকমান ছিলেন একজন আর্দশ পিতা। তাই তিনি তার পুত্রকে যেভাবে ধর্মের পথে পরিচালিত করার জন্য উপদেশ ও নির্দেশ দিয়েছিলেন- প্রত্যেক আর্দশবান পিতাকে ঠিক ঐভাবে ধর্মের পথে সন্তানকে পরিচালিত করতে হবে। যেমন পবিত্র কুরআনে বিষয়টি এভাবে এসেছে, ‘হে পুত্র আমার, সালাত কায়েম কর, সৎকাজের আদেশ দাও, অসৎকাজে নিষেধ কর এবং বিপদাপদে ধৈর্য ধারণ কর। নিশ্চয়ই এটি সাহসিকতার কাজ।’ (৩১নং সূরাহ্ আল লুকমান ১৭) মহানবী সা. বলেছেন, তোমার সন্তানকে ৭ বছর বয়সের সময় সালাতের আদেশ দেবে এবং ১০ বছর বয়সের সময় প্রয়োজনে মারবে। (আবূ দাঊদ)
১১. শিরক থেকে দূরে রাখা : সন্তানকে তাওহীদের ওপর প্রতিষ্ঠিত রাখা এবং যাবতীয় শিরক থেকে দূরে রাখা পিতার দায়িত্ব। হযরত লুকমান আ. যেভাবে তাঁর সন্তানকে শিরকমুক্ত থাকার জন্য উপদেশ দিয়েছিলেন। ঠিক তেমনিভাবে সকল পিতার ভূমিকা হওয়া উচিত। লুকমান (আ) বলেছিলেন আল্লাহর বাণী-‘‘হে বৎস! আল্লাহর সাথে শিরক করো না। নিশ্চয়ই শিরক মারাত্মক জুলুম।’’ (সূরাহ্ আল লুকমান,১৩)
১২. বিলাসিতামুক্ত মুক্ত জীবনে অভ্যস্ত করা : সন্তানকে কষ্টসহিষ্ণু ও ধৈর্যশীল এবং পরিস্থিতি মোকাবিলার উপযুক্ত হিসেবে গড়ে তোলা উচিত। কেননা, সন্তানকে প্রথম থেকে বিলাসিতা ও অলসপ্রবণ করে গড়ে তোলা সন্তানের ভবিষ্যতের জন্য মারাত্মক হুমকির কারণ হতে পারে। কাজেই মা-বাবাকে সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে।
১৩. বদ-দুআ না করা : মানবশিশু আল্লাহর নেয়ামত। কাজেই কখনো তাদের জন্য বদ দুআ করা উচিত নয়। সন্তান কোনো অন্যায় আচরণ করলে তা শুধরে দেয়াই হচ্ছে মা-বাবার কর্তব্য। তাদের প্রতি বদ দুআ বা অভিশাপ না দেয়ার ব্যাপারে মহানবী সা. বলেছেন, ‘তোমার সন্তানদেরকে বদ দুআ করোনা।’ (সহীহ মুসলিম,৩০০৯)
বরং সবসময় এ দুআই তাদের জন্য করতে হবে যে, ‘‘হে প্রভু আমাদের! তুমি তোমাদেরকে এমন স্ত্রী ও সন্তান দান কর- যারা আমাদের মনে তৃপ্তি দান করবে। আর আমাদেরকে মুত্তাকিদের নেতৃস্থানীয় বানাও।’’ (সূরা আল ফুরকান,৭৪)
(চলবে)
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।