Inqilab Logo

রোববার ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ০৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২১ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

গভীর সঙ্কটে বাংলাদেশ বাড়ছে উদ্বেগ

প্রকাশের সময় : ১৯ মার্চ, ২০১৬, ১২:০০ এএম

আহমদ আতিক : একের পর এক সমস্যা গ্রাস করছে বাংলাদেশকে। ফলে বাড়ছে ইমেজ সঙ্কট। অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা পরিস্থিতি নিয়ে নাক গলাচ্ছে বিদেশীরা। বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ কেলেঙ্কারি এখন বিশ্ব মিডিয়ায়। এটিএম বুথে স্কিমিং মেশিন বসিয়ে গ্রাহকের টাকা আত্মসাৎ করছে দেশী-বিদেশী চক্র। বাংলাদেশে জঙ্গি নেই বলা হলেও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর একের পর এক হামলার ঘটনা ঘটছে। অন্যদিকে ইউরোপ, আমেরিকা ও মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের অনেক দেশ বাংলাদেশী নাগরিকদের ভিসা প্রদানে করছে গড়িমসি। পার্শ্ববর্তী ও বন্ধু দেশ ভারতের ভিসাও এখন সোনার হরিণ। কিছু দেশ ঢাকা থেকে ভিসা কেন্দ্র সরিয়ে নিয়েছে ভারতের নয়াদিল্লি কিংবা অন্যত্র। যুক্তরাষ্ট্র গার্মেন্টস খাতে জিএসপি পুনর্বহাল করেনি। অস্ট্রেলিয়া, ব্রিটেন বাংলাদেশের কার্গো বিমানের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। পশ্চিমাদের দাবীকৃত নিরাপত্তা মান বহালে ব্যর্থ হলে ঢাকা-লন্ডন যাত্রীবাহী বিমান চলাচল বন্ধেরও হুমকি দিয়েছে ব্রিটেন। তাদের অনুসরণ করতে পারে বিশ্বের অন্য দেশগুলোও। মালয়েশিয়া দেশটিতে ১৫ লাখ বাংলাদেশী শ্রমিক নিয়োগ চুক্তি স্থগিত করেছে। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতেও শ্রমবাজার নিয়ে আশার খবর নেই। একটার পর একটা সম্ভাবনার দ্বার রুদ্ধ হয়ে পড়েছে।
এতসব সমস্যা থেকে উত্তরণের পথ কী, তাও বলতে পারছে না কেউ। সরকারি তরফ থেকে বেশ কিছু উদ্যোগের কথা বলা হলেও এগুলোর সফলতা দৃশ্যমান নয়। দৃশ্যমান সংকট কাটাতে ব্যর্থ হলে দেশের সার্বিক উন্নয়ন এবং এসডিজি বা সাসটেনেবল ডেভেলপমেন্ট গোল অর্জনেও এর প্রভাব পড়বে। এসব নিয়ে যেমন গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন বিশ্লেষকরা, তেমনি সরকারও উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে।
কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশ সরকারের রাজনৈতিক দূরদৃষ্টির অভাব, বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশীদের অবৈধ অভিবাসন, অপরাধে জড়িয়ে পড়া এবং জঙ্গিবাদের ঝুঁকিই মূলত এসব সমস্যার সৃষ্টি করেছে। এছাড়া বিভিন্ন দেশে পতিতালয় ব্যবসা চালানো, গৃহপরিচারিকাদের জোর করে যৌন পেশায় বাধ্য করা, মানবপাচার, চুরি-ডাকাতি, নিষিদ্ধ পণ্যের চোরাচালান, মারামারি ও জুয়াসহ নানা ধরনের অপরাধের অভিযোগ বাড়ছে বাংলাদেশীদের বিরুদ্ধে। সম্প্রতি মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশী পতিতা চক্রের সদস্য এবং তার পরিচালনায় যুক্তদের আটক করেছে সেদেশের পুলিশ। আজারবাইজান সীমান্তে কয়েক অস্ত্রধারী বাংলাদেশীকে অপরাধের জন্য হত্যা করেছে দেশটির সীমান্তরক্ষীরা।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও অর্থনীতিবিদ এ বি মির্জ্জা মো. আজিজুল ইসলামের মতে, বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের টাকার হিসাবে বের হয়ে যাওয়া এই অঙ্ক হয়তো খুব একটা বড় নয়, কিন্তু এর ফলে বহির্বিশ্বে আমাদের ভাবমর্যাদা সংকটে পড়বে। বাইরের মানুষ এটাকে আমাদের দক্ষতা ও সুশাসনের অভাব হিসেবেই চিহ্নিত করবে।
এদিকে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নিরাপত্তা পরিস্থিতির দৃশ্যমান উন্নতি না হলে সরাসরি ফ্লাইটটি বন্ধ করে দেবে বলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে চিঠি দিয়েছেন যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী। মার্চের শেষে যুক্তরাজ্য যে পর্যালোচনা রিপোর্ট দেবে, তা ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র ও অস্ট্রেলিয়া মেনে নেবে এবং সে অনুযায়ী তারা পদক্ষেপ নেবে। অবশ্য যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র ও অস্ট্রেলিয়া বাংলাদেশকে দীর্ঘদিন থেকেই অনুরোধ করে আসছে বিমানবন্দরের নিরাপত্তা জোরদার করার জন্য। যুক্তরাষ্ট্র ও অস্ট্রেলিয়া শাহজালাল বিমানবন্দরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা পর্যবেক্ষণ করার জন্য যুক্তরাজ্যকে দায়িত্ব দিয়েছে।
ইতোমধ্যে বিমানবন্দরের নিরাপত্তা জোরদারে যুক্তরাজ্য সরকারের দেয়া অ্যাকশন প্ল্যান মোতাবেক কাজ শুরু করে দিয়েছে সরকার। সূত্র জানায়, ঢাকা থেকে বিমানযোগে সরাসরি পণ্য পরিবহনে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারে যুক্তরাজ্যের সব ধরনের প্রস্তাব বাংলাদেশ মেনে নিচ্ছে। যুক্তরাজ্য সরকার বিশ্বব্যাপী বিমানে সন্ত্রাসী হামলার আশঙ্কা বৃদ্ধি পাওয়ায় বাংলাদেশের বিমানবন্দরের নিরাপত্তা জোরদারে গুরুত্ব দিচ্ছে।
বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটনমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন বলেন, বিমানবন্দরের নিরাপত্তায় কার্গো শাখার কাজ যুক্তরাজ্যভিত্তিক একটি কোম্পানিকে দেয়া হচ্ছে। এ ব্যাপারে আজ শনিবার সিদ্ধান্ত হবে। তিনি আশা করেন, যুক্তরাজ্যের কার্গো চলাচলে নিষেধাজ্ঞার বিষয়টা ৩১ মার্চের আগেই সমাধান হয়ে যাবে।
মেনন আরো জানান, এ সমস্যার মধ্যেই গত বুধবার জাপান ও বাংলাদেশের মধ্যে আলোচনায় তৃতীয় টার্মিনাল নিয়ে কাজের আগ্রহ প্রকাশ করে জাপান। তৃতীয় টার্মিনালের কাজ এরই মধ্যে চীনকে দেয়ার নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়েছে এমনটি জানিয়ে বিমানমন্ত্রী জাপানের এমন প্রস্তাবকে চাপ বলে উল্লেখ করেছেন। মেনন বলেন, সবাই আমাদের চাপে রাখতে চায়। তবে তিনি বলেন, শেষ মুহূর্তে এ চাপের কাছে নতিস্বীকার করবে না মন্ত্রণালয়।
সরকার বাংলাদেশের বন্ধুপ্রতিম সম্পর্কের দেশ ভারতের মন গলাতে পারছে না। চাপে রেখেছে তারাও। জঙ্গি ইস্যু, সংখ্যালঘু ইস্যুসহ বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে সরকারকে চাপে রাখছে ভারত। এমনকি বাংলাদেশ নীতিতে পরিবর্তনের আভাস দিয়েছেন ভারতের ক্ষমতাসীন দল বিজেপি শীর্ষ নেতা সুব্রমনিয়ম স্বামী। বাংলাদেশে মন্দিরে এবং হিন্দুদের ওপর হামলার তীব্র নিন্দা জানিয়ে তিনি এমন আভাস দিয়েছেন। সুব্রমনিয়ম স্বামী বলেছেন, এই ঘটনায় সরকার সম্পৃক্ত কিংবা অসহায়।
ঢাকাস্থ বিভিন্ন দেশের দূতাবাসের পক্ষ থেকে ভিসা জটিলতার বিষয়ে বলা হচ্ছে, তারা ভিসা দেয়া বন্ধ করেননি। তবে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির আবেদন ও সাথে দেয়া কাগজপত্র ভালো করে যাচাই-বাছাই করছেন। ফলে অনিচ্ছাকৃত বিলম্ব হচ্ছে। যুক্তরাজ্য, আরব আমিরাত এবং থাইল্যান্ড দূতাবাসের পক্ষ থেকে সাম্প্রতিককালে এ ধরনের তথ্য সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত হয়।
তবে বাস্তবতা হলো, বিভিন্ন দেশ ভিসা দিতে যেমন গড়িমসি করছে, তেমনি বিলম্ব করছে পাসপোর্ট ফেরত দেয়ার ক্ষেত্রেও। বাংলাদেশি কূটনৈতিক ও অফিসিয়াল পাসপোর্টের ক্ষেত্রেও কোন কোন ক্ষেত্রে হয়রানির অভিযোগ রয়েছে। এমনকি সম্মানজনক ‘কমনওলেথ ইয়ুথ অ্যাওয়ার্ডস-২০১৬’ নিতে যুক্তরাজ্যে যাওয়ার জন্য দুই দফা ভিসা আবেদন প্রত্যাখ্যান হওয়ার পর মিডিয়ায় আলোচনার কল্যাণে ভিসা পেয়েছেন সওগাত নাজবিন খান। এর ফলে ব্রিটেনসহ অনেক দেশেই বাংলাদেশীদের ভিসা প্রাপ্তির হার কমে আগের তুলনায় এক-চতুর্থাংশে দাঁড়িয়েছে। এ অবস্থা বাংলাদেশের ব্যবসা বাণিজ্যসহ সব খাতেই প্রভাব ফেলছে।
এ সমস্যা উত্তরণে কূটনৈতিক তৎপরতার মাধ্যমে ভিসা সমস্যা দূর করতে মনোযোগী হওয়ার পরামর্শ দেন রফতানিকারকদের সংগঠন এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ইএবি) সভাপতি ও এনভয় টেক্সটাইলসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আব্দুস সালাম মুর্শেদী।
এ বিষয়ে পররাষ্ট্র সচিব শহীদুল হক বলেন, যেসব দেশে অবৈধ বাংলাদেশি অভিবাসীর সংখ্যা বেশি, সেসব দেশে ভিসার ক্ষেত্রে কঠোরতা আরোপ করা হচ্ছে। তবে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কূটনৈতিক তৎপরতার মাধ্যমে সংকট সমাধানে চেষ্টা চালাচ্ছে। ভিসা পাওয়া নিয়ে সমস্যা দ্রুতই কমে যাবে বলে তিনি মনে করেন।
বিশিষ্ট সাংবাদিক সৈয়দ আবুল মকসুদ বলেন, বর্তমানে বাংলাদেশের নাগরিকদের জন্য বিদেশ ভ্রমণ কঠিন হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশের নাগরিকদের ভিসা দেয়া নিয়ে বিভিন্ন দেশ অসম্মানজনক আচরণ করছে। কোনো কোনো দেশের ভিসা অফিসই সরিয়ে নেয়া হয়েছে ঢাকা থেকে দিল্লিতে। কেউ সাত দিনের জন্য লন্ডন যাবেন, সেখান থেকে এসেই এক সপ্তাহ পরে থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনাম যাবেন, সে উপায় নেই। বর্তমানের এই অবস্থাটা খুবই অমর্যাদাকর একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশের জন্য। অতীতে কখনো বাংলাদেশিদের এ পরিস্থিতির মধ্যে পড়তে হয়নি। এমনকি স্বাধীনতার অব্যবহিত পরেও নয়, যখন বহু দেশের স্বীকৃতি পায়নি বাংলাদেশ। তিনি আরো বলেন, এ বছর ‘কমনওয়েলথ ইয়ুথ অ্যাওয়ার্ড’ প্রাপ্ত বাংলাদেশের মেয়ে সওগাত নাজবিন খান এর সাথে ব্রিটিশ হাইকমিশনের আচরণ সাড়ে ১৬ কোটি মানুষকে অপমানের সামিল।
এসব কিছুর মাঝেই বাংলাদেশের উন্নয়ন কর্মকা- এবং এসডিজি বা ‘সাসটেনেবল ডেভেলপমেন্ট গোল’ অর্জনের লক্ষ্যে এগিয়ে চলছে। সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ বা সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. মুস্তাফিজুর রহমান মনে করেন, পৃথিবী আরো জটিল হচ্ছে, ঠিকই। কিন্তু তার সঙ্গে সঙ্গে আমাদেরও বিভিন্ন ধরনের চ্যালেঞ্জের মোকাবেলা করতে হবে। এক্ষেত্রেও আমাদের অনেক ধরনের উৎকর্ষ বৃদ্ধি করার প্রয়োজন আছে। এসডিজি বাস্তবায়নে আমাদের অন্যান্য দেশের তুলনায় আরো অনেক বেশি চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হবে। তার সঙ্গে সুশাসন, জবাবদিহিতা, স্বচ্ছতা এগুলো তো আছেই।
ডয়চে ভেলের সাংবাদিক আরাফাতুল ইসলাম মনে করেন, টেকসই উন্নয়নে প্রয়োজন টেকসই রাজনৈতিক ব্যবস্থা। তার মতে, বাংলাদেশের সম্ভাবনা অনেক। তবে সমস্যা হচ্ছে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, যা উন্নয়নে বড় বাধা। কিন্তু সাসটেনেবল ডেভেলপমেন্ট গোল বা এসডিজির মূল কথা হচ্ছে টেকসই উন্নয়ন। এতে যে ১৭টি লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করা হয়েছে, তা অর্জন তখনই সম্ভব হবে, যখন বাংলাদেশের রাজনৈতিক ক্ষেত্রে একটি টেকসই ব্যবস্থা নিশ্চিত করা যাবে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: গভীর সঙ্কটে বাংলাদেশ বাড়ছে উদ্বেগ
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ