Inqilab Logo

বৃহস্পতিবার, ০৪ জুলাই ২০২৪, ২০ আষাঢ় ১৪৩১, ২৭ যিলহজ ১৪৪৫ হিজরী

সহিংস ভোটের মাঠ

প্রার্থীদের বাড়ি-প্রতিষ্ঠানে হামলা অব্যাহত ৯ জন নিহত, আহত সহ¯্রাধিক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ ইসি -বিশেষজ্ঞদের মত

প্রকাশের সময় : ১৯ মার্চ, ২০১৬, ১২:০০ এএম

আজিবুল হক পার্থ : প্রথমবারের মতো দলীয় প্রতীকে ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনের আয়োজন করে লেজেগোবরে পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন জেলায় সংঘর্ষের ঘটনা ঘটছে। যদিও ইসি এবারে নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছেন। কোথাও কোথাও লোকদেখানো ব্যবস্থা নিলেও তার কার্যকারিতা দেখা যায়নি। ইসির এমন ভূমিকায় প্রতিদিনই বাড়ছে নির্বাচনী সহিংসতা। সংঘর্ষে গত ৩৫ দিনে ৯ জন নিহত হয়েছে। আহত হয়েছে অন্তত দেড় হাজার প্রার্থী-সমর্থক। হামলাকারীরা প্রতিপক্ষের বাড়ি, নির্বাচনী ক্যাম্প, প্রচারণা, পথসভায় আক্রমণ করেছে। ভাঙচুর করেছে দোকানপাট ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। দেশের সব জেলাতেই সংঘর্ষে জড়িয়েছেন সরকারি দলের প্রার্থীরা। আর প্রতিপক্ষ হিসাবে কোথাও দলীয় বিদ্রোহী প্রার্থী আবার কোথাও ভিন্ন দলের প্রার্থীর সমর্থকরা ছিল। তৃণমূল পর্যায়ে এ ভোটের হানাহানিতে জড়িয়েছেন মেম্বার প্রার্থীরাও। এই অবস্থায় ভোটাররা ভোট কেন্দ্রে যাওয়ার আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন। নির্বাচনী প্রচারণা চলাকালে প্রার্থী ও সমর্থকদের মোকাবিলায় ইসি ব্যর্থ, তাই সুষ্ঠু ভোট গ্রহণ করতে পারবেন না বলে অনেকেই মনে করছেন। স্থানীয় সরকার ও নির্বাচন বিশেষজ্ঞদের করা ‘ঘরে ঘরে সংঘর্ষ’ ঘটে চলেছে। যদিও কমিশনের কর্মকর্তারা মনে করছেন দু-একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া নির্বাচন সুষ্ঠু হচ্ছে! গতকাল শুক্রবার যশোরের মনিরামপুরে নির্বাচনী সহিংসতায় আহত এক আওয়ামী লীগ কর্মী মারা গেছেন। এদিন পাবনা সদর উপজেলার ভাড়ারায় সম্ভাব্য চেয়ারম্যান প্রার্থীর বাড়িসহ ৭টি বাড়িতে হামলা এবং অগ্নিসংযোগ করেছে প্রতিপক্ষ চেয়ারম্যান প্রার্থীর সমর্থকরা। পিরোজপুরের কাউখালী উপজেলার চিরাপাড়া পারসাতুরিয়া ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের চেয়ারম্যান প্রার্থী মাহামুদ খান খোকনের চাচা আবদুল মজিদ খানকে (৬০) কুপিয়ে জখম করেছে জাতীয় পার্টির (জেপি) চেয়ারম্যান প্রার্থী বজলুর রহমান নান্নুর সমর্থকেরা। খুলনা জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ও বটিয়াঘাটা উপজেলার সুরখালি ইউনিয়নের আওয়ামী লীগ মনোনীত চেয়ারম্যান প্রার্থী মুশফিকুর রহমান সাগরকে লক্ষ করে গুলি করেছে দুর্বৃত্তরা। এতে তিনি রক্ষা পেলেও জাহাঙ্গীর হোসেন নামে তার এক কর্মী গুলিবিদ্ধ হন। ভোলার বোরহানউদ্দিনে পৃথক দু’টি সহিংস ঘটনায় নির্বাচনী অফিস, প্রচার মাইক ভাঙচুর ও সংঘর্ষে কমপক্ষে ২৫ জন আহত হয়েছে। এ ঘটনায় পুরো এলাকায় উত্তেজনা বিরাজ করছে।
এর আগে পরপর চার দিনে দেশের তিন জেলায় তিনজন নিহত ও তিন শতাধিক আহত হয়েছে। মঙ্গলবার মেহেন্দীগঞ্জে একজন নিহত হয়েছে। এর আগের বগুরারা শিবগঞ্জে নিহত হয়েছে একজন। তার ১৩ মার্চ কিশোরগঞ্জের বেরুয়াইল গ্রামে একজন, ১০ মার্চ ভোলা সদর উপজেলার চরসামাইয়া ইউনিয়নে একজন, ৯ মার্চ পটুয়াখালীর বাউফল উপজেলার আদাবাড়িয়া ইউনিয়নে একজন, ৮মার্চ পিরোজপুরের নাজিরপুর উপজেলায় একজন, ২২ ফেব্রুয়ারি বরগুনার আমতলীর হলদিয়া ইউনিয়নে একজন এবং সাতক্ষীরায় একজন নিহত হন।
স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ও সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ২০০৭-০৮ সাল থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত নির্বাচনে সহিংসতার মাত্রা অনেকটাই কমে এসেছিল। কিন্তু ২০১৪ সাল থেকে তা আবার বাড়তে শুরু করেছে। ১৪ সালের পর থেকে যতগুলো নির্বাচন হয়েছে সবগুলোতেই সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। ইউপি নির্বাচনের সময় যতই ঘনিয়ে আসবে সহিংসতার মাত্রা আরও বাড়বে। সহিংসতার মূল কারণটিই হচ্ছে দলীয় প্রতীকে চেয়ারম্যান প্রার্থী নির্বাচন করা। আগে সহিংসতা হতো নির্বাচনের পর, কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে মনোনয়নপত্র জমা দেয়ার আগেই সহিংসতা শুরু হয়েছে।
সারাদেশের প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, প্রতিদিনই ঘটছে সংঘাত-সহিংসতা। প্রথম ধাপের ইউপি ভোটের দিন যতই ঘনিয়ে আসছে, সংঘাত-সহিংসতা ততই বেড়েই চলেছে। এ নিয়ে প্রার্থীদের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। নির্বাচন বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এবার ভোটের আগেই প্রচার-প্রচারণা নিয়ে ব্যাপক সংঘাত-সহিংসতা হচ্ছে। তারা বলছেন, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী ও দলের বিদ্রোহী প্রার্থীরাই নিজেদের মধ্যে বেশি সংঘাত সৃষ্টি করছেন। দলীয় নির্বাচনের কারণে এমন সংঘাত-সহিংসতা বেড়ে গেছে। ভোটের দিন আরও বেশি সংঘাতের আশঙ্কা প্রকাশ করছেন তারা।
অন্যদিকে গোয়েন্দা সংস্থাগুলো নির্বাচন কমিশনকে আগেই বলেছিল দলীয়ভাবে এ নির্বাচন হওয়ায় ক্ষমতাসীন দলের বিদ্রোহী প্রার্থীরা মাঠে রয়েছেন। ফলে দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দল ও দলীয়-বিদ্রোহী প্রার্থীদের মধ্যে সংঘাত-সংঘর্ষের আশঙ্কা বেশি রয়েছে।
আগামি ২২ মার্চ দেশের ৭ শতাধিক ইউপিতে নির্বাচন। ভোটের দিন এগিয়ে আসার সাথে সাথে আতংক বেড়ে যাচ্ছে ভোটারদের মধ্যে। দলীয় প্রতীকে ইউপি নির্বাচনের সিদ্ধান্তের পর থেকেই ইউপিতে সংঘর্ষের আশঙ্কা করেন নির্বাচন বিশ্লেষকরা। তারা ইসিকে সবার সাথে আলোচনার পর সিদ্ধান্ত নেবার আহ্বান জানিয়েছিলেন।
শুক্রবার নির্বাচনী প্রচারণার নবম দিনে ভোলায় প্রতিপক্ষের হামলায় মেম্বার প্রার্থীর সমর্থক নিহত হয়েছে। চরসামাইয়া ইউনিয়নের বজলু মেম্বারের পক্ষে নির্বাচনী প্রচারণা শেষ করে বৃহস্পতিবার গভীর রাতে বাড়ি ফেরার পথে প্রতিপক্ষ মেম্বার প্রার্থী জাহাঙ্গীর সনির ছেলে শামিমের নেতৃত্বে সিরাজের ওপর হামলা করা হয়। গুরুতর আহত অবস্থায় সিরাজকে ভোলা সদর হাসপাতালে নেয়া হলে ডাক্তার মৃত বলে ঘোষণা করেন। এছাড়া নারায়ণগঞ্জে আ.লীগ ইউপি চেয়ারম্যান প্রার্থীর সমর্থকদের সংঘর্ষ, নারীসহ আহত হয়েছে ৩০ জন। লক্ষ্মীপুরে বিএনপি প্রার্থীর গণসংযোগে আওয়ামী লীগের হামলায় আহত ১০ জন। বাগেরহাটে আ’লীগের দুই পক্ষে সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ ১০ জন। এছাড়াও দেশের বিভিন্ন এলাকায় বিক্ষপ্তি সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে।
এদিকে তফসিলের পর থেকে সারা বিক্ষিপ্ত সংঘর্ষ চলছে। গত সোমবার পটুয়াখালী জেলার বাউফলে আওয়ামী লীগের দলীয় প্রার্থীর উঠান বৈঠকে বিদ্রোহী প্রার্থীর সমর্থকদের হামলায় ইউনিয়ন স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি আশ্রাফ ফকির (৩৫) নিহত হন। এ ঘটনায় আহত হয় আরো ৫ জন।
প্রথম ধাপের মনোনয়নপত্র জমাদানের শেষ দিন সাতক্ষীরায় আওময়ামীলীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষে একজন নিহত হয়। নৌকার প্রার্থীসহ অর্ধশত আহত হয়। এছাড়া পিরোজপুরের আওয়ামলীগের হামলায় নিহত হয় ছাত্রদল নেতা। লক্ষ্মীপুরের কমলনগরে বিএনপির চেয়ারম্যান প্রার্থী মোসলেহ উদ্দিনের গণসংযোগে হামলা করেছে আওয়ামী লীগের চেয়ারম্যান প্রার্থী ফয়সাল আহমদ রতনের সমর্থকরা।এতে ২০জন আহত হয়েছে। এছাড়া সাতক্ষীরার তালা উপজেলায় ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীর ওপর হামলা করেছেন বিদ্রোহী প্রার্থীর কর্মী-সমর্থকরা। এ ছাড়া ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জে আওয়ামী লীগ প্রার্থীর ওপর হামলা করেছে যুবলীগের এক নেতার সমর্থকরা। সিরাজগঞ্জের রায়গঞ্জেও আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থীর ওপর হামলা করেছে স্থানীয় যুবলীগ।
প্রার্থীদের অভিযোগ ও আশঙ্কার বিষয়ে নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) মো. জাবেদ আলী বলেন, ভোট সুষ্ঠুভাবে হবে কি না, তা নিয়ে প্রার্থীদের মধ্যে সবসময় আশঙ্কা থাকে, এবারো আছে। আমরা আশ্বস্ত করতে চাই Ñ সুষ্ঠু নির্বাচনে সব ধরনের পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। যেসব অভিযোগ ইসিতে এসেছে সেগুলো তদন্ত করা হচ্ছে। অভিযোগের সত্যতা প্রমাণিত হলে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে।
ইসি সূত্র জানায়, ইউপি নির্বাচনের প্রচার শুরুর পর থেকে প্রতিদিন স্থানীয় সংসদ সদস্য, উপজেলা চেয়ারম্যান ও পৌরসভার মেয়ররাও নির্বাচনে প্রভাব বিস্তারসহ শতাধিক অভিযোগ জমা পড়ছে ইসিতে। এসব অভিযোগ এসেছে সংশ্লিষ্ট প্রার্থীর কাছ থেকে। আর এসব অভিযোগের বিষয়ে কয়েকটি কমিটি গঠন করেই দায় সেরেছে ইসি। সব অভিযোগের তদন্ত ভার ইসি সচিবালয় ছেড়ে দিয়েছে সংশ্লিষ্ট রিটার্নিং কর্মকর্তার ওপর। কিন্তু তারা এসব অভিযোগ আমলে নিচ্ছে না এমন অভিযোগও করেছেন প্রার্থীরা। আবার রিটার্নিং কর্মকর্তারা পর্যাপ্ত লোকবল ও পুলিশি সহায়তা পাচ্ছেন না এমন অভিযোগও করেছেন ইসি সচিবালয়ে বলে জানা গেছে।
এ বিষয়ে নির্বাচন পরিচালনা শাখার উপসচিব সামসুল আলম বলেন, প্রার্থী, প্রতিপক্ষ ও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের নিয়েও অনেকের অভিযোগ রয়েছে। আমাদের কাছে যেসব অভিযোগ আসছে তা কমিশনের নজরে আনতে ফাইলে উপস্থাপন করা হচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির বিষয়েও নজর রাখা হচ্ছে। আমরা কোনো ছাড় দিচ্ছি না। ইতোমধ্যে নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ না করতে কয়েকটি পদক্ষেপও নেয়া হয়েছে।
এদিকে অনিয়মের অভিযোগে বাগেরহাটের ফকিরহাট উপজেলার মূলঘর ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচন স্থগিত করেছে নির্বাচন কমিশন। মুলঘর ইউনিয়িন পরিষদের স্বতন্ত্র প্রার্থী আক্তারুজামান মঞ্জুর মনোনয়নপত্র ছিনতাইয়ের অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় ওই ইউনিয়নের নির্বাচন স্থগিত করা হয়েছে। ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের পরিবেশ শান্তিপূর্ণ রাখতে ব্যর্থ হওয়ায় বাগেরহাটের মোরেলগঞ্জ এবং রামপাল থানার ওসিকে বদলির নির্দেশ দিয়েছে নির্বাচন কমিশন
নির্বাচনকে প্রভাবিত করা এবং সরকারি কাজে বাধা দেয়ার অভিযোগে বাগেরহাট জেলার চিতলমারীর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে (ইউএনও) প্রত্যাহার করতে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দিয়েছেন নির্বাচন কমিশন (ইসি)।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: সহিংস ভোটের মাঠ

১৯ মার্চ, ২০১৬
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ