দেশে দেশে রোজার উৎসব
মাহে রমজান আরবী নবম মাসের নাম। চাঁদের আবর্তন দ্বারা যে এক বৎসর গণনা করা হয়,
গোটা আরব তমসাচ্ছন্ন। অসত্য কুফরির ঘন কালো আঁধারে ছেয়ে গিয়েছিলো সর্বত্র। কোথাও সত্যের আলো নেই। সর্বত্র জুলুম, শোষণ। সবল ছিলো শাসক আর দুর্বল হলো শোষিত। শোষিত মানবতা হার মেনেছিলো বর্বরতার কাছে। মানবতার আর্তচিৎকারে বাতাস ক্রমশ ভারী হয়ে ওঠেছিলো। পাশবিকতার দাপট ছিলো চরমে। ইনসাফের লেশমাত্র ছিলো না। বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কেঁদে বেড়াতো। নারীরা ছিলো ভোগ্য সামগ্রী। সমাজে কোনো মর্যাদা ছিলো না তাদের, ছিলো না নূন্যতম অধিকার। কন্যা সন্তান জন্মগ্রহণ করলে পিতার অবয়ব বীভৎস হয়ে ওঠতো। পশুত্বের পরিচয় দিয়ে কন্যা সন্তানকে জীবন্ত প্রোথিত করা হতো। বর্বরতার সেই যুগসন্ধিক্ষণে ১২ রবিউল আউয়াল সুবহে সাদিকের সময় মানবতার রহমত ও উত্তম চরিত্রের প্রতিবিম্বরূপে, সত্যের আলো ছড়াতে, পুণ্যের পথ দেখাতে এক মহামানবের আবির্ভাব হলো। তার আদর্শ গ্রহণ করে রাহজান থেকে হয়ে গেলো রাহবার। এ পরশমণির পরম সৌভাগ্য যারা লাভ করলো, চরিত্র তাদের সুষম হলো, জীবন্ত স্বপ্ন তাদের সফল হলো। খাঁটি সোনার চেয়েও খাঁটি তারা হলো। এ স্বর্গ পুষ্পের সান্নিধ্য সৌরভ যারা পেলো, বিশ্ব বাগানে তারা গোলাপের খোশবু ছড়ালো। সেই মহামানবই হলেন রহমাতুল্লিল আলামিন আমাদের প্রিয়নবী রাসুলে আরাবি মুহাম্মদ (সা.)। এই মহামানবের উত্তম আদর্শ নিয়েই বক্ষ্যমাণ নিবন্ধের মূল বিষয়। তাই তার মহত্তম অনুকরণীয় ও অনুসরণীয় আদর্শের প্রতি আলোচনা করার প্রায়াস পাবো ইনশা আল্লাহ।
রাসুল (স.)- এর চরিত্র মাধুরী : মুহাম্মদ (সা.) হলেন মহান চরিত্রের অধিকারী ও আদর্শের জীবন্ত প্রতীক। জন্মের পর হতেই তার মাঝে বিরাজ করছিলো সর্বোত্তম চরিত্র মাধুরী, সর্বোত্তম আদর্শ, সর্বোত্তম মহৎ মানুষ ও সর্বোত্তম প্রতিবেশী ইত্যাকার মহত্তম গুণ। বাল্যকাল থেকেই তার স্বভাব ছিলো কলুষতা, কাঠিন্য, কর্কশতা ও অহমিকামুক্ত। অনুক্ষণ তিনি ছিলেন দায়শীল, শ্রদ্ধাশীল সহানুভূতিশীল ও ঔদার্যশীল এবং নিষ্কলুষ নির্ভেজাল সোনা। তাইতো অতি অল্প বয়েসেই ‘আল-আমিন’ উপাধিতে বিভূষিত হন। অধিকন্ত পরনিন্দা, অশ্লীল ও অশিষ্ট বাক্য কখনই তার পবিত্র মুখ হতে নিঃসৃত হয়নি। এক কথায় তিনি হলেন, সকল গুণের আধার। বিশ্ববাসী সকলের নিমিত্ত নমুনা ও মহান আদর্শ।
রাসুল (সা.)- এর সততা : সততা উত্তম চরিত্রের পূর্বশর্ত, সততা উত্তম আদর্শ। সততার মাঝেই নিহিত আছে ইহকালিন সাফল্য ও পরকালের নাজাত। বলা বাহুল্য, জন্ম হতে মৃত্যু অবধি রাসুল (সা.) হলেন সততার মূর্ত প্রতীক। যার দর”ন মক্কার কাফির-মুশরিক সকলের সকাশে তিনি আস-সাদিক তথা সত্যবাদী নামে পরিচিত। দৃষ্টান্তস্বরূপ বলা যায়, মক্কার কাফের গোষ্ঠী ছিলো তার ঘোরতর শত্রু। তাকে হত্যা করে ইসলামের বিলুপ্তির জন্য সদা অধীর আগ্রহে প্রহর গুনতো। এতদসত্তে¡ও তাদের ধনসম্পদ গচ্ছিত রাখার সর্বাধিক বিশ্বস্ত বলে তাকেই জ্ঞান করতো। সুতরাং তার সততার পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করেই মানুষ দলে দলে ইসলামে প্রবিষ্ট হয়েছিলো। তাই তার সততা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করা একান্ত অপরিহার্য।
রাসুল (সা.)- এর উদারতা : প্রিয়নবী (সা.)- এর অনুপম বৈশিষ্ট্যসমূহের মধ্যে একটি বিশেষ গুণ হলো, উদারতা। ইসলাম আবির্ভাবের পর দুনিয়ার বুক থেকে এ গুণটি নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার জন্য বিধর্মীরা কোনো প্রচেষ্টাই বাদ রাখেনি। এমনকি প্রিয় নবীজির উপর নৃশংস নির্যাতনও চালিয়েছে তারা। তৎসত্তে¡ও সবসময় তিনি তাদের প্রতি ছিলেন উদার, ছিলেন মহৎপ্রাণ। একবার উহুদ প্রান্তরে কাফের বাহিনীর তরবারির আঘাতে হুজুর (সা.)- এর পবিত্র দেহ রক্তে রঞ্জিত হয়েছিলো। বর্শার ফলা শিরস্ত্রাণ ভেদ করে মাথায় আঘাত হেনেছিলো। দাঁত মুবারক শহিদ হয়েছিলো। কিন্তু সেই করুণ মুহূর্তেও তিনি ঔদার্য ও ক্ষমার আদর্শ ত্যাগ করেন নি। বরং কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে এই বলে দোয়া করলেন, হে রাব্বুল আলামিন! ওদের ক্ষমা করে দাও। এরা তো অবুঝ।’
রাসুল (সা.)- এর সহিষ্ণুতা : মহানবী (সা.)- এর ধৈর্য ও সহিষ্ণুতার অবস্থা এমন ছিলো যে, সমস্ত সাহাবায় কেরামদের ধৈর্যও একত্রে তার সমকক্ষ হবে না। এর একটি নমুনা হজরত আবু হুরায়রা (রা.)- এর বর্ণনায় পরিলক্ষিত হয়। তিনি বলেন, ‘একবার এক বেদুঈন মসজিদে পেশাব করে দিলো। সাহাবিরা এ কান্ড দেখে রাগে রোষে তেড়ে এলেন। রাসুল (সা.) তখন তাদের থামিয়ে বললেন, ‘ তাকে তোমরা ছেড়ে দাও। যেখানে সে পেশাব করেছে, তাতে পানি ঢেলে দাও। স্মরণ রেখো, তোমাদের আসানী সৃষ্টিকারী হিসেবে পাঠানো হয়েছে। দুর্বিষহ বিড়ম্বনা সৃষ্টিকারী হিসেবে নয়।’ (বোখারি, কিতাবুল অজু)
রাসুল (সা.)- এর বদান্যতা : বদান্যতা-দানশীলতা একটি মহৎ গুণ। এর পুঙ্খানুপুঙ্খ প্রতিফলন মহানবী (সা.)- এর মাঝেই ঘটেছিলো। প্রিয়নবী (সা.) নিতান্তই দরিদ্র্য ও অসহায়ের ন্যায় দিনাতিপাত করতেন। তথাপি পৃথিবীর কোনো রাজা-বাদশাহের দান দক্ষিণা তার ধারে কাছে পৌঁছতে পারেনি। এর প্রকৃষ্ট প্রমাণ মিলে তিরমিজি শরিফে। নবীজি (সা.)-এর কাছে একবার নব্বই হাজার দিরহাম আসলে তিনি একটি মাদুরের উপর উপবেশ করে সেখান থেকে সমুদয় দিরহাম বণ্টন করে দিলেন। বণ্টণ শেষ হওয়ার পরক্ষণেই এক ভিখারি এসে হাজির। নবী কারিম (সা.) বললেন, ‘আমার কাছে এখন কিছুই নেই। তাই আমার নাম বলে কারো কাছ থেকে কিছু নিয়ে নাও। পরে আমি তা পরিশোধ করে দিবো। ( খাসায়েলে নববী)(চলবে)
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।