Inqilab Logo

রোববার ১৭ নভেম্বর ২০২৪, ০২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৪ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

তুচ্ছ কারণেই ঘটছে নৃশংস ঘটনা

সাখাওয়াত হোসেন : | প্রকাশের সময় : ৩০ অক্টোবর, ২০১৭, ১২:০০ এএম

ধর্মীয় মূল্যবোধ কমে যাওয়া, পারিবারিক সুশিক্ষার অভাব, অপরাধীরা ধরা না পড়া এবং দ্রুত সময়ের মধ্যে সঠিক বিচার না হওয়ায় এ ধরনের ঘটনা ঘটছে বলে উল্লেখ করছেন বিশেষজ্ঞরা


তুচ্ছ কারণেই রাজধানীসহ দেশে নৃশংস ঘটনা বেড়েই চলেছে। গলা কেটে হত্যা করে লাশের টুকরো করা, শ্বাসরোধে হত্যা করে মাটিচাপা দেয়া, ছোট-বড় নিয়ে তর্কের মধ্যে ছুরিকাঘাতে হত্যা, চুরির অপরাধে পুড়িয়ে বা বেঁধে পিটিয়ে হত্যা এখন নিত্যদিনের ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। কে বড়, কে ছোটর (সিনিয়র-জুনিয়র) মতো তুচ্ছ বিষয়কে কেন্দ্র করে সৃষ্ট দ্ব›েদ্ব রাজধানীতে গত ১০ মাসে খুন হয়েছে ৯ কিশোর-তরুণ। একই ধরনের দ্ব›েদ্ব ছুরিকাঘাত বা পিটুনিতে আহত হয়েছে আরো কয়েকজন। এলাকায় প্রভাব বিস্তার ও সিনিয়র-জুনিয়র দ্ব›েদ্ব উঠতি বয়সের কিশোর-তরুণরা এতটাই হিংস্র হয়ে উঠছে যে নিজের বন্ধু বা সহপাঠীর রক্ত ঝরাতেও দ্বিধা করছে না। অপরাধ ও সমাজবিজ্ঞান বিভাগের বিশেষজ্ঞদের দাবি, সামাজিক ও পারিবারিক বিভিন্ন জটিলতা ও টানাপড়েনের কারণে এ ধরনের নৃশংস হত্যাকান্ডের ঘটনা ঘটছে। পারিবারিক সুশিক্ষার অভাব, অপরাধীরা ধরা না পড়া এবং দ্রুত সময়ের মধ্যে সঠিক বিচার না হওয়াও একটি কারণ বলে উল্লেখ করছেন বিশেষজ্ঞরা।
সম্প্রতি অতিরিক্ত আইজিপি পদে পদোন্নতিপ্রাপ্ত ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি মোহাম্মদ শফিকুল ইসলাম বিপিএম দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, এখন সমাজ অসিঞ্চু হয়ে উঠেছে। মানুষের মধ্যে সামাজিক দায়বদ্ধতা আর আগের মতো কাজ করে না। মানুষ ব্যক্তিকেন্দ্রিক হয়ে উঠেছে। এ জন্যই সামান্য কারণেই দেশে নৃশংস ঘটনা ঘটছে। তিনি বলেন, এ ক্ষেত্রে অভিভাবকদের সন্তানের ব্যাপারে আরো যত্মবান হতে হবে। সন্তান যেন মানবিক গুণাবলি নিয়ে বেড়ে ওঠে সে দিকে লক্ষ রাখতে হবে অভিভাবকদের। এক প্রশ্নের জবাবে অতিরিক্ত আইজিপি পদে পদোন্নতিপ্রাপ্ত ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি মোহাম্মদ শফিকুল ইসলাম বিপিএম বলেন, কোনো ঘটনা ঘটার পর পুলিশ সক্রিয় হয় এটা সঠিক নয়, পুলিশ প্রতি মুহূর্তে অপরাধীদের বিরুদ্ধে সক্রিয় রয়েছে। পুলিশের পাশাপাশি সমাজের সকল মানুষ এগিয়ে এলে এ ধরনের পরিস্থিতি থেকে দ্রুত উত্তরণ সম্ভব বলে তিনি মন্তব্য করেন।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. কাজী সাইফুদ্দীন দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, সামাজিক ও পারিবারিক শৃঙ্খলা এবং প্রাতিষ্ঠানিক শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে হবে। বর্তমানে সব জায়গায় এ ধরনের অনিয়মে পরিণত হয়েছে। সে জন্য এ ধরনের ঘটনা ঘটছে। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. ফরিদা আক্তার খানম দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, ধর্মীয় মূল্যবোধ কমে গেছে। বর্তমানে যুবক শ্রেণীর মধ্যে বড়দের শ্রদ্ধা ও ছোটদের স্নেহ কমে গেছে। যুবকদের মধ্যে এক ধরনের অস্থিরতা কাজ করছে। সামাজিক ও পারিবারিক বন্ধন নষ্ট হয়ে গেছে। যৌথ পরিবার নেই। ফলে যুবক ও কিশোররা কোনো অঘটন সহজেই করে ফেলছে। এ বিষয়ে সকলকে আরো যত্মবান ও পরিবারের পক্ষ থেকে সন্তানদের প্রতি সতর্ক নজর রাখতে হবে বলে তিনি মন্তব্য করেন। তিনি আরো বলেন, বর্তমান সময়ে প্রযুক্তি নির্ভরতার কারণেও কিশোর-যুবকরা অস্বাভাবিক আচরণ করছে। আইনের শাসন ও বিচারপ্রার্থীদের দ্রুত বিচার নিশ্চিত হলে এ ধরনের ঘটনা কমে আসবে। এটা নিশ্চিত করা খুবই জরুরি। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সূত্রে জানা গেছে, কে বড়, কে ছোট (সিনিয়র-জুনিয়র) এ দ্ব›েদ্ব রাজধানীতে গত ১০ মাসে খুন হয়েছে ৯ কিশোর-তরুণ। একই ধরনের দ্ব›েদ্ব ছুরিকাঘাত বা পিটুনিতে আহত হয়েছে আরো কয়েকজন। সর্বশেষ রাজধানীর চকবাজার থানা এলাকায় খুন হয়েছেন পুরান ঢাকার ইসলামবাগ আইডিয়াল স্কুলের এক জেএসসি (জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট) পরীক্ষার্থী। তার নাম মো: হাসান (১৬)। গত শনিবার ২৮ অক্টোবর ভোর ৪টার দিকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান হাসান। এ ঘটনায় অভিযুক্ত আলীকে (১৫) আটক করা হয়েছে। গত ৬ অক্টোবর কদমতলীর রায়েরবাগের মুজাহিদনগর এলাকায় গ্রিল মিস্ত্রি রফিকুল ইসলাম শিপনকে (১৮) ছুরিকাঘাতে হত্যা করে তার বন্ধুরা। এর আগে চলতি বছরের ৬ জানুয়ারি উত্তরার ১৩ নম্বর সেক্টরের ১৭ নম্বর রোডে খুন হয় নবম শ্রেণির ছাত্র আদনান কবির (১৫)। এ ঘটনার দুই সপ্তাহের মধ্যে (১৫ জানুয়ারি) রূপনগরে হত্যার শিকার হয় কিশোর কামাল হোসেন। ১৮ জানুয়ারি তেজগাঁওয়ের তেজকুনিপাড়ায় খুন হয় আবদুল আজিজ (১৮) নামে এক তরুণ। তেজগাঁও থানার ওসি মো: মাজহারুল ইসলাম জানান, এলাকায় সিনিয়র-জুনিয়র দ্ব›দ্ব ও ক্রিকেট খেলা নিয়ে পূর্বশত্রুতা নিয়ে ঘটনাটি ঘটেছে। ২৫ আগস্ট দারুসসালামের টোলারবাগে সিনিয়র-জুনিয়র দ্ব›েদ্বর জেরে ছুরিকাঘাত করে শাহিনকে (১৬) খুন করা হয় বলে অভিযোগ তার মা সালেহা বেগমের। গত ২২ আগস্ট ভোরে মিরপুরের উত্তর পীরেরবাগ এলাকায় খুন হন কবির হোসেন (২১) নামে আরেক তরুণ। গত ১৩ আগস্ট রাতে মোহাম্মদপুরের কাদেরিয়া তৈয়বিয়া আলিয়া কামিল মাদ্রাসার দশম শ্রেণির ছাত্র মোফাজ্জল হোসেনকে পিটিয়ে হত্যা করে নবম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন মোহাম্মদপুর থানার ওসি জামাল উদ্দিন মীর। স¤প্রতি ঘটে যাওয়া কয়েকটি ঘটনার আলোকে অপরাধ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক এম মোজাহেরুল হক সাংবাদিকদের বলেন, নিজেকে বড় হিসেবে জাহির করার প্রবণতা থেকে এ ধরনের দ্ব›েদ্বর সৃষ্টি হচ্ছে। এ প্রবণতা কমাতে হলে শিশু-কিশোর-তরুণদের মনন বিকাশে রাজনৈতিক দল, সরকারি প্রতিষ্ঠান ও সংগঠনগুলোকে এগিয়ে আসতে হবে। পড়ালেখার পাশাপাশি তরুণদের সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও গঠনমূলক কাজে যুক্ত করা গেলে এসব ঘটনা অনেকটাই এড়ানো সম্ভব বলেও মনে করেন তিনি। স্থানীয় ও থানা পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, গতকাল রোববার ভোরে পটুয়াখালীর বাউফল উপজেলার গোসিংগা গ্রামের নিজের মাছের ঘেরের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় জীবন বেপারি (২০) নামের এক যুবককে দেখে সন্দেহ হয় ঘেরের মালিক মিন্টু মৃধার। সে তার গতিরোধ করে পরিচয় জানতে চাইলে বাগি¦তন্ডা শুরু হয়। এ সময় চোর সন্দেহে মিন্টু মৃধা লাঠি দিয়ে জীবনকে মারধর করে। পরে জীবন অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে বাড়িতে নিয়ে যায় মিন্টু, আর সেখানেই তার (জীবন) মৃত্যু হয়। সূত্র জানায়, নরসিংদীর শিবপুর উপজেলার খৈনকুট গ্রামের কিশোরী মোবাইল ফোন চোর নাটক সাজিয়ে আজিজা খাতুন (১৩) নামে কিশোরীকে নির্জন স্থানে নিয়ে হাত-মুখ বেঁধে কেরোসিন ঢেলে পুড়িয়ে হত্যা করা হয় গত ২৮ অক্টোবর। মামলার এজাহারে অভিযোগ করা হয়, বিউটির স্বামী সালাম মিয়া তিন মাস আগে মালয়েশিয়া যান। এরপর বিউটি এক যুবকের সঙ্গে পরকীয়ায় জড়িয়ে পড়েন। স¤প্রতি কিশোরী আজিজা তার চাচীর পরকীয়ার ঘটনা দেখে ফেলে। এ জন্য তাকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করে বিউটি ও তার লোকজন।

 



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: নৃশংস ঘটনা
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ