Inqilab Logo

সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

শিল্পায়ন পর্যটন উপশহরের দুয়ার

মিনি সিঙ্গাপুরের পথে মাতারবাড়ী

শফিউল আলম : | প্রকাশের সময় : ২৬ অক্টোবর, ২০১৭, ১২:০০ এএম

 পৃথিবীর দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকতের ধারক দেশের প্রধান পর্যটন শহর কক্সবাজার। আর কক্সবাজারের মহেশখালী দ্বীপ বা উপদ্বীপ যেন প্রকৃতির নিপূণ হাতে গড়া রূপ-নিসর্গের অনন্য এক ঠিকানা। কী না আছে এই দ্বীপটিতে! উঁচু পাহাড় টিলা, বন-জঙ্গল, সমতলে ছবির মতো জনবসতি ক্ষেত-খামার আর ঠিক তার কিনারায় আছড়ে পড়ছে সুনীল বঙ্গোপসাগরের ঢেউ। পাহাড়ের শীর্ষে দাঁড়িয়ে খাদ ঘেঁষে ফেনীল সমুদ্রের নাচন আর সুদূরের বিস্তারকে বিহঙ্গ দৃষ্টিতে উপভোগের আনন্দই যেন অপার্থিব অবর্ণনীয়। স¤প্রতি মালয়েশিয়ার সমুদ্রবেষ্টিত লংকাউই পর্যটনকেন্দ্রে বেড়াতে যায় কক্সবাজার এবং চট্টগ্রাম নগরীর বাসিন্দা দুইটি পরিবার। ফিরে এসে তারা আফসোসের সুরেই জানালেন, ‘আমাদের মহেশখালীর মতো একটি উঁচুনিচু দ্বীপ সাগরকোলের লংকাউই। অথচ প্রাকৃতিক নিজস্ব বৈশিষ্ট্যগুলোকে অটুট রেখেই সার্বক্ষণিক নিরাপত্তা ও সেবার নিশ্চয়তাসহ সেখানে গড়ে তোলা হয়েছে পরিপূর্ণ পর্যটনের অবকাঠামো সুবিধা। বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে ভ্রমণপিপাসু মানুষ ছুটে যাচ্ছে প্রাকৃতির সৌন্দর্য অবগাহনে। মহেশখালী মাতারবাড়ী সোনাদিয়াকে কেন্দ্র করে সেই একই ধরনের অবকাঠামো গড়ে তোলা হলে দেশি-বিদেশি পর্যটকরা আকৃষ্ট হবে লংকাউইর মতোই। কেননা বঙ্গোপসাগরের ধারে মহেশখালী কিংবা কুতুবদিয়া প্রাকৃতিক রূপ-আকর্ষণে লংকাউইর চেয়ে অনেক বেশিই এগিয়ে আছে’।
সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, মাতারবাড়ীকে কেন্দ্র করে মূলত জাপানী সংস্থা জাইকার গবেষণা ও পরিকল্পনায় ‘বিগ-বি বা বে অব বেঙ্গল ইন্ডাস্ট্রিয়াল গ্রোথ বেল্ট’ এবং জ্বালানি খাতের সর্ববৃহৎ ও সমন্বিত স্থাপনা ‘এনার্জি হাব’, বহুমুখী গভীর সমুদ্রবন্দর গড়ে তোলা হচ্ছে। আর সেই পরিকল্পনায় অপরিহার্য দিক ও বিভাগ (কম্পোনেন্ট) হিসেবে সেখানে প্রতিষ্ঠা করা হবে আধুনিক যুগোপযোগী পর্যটন ও অবকাশ বিনোদন কেন্দ্র, বিশেষায়িত অর্থনৈতিক জোন, শিল্প-বাণিজ্য প্রতিষ্ঠান এমনকি আধুনিক মানের হাসপাতাল। মাতারবাড়ী ও এর আশপাশ এলাকাজুড়ে গড়ে উঠতে যাচ্ছে একটি টাউনশিপ বা উপশহর। মেগাপ্রকল্প ও গুচ্ছপ্রকল্পের হাত ধরে এর মধ্যদিয়ে মাতারবাড়ীতে উন্মোচিত হবে পর্যটন, উপশহর ও বিনিয়োগ-শিল্পায়নের দুয়ার। জাপানের প্যাসিফিক ইন্টারন্যাশনাল কনসালট্যান্টস সমীক্ষা প্রতিবেদনে মহেশখালীর সোনাদিয়া উপদ্বীপকে ইতোপূর্বে গভীর সমুদ্র বন্দর স্থাপনের জন্য উপযুক্ত স্থান হিসেবে চিহ্নিত করে। তবে মাতারবাড়ীকে ঘিরে বেশকিছু মেগাপ্রকল্প বিশেষত জ্বালানি হাব গড়ে তোলার মহাপরিকল্পনার সাথে বহুমুখী গভার সমুদ্র বন্দর সুবিধাও সৃজন করা হচ্ছে। আর সোনাদিয়াকে ঢেলে সাজানো হবে বিদেশি পর্যটক আকর্ষণের উপযোগী সুযোগ-সুবিধায়।
সমগ্র মহেশখালী দ্বীপকে ইকো ট্যুরিজমের আওতায় আনারও উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে মাতারবাড়ী ও আশপাশ এলাকার পরিবেশ-প্রতিবেশ, ভূ-প্রকৃতি ও সমুদ্র উপকূলভাগ সুরক্ষার লক্ষ্যে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ে ইকোলজিক্যালি ক্রিটিক্যাল (নাজুক পরিবেশসম্পন্ন) হিসেবে রক্ষণাবেক্ষণের ব্যাপারেও চিন্তা-ভাবনা চলছে। পাহাড়-সাগর, দীর্ঘ সৈকত, সামুদ্রিক পাহাড়ি হরেক জাতের পাখ-পাখালীর উড়াউড়ি, সাগরে জেলেদের মাছ ধরার দৃশ্য, লাল কাঁকড়ার ছোটাছুটি, ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল, চাষীদের লবণ তৈরির দৃশ্য এতসব কিছু একসঙ্গে মিলবে মহেশখালী মাতারবাড়ীতে। যা পৃথিবীতে অনন্য, যদিও রয়ে গেছে প্রায় অজানা।
এদিকে মাতারবাড়ী বহুমুখী সমুদ্র বন্দর ও এনার্জি হাবের সুবিধাকে কাজে লাগিয়ে সেখানে পর্যটন কেন্দ্র ছাড়াও পর্যায়ক্রমে গড়ে তোলা হবে বিশেষায়িত অর্থনৈতিক জোন, উপশহর ও বিভিন্ন আর্থ-সামাজিক উন্নয়নমূলক প্রতিষ্ঠান। কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, এলএনজি টার্মিনাল, এসএমপি স্টেশন, বহুমুখী সুবিধা সম্বলিত সমুদ্র বন্দরের মতো অবকাঠামো সুবিধা এরজন্য বেশ সহায়ক হবে। বিদ্যুৎপ্রকল্প ও এলএনজি টার্মিনাল থেকে জ্বালানি সরবরাহ সহজতর হবে। এরফলে সেখানে শিল্পায়ন সম্ভাবনা রয়েছে অবারিত। বিদেশি সরাসরি বিনিয়োগ (এফডিআই) এবং যৌথ উদ্যোগে বিনিয়োগের সম্ভাবনার দ্বারও খুলে যাবে। অর্থনৈতিক জোনের জন্য মাতারবাড়ীতে বিস্তীর্ণ ভূমি বরাদ্দ রাখা হচ্ছে। সেখানে জনবসতি তুলনামূলক কম হওয়ার সুবাদে শিল্প জোন গড়ে তোলা সুযোগ রয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো আরও জানায়, মাতারবাড়ী থেকে সরাসরি জ্বালানি গ্যাস ও বিদ্যুৎ ব্যবহার করে সিমেন্ট কারখানা, রাসায়নিক শিল্প, খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প, ওষুধ ও পেটেন্ট শিল্প, গার্মেন্টস ও নিটওয়্যার, পাদুকা শিল্প, সিরামিক শিল্প, ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প গড়ে তোলার পরিকল্পনা নেয়া হচ্ছে।
শুধু তাই নয়, দেশ-বিদেশের বিভিন্ন কোম্পানি যৌথ উদ্যোগে এ ধরনের শিল্প স্থাপনের ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ এবং প্রস্তাব পেশ করেছে। সরকার এ ব্যাপারে ধারাবাহিক সমীক্ষা ও গবেষণা চালিয়ে আসছে। সম্ভাব্য বিনিয়োগ ও শিল্পায়ন নিশ্চিত হলে মাতারবাড়ী সমুদ্র বন্দর থেকেই সরাসরি রফতানি করা সম্ভব হবে শিল্পে উৎপাদিত পণ্যসামগ্রী। কেননা চীন, উত্তর-পূর্ব ভারত, নেপাল, ভূটান, মিয়ানমারে বাংলাদেশের উৎপাদিত হরেক পণ্যের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। সেই সঙ্গে মহেশখালীসহ সমগ্র কক্সবাজারের জনসাধাণের ব্যাপক কর্মসংস্থানের পথ খুলে যাবে। ভাগ্য পরিবর্তন হবে এলাকাবাসীর।
মাতারবাড়ীতে মেগাপ্রকল্প ও গুচ্ছপ্রকল্প বাস্তবায়নের সাথে সাথে বিভিন্ন দেশের বিনিয়োগকারী, বিশেষজ্ঞ, প্রকৌশলী, নির্বাহী, কারিগরসহ বিভিন্ন স্তরের মানুষের আগমন বৃদ্ধি পাবে। তাদের প্রয়োজনেই সেখানে অনিবার্যভাবে গড়ে উঠবে একটি টাউনশিপ বা উপশহর। যাকে ঘিরে অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের পরিধি বিস্তৃত হবে। বাড়বে কর্মচাঞ্চল্য। এর সম্প্রসারণ ঘটবে পর্যটন শহর কক্সবাজার থেকে শুরু করে দক্ষিণ চট্টগ্রামজুড়ে। এরফলে সমৃদ্ধ হবে দেশের অর্থনীতি। চিটাগাং চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাষ্ট্রির সভাপতি মাহবুবুল আলম এ প্রসঙ্গে জানান, মহেশখালীর মাতারবাড়ীতে এলএনজি টার্মিনাল, বিদ্যুৎ কেন্দ্রসহ এনার্জি হাব ও বহুমুখী বন্দর গড়ে তোলার যে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে তা খুবই সময়োপযোগী। এরফলে বিশেষ করে চট্টগ্রামে দীর্ঘদিনের গ্যাস ও বিদ্যুতের সঙ্কট নিরসন হবে। দেশি-বিদেশি বিনিয়োগে গতি ফিরে আসবে। অর্থনৈতিক কর্মকান্ড বৃদ্ধি পাবে, পর্যটন খাতের উন্নয়ন হবে। আমাদের প্রত্যাশা অবিলম্বে পরিকল্পিতভাবে মেগাপ্রকল্পসমূহের বাস্তবায়ন। এরফলে বাংলাদেশের মধ্যআয়ের দেশে উন্নীত হওয়ার লক্ষ্য পূরণ হবে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: পর্যটন

৩১ ডিসেম্বর, ২০২২

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ