Inqilab Logo

শনিবার ১৬ নভেম্বর ২০২৪, ০১অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৩ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

৫ হাত ঘুরে বাড়ে চালের দাম

এডিবি’র গবেষণার তথ্য : মধ্যস্বত্বভোগীর কারসাজিতে ন্যায্য দাম থেকে বঞ্চিত কৃষক, ভোক্তাদের নাভিশ্বাস

নূরুল ইসলাম | প্রকাশের সময় : ২৫ অক্টোবর, ২০১৭, ১২:০০ এএম

 ধান থেকে চাল উৎপাদন এবং সে চাল ভোক্তার কাছে পৌঁছানোর আগে পাঁচ ধরনের মধ্যস্বত্বভোগীর হাত ঘুরে আসে। এসব মধ্যস্বত্বভোগীর পকেটে যায় চালের দামের ৪০ শতাংশ। প্রতি কেজি ধান উৎপাদনে যেখানে একজন কৃষকের খরচ হয় ২০ থেকে ২৩ টাকা। সেই ধান ২৪ টাকা কেজি দরে বিক্রি করতে হয় কৃষককে। অথচ বাজারে বর্তমানে চালের কেজি ৬৪ থেকে ৭২ টাকা। অর্থাৎ ধান থেকে চাল উৎপাদন ও বিপণনের প্রক্রিয়ায় দামের বড় অংশই চলে যাচ্ছে মধ্যস্বত্বভোগীর পকেটে। চলের বাজার নিয়ে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) গবেষণায় উঠে এসেছে এ সংক্রান্ত তথ্য। সংস্থাটির ‘দ্য ট্রান্সফরমিং অব রাইস ভ্যালু চেইন ইন বাংলাদেশ অ্যান্ড ইন্ডিয়া: ইমপ্লিকেশন ফর ফুড সিকিউরিটি’-শীর্ষক গবেষণায় দেখা গেছে, ধান-চালের দাম নির্ধারণে মধ্যস্বত্বভোগীদের একচ্ছত্র আধিপত্যের ফলে দেশের ধান উৎপাদনে নিয়োজিত কৃষকরা যেমন ন্যায্য দাম থেকে বঞ্চিত, তেমনি বেশি দামে চাল কিনে ভোক্তাদের নাভিশ্বাস উঠছে। গবেষণায় বলা হয়, প্রতিবেশী দেশ ভারতের চেয়ে বাংলাদেশের মধ্যস্বত্বভোগীরা মুনাফা করছেন অতিমাত্রায়।
গবেষণা প্রতিবেদনে দেখা যায়, দীর্ঘ সময় বিনিয়োগ করেও প্রতি কেজি ধানে ১-২ টাকার বেশি মুনাফা করতে পারেন না কৃষক। দাম নির্ধারণে অক্ষমতার কারণে অনেক সময় লোকসানের মধ্যেও পড়তে হয় তাদের। অন্যদিকে, ধান থেকে চাল রূপান্তর প্রক্রিয়ায় জড়িত ব্যবসায়ী ও মিলাররা সেই ধান কেনেন কৃষকের বিক্রি দামের চেয়ে দেড় গুণ বেশি টাকা দিয়ে। এতে মিলারদের ধান সংগ্রহ প্রক্রিয়াতেও ধানের দামের ৫০ শতাংশ চলে যায় মধ্যস্বত্বভোগীর হাতে। কৃষকের কাছ থেকে প্রতিকেজি ২৪ টাকা দামে ধান কিনে তার সঙ্গে আরো ৫০ শতাংশ খরচ যোগ করেও চালকল মালিকদের মুনাফা করা সম্ভব। সে হিসাবে মিলারের যৌক্তিক মুনাফাসহ প্রতি কেজি চালের দাম ৩৭ টাকার মধ্যে থাকার কথা। কিন্তু সেই চাল বাজারে এখন বিক্রি হচ্ছে ৬৪-৭২ টাকায়। মধ্যস্বত্বভোগীরাই নির্ধারণ করছেন এ দাম। এখানে কৃষক ও ভোক্তার কোনো হাত নেই। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ অটোরাইস ও হাসকিং মিল মালিক সমিতির কোষাধ্যক্ষ ও বগুড়া চালকল মালিক সমিতির সভাপতি আমিনুল ইসলাম গতকাল ইনকিলাবকে বলেন, আমরা সরকার নির্ধারিত দামেই ধান কিনি। এক মন ধানে সর্বোচ্চ ২৬ কেজি চাল হয়। প্রসেসিং খরচ বাবদ চালের দাম ধানের তুলনায় কিছুটা বাড়ে। তাই বলে ৫০ শতাংশ বাড়ে না। তিনি বলেন, আমরা সরাসরি আড়তদারদের কাছে চাল বিক্রি করি না। এখানে মধ্যস্বত্বভোগী ফরিয়া আছে। তারাই ট্রাক ভাড়াসহ আনুসাঙ্গিক খরচের দোহাই দিয়ে দাম বাড়িয়ে দেয়। আর সব দোষ পড়ে মিলারদের কাঁধে।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) এক গবেষণায় দেখা গেছে, প্রতি কেজি চালের দাম ৬ থেকে ১০ টাকা পর্যন্ত বাড়ায় অটো রাইস মিলাররা। খাদ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, সরকারকে প্রয়োজনমতো চাল সরবরাহ করতে বাধ্য থাকবে, এমন শর্তে চাতাল চালু করতে পারে মিলাররা। অথচ সরকারের সংগ্রহ মৌসুম শুরু হলেই নানা তালবাহানা শুরু করেন মিলাররা। প্রয়োজনমতো চাল কিনতে চান না তারা। গত বছর দেশের সাতটি বিভাগের ২১ হাজার ৭২৩টি চালকলের মধ্যে ২০ হাজার ৪৫১টি চালকলের মালিক সরকারের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়েছিল। সে হিসাবে দেশের প্রায় ৯৫ শতাংশ মিলার গত বছর সরকারের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়েছিল। ফলে সর্বোচ্চ চাল সংগ্রহ করতে সমর্থ হয় সরকার। এ কারনে চালের মূল্য ছিল স্থিতিশীল। চলতি বছরে চুক্তিযোগ্য হাসকিং ও অটো রাইস মিলের সংখ্যা ২২ হাজার ৬৫৪টি হলেও সরকারের সঙ্গে চুক্তি করেছে মাত্র ৭ হাজার ২৮৪টি মিল। এতে করে সরকার চাল সংগ্রহ করতে পারেনি। মধ্যস্বত্বভোগীদের কারসাজিতে বাজারে বেড়ে গেছে চালের দাম। যদিও এবারও কৃষকদের কাছ থেকে ২৪ টাকা দরেই কেনা হয়েছিল ধান। এ প্রসঙ্গে নওগাঁ ধান চাল আড়তদার ব্যবসায়ী মালিক সমিতির সভাপতি নিরোদ বরণ সাহা গতকাল ইনকিলাবকে বলেন, আমাদের দেশের কৃষকরা সরকারী গুদামে চাল বিক্রি করতে মোটেও আগ্রহী নয়। সরকারের হয়ে যারা চাল সংগ্রহ করে তাদের অধিকাংশই রাজনৈতিক কর্মী। তারা মূলত নি¤œমানের চাল কেনে। এর সাথে চালের ব্যবসার কোনো সম্পর্ক নেই। এবার চালের দাম বাড়ার কারণ সম্পর্কে তিনি বলেন, এবার মৌসুমের শুরুতে অতি বৃষ্টি ও বর্ষার কারনে শুরু থেকেই ধানের দাম বেশি ছিল। সে কারনে চালের দাম কিছুটা বেড়েছে। মিথ্যা প্রপাগান্ডার মধ্যে চালের অস্বাভাবিক বাজার ছিল মাত্র তিন দিন। এরপর স্বাভাবিক রয়েছে। বর্তমানে যে চাল ৬২ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে সেটি একেবারে চিকন চাল উল্লেখ করে এই চাল ব্যবসায়ী বলেন, মাঝারী চিকন চালের দর এখনও ৪৩-৪৪ টাকাই আছে।
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, চালের দাম নির্ধারণে মধ্যস্বত্বভোগী ব্যবসায়ীরা ভীষণ শক্তিশালী ও পারদর্শী। কেননা বাজার তৈরি ও নিয়ন্ত্রণে কৃষকের কোনো ধরনের সাংগঠনিক সক্ষমতা নেই। আবার সরকারের হাতেও সেই দক্ষতা ও হাতিয়ার নেই। ওই কর্মকর্তা মনে করেন, সঠিক নীতিমালার অভাবে চাল কেনার ক্ষেত্রে সরকারও উল্টো ব্যবসায়ীদের দ্বারা প্রভাবিত ও নিয়ন্ত্রিত হয়।
দেশের প্রান্তিক কৃষকদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, আর্থিক সঙ্গতি ও মজুদক্ষমতা না থাকায় বাধ্য হয়েই স্থানীয় ব্যবসায়ীদের কাছে মৌসুমের শুরুতেই ধান বিক্রি করে দেয় তারা। গ্রামের ফড়িয়া কিংবা স্থানীয় মোকাম ব্যবসায়ীদের কাছে দেশের ৬৩ শতাংশ কৃষক ধান বিক্রি করে থাকে। মাত্র ৩০ শতাংশ কৃষক সরাসরি মিল মালিকদের কাছে ধান বিক্রি করে থাকে। জানতে চাইলে বগুড়া জেলার আদমদীঘি থানার কৃষক আব্দুস সালাম বলেন, ধানের চারা রোপনের পর থেকে পাকা ধান কাটা পর্যন্ত খরচ আগের তুলনায় অনেক বেড়েছে। সাথে পানি ও সার দেয়াসহ আগাছা দমনেও খরচ বেড়েছে। এখন অবস্থাটা এমন দাঁড়িয়েছে যে, এক বিঘা জমিতে ধান উৎপাদন করতে যে পরিমান খরচ হয়, ওই জমির ধান বিক্রি করে সেই টাকাও উঠে না। অনেকেই ঋণ করে ধানের পেছনে টাকা লগ্নি করে থাকে। ধান কাটার পর সেই ঋণ শোধ করার তাগাদা থেকেই কৃষক তড়িঘড়ি ফরিয়াদের কাছে কম দামে ধান বিক্রি করতে বাধ্য হয়। সরকার কখন দাম নির্ধারণ করবে সে আশায় বসে থাকার সময় থাকে না। নওগাঁ জেলার এক কৃষক বলেন, এবারও ধানের দর কেজি প্রতি ২৫ টাকার বেশি ওঠেনি। অথচ নাজিরশাল চালের দাম এখন ৭২ টাকা, মিনিক্যাট ৬৪ টাকা। তাহলে আমাদের কি লাভ হলো?
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, চাল সংগ্রহ মৌসুম শুরু হলে সরকার দুই ভাবে ব্যবসায়ীদের দ্বারা প্রভাবিত হয়। প্রথমত: সরকার ব্যবসায়ীদের কথামতো কৃষকদের কাছ থেকে ধান কেনা থেকে বিরত থাকে। দ্বিতীয়ত: বাজার থেকে ধান না কেনার কারণে বাজারের একচ্ছত্র আধিপত্য ব্যবসায়ীদের হাতে তুলে দেয়া হয়। এতে করে কারসাজির অভিযোগ সবসময়ই ব্যবসায়ীদের দিকেই থাকে। সরকারের উচ্চমহল থেকে চালকলগুলোর বিরুদ্ধে কারসাজির অভিযোগ করা হলেও কোনো ধরনের শাস্তির মুখোমুখি হতে হয় না তাদের। সংশ্লিষ্টদের মতে, বাজারের নিয়ন্ত্রণ পুরোপুরি ব্যবসায়ীদের হাতে চলে যাওয়ায় চলতি বোরো মৌসুমের পর চাল সগ্রহে ব্যর্থ হয় সরকার। এতে বেড়ে যায় চালের দাম।

 



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: চাল

১১ জানুয়ারি, ২০২৩

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ