ইভিএম-এ ভোট কেন?
আগামী জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম-এ ১৫০ আসনে ভোট গ্রহণের পরিকল্পনার কথা জানিয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার। কাকতালীয় কিনা জানি না, ১৫০ সংখ্যাটা আমাদের এর আগে চিনিয়েছিলেন রকিবুল
কে, এস, সিদ্দিকী
প্রচলিত সূফী তরিকাগুলোর মধ্যে সর্বাধিক প্রসিদ্ধ ও প্রচলিত তারিকা চতুষ্টয় হচ্ছে- কাদেরিয়া, চিশতিয়া নকশবন্দিয়া এবং সোহরাওয়ার্দীয়া তরিকা। উপমহাদেশে প্রথমোক্ত দুটি তরিকার ভক্ত-অনুসারীদের সংখ্যা বিপুল। অতঃপর নকশবন্দিয়া তারিকার স্থান। সোহরাওয়ার্দীয়া তরিকার অনুসারীদের সংখ্যা তুলনামূলকভাবে কম। এ তরিকার প্রবর্তক ছিলেন হযরত শেখ শাহাবুদ্দীন উমর সোহরাওয়ার্দী (রহ.)। তাঁর জীবন ও কর্মের বিবরণ নিম্নরূপ-
তিনি একজন খানকা নিবাসী। সাধকই ছিলেন না, শরীয়তের খাটি অনুসারী আলেম ও কওমের একনিষ্ঠ খাদেমও ছিলেন। তাঁর উপাধি ছিল শায়খুশ-শুয়খ শায়খুল ইসলাম, হযরত খাজা মাখদুম সে সময়কার তিনি ছিলেন এক মহান সাধক, খাটি আলেম ও অতুলনীয় ধর্মবিদ। বংশ মর্যাদার দিক দিয়েও ছিলেন তিনি অতি উচ্চ মর্যাদার অধিকারী ছিলেন হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রা.)-এর বংশধর।
পূর্ণ বংশ তালিকা
আবু হাফস উমর ইবনে মোহাম্মদ ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে আম্বিয়া ইবনে সাদ ইবনে হোসাইন ইবনে কাশেম ইবনে আলকামা ইবনে নসর ইবনে মাআজ ইবনে আবদুর রহমান ইবনে কাসেম ইবনে মোহাম্মদ ইবনে আবি বকর সিদ্দীক (রা.)। হযরত আম্বিয়া ছিলেন হযরত শাহাবুদ্দিন উমরের পরদাদা এবং সোহরাওয়ার্দীয়া সিলসিলার একজন বিখ্যাত সাধক ও আরেফে কামেল। তাই বলা যায়, হযরত শাহাবুদ্দিনের খান্দানের সদস্যবৃন্দ ছিলেন জ্ঞানভা-ার ও আধ্যাত্মিক ঘরানার আলোর প্রতীক এবং তাদের নিকট হতেই তিনি জ্ঞান লাভ করেন।
বিখ্যাত প্রাচ্য গবেষক নোলডেকী-এর গবেষণা অনুযায়ী সোহরাওয়ার শাহাবুদ্দিনের পূর্ব পুরুষদের জন্মস্থান ছিল। আসলে স্থানটির নাম সোহরাব। প্রাচীন যুগে সোহরাব একজন ইরানী গভর্নর ছিলেন, কাসবাটি তার নামেই প্রসিদ্ধি লাভ করে। পরে যুগের পরিবর্তনে নামটি বিকৃত হয়ে সোহরাওয়ার্দী হয়ে যায়। এ কাসবার পার্বত্য এলাকা হামদান হতে জানজানগামী সড়কে অবস্থিত। হিজরী চতুর্থ শতকে যখন সোহরাওয়াদী খান্দান এখানে বসবাস করতো, তখন এ কাসবা কুদীদের অধিকারে ছিলভ তাদের ধর্ম-কর্ম ছিল নীতি-নৈতিকতা বর্জিত। এ কারণেই আল্লাহতালা এ অসভ্য লোকদের হেদায়েতের জন্য এ বংশকে সেখানে প্রেরণ করেন।
হযরত শেখ শাহাবুদ্দিন সোহরাওয়ার্দী হিজরী ৫৩৬ সালের রজব মাসের শেষ দিকে অথবা শাবান মাসের প্রথম দিকে সহরওয়ার্দে জন্ম গ্রহণ করেন। শৈশবেই তিনি শিক্ষা গ্রহণের জন্য তাঁর চাচা শখ আবু নজীব আবদুল কাহের সোহরাওয়ার্দীর নিকট বাগদাদে চলে গিয়েছিলেন। তাঁর এ বুজুর্গ চাচাই ছিলেন তার জাহেরী ও বাতেনী শিক্ষা গুরু ও পীর-মুর্শিদ। এগারো বছর বয়সে তিনি হাদীস শিক্ষা আরম্ভ করেন এবং যুগের সেরা মোহাদ্দেসগণের কাছ থেকে শিক্ষা লাভ করে বিভিন্ন বিষয়ে পারদর্শিতা অর্জন করেন।
শেখ আবুল কাশেম ইয়াহিয়া ইবনে আলী আল-বাগদাদী (ওফাত : ৫৫৫ হি.) ছিলেন বিখ্যাত ফেকাবিদ। তাঁর কাছে তিনি ফেকাশাস্ত্র অধ্যয়ন করেন এবং তাঁর মুরব্বী চাচার নিকট তাসাওয়া শাস্ত্র ও ওয়াজ এবং জিকির-আজকারের নিয়ম-নীতি শিক্ষা করেন। তাছাড়া হযরত গাওসুল আজম শেখ আবদুল কাদের জিলানী (র.)-এর নিটক (ওফাত : ৫৬১ হি.) আধ্যাত্মিক শিক্ষা লাভ করেন।
ইমাম ইয়াফেয়ী (র.) রওজাতুল মাফাখির, তাক মিলাতু রজজির রিয়াহীন নামক গ্রন্থে লিখেছেন যে, হযরত শাহাবুদ্দিন সোহরাওয়ার্দী (র.) তাঁর যৌবনকালে ‘কালাম’ শাস্ত্র পরিপূর্ণভাবে সমাপ্ত করতে খুবই সক্রিয় ছিলেন, কিন্তু তাঁর বুজুর্গ চাচা তাঁর এ আগ্রহ-উৎসাহকে পছন্দ করতেন না। এ কারণে এক দিন চাচা তাঁকে হযরত গাওসুল আজম (র.)-এর খেদমতে নিয়ে যান এবং তাঁর নিকট অবস্থা বর্ণনা করেন। হযরত গাওসুল আজম (র.) শাহাবুদ্দীন সোহরাওয়ার্দীকে কালাম শাস্ত্রের কিছু কিতাবের নাম জিজ্ঞাসা করেন যেগুলো তাঁর অধ্যয়নে ছিল। অতঃপর তিনি তাঁর বক্ষে হাত রাখেন। এর ফলে কালাম শাস্ত্রের সমস্ত বিষয় তিনি ভুলে যান, কিন্তু তার অন্তরের সকল দ্বার উন্মুক্ত হয়ে যায় এবং তাতে বাতিনী সব ইলম ভরে যায়।
হযরত শেখ শাহাবুদ্দিন (র.) কেবল খানকার সাধক ছিলেন না বরং তিনি স্বীয় প্রভাব প্রতিপত্তি বলে দেশ ও জাতির বিরাট কল্যাণ সাধন করেন। বিশেষতঃ ইসলামী রাষ্ট্রগুলোর সরকারসমূহের মধ্যে সন্ধি স্থাপনে তাঁকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। এ কারণে বাগদাদের বিভিন্ন খলিফা ও আমির ওমরা এবং ইসলামী রাষ্ট্রগুলোর সরকারসমূহ তাঁর খুবই সম্মান করতেন। ইসলামী রাষ্ট্রগুলোর শাসকবর্গের নিকট সন্ধি বা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে দূত প্রেরণ করতে হলে তারই শরণাপন্ন হতে হতো এবং সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রে তিনি প্রেরিত হতেন। তার জীবনে এরূপ দৃষ্টান্তের অভাব নেই।
হজরত ইমাম ইয়াফেয়ী (র.) বর্ণনা করেন যে, একবার তাঁর সাথে হযরত শেখ আকবর মুহিউদ্দীন ইবনে আরাবী মোহাম্মদ ইবনে আলী আত্তায়ী (ওফাত : ৬৩৮ হি.)-এর সাক্ষাৎ হয়। দুইজন একে অপরকে দেখেন, কিন্তু তাদের মধ্যে কোনো কথা বার্তা হয় নি। অতঃপর লোকরা শেখ শাহাবুদ্দিন সম্পর্কে শেখ ইবনে আরাবীকে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন ঃ ‘শেখ শাহাবুদ্দিন সোহরাওয়ার্দী (র.) হাক্কীকত সমূহের একটি সমুদ্র...।’
আরবী ও ফারসী উভয় ভাষায় শেখ শাহাবুদ্দিন (র.) কবিতা বলতেন। ইবনে খালকান তার কিতাবে নমুনাস্বরূপ আটটি নির্বাচিত কবিতা উদ্ধৃত করেছেন। তার ফারসী ভাষার রচিত রুবাঈগুলো আমিন আহমদ রাজী তার ‘হাফতে একলাম’ নামক গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন। ‘রিয়াজুছ-ছালেহীন গ্রন্থে রেজা কুলিখান এবং মাজ মাউছ-ছাফা গ্রন্থে তাঁর ফারসী রুবাঈয়াত’ উল্লেখিত হয়েছে।
বিখ্যাত প্রাচ্যবিদবুরুক্লান তাঁর বৃহদাকারের কিতাব তারিখে আদবিয়াতে আরব-এর হজরত শেখ শাহাবুদ্দিন (র.)-এর একুশটি কিতাবের সন্ধান দিয়েছেন। তাঁর প্রসিদ্ধ কিতাবগুলোর নাম এই-
(১) বুগয়াতুল বায়ান ফি তফসীরিল কোরআন
(২) আ’লামুল হুদা অ-আকীদাতু আরবাবিত-তোকা
(৩) জাজবুল কুলুব ইলা মোওয়াখেলাতিল মাহবুব
(৪) কিতাবুল আছায়া
(৫) আর রাহীকুল মাখতুম লিজাবিয়িল উকুলে ওয়াল ফাহুম।
(৬) ছাফ ওয়াতুছ ছুফিয়া
(৭) মাকামাতুন আরেফীন
(৮) রিসালাতুন ফি ইতিকাদিল হোকামা
(৯) আসরারুল আরেফীন ওয়া সিয়ারুত তালেবীন
(১০) কিতাবুল আওয়াদ
(১১) রাশফুল নাছায়িহিলী ঈমানিয়া ওয়া কাশফুল ফাজাহিল ইউনানিয়া
(১২) আওয়ারিফুল মাআরিফ।
শেষোক্ত ‘আওয়ারিফুল মাআরিফ’ হযরত শেখ শাহাবুদ্দিন সোহরাওয়ার্দীর (র.) এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ কিতাব যাকে যথার্থভাবে তাসাওফের মৌলিক কিতাব আখ্যায়িত করা যায়। এ কিতাব তিনি পবিত্র মক্কা মোকাররমায় রচনা করেন এবং এর গুরুত্বপূর্ণ ও জটিল বিষয়গুলো খানাই কাবার তোয়াফও জিয়ারতের পর আল্লাহর নিকট সাহায্য প্রার্থনা করে সমাধান বের করেন। এ কিতাবে তাসাওফের গুরুত্বপূর্ণ সকল বিষয়কে কোরআনুল করীমের সংশ্লিষ্ট আয়াতসমূহ এবং বিশ্বস্ত সনদে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (স.)-এর হাদীসগুলোর আলোকে সহজ ও আকর্ষণীয়ভাবে তুলে ধরেছেন। সকল বর্ণনাকারী ও মাশায়েখে ওস্তাদগণের সিলসিলা বা ধারা তিনি সাহাবায়ে কেরামের প্রত্যেকের নাম সহকারে রাসূলুল্লাহ (স.) পর্যন্ত যুক্ত করে দিয়েছেন। এটি কিতাবের এমন একটি বৈশিষ্ট্য যা তাসাওফের অন্যান্য কিতাবে অবর্তমান। আওয়ারিফুল মাআরিফ- আরবী ভাষায় রচিত এর বিভিন্ন ভাষায় অনুবাদ হয়েছে।
উপমহাদেশে সোহরাওয়ার্দীয়া তরিকার প্রবর্তক হচ্ছে শেখুল ইসলাম হযরত খাজা বাহাউদ্দীন জাকারিয়া মুলতানী (ওফাত : ৬৬৬ হি.) তাঁর মাজার মুলতানে অবস্থিত। তারই খান্দানের মাধ্যমে এ রূহানী সিলসিলা বা আধ্যাত্মিক ধারা উপমহাদেশের নানাস্থানে প্রসার লাভ করে। হযরত শেখ শাহাবুদ্দিন সোহরাওয়ার্দী (র.) হিজরী ৬৩২ সালের ১ মহররম বাগদাদে ইন্তেকাল করেন। ইন্তেকালের পূর্বেও তাঁর শান শওকত অক্ষুণœ ছিল। তাঁর খেদমতে প্রতিনিয়ত হাজার হাজার টাকা আসতো এবং সমস্তই তিনি আল্লাহর রাস্তায় দান করে দিতেন। ওফাতের সময় তাঁর ভা-ার হতে মাত্র ছয় দীনার পাওয়া যায় এবং তাও তাঁর কাফন-দাফনে খরচ হয়ে যায়। বাগদাদের ওয়ারদিয়া কবরস্থানে তাঁর মাজার অবস্থিত এবং সেখানে ভক্ত অনুসারীদের সমাগম হয়ে থাকে। বাংলাদেশে ও সোহরাওয়ার্দীয়া তরিকায় বেশ কিছু অনুসারী আছে। মরহুম হোসেন শহীদ সোহ্রাওয়ার্দী ছিলেন এ বংশেরই কৃতি সন্তান।
বাংলাদেশে সোহরাওয়ার্দীয়া তরিকার বিস্তার-প্রসারের ধারাবাহিক বিবরণ কিংবা এ তরিকার ভক্ত অনুসারীদের কোনো স্বতন্ত্র পরিচিতি আমাদের জানা নেই। বাংলাদেশে ইসলাম প্রচারে এ তরিকার ভূমিকা আলাদাভাবে নির্ণয় করার প্রয়োজন অস্বীকার করা যায় না। আমাদের দেশে চিশতিয়া, কাদেরিয়া ও নকশবন্দিয়া, এ তরিকা ত্রয়ের ওপর আলাদা বিস্তারিত সুবিন্যস্ত অথবা বিক্ষিপ্তভাবে অনেক কিছু হলেও সোহরাওয়ার্দীয়া তরিকা সম্পর্কে বিশদ বিবরণের অভাব রয়েছে। এদেশে সোহ্রাওয়ার্দী খান্দানের কতিপয় বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব ছিলেন এবং তাদের বংশধরেরাও হয়তো থাকতে পারেন।
বাংলাদেশে প্রচলিত সব তরিকার সাধক ও ভক্ত-অনুসারী এবং এসব তরিকার বহুশাখা-উপশাখাও রয়েছে সাধারণ ভক্ত অনুসারীদের এসব বিষয়ে তেমন ধারণা নেই। উল্লেখ্য, তরিকতের প্রবর্তকগণ মজহাব চতুষ্টয়ের কোনো মজহাবের অনুসারী ছিলেন। যেমন কাদেরিয়া তরিকার প্রবর্তক হযরত গাওসুল আজম আবদুল কাদের জিলানী (র.) হাম্বলী মজহাবের অনুসারী হলেও তিনি বিভিন্ন বিষয়ে অন্যান্য মজহাবের প্রতিও উদার ছিলেন বলে জানা যায়। চিশতিয়া তরিকা ও নকশবন্দিয়া তরিকার প্রবর্তকদ্বয় হানাফী মজহাবের অনুসারী ছিলেন। সোহরাওয়ার্দীয়া তরিকার প্রবর্তক শাফেয় মজহাবের অনুসারী ছিলেন বলে জানা যায়। এ তরিকার বিভিন্ন শাখা রয়েছে। (চলবে)
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।