দেশে দেশে রোজার উৎসব
মাহে রমজান আরবী নবম মাসের নাম। চাঁদের আবর্তন দ্বারা যে এক বৎসর গণনা করা হয়,
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
যে বিষয়ে কোন অকাট্য দলীল বা ইজমা থাকবে না। যদি উক্ত বিষয়ে অকাট্য দলীল থাকে তবে সে দলীল ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ তথা তাবিলের পর্যায়ভুক্ত হতে হবে। এমন মতবিরোধপূর্ণ বিষয় যার ক্ষেত্রে শরীয়ত প্রণেতার উদ্দেশ্য বর্ণনা করতে যেয়ে একপক্ষ তাকে বৈধ বলেছেন অন্যপক্ষ তাকে অবৈধ বলেছেন। বিষয়টি আকীদা বা তাওহীদের মূলনীতি কিংবা কুরআন- সুন্নাহ’র মুতাশাবিহ এর অন্তর্ভূক্ত হবে না। বিষয়টি এমন সা¤প্রতিক সমস্যা যা ইতোমধ্যে সমাজে প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে বা এমন আবশ্যম্ভাবী যার শরঈ বিধান আবশ্যক।
সা¤প্রতিকতার ফিকহ তথা আধুনিক বিষয়ের ইসলামী সমাধান অতি সূ² একটি বিষয়। এ এমন এক জিজ্ঞাসা যে সম্পর্কে সরাসরি কোন বিধান বর্ণিত নেই। এ জন্য এ বিষয়ের বিধান নির্ণয়ের পূর্বে এর খুঁটিনাটি সব কিছু ভালভাবে অনুধাবন অপরিহার্য। খলিফা উমর রা. কর্র্তৃক আবু মুসা আশয়ারী রা. কে লেখা পত্রে তিনি বলেন- “নিশ্চয় বিচার-ফয়সালা একটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব যা প্রত্যেক যুগে চলে আসছে। তোমার কাছে কোন কোন মামলা আসলে তা ভালভাবে অনুধাবন করবে (অতঃপর তা কার্যকর করবে)। কেননা মৌখিক ফয়সালার কোন অর্থ হয় না, যতক্ষণ না তা কার্যকর হয়। যেসব মামলার ফয়সালা কুরআন ও হাদীসে না পাওয়া যাবে সেগুলোকে খুব গভীরভাবে অনুধাবন করবে।
আধুনিক বিষয়টি সম্পর্কে প্রাজ্ঞজনের পরামর্শ গ্রহণ করতে হবে। এ সম্পর্কে মহান আল্লাহর নির্দেশও রয়েছে: “জ্ঞানীদের কাছে জিজ্ঞেস কর যদি তোমরা না জান”। শিক্ষা ব্যবস্থার ত্রæটির কারণে বর্তমান সময়ে একজন আলিমের পক্ষে বিজ্ঞান, চিকিৎসা, ব্যবসায় সম্পর্কিত বিভিন্ন বিষয় যথার্থভাবে জানার সুযোগ নেই। এজন্যই উদ্ভ‚ত যাবতীয় বিষয় সংশ্লিষ্ট প্রাজ্ঞজনের কাছ থেকে ভালভাবে অবগত হওয়া কর্তব্য। যেমন- কেউ যদি টেস্ট টিউব বেবী, জরায়ূ ভাড়াদান, মরণোত্তর অঙ্গদান, শেয়ার মার্কেট, ব্যাংক কার্ড ইত্যাদি বিষয়ের বিধান নির্ণয় করতে চান তবে নিশ্চয় তাকে এসবের প্রক্রিয়া ও আনুষঙ্গিক সব বিষয় সংশ্লিষ্ট নির্ভরযোগ্য ও অভিজ্ঞ ব্যক্তি থেকে জানতে হবে।
বিধান নির্ণয়ের ক্ষেত্রে মুজতাহিদ যেন সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারেন তার জন্য মহান আল্লাহর সাহায্য কামনা করা অবশ্য কর্তব্য। আমরা কোনভাবেই এ আত্মিক দিককে অবহেরা করতে পারি না। মহান আল্লাহ ফিরিশতাদের ঘটনা বর্ণনা করে এ সংক্রান্ত আদব আমাদেরকে শিখিয়েছেন। নিজের অক্ষতার ক্ষেত্রে তিনি আমাদেরকে বলতে বলেছেন: “আপনার পবিত্রতা, আপনি আমাদেরকে যা শিখিয়েছেন তার চেয়ে বেশি কোন জ্ঞান আমাদের নেই। মহান আল্লাহ আরও বলেন, “বল, হে আমার প্রতিালক! আমার জ্ঞান বৃদ্ধি কর।” বিধান উদ্ভাবনের সময়ে করণীয়: সমসাময়িক সমস্যার সমাধান উদ্ভাবনের ক্ষেত্রে গবেষকের যেসব করণীয় তা হল- ক. দলীল, প্রস্তাব ও প্রেক্ষাপট বর্ণনা করা: ইমাম ইবনে কাইয়্যিম বলেন, মুফতি বা মুজতাহিদের উচিত বিধানের দলীল ও সূত্র বর্ণনা করা এবং ফাতওয়া জিজ্ঞেসকারীকে দলীলবিহীন উত্তর না দেয়া।
যেহেতু সা¤প্রতিক আবিস্কারের অধিকাংশই অমুসলিম কর্তৃক উদ্ভাবিত সেহেতু মুসলিম গবেষকের উচিত এসব বিষয়ের যে যে দিক শরীআহ’র সাথে সাংঘর্ষিক সেগুলো পরিত্যাগ করে এর বিকল্প পদ্ধতি বের করা। ইমাম ইবনে কাইয়্যিম বলেন, মুফতি বা মুজতাহিদের জন্য আবশ্যক যদি তিনি ফাতওয়া তলবকারী তা সমাধান প্রত্যাশীদেরকে কোন কাজ থেকে নিষেধ করেন অথচ বিষয়টি তার জন্য অতি জরুরী তবে তিনি তাকে বা তাদেরকে উক্ত কাজের বিকল্প পথ বলে দিবেন। যাতে উক্ত ব্যক্তির জন্য হারামের দরজা বন্ধ হয়ে যায় ও শরীআহ অনুমোদিত পদ্ধতির দরজা উন্মুক্ত থাকে।
সা¤প্রতিক জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের বিধান বর্ণনার পূর্বে ভূমিকাস্বরূপ উক্ত বিষয়ের আনুষঙ্গিক বিভিন্ন দিক আলোচনা করতে হবে, যাতে উক্ত বিষয়ের বিধান মানুষ সহজে বুঝতে পারে। যেমন মহান আল্লাহ যাকারিয়া আ. এর ঘটনা বর্ণনা করেছেন যে, বার্ধক্যের এমন পর্যায় তাঁর সন্তান হয়েছিল যে পর্যায়ে সাধারণত সন্তান হয় না। মহান আল্লাহ এ ঘটনাটি ঈসা আ. এর পিতা ছাড়া জন্ম হওয়ার ঘটনা বর্ণার পূর্বে ভূমিকাস্বরূপ উল্লেখ করেছেন। যাতে অতিশয় বৃদ্ধ দম্পতি থেকে সন্তান জন্ম নেয়ার ঘটনা বিশ্বাস করানোর মাধ্যমে পিতা ছাড়া সন্তান জন্ম হওয়ার ঘটনা বিশ্বাস করা সহজ হয়। প্রশ্নকারীর প্রশ্নের উত্তর দেয়ার সাথে সাথে সম্পূরক বিভিন্ন তথ্য প্রদান করাও মুজতাহিদের কর্তব্য। ইমাম বুখারী র. তার সহীহ বুখারীতে “মান আজাবাস সাঈল বিআকসারি মিমমা সাআলাহু আনহু” শীর্ষক একটি অধ্যায় অন্তর্ভূক্ত করে দেখিয়েছেন। মহানবী সা. অনেক প্রশ্নের জবাবের সাথে সাথে অতিরিক্ত তথ্য প্রদান করেছেন।
মাকাসিদে শরীআহ’র প্রতি দৃষ্টি রাখা : মাকাসিদে শরীআহ বলা হয়, বান্দার কল্যাণ নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে যেসব নির্দিষ্ট উদ্দেশ্যকে সামনে নিয়ে ইসলামী আইন প্রণীত হয়েছে যেসব উদ্দেশ্যকে। সা¤প্রতিক বিষয় পর্যাবেক্ষণকারী গবেষকের জন্য মাকাসিদে শরীআহ’র গুরুত্বপূর্ণ কিছু দিক এখানে উল্লেখ করা হল। ১. কল্যাণ নিশ্চিত করা। ২. কষ্ট দূরীভূত করার নীতি বাস্তবায়ন করা। ৩. ফলাফল পর্যবেক্ষণ করা।
এর দ্বারা উদ্দেশ্য গবেষক সা¤প্রতিক বিষয়ের বিধান নির্ণয়ের সময় এ সংক্রান্ত কোন গবেষণাপ্রসূত বিধান আছে কি না এবং সে বিধান পরিবর্তনের মাধ্যমে উদ্ভূত সমস্যার সমাধান সম্ভব কি না তা দেখবেন। লক্ষ করবেন স্থান-কাল-পাত্র ভেদে উক্ত বিধান পরিবর্তনযোগ্য কি না? কেননা শরীয়াতের ইজতিহাদপ্রসূত অনেক বিধান স্থান-কাল-সমাজ পরিবর্তনের কারণে পরিবর্তিত হওয়ার প্রমাণ রয়েছে। এ কারণে একই মাযহাবের মুতাক্কাদিমীন ও মুতাআখখিরীনের মধ্যে ফাতওয়ার ভিন্নতা দেখা যায়। এরই প্রেক্ষিতে ইসলামী আইনের মূলনীতি শাস্ত্রের সূত্র রয়েছে: “যুগের পরিবর্তনে বিধানের পরিবর্তন স্বীকৃতি”। আল্লামা ইবনে কাইয়্যিম তাঁর ইলামুল মুয়াক্বিয়ীনের মধ্যে শীর্ষক একটি অধ্যায় অন্তর্ভূক্ত করেছেন’’।
ফকীহগণ ইসলামী আইন নির্ণয়ের ক্ষেত্রে সামাজিক প্রথা ও প্রচলনকে গুরুত্বের সাথে মূল্যায়ন করেছেন, যার দৃষ্টান্ত অসংখ্য যেমন-রজ:স্রাব ও প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার সময়কাল, গর্ভধারণের মেয়াদ, যেসব অপবিত্রতাকে ক্ষমা করা হয়েছে, শপথ, অঙ্গীকার, অসীয়ত ইত্যাদি। ইসলামী বিধান নির্ণয়ের ক্ষেত্রে সামাজিক প্রথার গুরুত্ব প্রমাণিত হয় ফিকহী মূলনীতি ‘রীতি ও বিবেচ্য বিধান’ থেকে যা মূলত ইবনে মাসউদ রা. এর উক্তি-“মুসলমানগণ যা ভাল মনে করেন আল্লাহর কাছেও তা ভাল। আর তারা যা খারাপ মনে করেন তা আল্লাহর কাছেও খারাপ”। এর আলোকে প্রণীত। এ ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞগণ ৪টি বিশেষ শর্ত প্রদান করেছেন। ১. সামাজিক প্রথাটি ব্যাপক সমাদৃত থাকা। ২. প্রথাটি প্রচলনের শুরু থেকে অদ্যাবধি অবিকৃত অবস্থায় থাকা। ৩. উক্ত প্রথার বিপরীতে ভিন্ন কোন প্রথা চালু না থাকা। ৪. প্রথাটি শরীয়াতের স্পষ্ট বিধান বিরোধী না হওয়া। (চলবে)
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।