Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

চট্টগ্রামে প্রযুক্তির দিকে ঝুঁকছে পেশাদার সন্ত্রাসীরা

বাড়ছে সাইবার অপরাধ

রফিকুল ইসলাম সেলিম : | প্রকাশের সময় : ১৬ অক্টোবর, ২০১৭, ১২:০০ এএম

অনলাইনে পণ্য বিক্রির চটকদার বিজ্ঞাপন দিয়ে প্রতারণার মাধ্যমে অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে ছিনতাইকারী চক্র। ফেইসবুকে আকর্ষণীয় ছবি পোস্ট করে চোরাই মোটর সাইকেল বিক্রির জমজমাট ব্যবসা চোর চক্রের সদস্যদের। কয়েক মিনিটেই মোবাইল ফোন সেটের আইএমইআই (ইন্টারন্যাশনাল মোবাইল ইকুইপমেন্ট আইডিন্টিটি) বদলে দিচ্ছে ছিঁচকে পকেটমার। চট্টগ্রামে সাইবার অপরাধীদের তৎপরতা বাড়ছে। পেশাদার অপরাধীরাও ঝুঁকছে আধুনিক প্রযুক্তির দিকে। তাদের এ ডিজিটাল অপরাধ মোকাবেলায় পুলিশকে রীতিমত হিমশিম খেতে হচ্ছে।
দেশের অন্য এলাকার মতো চট্টগ্রামে সাইবার অপরাধীদের দাপট চলছে দীর্ঘদিন ধরে। ইন্টারনেট, মোবাইল, অনলাইনে নানা প্রতারণার ফাঁদ তৈরী করে নানা অপরাধ করছে সাইবার অপরাধীরা। মোবাইল ফেইসবুকে বন্ধুত্বের আহŸান, পরে প্রেমের ফাঁদ পেতে উঠতি ব্যবসায়ী ও যুবকদের নিজেদের আস্তানায় নিয়ে জিম্মি করে পণের টাকা আদায়ের ঘটনা ঘটছে প্রায়ই। তবে পেশাদার অপরাধীরাও এখন প্রযুক্তি নির্ভর অপরাধ করছে। পুলিশের চোখে ফাঁকি দিতে তারা আধুনিক তথ্য প্রযু্িক্তর মাধ্যমে অপরাধ কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। সম্প্রতি নগরীতে এধরনের অপরাধে জড়িত কয়েকটি চক্রকে পাকড়াও করে পুলিশ।
সাজ্জাদ নেওয়াজ খান (৩২) একজন পেশাদার ছিনতাইকারী। সে ও তার সহযোগীরা বিক্রয় ডটকমে দামি মোবাইল সেটসহ পণ্য বিক্রির বিজ্ঞাপন দেওয়া শুরু করে। পুলিশ জানায়, মাত্র কয়েকদিনে তারা বিজ্ঞাপন দিয়ে প্রতারণার মাধ্যমে কয়েক লাখ টাকা হাতিয়ে নেয়। তাদের প্রতারণার শিকার হয়েছে ঢাকা, সিলেট, সাভার, নওগাঁসহ বিভিন্ন এলাকার অনেক ক্রেতা। নগরীর ডবলমুরিং থানায় আবু তালেব নামে চট্টগ্রামের প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রের করা মামলায় ডিবি পুলিশ সাজ্জাদ ও তার এক সহযোগী সুমন খন্দকারকে (২২) নগরীর পাঠানটুলী থেকে গ্রেফতার করে।
জিজ্ঞাসাবাদে তারা জানায়, প্রথমে তারা বিক্রয় ডটকমে বিভিন্ন ব্রান্ডের দামি মোবাইল সেট বিক্রির বিজ্ঞাপন দেয়। লোকজন সেগুলোতে আকৃষ্ট হয়ে টাকা পরিশোধ করলে সে টাকা হাতিয়ে নেয় তারা। কিন্তু পরবর্তিতে তারা আর কোন মোবাইল ফোন ক্রেতাদের ঠিকানায় পাঠায় না। বিক্রয় ডটকমে বিভিন্ন ধরনের মোবাইল সেটের বিজ্ঞাপন দেখে ক্রেতাদের কেউ যোগাযোগ করলে তারা নিজেদের মোবাইল আমদানিকারক হিসেবে পরিচয় দেয়। এছাড়া এই চক্রটির সাথে সুমনের স্ত্রীও জড়িত। তিনি কাস্টমার কেয়ার সেন্টারের নামে লোকজনের সাথে কথা বলে প্রতারণা করেন।
ঢাকার একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের এক শিক্ষক পুলিশকে জানান, কয়েকমাস আগে অনলাইনে বিজ্ঞাপন দেখে তিনি ৪০ হাজার টাকায় একটি স্যামসাং ব্রান্ডের মোবাইল কেনার আগ্রহ প্রকাশ করেন। কয়েকদিন পর তারা ওই সেটের প্যাকেটের ভেতরে করে পুরানো একটি সেট পাঠায় তাকে। টাকা পাঠানোর আগ পর্যন্ত তাদের সাথে সুমনের যোগাযোগ হয়। পরে সুমন ফোনের ইনকামিং কল বন্ধ করে দেয়, যেন তার সাথে আর যোগাযোগ করতে না পারে। সিলেট ও বারিধারার দুই ব্যক্তি এই চক্রের প্রতারণার শিকার হয়েছেন। তারাও এদের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন বলে জানায় পুলিশ।
মোটরসাইকেল চোরচক্রের সদস্যরা অনলাইনে চোরাই মোটরসাইকেলের ব্যবসা করছে। সম্প্রতি নগরী ও জেলায় অভিযান চালিয়ে এমন একটি চক্রের কয়েকজনকে পাকড়াও করে পুলিশ। তারা প্রথমে চোরাই মোটর সাইকেলের ছবি তুলে তাদের নিজেদের ফেইসবুকে বিক্রির বিজ্ঞাপন দেয়। চক্রের সদস্যরা সবাই ওই ছবি ও বিক্রির বিজ্ঞাপন বন্ধুদের সাথে শেয়ার করে। ক্রেতারা ফেইসবুকে যোগাযোগ করে বিকাশে টাকা পরিশোধের পর ক্রেতাদের কাছে মোটরসাইকেল পৌঁছে দেওয়া হয়। এই চোরচক্রের সদস্যরা জানায়, প্রকাশ্যে কোন শো-রুমে রেখে এসব মোটর সাইকেল বিক্রি করাতে পুলিশের হাতে ধরা পড়ার ঝুঁকি থাকে। আর এজন্য তারা অনলাইনে এ হাট খুলে বসেন। গ্রেফতার হওয়ার আগে তারা অনেক মোটরসাইকেল বিক্রিও করে। অনলাইনে নগরীতে ইয়াবা বিক্রির খবরও পাওয়া গেছে। কয়েকটি চক্র পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে এ প্রক্রিয়ায় মাদক ব্যবসা করছে। নগর পুলিশের একজন কর্মকর্তা জানান, ইয়াবার হোমডেলিভারি দেওয়ার এমন তথ্য আমাদের কাছে আছে। তবে এই চক্রটিকে এখনও ধরা যায়নি। তাদের ধরতে কাজ করছে বিশেষ টিম।
এদিকে পকেটমার, চোর, ছিনতাইকারীরাও মোবাইল ফোনে আইএমইআই বদল করছে। চুরির পর পর আইএমইআই বদল করে নেওয়া ফোন সেট দিয়ে নানা অপরাধ করছে অপরাধীরা। ফলে এসব ফোন সনাক্ত করাও পুলিশের জন্য কঠিন হয়ে যায়। নগরীতে গোয়েন্দা পুলিশ, কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিট ও পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) সদস্যরা বিভিন্ন সময়ে মোবাইলের আইএমইআই পাল্টানোর কারিগরদের গ্রেফতার করে এবং বেশকিছু সেটও জব্দ করে। সর্বশেষ মহানগরী ও জেলার ফটিকছড়িতে অভিযান চালিয়ে এই চক্রের ৮ সদস্যকে পাকড়াও করে পুলিশ। তাদের কাছ থেকে উদ্ধার করা ৭০টি ফোনসেট যাদের আইএমইআই বদল করা হয়েছে। জিজ্ঞাসাবাদে তারা জানায়, পকেটমার বা ছিনতাইয়ের পর কয়েক মিনিটের মধ্যেই তারা আইএমইআই বদল করে ফেলে। সাধারণত বেশি দামি সেটের আইএমইআই পরিবর্তন করে থাকে তারা।
চট্টগ্রাম কলেজের এইচএসসি প্রথম বর্ষের এক ছাত্রী গত ২৯ মার্চ তার ব্যবহৃত আইফোন (সিক্স-এস) মোবাইল ফোন সেটটি হারিয়ে ফেলেন। তখন চকবাজার থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করা হয়। মোবাইল সেটের আইএমইআই নম্বরের সূত্র ধরে সাত মাস পর সেটটি উদ্ধার করে গোয়েন্দা পুলিশ। একটি ফোন সেটের জন্য একটি স্বতন্ত্র আইএমইআই নম্বর দেওয়া থাকে। উদ্ধারের পর দেখা যায়, সেটটি আই ফোন নয়; সাধারণ ব্রান্ডের একটি সিম্ফনি মোবাইল সেট। অভিযানে অংশ নেওয়া গোয়েন্দা পুলিশের এসআই শিবেন বিশ্বাস জানান, উদ্ধার করা সিম্ফনি ব্রান্ডের ভি-৭৫ সেটটি ব্যবহৃত হচ্ছিল আই ফোনের আইএমইআই নম্বর দিয়ে। চুরির পর পর একটি চক্র মোবাইল সেটের আইএমইআই নম্বর পরিবর্তন করে দেয়। যার কাছ থেকে সেটটি উদ্ধার করা হয় তিনি জানান, গত এপ্রিল মাসে স্টেশন রোড থেকে সাড়ে চার হাজার টাকায় সেটটি কিনেছিলেন তিনি।
নগরীতে সাইবার অপরাধ দমনে কাজ করছেন ডিবি পুলিশের এডিসি ও চট্টগ্রামে কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের প্রধান এএমএম হুমায়ুন কবির। তিনি গতকাল ইনকিলাবকে বলেন আইএমইআই পরিবর্তন করার পর ওই ফোনসেট চোরকে আর ধরা যায়না। ধরা পড়ার ভয়ে চোরের দল আইএমইআই নম্বর বদলে ফেলে। তাছাড়া পরবর্তীতে এ মোবাইল দিয়ে কোন অপরাধ করলে অপরাধীদের সনাক্ত করা কঠিন হয়ে পড়ে। অনেক চাঞ্চল্যকর মামলা তদন্ত করতে গিয়ে দেখা গেছে একই আইএমইআই নাম্বারে একাধিক ফোনসেট। অর্থাৎ অপরাধের পর ওই নাম্বার বদলে দিয়েছে তারা। সাইবার অপরাধ বাড়ছে স্বীকার করে তিনি বলেন, অপরাধীরা নিত্যনতুন কৌশল নিচ্ছে এক্ষেত্রে তারাও প্রযুক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহার করছে। তবে পুলিশ বাহিনীতেও অপরাধীদের সনাক্ত করতে নিত্যনতুন প্রযুক্তির সংযোজন করা হচ্ছে। এখন অপরাধ করে হয়তো কিছু দিন পালিয়ে থাকা যায় কিন্তু পার পাওয়ার সুযোগ অনেক কমে গেছে।
জটিল ও চাঞ্চল্যকর মামলা তদন্ত করছে পুলিশের নবগঠিত বিশেষায়িত ইউনিট পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। পিবিআই কর্মকর্তা সন্তোষ চাকমা বলেন, নিত্যনতুন প্রযুক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহার করছে অপরাধীরা। এ কারণে অপরাধীদের ধরতে অনেক বেগ পেতে হচ্ছে। একসময় মোবাইল ট্র্যাকিংয়ের মাধ্যমে অপরাধীদের অবস্থান শনাক্ত করা যেত। এখন দেখা যাচ্ছে কোন অপরাধ সংগঠনের আগে তারা একটি অনিবন্ধিত সিম ব্যবহার করছে। অপরাধের পর ওই সিম নষ্ট করে ফেলছে। তাছাড়া সিম ছাড়াও বিভিন্ন অ্যাপসের মাধ্যমে তারা নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ করছে। যার কারণে সহজে তাদের শনাক্ত করা যাচ্ছে না।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ