Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

রোহিঙ্গা শিবিরে কিছুক্ষণ

আহমদ জুবায়ের | প্রকাশের সময় : ১২ অক্টোবর, ২০১৭, ১২:০০ এএম

সারারাত বৃষ্টির পর কেবল সূর্য উঠেছে রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে। কর্দমাক্ত মাঠ। মাঠের অদূরে ঘেঁষাঘেঁষি করে আছে অনেকগুলি তাবু। তাবুগুলি রোহিঙ্গা শরণার্থীদের। লোকজনের ভিড় ক্রমশ বাড়ছে সেখানে। সাংবাদিক, পুুলিশ, সেনাবাহিনী, ত্রাণকর্মী প্রত্যেকেই আপন দায়িত্বে ব্যস্ত। একটি ছেঁড়া তাবুর বাইরে এক মা তার ছোট্ট বাচ্চাকে বুকে জড়িয়ে বসে আছেন। নির্বাক তার ভাষা। নির্লিপ্ত তার চাহনি। যেনো কোনো মানবহীন পৃথিবীতে জানোয়ারের আক্রমণে বিধ্বস্ত তিনি। কোলের বাচ্চাটি আমাদের শব্দ পেয়ে ভয়ে তার মাকে আরও শক্তভাবে জড়িয়ে ধরলো। আমরা অভয় দিলাম। কোলে নিতে চেষ্টা করলাম বহু। এলোই না। মা ইশারায় দেখিয়ে দিলেন বাচ্চাটির কর্দমাক্ত শরীরের পেছন দিকের বড়োসড়ো এক জখম। যেনো কোনো ভারী অস্ত্র দিয়ে আঘাত করা হয়েছে। অনেকক্ষণ ধরে তাকিয়ে থাকলাম। বিস্ময়ের মাত্রা ছাড়িয়ে গেলো। মানুষ এতো পাষন্ড হয় কী করে?
তিন থেকে চার বছরের একটি বাচ্চাও সন্ত্রাসীদের নির্মম নির্যাতনের শিকার। বুক ফেটে কান্না এসেছিলো। হায় মানবতা, কোথায় তুমি! এমন নির্লজ্জ, বর্বর জাতি থেকে কবে নির্যাতিত-নিপীড়িতদের রক্ষা করবে? কী অপরাধ এই অবুঝ বাচ্চাটির? কী অপরাধ এই অবলা নারীর? দোভাষীর মাধ্যমে জানতে পারলাম, শিশুটির পিতাকে আরাকান দস্যুরা নির্মমভাবে গুলি করে মেরেছে। বাড়িঘর জ্বালিয়ে দিয়েছে। অসহ্য নির্যাতন করেছে। অবশেষে বাঁচার তাগিদে ছয়-সাতদিনের দীর্ঘপথ পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে এসেছে। কী কারণে তাদেরকে তাদের পৈত্রিক ভিটে থেকে বিতাড়িত করা হলো? অপরাধ কি মুসলমান হওয়া, না অন্যকিছু! মিয়ানমারের সেনাবাহিনী জানিয়েছে, সন্ত্রাসদমনে তারা মুসলিমনিধন নয়, জঙ্গিনিধন করছে। তাহলে এই নারী ও শিশুদের অপরাধ কী? তারা নিশ্চয়ই জঙ্গি নয়। তাদের প্রতি এই অমানবিক আচরণ কেনো তাহলে?
এদিকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় নারী ধর্ষণের যথেষ্ট আলামত পেয়েছে। শিশু নির্যাতনের খোঁজ পেয়েছে। কিন্তু জোরালো তেমন কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না। মিয়ানমার সরকার বলছে, ‘রাখাইনরাজ্যের নাগরিকদের ওপর নির্যাতনের সংবাদ সঠিক নয়, মিথ্যে গুজব।’ তাহলে কোন সুখে লাখো রোহিঙ্গা নিজের ভিটেমাটি ছেড়ে বাংলাদেশে আসছেন! ধর্ম নিয়ে কোনো বিতর্ক নয়। ধর্ম বিতর্ক করার জিনিসও নয়। তারপরও একটি জিনিস বারবার অন্তরে খোঁচা দিচ্ছে। বুদ্ধদেব জীবনভর যে বাণী প্রচার করে গেছেন, তার মাঝে অহিংসা পরম ধর্ম, জীবহত্যা মহাপাপ ইত্যাদি উক্তি কালজয়ী হয়ে আছে। প্রশ্ন হলো, রোহিঙ্গারা কি তাহলে জীবের বাইরের কিছু? নাকি বুদ্ধদেবের এ বাণী তাদের জন্য নয়?
আমরা বিশ^াস করি, ধার্মিক ব্যক্তি কখনও সন্ত্রাসী হতে পারে না। কারণ ধর্ম ও সন্ত্রাসের মাঝে রাতদিনের ফারাক। কোনো ধর্মই তার অনুসারীদের সন্ত্রাসী কর্মকান্ডে উৎসাহ দেয় না। পবিত্র কোরানে বলা হয়েছে, ‘যে ব্যক্তি প্রাণের বিনিময়ে প্রাণ অথবা পৃথিবীতে অনর্থ সৃষ্টি করা ছাড়া কাউকে হত্যা করে, সে যেনো সব মানুষকেই হত্যা করলো। আর যে কারোর জীবন রক্ষা করে, সে যেনো সবার জীবন রক্ষা করলো।’ (সুরা মায়িদা: ৩৩)। তাছাড়া মানবতার নবী (সা.) বিদায়হজের ভাষণে বলেছেন, ‘সাবধান! ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি কোরো না। যার যার ধর্ম সে সে পালন করবে।’ আরও বলেছেন, ‘কাউকে অন্যায়ভাবে হত্যা করবে না।’
রোহিঙ্গা নির্যাতনের প্রতিবাদে ইতোমধ্যেই বিশে^র বিভিন্ন দেশ, জাতি, সংগঠন, প্রতিষ্ঠান থেকে প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে। এরপরও রোহিঙ্গা মুসলমানরা নির্যাতিত হয়ে পালিয়ে আসছে নাফনদী পেরিয়ে। বিভিন্ন গণমাধ্যমই এর বড় সাক্ষী। এই হত্যাযজ্ঞ মানবতাহীন কাজের নিন্দাসহ কার্যকর স্থায়ী পদক্ষেপ নেয়া দরকার। মধ্যযুগীয় বর্বরতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো প্রয়োজন।
লেখক : শিক্ষার্থী



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন