Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

বাংলাদেশে ফের রোহিঙ্গাদের ঢল নামার আশঙ্কা জাতিসংঘের

রাখাইনে বাড়িঘর এখনও পুড়ছে

| প্রকাশের সময় : ৭ অক্টোবর, ২০১৭, ১২:০০ এএম

ইনকিলাব ডেস্ক : মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ অব্যাহত রয়েছে। মংডুতে গত ২৪ ঘণ্টায় রোহিঙ্গা মুসলমানদের কয়েকটি বাড়িতে আগুন দেওয়া হয়েছে।
মংডু থেকে বিবিসির বর্মী বিভাগের সাংবাদিক জানিয়েছেন, গতকাল (শুক্রবার) দুপুরে রোহিঙ্গাদের আটটি ঘরে অগ্নিসংযোগ করা হয়। এর মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগে বৃহস্পতিবার রাতেও আরো ১৫টি বাড়িতে আগুন দেওয়া হয়। কর্তৃপক্ষ বলছে, এ দুটো অগ্নিকাÐে কোন হতাহতের ঘটনা ঘটেনি, কারণ সেসময় এই বাড়িগুলো জনশূন্য ছিলো। সরকারের জারি করা কারফিউ’র মধ্যেই এসব বাড়িতে অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটলো। নির্যাতনের কারণে দেশটিতে বহু রোহিঙ্গা ঘরবাড়ি ছাড়া হয়েছে। অনেকের বাড়িঘর আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। গত কয়েক সপ্তাহে বাংলাদেশেই পালিয়ে এসেছে পাঁচ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা।
বাংলাদেশের কর্মকর্তারা বলছেন, মাঝখানে রোহিঙ্গাদের আসা কিছুটা কমে গেলেও স¤প্রতি তাদের আসা আবার বেড়ে গেছে। কক্সবাজারের কর্মকর্তারা বলেছেন, দিনে দুই থেকে তিন হাজারের মতো রোহিঙ্গা সীমান্ত পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে আসছে। গতকাল দুপুরে মংডুর নর্থ মিওমা ওয়ার্ড এলাকার আটটি বাড়িতে আগুন দেওয়া হয়। বলা হচ্ছে, এই এলাকায় রোহিঙ্গা মুসলমান এবং বৌদ্ধরা একসাথে বসবাস করেন।
মংডুতে ফায়ার সার্ভিস বলছে, কারা আগুন লাগিয়েছে সে বিষয়ে এখনও পর্যন্ত কিছু জানা যায়নি। তবে এ বিষয়ে তদন্ত চলছে। গত বৃহস্পতিবার রাতেও মংডুর তিন নম্বর ওয়ার্ডে রোহিঙ্গাদের ১৫টি বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করা হয়। এসব বাড়িঘরেও কেউ ছিলো না বলে বিবিসির বর্মী বিভাগের সংবাদদাতা বলছেন। এই এলাকায় শুধু রোহিঙ্গা মুসলমানদেরই বসতি বলে জানা গেছে।
ফায়ার সার্ভিস বলছে, বৃহস্পতিবার রাতে আগুন নেভাতে তাদের তিন ঘণ্টার মতো সময় লাগে। কর্মকর্তারা বলেন, পরে প্রবল বৃষ্টির কারণে আগুন নিভে গেছে।
স্থানীয় কর্তৃপক্ষ বলছে, কীভাবে এই আগুন লেগেছে তারা তার কারণ খুঁজে দেখার চেষ্টা করছেন। মিয়ানমারে সেভেন ডে নিউজ নামের একটি সংবাদ সংস্থার ফেসবুকে বৃহস্পতিবারের অগ্নিকাÐের কিছু ছবি প্রকাশ করা হয়েছে যাতে দেখা যাচ্ছে সেখানে বাঁশ ও বেড়া দিয়ে তৈরি বেশ কয়েকটি বাড়িঘর আগুনে পুড়ে শেষ হয়ে গেছে। মংডু সরকারের কঠোর নিয়ন্ত্রণের মধ্যেই রয়েছে- মিয়ানমার সরকারের এই দবির মধ্যেই এ-দুটো অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটলো। বিবিসির সংবাদদাতা বলছেন, এর ফলে এখনও মংডুতে যেসব মুসলিম রোহিঙ্গা রয়ে গেছে তাদের মধ্যে আতঙ্কের সৃষ্টি হয়েছে।
বাংলাদেশে ফের রোহিঙ্গাদের ঢল নামার আশঙ্কা জাতিসংঘের
এদিকে মিয়ানমার থেকে নতুন করে বাংলাদেশমুখী রোহিঙ্গাদের ঢল নামার আশঙ্কা প্রকাশ করেছে জাতিসংঘ। গতকাল জাতিসংঘের মানবিক সহায়তা বিভাগের প্রধান ও জরুরি ত্রাণ সমন্বয়ক মার্ক লোকক এ আশঙ্কার কথা জানান। একইসঙ্গে তিনি বিদ্যমান পরিস্থিতিকে ‘অগ্রহণযোগ্য’ বলে মন্তব্য করেন। জেনেভায় এক সংবাদ সম্মেলনে এ বিষয়ে কথা বলেন মার্ক লোকক। তিনি বলেন, মিয়ানমারে এখনও কয়েক লাখ রোহিঙ্গা রয়ে গেছেন। আবারও তাদের ঢল নামলে উদ্ভূত পরিস্থিতি মোকাবিলায় আমরা প্রস্তুত থাকতে চাই।
চলতি বছরের ২৫ সেপ্টেম্বর মিয়ানমারে রোহিঙ্গা নিধন শুরুর পর প্রায় সাড়ে পাঁচ লাখ মানুষ বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে। মিয়ানমার এখনও জোর দিয়ে বলেছে, ‘সন্ত্রাসীদের’ বিরুদ্ধে বর্মি সেনাবাহিনী লড়াই চালিয়ে যাবে। রোহিঙ্গাদের নিজেদের ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেওয়ার জন্য উল্টো রোহিঙ্গাদেরই দায়ী করছে সেনাবাহিনী।
রোহিঙ্গা নিধনে আন্তর্জাতিক স¤প্রদায়ের নিন্দা ও প্রতিবাদের মুখেই রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে দেশবাসীকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহŸান জানান মিয়ানমারের সেনাপ্রধান জেনারেল মিন অং হ্লাইং। নিজের ফেসবুক পেজে দেওয়া এক পোস্টে তিনি বলেন, ‘তারা রোহিঙ্গা হিসেবে স্বীকৃতি চাইছে। কিন্তু তারা কখনোই মিয়ানমারের জাতিগত গোষ্ঠী নয়। আর আমাদের এই সত্য প্রতিষ্ঠায় এক হওয়া উচিত’।
ফরাসি বার্তা সংস্থা এএফপি’র অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, এখনও রাখাইনে থেকে যাওয়া রোহিঙ্গাদের তাড়িয়ে দিতে নতুন করে দ্বিগুণ শক্তিতে অভিযান শুরু করেছে মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনী। জাতিসংঘের আশঙ্কা, বাংলাদেশে ইতোমধ্যেই থাকা ৯ লাখ রোহিঙ্গার সঙ্গে সেখানকার অবশিষ্ট ৩ লাখ রোহিঙ্গা যুক্ত হয়ে রোহিঙ্গাদের সংখ্যা ১২ লাখে দাঁড়াবে।
মিয়ানমার স¤প্রতি রোহিঙ্গাদের ফেরত নেয়ার ঘোষণা দিলেও পালিয়ে আসা শরণার্থীরা বলছেন, পশ্চিম রাখাইনে থেকে যাওয়া অবশিষ্ট রোহিঙ্গাকে দেশছাড়া করতে মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনী ফের তাÐব শুরু করেছে। তাদের তাড়িয়ে দিতে দেশটির নিরাপত্তা বাহিনী অভিযান দ্বিগুণ জোরদার করা হয়েছে। পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা বলছেন, প্রতিদিন বাংলাদেশের সীমান্তে ছুটছে হাজার হাজার মানুষ। বহু গ্রাম এখন একেবারেই জনমানবশূন্য।
বাংলাদেশে পাঁচ সপ্তাহে প্রায় সাড়ে ৫ লাখ রোহিঙ্গা আশ্রয় নেওয়ার পর কয়েকদিন ঢল কিছুটা থেমেছিল। তবে গত কয়েকদিনে তা আবারও বেড়েছে। এখন প্রতিদিন ৪ হাজার থেকে ৫ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আসছে।
পালিয়ে বাংলাদেশে এসেছেন মংডুর বাসিন্দা রাশিদা বেগম। তিনি বলেন, ‘স্থানীয়রা আমাদের কয়েক সপ্তাহে ধরে বলছিল যে, আমরা সেখানে থাকলে তারা নিরাপত্তা দেবে। কিন্তু এরপর সেনারা এসে ঘরে ঘরে তল্লাশি শুরু করে। তারা আমাদের চলে যাওয়ার নির্দেশ দেয়।’ তিনি বলেন, ‘স্থানীয়রা আশ্বাস দিয়েছিল, তারা আমাদের কোনো ক্ষতি করবে না। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আমাদের ঘর থেকে বের করে দিয়ে বাড়িতে আগুন দেয়।’ হাসিনা খাতুন নামের আরেক পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা নারী বলেন, ‘স্থানীয়রা আমাদের বলেছিল, বাংলাদেশে যেও না। সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে। আমরা তাদের বিশ্বাস করেছিলাম। আমি গ্রামেই থাকতে চেয়েছিলাম। কিন্তু পরিস্থিতির কোনও উন্নতি হয়নি। শেষ পর্যন্ত আমাদের চলে আসতে হল।’
ফজলুল হক নামে স্থানীয় একজন কাউন্সিলর জানান, সেপ্টেম্বরের শেষ দিকে নৌকাবোঝাই মানুষের আসা প্রায় বন্ধ হয়ে গেলেও স¤প্রতি আবার তা জোরালো হয়েছে। পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা সেনাবাহিনীর নির্যাতন ও বলপ্রয়োগের অভিযোগ করেছেন। গ্রাম খালি করার জন্য সেনাবাহিনীর নির্দেশ পাওয়ার পর গত রোববার বাংলাদেশে আসেন নুরুল আমিন। তিনি বলেন, সাপের মতো একেবেঁকে এক সারি রোহিঙ্গাকে তিনি উপকূলের দিকে যেতে দেখেছেন। তিনি বলেন, ‘আমরা যখন গ্রাম ছাড়ি, চারদিক থেকে গ্রামবাসীরা এসে আমাদের সঙ্গে যোগ দিল।’
এএফপি’র প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সেনাবাহিনী এখন আর কাউকে হত্যা করছে না, শুধুমাত্র বাড়িঘর জ্বালিয়ে দিচ্ছে। বাংলাদেশ সীমান্ত থেকে বাড়িঘরে আগুনের কালো ধোঁয়া দেখা যাচ্ছে।
জাতিসংঘের মঙ্গলবারের তথ্য অনুযায়ী, ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশে ৫ লাখ ৯ হাজার রোহিঙ্গা প্রবেশ করেছে। সংস্থাটির আবাসিক সমন্বয়কারী রবার্ট ওয়াকিনস বলেন, ‘কক্সবাজারে থাকা রোহিঙ্গারা খুবই নাজুক অবস্থায় আছে। তাদের অনেকেই এখন সেই বিভীষিকা কাটিয়ে উঠতে পারেনি। তাদের বসবাসও করতে হচ্ছে অনেক মানবেতর পরিস্থিতিতে। আমাদের লক্ষ্য ১২ লাখ রোহিঙ্গার মানবিক সহায়তা নিশ্চিতের জন্য প্রস্তুত থাকা। কারণ ইতোমধ্যে ৮ লাখের বেশি রোহিঙ্গা অবস্থান করছে বাংলাদেশে। আর আগামী ৬ মাসে আরও ৩ লাখ রোহিঙ্গার বাংলাদেশে প্রবেশের সম্ভাবনা রয়েছে।’
বাংলাদেশে ও ত্রাণ সংস্থাগুলো এই বিশাল সংখ্যক রোহিঙ্গাকে সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে। সহায়তায় এগিয়ে এসেছে জাতিসংঘ, ইউনিসেফসহ বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক সংস্থা। রোহিঙ্গাদের উপর এই নির্যাতনকে জাতিগত নিধনের ‘পাঠ্যপুস্তকীয় উদাহরণ’ হিসেবে উল্লেখ করেছে জাতিসংঘ। তবে মিয়ানমার বরাবরই এই অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে। সূত্র : বিবিসি, এএফপি ও রয়টার্স।



 

Show all comments
  • Ahmad Anam ৭ অক্টোবর, ২০১৭, ৪:৪৮ পিএম says : 0
    জাতিসংঘ কি এটা বুঝাতে চাচ্ছে যে, তারা মায়ানমার সেনাদের কাছে অতিদূর্বল?
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ