Inqilab Logo

শুক্রবার ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৫ আশ্বিন ১৪৩১, ১৬ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬ হিজরী

রাষ্ট্র ও রাজনীতিতে ধর্মের অবিভাজ্যতা

মো. আবদুল লতিফ নেজামী | প্রকাশের সময় : ৫ অক্টোবর, ২০১৭, ১২:০০ এএম

মহামান্য প্রেসিডেন্ট মো. আবদুল হামিদ দুর্গাপূজা উপলক্ষে শনিবার রাজধানী ঢাকার বনানী পূজামÐপে প্রদত্ত বক্তৃতায় অনেক কথার মধ্যে বলেছেন, ‘বিশ^কে ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র গঠনের ধারণা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। অতীতে ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্রকে কেন্দ্র করে জাতিতে জাতিতে বহু সংঘাত হয়েছে, যুদ্ধ হয়েছে। ধর্মের নামে মনুষ্যত্ব, ভ্রাতৃত্ববোধ, সহমর্মিতা ভূলুন্ঠিত হয়েছে।’ তিনি আরো বলেন, ‘কোনো ধর্ম নয়, বরং ধর্মনিরপেক্ষতা হবে একটি জাতি ও দেশ গঠনের ভিত্তি’ প্রভৃতি।
মহামান্য প্রেসিডেন্ড প্রথমেই বলেছেন যে, ‘বিশ^কে ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র গঠনের ধারণা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে’। ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র গঠনের ধারণা থেকে বেরিয়ে আসার যে পরামর্শ তিনি দিয়েছেন উক্ত অনুষ্ঠানে, তা কি ঠিক? রাষ্ট্র ও রাজনীতিতে ধর্মের অবিভাজ্যতা অস্বীকার করার কোন সুযোগ আছে কি? রাজনীতিতে ধর্মের প্রযোজ্যতা ঐতিহাসিক ও ঐতিহ্যিক নয় কি? রাষ্ট্র ও রাজনীতিতে ধর্মের অন্তর্ভুক্তি ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় প্রমাণিত, শাশ্বত ও জীবন্ত। রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও ধর্মীয় নেতৃত্বের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের উপস্থিতি সব সময়ই লক্ষ করা যায়। তাই মুসলিম জনসংখ্যা অধ্যুষিত বাংলাদেশে ধর্মরিপেক্ষতা নয়, বরং ধর্মীয়করণ করে এদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ভাবলোক ও ভাবাদর্শের প্রতিধ্বনিত করা অপরিহার্য হয়ে উঠেছে।
মুসলিম-অমুসলিম অনেক দেশে রাষ্ট্রধর্ম রয়েছে। আলজেরিয়া, বাহরাইন, ব্রæনেই, কমোরস, মিসর, ইরাক, জর্ডান, কুয়েত, লিবিয়া, মালয়েশিয়া, মালদ্বীপ, মরক্কো, ওমান, কাতার, সোমালিয়া ও তিউনিসিয়ায় ইসলাম রাষ্ট্র ধর্ম। ইউরোপের অধিকাংশ দেশেই খ্রিস্টধর্ম রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে স্বীকৃত। পোল্যান্ড, আয়ারল্যান্ড, ইতালী ও স্পেনে প্রধান ধর্ম রোমান ক্যাথলিক। ডেনমার্ক, জার্মানি, সুইডেন ও ফিনল্যান্ডে লুথেরান ধর্ম প্রাধান্য পায়। আর্জেন্টিনা, কোস্টারিকা, মাল্টা, মেনাকো, সুইজাল্যান্ডের কিছু ক্যান্টন ও ভাটিকান সিটির রাষ্ট্রধর্ম রোমান ক্যাথলিক। সাইপ্রাস ও গ্রিসে ইস্টার্ন অর্থডক্স চার্চকে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে অনুমোদন দেয়া হয়েছে। অ্যান্ডোরা, ডোমিনিকান রিপাবলিক, এল সালভেদর, প্যারাগুয়ে, পেরু, পর্তুগাল ও ¯েøাভাকিয়ার সংবিধানে ক্যাথলিক ধর্মকে বিশেষভাবে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। আর্মেনিয়ায় অ্যাপোস্টালিক চার্চ রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে স্বীকৃত। ইহুদি ধর্মই ইসরাইলের চালিকা শক্তি। বিশে^র একমাত্র হিন্দু রাষ্ট্র নেপাল।
রাষ্ট্র ও রাজনীতিতে ধর্মের অবিভাজ্যতা এবং রাজনৈতিক ও ধর্মীয় নেতৃত্বের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের উপস্থিতি অন্যান্য দেশেও লক্ষ করা যায়। বিশ্বের বৃহৎ গণতান্ত্রিক দেশ ভারতে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি), শিবসেনা, আকালী দল, বজরং, হিন্দু মহাসভা, বিশ্ব হিন্দু পরিষদ, মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলামী, জমিয়তে উলামায়ে হিন্দ প্রভৃতি ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলের অস্তিত্ব বিদ্যমান। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ক্রিশ্চিয়ান কোয়ালিশন, ক্রিশ্চিয়ান কোয়ালিশন অব ফ্লোরিডা ও ক্রিশ্চিয়ান ক্যালেঞ্জিস্ট পার্টি অব আমেরিকা, জার্মানিতে ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্রেটিক ইউনিয়ন ও ক্রিশ্চিয়ান সোস্যাল ইউনিয়ন, নিউজিল্যান্ডে ক্রিশ্চিয়ান হেরিটেজ অব নিউজিল্যান্ড ও ক্রিশ্চিয়ান কোয়ালিশন অব নিউজিল্যান্ড, রাশিয়ায় ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্র্যাটস, অস্ট্রেলিয়ায় ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্রেটিক পার্টি, বেলজিয়ামে ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্রেটিক এন্ড ফ্লেযিশ পার্টি, কানাডায় ক্রিশ্চিয়ান হেরিটেজ পার্টি, বেলারুশে কনজারভেটিভ ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্রেটিক পার্টিসহ প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের বিভিন্ন দেশে ধর্মভিত্তিক রাজনেতিক দল আছে।
সব দেশেই সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের ধর্মীয় বিশ^াস ও মূল্যবোধ এবং সাংস্কৃতিক চেতনাকে গুরুত্ব দেয়া হয়। মুসলিম অমুসলিম অনেক দেশে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে স্বীকৃত। জনগণের অনুভূতির কথা বিবেচনা করে সকল দেশেই ধর্মভিত্তিক রাজনীতিসহ অনেক ধর্মীয় মূল্যবোধকেও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার মধ্যে আনা হয়।
‘অতীতে ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্রকে কেন্দ্র করে জাতিতে জাতিতে বহু সংঘাত হয়েছে, যুদ্ধ হয়েছে’ বলে প্রদত্ত বক্তব্যও সঠিক নয়। ইসলামভিত্তিক ধর্মীয় রাষ্ট্র গঠনের পর ডাকাতের তলোয়ার কোষবদ্ধ ও দুর্ধর্ষ খুনিরা পরিণত হয় ইনসানিয়াতের মুহাফিজে। ধর্মভিত্তিক ইসলামী রাষ্ট্র সংঘাত নয়, বরং মজলুম মানবতার রক্ষা কবচ, নির্যাতিতদের সুরক্ষায় তীব্র ভাষা, অসহায়ের নিরাপত্তা, বঞ্চিতদের অধিকার। ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র ইজ্জতের গ্যারান্টি ও শান্তির হাতিয়ার।
ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র গঠনের আগে বিশ্ব সভ্যতা মুখ থুবড়ে পড়েছিল। ধুমড়ে-মুচড়ে যাচ্ছিল মানবতা, মানবাধিকার। ভেসে আসতো বৈষম্যের শিকার মজলুমদের আর্তচিৎকার, আঘাত হানতো আকাশের দ্বারে উৎপীড়িতদের আহাজারী এবং ধ্বনিত হতো ক্রন্দনরোল। শুরু হয়েছিল বিশ্বের সর্বত্র নৈতিক অবক্ষয়। অশ্লীলতা ছড়িয়ে পড়েছিল এবং নগ্নাশ্রয়ী অপসংস্কৃতির পথ প্রশস্ত হয়েছিল। অপসংস্কৃতির দূষিত জোয়ারে শুধু সুস্থ সংস্কৃতিই ধ্বংস নয়, ভেসে গিয়েছিল চিরায়ত মূল্যবোধ, ধ্যান-ধারণা, চরিত্র, ধর্ম ও আদর্শ। বিপন্ন হয়ে পড়েছিল নৈতিক মেরুদÐ। মানুষ পঙ্গুত্ব বরণ করেছিল মন-মননে, নীতি-নৈতিকতায় ও চিন্তা-চেতনায়। ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র গঠনের পরই সকল মানুষের ব্যক্তিগত ও ধর্মীয় স্বাধীনতাসহ সামগ্রিক নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়। ফেতনা-ফাসাদ ও অত্যাচার-নির্যাতন দূর করে ইনসাফ ভিত্তিক দ্বীন প্রতিষ্ঠাই ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র গঠনের উদ্দেশ্য।
ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র সংঘাত নয়, বরং ইসলাম সার্বজনীন সাম্য, মৈত্রী ও স্বাধীনতার ধর্ম। মানবিকতা ও কল্যাণের ধর্ম। পৃথিবীর প্রথম মৌলিক মানবাধিকার চুক্তি বলে খ্যাত মদিনা সনদে অমুসলিদের জানমালের পূর্ণ নিরাপত্তা প্রদান করা হয়েছে। ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্রে সংঘাত আবিষ্কার মুসলমানদের জঙ্গী হিসেবে চিহ্নিত করা। ধর্মভিত্তি রাষ্ট্রের অপ্রতিহত প্রভাব থেকে জনগণকে বিচ্ছিন্ন করা এবং ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্রের প্রতি জনগণকে শত্রæভাবাপন্ন করে তোলা। কারণ ধর্মের প্রভাব জনগণের ওপর অপরিসীম। অন্য কোনো ধর্মীয় সমাজের মানুষের, অন্য কোনো ভাষাভাষী মানুষের, অন্য কোনো এলাকার মানুষের, এমনকি কোনো ধর্মে বিশ্বাসী নন এমন কোনো মানুষের মানবাধিকার পরমাণু পরিমাণ লঙ্ঘন করার বা কেড়ে নেয়ার সুযোগ ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্রে নেই। অতএব, ইসলামের মৌলনীতি অনুসরণ করে ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্রের পক্ষে সা¤প্রদায়িক হওয়ার এবং মানবিকতাবোধের পরিপন্থী কিছু করার কোনো কোনো উপায় নেই।
ধর্মের নামে মনুষ্যত্ব, ভ্রাতৃত্ববোধ, সহমর্মিতা ভূলুন্ঠিত হয়েছে, বলে মহামান্য রাষ্ট্রপতি যে উক্তি করেছেন, তা মোটেও গ্রহণযোগ্য নয়। কেননা, ইসলাম ধর্মই কেবল মানুষের সুকুমার বৃত্তির বিকাশ, নৈতিক উৎকর্ষ সৃষ্টি, সৃজনশীল প্রতিভার উন্মেষ, স্বশিক্ষিত ও মার্জিত করে তোলার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। ইসলাম ধর্ম মানুষের চেতনাকে শাণিত, কর্তব্যবোধে উজ্জীবিত, দীপ্ত পথে বলিয়ান ও উদ্দিপ্ত করতে সহায়তা করে আসছে। ভূমিকা রাখছে চিন্তা-ভাবনার জগতে বিরাজমান নৈরাজ্যের উন্নতি ঘটাতে, উন্নত মানবিক জীবন ও সমাজের মনোভূমিতে শৃংখলা আনতে। ইসলাম মানুষের অন্তরে পারস্পরিক ভালোবাসা, সাম্য ও মৈত্রীর অনুভূতি স্বতঃস্ফুর্তভাবেই জাগ্রত করে। মানুষের মনে ন্যায়বোধ, কর্তব্যপরায়নতা, শৃংখলা, শিষ্টাচারবোধ, মানবাধিকার, জীবন-যাপনের মানসিকতা, সৌহার্দ্যবোধ, অধ্যবসায় ইত্যাদি নৈতিক ও আত্মিক গুণাবলী অর্জনে সহায়তা করে। মানুষকে সংস্কৃতিমনস্ক করা ও কুসংস্কারমুক্ত মানুষ হিসেবে গড়ে উঠতে উৎসাহিত করার ক্ষেত্রে ইসলামের অবদান অনস্বীকার্য। শুধু ইসলামই পারে বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে, ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য দূর করতে এবং সকলকে ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ করতে।
‘একটি অশুভ মহল ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার অপচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে’ বলে প্রেসিডেন্ট যে উক্তি করেছেন, তা কি ঠিক? কেননা, বিশ^ব্যাপী ধর্মনিরপেক্ষবাদীদের ব্যর্থতা ইসলাম ধর্মপন্থীদের গ্রহণযোগ্যতা বাড়িয়ে দিয়েছে। বিশ^ায়িত ও পরস্পর সম্পর্কযুক্ত পৃথিবীতে বর্তমান শাসন ব্যবস্থা দুর্বল হয়ে পড়ায় ইসলামের দিকে ফেরার তাড়া দেখা দিয়েছে এবং ইসলামকে বিশ^ ব্যবস্থার চালকের আসনে বসানোর জন্যে প্রয়াস চালানো হচ্ছে। কারণ, একমাত্র ইসলাম ধর্ম বিশ^াসের আওতায়ই সমতাবাদী সমাজের ধারণা সৃষ্টি হতে পেরেছে। তাছাড়া ইসলামে অস্পৃশ্যতার স্থান নেই।
ইসলাম ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা বিশ^ব্যাপী অতুলনীয় প্রশংসার অধিকারী। মুসলমানদের জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ইতিহাস-ঐতিহ্য, সাহিত্য-সংস্কৃতি, দর্শন-বিজ্ঞান, প্রভৃতি এতো উৎকৃষ্ট যে, তার উত্তরাধিকত্ব অর্জন পৃথিবীর যেকোন জনগোষ্ঠির পক্ষেই শ্লাঘার বিষয়। মুসলমানদের ইসলাম ধর্ম ভিত্তিক শাসন-ব্যবস্থা এতো উন্নত ছিল যে, তা রোমান ও ব্রিটিশ-শাসন ব্যবস্থাকেও হার মানিয়েছে। ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী ও সমাজতন্ত্রীদের সর্বাত্মক বিরোধিতা সত্তে¡ও নানা তন্ত্র-মন্ত্র, মতবাদ, ইজম-বিভ্রান্ত মানুষ এখন ইসলামের দিকে হন্যে হয়ে ছুটতে শুরু করেছে। ইসলামের শাশ^ত নীতি, আদর্শ ও মূল্যবোধের চেতনা নতুন করে সঞ্জীবিত করার প্রেরণা যোগাচ্ছে। ইসলামী আদর্শিক চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে মানুষ বলিষ্ঠ পদক্ষেপে ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র গঠনের দিকে এগিয়ে আসছে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশেও অনেক বিধর্মী ইসলামের তৌহিদবাদের দিকে অগ্রসর হচ্ছে।
ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র গঠনের ধারা চর্চা করা একটি গণতান্ত্রিক দায়। কেননা গণতন্ত্রের দায় হচ্ছে সমাজের নানা মতের প্রকাশের সুযোগকে অবারিত করা। সমাজের সকল মত ও পথের মানুষের মনের কথা প্রকাশ করতে পারলেই গণতন্ত্র একটি সফল প্রক্রিয়া হয়ে উঠে। ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্রীদের ব্যর্থতায় জনগণের কাছে ইসলামপন্থীদের গ্রহণযোগ্যতা ক্রমশঃ বাড়ছে। ইসলামী নীতি ও আদর্শের সাথে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের বড় রকমের তফাৎ নেই। ইসলামী ঐতিহ্যের মধ্যেও শুরা (পরামর্শ), ইজমা (পারস্পরিক সম্মতি), হিজবের (দল) চর্চা রয়েছে। ইসলামের সাথে পশ্চিমা গণতন্ত্রের তফাৎ হচ্ছে সার্বভৌমত্বের ধারণাকে কেন্দ্র করে। ইসলাম আল্লাহর সার্বভৌমত্বকে জনগণকে সাথে নিয়ে প্রয়োগ করতে চায়। আর প্রচলিত গণতন্ত্র জনগণের সার্বভৌমত্বকে প্রাধান্য দেয়। ধর্মীয় রাজনীতি চালু হওয়ার কারণে বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক সঙ্ঘাত সৃষ্টির নজির নেই।
প্রেসিডেন্টের মতে, ‘কোনো ধর্ম নয়, বরং ধর্মনিরপেক্ষতা হবে একটি জাতি ও দেশ গঠনের ভিত্তি’। কিন্তু মানুষের মধ্যে ধর্মীয় বিশ্বাসই সমাজ, মনবিকতা, সততা, নৈতিকতা, মানবিকতা, সাম্য, সুস্থ জীবনবোধ ও সহাবস্থানবোধ তৈরি করে। ধর্ম বিশেষ করে ইসলাম ধর্ম ধারণ, চর্চা ও অনুশীলনের মাধ্যমে সততায়, নৈতিকতায়, মানবিকতায়, গঠনমূলক চিন্তা-ভাবনায়, দূরদর্শিতায়, ঔদার্যবোধে ও মহত্বে উদ্বুদ্ধ করতে মর্যাদাপূর্ণ জীবন-যাপনের সুযোগ সৃষ্টিতে সাহায্য করে। এদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ইতিহাস ও ধর্মীয় সংস্কৃতির পরম্পরা এবং এই পরম্পরাভিত্তিক সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের সাংস্কৃতিক জাতিসত্ত¡ার লালন ও চর্চা একান্ত কাম্য। কিন্তু পরিকল্পনা অনুযায়ী শিকড় থেকে ক্রমশঃ আমাদেরকে বিচ্ছিন্ন ও উন্মুল করে দেয়ার নানা চক্রান্ত করা হচ্ছে। মুসলমানদের হানাহানি ও রক্তাক্ত বিভাজনে এবং চরম নৃশংসতায় লিপ্ত করানো হচ্ছে। মুসলমানদের ভাস্কর্যের নামে পৌত্তলিকতায় অভ্যস্ত করানো হচ্ছে। মুসলমানদের মধ্যে বিকৃতি, বিচ্যুতি ও স্খলন ঘটানো হচ্ছে। এখন আমাদেরকে শিকড় খুঁজতে বাধ্য করা হচ্ছে প্রতিবেশী সংখ্যালঘিষ্ট সমাজের ইতিহাস, ধর্মীয় সংস্কৃতি এবং সাংস্কৃতিক জাতিসত্তার মধ্যে।
বাংলাদেশি জাতিসত্ত¡ার মর্মমূলে রয়েছে ধর্ম। ধর্মই আমাদের জাতিসত্ত¡ার অস্তিত্বের শর্ত এবং স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের গ্যারান্টি। ধর্ম ছাড়া আমাদের জাতিসত্ত¡ার সবল ও সফল অস্তিত্ব নির্মাণ সম্ভব নয়। স্বাধীন রাষ্ট্রীয় ভূখÐভিত্তিক বাংলাদেশি চেতনা এবং জীবনভিত্তিক ধর্মীয় চেতনা ও দৃষ্টিভঙ্গী ৯০ ভাগ মানুষের অস্তিত্বের ভিত্তি-শর্ত তৈরি করেছে। আমাদের অস্তিত্ব স্বাধীন মর্যাাদা, আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার, ঐক্য, শক্তি, সৃজনশীলতা, শৃংখলা, কর্মপন্থা, সমষ্টিক উদ্যোগ, সামগ্রিক কল্যাণ এবং ভবিষ্যৎ সবকিছুই ধর্মীয় সংস্কৃতি ও ধর্মভিত্তিক জাতিসত্ত¡ার পরিপূর্ণ বিকাশের ওপর নির্ভরশীল।
আজকের পৃথিবীতে রাষ্ট্রীয় ভূখÐভিত্তিক অবস্থান স্ব স্ব ধর্মই স্ব স্ব জাতির অস্তিত্ব ও শর্ত হয়ে দাঁড়িয়েছে। ধর্মের নামে জাতিসত্ত¡ার নাম এবং এর ভিত্তিতে প্রধান্য পাচ্ছে নিজস্ব সাংস্কৃতিক ব্যবস্থা। যেমন ডলারে ইন গড উই ট্রাস্টসহ বিদেশি মুদ্রা থেকে শুরু করে তাদের শপথ, শিক্ষা ব্যবস্থা, চার্চ, পোপ, ট্রিনিটি, ক্রশ, রীতি-নীতি, কংগ্রেস, পার্লামেন্টের কার্যবিবরণী, রোববারের অনুষ্ঠানাদি, আচার অনুষ্ঠান, সিলেবাস-কারিকুলাম, পত্র-পত্রিকা, রেডিও-টিভি, চলচ্চিত্র, ব্যক্তি জীবন, সংস্কৃতি, মিশনারীদের কর্মকাÐÑসবত্রই নিজস্ব ধর্ম অতি প্রকট।
পরিশেষে বলা যায় যে, ইসলাম ধর্ম কেবল একটি বিশ্বাসের নাম নয়, বরং এটি একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান। রাজনীতি, অর্থনীতি, শিক্ষা ও সংস্কৃতিসহ জীবনের সর্বক্ষেত্রে ধর্মীয় আদেশ-নিষেধ মেনে চলার জন্যে পবিত্র কোরআনে সুস্পষ্ট নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে। মুসলমানদের খÐিতভাবে জীবন-যাপনের সুযোগ নেই। ইসলাম একটি রাষ্ট্রিক চেতনা। ইসলামের আছে বিকল্প স্বপ্ন, বিকল্প রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রনৈতিক ভাবনা। যা অনায়াসে সেক্যুলার সভ্যতার বিকল্প মডেল। ইসলাম ধর্মানুসারী মুসলমানরা এমন এক জাতি যে, তাদের বিশ্বাস, আমল-আখলাক, আচার-ব্যবহার, জীবন ধারণ, জীবন-মনন, শাসন পদ্ধতি, আনন্দ-উৎসব, সুষ্পষ্ট ঐশী বিধান ও মহানবীর (সা.) সর্বোত্তম জীবনাদর্শানুযায়ী পরিচালিত হয়ে থাকে। আর এই সবই রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনার সাথে সম্পৃক্ত। তাই রাষ্ট্র থেকে ধর্মকে আলাদা করার কোন অবকাশ নেই এবং রাষ্ট্রে ধর্মের অবিভাজ্যতা অস্বীকার করার ও উপায় নেই।
লেখক: ইসলামী ঐক্যজোটের চেয়ারম্যান ও বাংলাদেশ নেজামে ইসলাম পার্টির মহাসচিব।
[email protected]



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন