Inqilab Logo

রবিবার, ৩০ জুন ২০২৪, ১৬ আষাঢ় ১৪৩১, ২৩ যিলহজ ১৪৪৫ হিজরী

দেশের পর্যটন খাত বিশ্ব পর্যায়ে তলানীতে

সরদার সিরাজ | প্রকাশের সময় : ৩০ সেপ্টেম্বর, ২০১৭, ১২:০০ এএম

ভেনিস একটি আর্টিফিসিয়াল শহর। পানির মধ্যে অবস্থিত ইটালির এই ছোট শহরটি। মোট জনসংখ্যা ৬০ হাজার। কিন্তু প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর। প্রতিদিন এখানে ৬০ হাজারের মত পর্যটক আসে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে। এতে কিছু ক্ষয় ক্ষতিও হয়। তাই কর্তৃপক্ষ কিছু বিধি-নিষেধ আরোপ করেছ স¤প্রতি। তেমনি ঘটনা ঘটেছে আমস্টাডার্মে। এখানে প্রতিবছর ১৭ মিলিয়ন পর্যটক আসে। এই জন¯্রােত রোধ করার জন্য কর্তৃপক্ষ ওয়াইন ও নাচগানের উপর উচ্চ কর আরোপ করেছে অতি স¤প্রতি। গত বছরের সেপ্টেম্বরে চীনের পর্যটন কেন্দ্র হেনান এবং হুনান প্রদেশে খুলে দেওয়া হয় বিশ্বের সবচেয়ে আকর্ষণীয় ঝুলন্ত সেতু। পায়ের নিচে স্বচ্ছ কাচের তৈরি ৩০০ মিটার দীর্ঘ এই সেতুটি ১৮০ মিটার উঁচুতে। পর্যটকদের জন্য খুলে দেওয়ার মাত্র ১৩ দিন পরই কর্তৃপক্ষ বন্ধ করে দেয় কাচের সেতুটি। বিষয়টি পর্যটকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। চীনের ঐ কাচের সেতুর পর আলোচনায় উঠে এসেছে সুইজারল্যান্ডের ৫০০ মিটার দীর্ঘ সেতু। সুইজারল্যান্ডের জেরমাট শহরের সেতুটি ইতোমধ্যেই পর্যটকদের মধ্যে ব্যাপক সাড়া ফেলেছে। এটি শুধুমাত্র পায়ে হেঁটে চলার জন্যই। এর উপর দাঁড়িয়ে চারপাশের নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক দৃশ্য উপভোগ করার জন্য সেতুটি পর্যটকদের মধ্যে ব্যাপক আকর্ষণ সৃষ্টি করেছে। সেতুটি দেশটির পর্যটন খাতকে সমৃদ্ধ করছে। মূলত সাঁকো হিসেবেই কাজ করবে বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু এই ঝুলন্ত সেতুটি। গ্রাবেনগোফের এই সংকীর্ণ উপত্যকার ৮৫ মিটার উপরে ঝুলছে এই সাঁকোটি। এর আগেও জেরমাটে একটি ঝুলন্ত সেতু ছিল। তবে সেটি উপর থেকে ছিটকে পড়া পাথরে ধ্বংস হয়েছিল। তাই নতুন সেতুটি যেসব রজ্জু দিয়ে বানানো হয়েছে, তার ওজন প্রায় আট টন। লোকজনের চলার সময় যাতে এটি দুলে উঠতে না পারে সেভাবেই এটিকে তৈরি করা হয়েছে। কর্তৃপক্ষ মনে করছেন, উপর থেকে মাটারহর্ন, ওয়েসিহর্ন এবং বার্নেস আল্পসের সৌন্দর্য উপভোগ করার জন্য পর্যটকদের জন্য নতুন সম্ভাবনা দুয়ার উন্মোচন করেছে। জারমেট এবং গ্রাসেনের মধ্যে যাতায়াতের জন্য আগে যেখানে তিন থেকে চার ঘণ্টা লাগতো, সেখানে এই সাঁকো ব্যবহার করে মাত্র ১০ মিনিটেই সে দূরত্ব ঘোচানো সম্ভব হয়েছে। তবে যাদের উচ্চতা ভীতি রয়েছে তাদের এই সাঁকোতে চড়ার জন্য সাবধান করা হয়েছে। এর আগে সবচেয়ে দীর্ঘ ঝুলন্ত সেতুটি ছিল অস্ট্রিয়ায়। মাটি থেকে ১১০ মিটার উপরের সেই সেতুটি ছিলো ৪০৫ মিটার লম্বা। কাচের সেতুর কাহিনী এখানেই শেষ নয়। আরো আছে। যেমন গত পয়লা সেপ্টেম্বর, চীনের কুয়াংতুং প্রদেশের ইয়ুনমেনশান দর্শনীয় স্থানে প্রদেশটির সবচেয়ে লম্বা কাচের সেতু আনুষ্ঠানিকভাবে পর্যটকদের জন্য উন্মুক্ত করা হয়েছে। এর দৈর্ঘ্য ৩১৬ মিটার, ভূমি থেকে ১৬৮ মিটার উঁচুতে অবস্থিত। সেতুটি নির্মাণে ব্যবহার করা হয়েছে ১৩০টি কাচ। এভাবে বিশ্বের প্রতিটি দেশই তার পর্যটন খাতকে আকর্ষণীয় করে ব্যাপক অর্থ উপার্জন ও কর্মসংস্থান করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করছে। এমনকি এ ব্যাপারে অনেক দেশের মধ্যে প্রতিযোগিতাও চলছে। ফলে অনেক দেশের জাতীয় অর্থনীতির প্রাণ হয়ে উঠেছে পর্যটন খাত। যেমন: বিশ্ব পর্যটন সংস্থার প্রতিবেদন, ২০১৭ এর তথ্য অনুযায়ী, ‘সিঙ্গাপুরের জাতীয় আয়ের ৭৫ শতাংশই আসে পর্যটন খাত থেকে। তাইওয়ানে আসে ৬৫ শতাংশ, হংকংয়ের ৫৫ শতাংশ, ফিলিপাইনের ৫০ শতাংশ ও থাইল্যান্ডের ৩০ শতাংশ। মালদ্বীপের অর্থনীতি প্রায় পুরোটাই পর্যটন খাতের ওপর নির্ভরশীল। ক্যারিবিয়ান দ্বীপগুলোও মূলত পর্যটননির্ভর। মালয়েশিয়ার বার্ষিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ৭ শতাংশ আসে পর্যটন খাত থেকে। এশিয়ার সুইজারল্যান্ড নামে খ্যাত ভুটানও পর্যটনে এখন অনেক এগিয়ে। বর্তমানে বিশ্বব্যাপী পর্যটকের সংখ্যা প্রায় ৯০ কোটি। ধারণা করা হচ্ছে, ২০২০ সাল নাগাদ এ সংখ্যা দাঁড়াবে ১৬০ কোটি। পর্যটন বিশেষজ্ঞদের মতে, এ বিপুলসংখ্যক পর্যটকের প্রায় ৭৩ শতাংশ ভ্রমণ করবেন এশিয়ার দেশগুলোতে’। উপরন্তু উক্ত প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, ‘২০১৮ সালের মধ্যে এ শিল্পে ২৯ কোটি ৭০ লাখ লোকের কর্মসংস্থান হবে, যা বিশ্ব অর্থনীতিতে অবদান রাখবে ১০.৫ ভাগ। বাংলাদেশ যদি এ বিশাল বাজার ধরতে পারে তাহলে পর্যটনের হাত ধরেই বদলে যেতে পারে অর্থনীতি। বর্তমানে পর্যটন সক্ষমতা বা প্রতিযোগিতার (টিটিসিআই) দিক থেকে ১৪৪টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১১৮। অর্থাৎ পর্যটন খাতে বিশ্ব পর্যায়ে আমাদের অবস্থান তলানীতে। অথচ পর্যটনকে কেন্দ্র করে অর্থনীতির বিকাশ ঘটিয়ে ইতোমধ্যেই বিশ্বের অনেক দেশ প্রমাণ করেছে ‘পর্যটন গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক শক্তি’।
বাংলাদেশের পর্যটন খাত নিয়ে হতাশজনক খবর দিয়েছে, ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম (ডবিøউইএফ) তার ‘ভ্রমণ ও পর্যটন প্রতিযোগিতা সূচক ২০১৭’ শীর্ষক প্রতিবেদনে। এতে বলা হয়েছে, ‘বাংলাদেশের পর্যটন খাতের বর্তমান অবস্থা বিশ্ব পর্যায়ে লজ্জাজনক। কারণ, পর্যটক আকর্ষণে বিশ্বের সবচেয়ে পিছিয়ে থাকা দেশগুলোর একটি বাংলাদেশ। এমনকি প্রতিবেশী দেশগুলোর তুলনায় পিছিয়ে আছে বাংলাদেশ। পর্যটনে বিশ্বের ১৩৬টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১২৫। দক্ষিণ এশিয়ার পাঁচটি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ রয়েছে ৫ নম্বরে। এমনকি পাকিস্তানও এক ধাপ ওপরে’। পর্যটক আকর্ষণে একটি দেশ কতটা নিরাপদ, অবকাঠামো সুবিধা কেমন, বিমানবন্দর কতটা উন্নত, আবাসন ব্যবস্থার মান কেমন- মোটা দাগে এমন ১৪টি বিষয় বা সূচকের ভিত্তিতে এই প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে। প্রতিটি সূচকে সর্বোচ্চ নম্বর ছিল ৭, আর সর্বনিম্ন নম্বর ১। একেকটি সূচকে প্রাপ্ত নম্বর গড় করে একটি দেশের সার্বিক নম্বর নির্ধারণ করা হয়েছে এবং সেই অনুযায়ী ক্রমতালিকা করা হয়েছে। বিশ্বের ভ্রমণ ও পর্যটনশিল্প নিয়ে ডবিøউইএফ প্রতি দুই বছর পরপর এই প্রতিবেদন প্রকাশ করে। ২০১৫ সালে সর্বশেষ প্রকাশিত প্রতিবেদনে ১৪১টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১২৭। প্রতিবেদনে বাংলাদেশ-বিষয়ক তথ্য-উপাত্ত নিয়ে কাজ করেছে সিপিডি। অপরদিকে, সরকারি হিসাব অনুযায়ী, ২০১৬ সালে ৫ লাখের বেশি পর্যটক বাংলাদেশে এসেছেন। আগের বছরে যা ছিল সাড়ে ৪ লাখের মতো। প্রতিবেশী দেশ নেপালে একই সময়ে পর্যটক এসেছে ৭ লাখ ২৯ হাজার আর ভারতে প্রায় ৯০ লাখ। অথচ আমাদের দেশে পর্যটকদের আকর্ষিত করার জন্য আন্তর্জাতিক পর্যটনমেলা, বিভিন্ন দেশে ‘রোড-শো’ ইত্যাদি করা হয় বিপুল অর্থ ব্যয় করে। কিন্তু দেশের অভ্যন্তরে যদি যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত না হয়, পর্যটন এলাকায় ও যাতায়াত যদি নিরাপদ না হয়, বিনোদন যদি ফ্রি না হয়, ভালো দোভাষী যদি না থাকে, একটু বৃষ্টি হলেই যদি সব তলিয়ে যায় পানিতে, তাহলে কি কেউ আসবে এ দেশের নয়নাভিরাম দৃশ্য দেখতে? এ ব্যাপারে এক দৈনিকে প্রকাশিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষিকার একটি নিবন্ধ স্মরণীয়। তিনি বলেন, ‘ভুটানের এক বৌদ্ধ ভিক্ষু এসেছিলেন বগুড়ার এক প্রাচীন বৌদ্ধ বিহার দেখার জন্য। তিনি আমাকে সঙ্গী করে নিয়েছিলেন। দু’জনেই যাচ্ছিলাম একটি গাড়িতে করে। আমি রাস্তার দু’পাশের বিভিন্ন স্থানের ও দৃশ্যের বর্ণনা দিচ্ছিলাম। গাড়ি চলতে চলতে বগুড়ার সন্নিকটে পৌঁছলে এক হাতি এসে গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে যায়। বুঝলাম চাঁদাবাজ হাতি। ড্রাইভারকে দিয়ে পঞ্চাশ টাকার একটি নোট দিলাম। কিন্তু কিছুতেই তা নিল না হাতিটি। আমি হতভম্ব হয়ে পড়লাম। লজ্জায় মাথা হেট হয়ে আসছিল ঐ বিদেশির জন্য। কিছুক্ষণ পর হাতি চরম ক্ষুব্ধ তার সুর দিয়ে গাড়ির গøাস ভাঙ্গা শুরু করে দিল। ভয়ে ঐ বিদেশি গাড়ি থেকে নেমে দিলেন এক দৌড়। তার আর সেই প্রাচীন বৌদ্ধ বিহারে যাওয়া হলো না। এখন বলুন, ঐ বৌদ্ধ ভিক্ষু কি কখনো আর এ দেশে আসবেন পর্যটন এলাকা দেখার জন্য? আসবেন না। এমনকি তার দেশেরও কেউ নয়’। এ ব্যাপারে আর একটি উদাহরণ স্মরণযোগ্য। সেটা হচ্ছে: সম্ভবত বিষয়টি ফক্স লাইফে দেখেছি কিছুদিন আগে। ‘এক বিদেশি ঢাকা থেকে যাচ্ছেন সুন্দরবন দেখার জন্য। তিনি একটি গাড়িতে চড়ে রওনা দিয়েছেন। ঢাকা থেকে আরিচাঘাট যেতে সময় লেগেছে তার ১২ ঘণ্টা। সেখান থেকে ফেরিতে ওপার যেতে লেগেছে ৩ ঘণ্টা। ওপার গিয়ে তিনি বললেন, এখন সুন্দরবন যেতে কত যে সময় লাগবে তা জানি না। সমস্ত রাস্তায় প্রচÐ যানজট। তারপর তাকে দেখা গেল সুন্দরবনের মধ্যে এক নদীতে নৌকায় চড়ে মাছ ধরছেন’। এখন বলুন কে আসবে এখানে বেড়াতে? আসবে না। কারণ, বিষয়টি বিশ্বের বহু মানুষ এটি দেখেছেন এবং এ দেশের যাতায়াতের করুণ চিত্র সম্পর্কে ধারণা পেয়েছেন। ফলে তারা আসবেন না। তাই আসল বিষয় হচ্ছে, পর্যটনের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করা। এসব না করে মেলা ও রোড-শো করে পর্যটক কিংবা বিনিয়োগ বৃদ্ধি পাবে না। অবশ্য কিছু আমলার বিদেশে গিয়ে আনন্দফূর্তি করা হয় এই যা। তদ্রæপ হয়েছে ঢাকায় মশা মারার প্রয়োজনীয় ঔষুধ না দিয়ে গাপ্পি মাছ ছেড়ে মশা ধ্বংস করার মতো মশকরা করা! তাই এসব নয়-ছয় বাদ দিয়ে পর্যটক বৃদ্ধি করার জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরি করা আবশ্যক। তাহলে পর্যটনের আয় ও কর্মসংস্থান ব্যাপক বৃদ্ধি পাবে। এ দেশে আকর্ষণীয় পর্যটন কেন্দ্র রয়েছে বিভিন্ন অঞ্চলেই। সর্বোপরি রয়েছে বিশ্বের সর্বদীর্ঘ সি-বিচ। তাই এ দেশের পর্যটন খাত খুবই সম্ভাবনাময় খাত। স্মরণীয় যে, ওয়ার্ল্ড ট্রাভেল অ্যান্ড ট্যুরিজম কাউন্সিল (ডবিøওটিটিসি) এর মতে, এ বছরের শেষে বাংলাদেশের পর্যটনশিল্পের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কর্মসংস্থান দাঁড়াবে ৩৮.৯১ লাখ, যা বাংলাদেশের সর্বমোট কর্মসংস্থানের ৪.২ ভাগ। ফলে বাংলাদেশে এ শিল্পে বার্ষিক কর্মসংস্থানের প্রবৃদ্ধি দাঁড়াবে ২.৯ ভাগ। উক্ত সংস্থার ২০১৪ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী ২০১৩ সালে বাংলাদেশে পর্যটন শিল্পে ১২ লাখ ৮১ হাজার ৫০০ লোকের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে, যা দেশটির সর্বমোট কর্মসংস্থানের ১.৮ ভাগ। বাংলাদেশের পর্যটন শিল্পের ওপর প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে ২৭ লাখ ১৪ হাজার ৫০০টি চাকরি সৃষ্টি হয়েছে, যা সর্বমোট কর্মসংস্থানের ৩.৭ ভাগ। অর্থাৎ এ দেশে পর্যটন খাতের অবদান বাড়ছে। তবে গতি খুব ধীর। এই অবস্থায় এ দেশের পর্যটন খাতের উন্নয়নে গুরুত্ব দেওয়া হলে দেশের অর্থনীতির বড় নিয়ামক হতে পারে।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট

 

 

 



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন