Inqilab Logo

রোববার ১৭ নভেম্বর ২০২৪, ০২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৪ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সৃজনশীল শিক্ষা পদ্ধতি নিয়ে কিছু কথা

মো. আলতাফ হোসেন উজ্জ্বল | প্রকাশের সময় : ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৭, ১২:০০ এএম

পরীক্ষায় সৃজনশীল পদ্ধতি চালু হয়েছে নাকি বিদেশে বহুল প্রচলিত। তাই এ দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও সৃজনশীল পদ্ধতিটা চালু হয়েছে। আমারও একবার বিদেশে যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল। তাই আমিও সেখানকার অভিজ্ঞতায় আমাদের দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে মাঝে মাঝে ভাবি। এ ভাবনার কারণ আর কিছুই নয়- আমাদের শিক্ষার ক্ষেত্রে যেমন, সমাজের অন্যান্য ক্ষেত্রেও প্রতিযোগিতা চালু আছে।
আমাদের দেশের শিক্ষক/শিক্ষিকারা ব্রতকথার মতো একটানা কথা বলে যাবেন আর ছাত্র-ছাত্রীরা চুপচাপ মন দিয়ে শুনবে এবং বসে লিখবে, কিন্তু কোন প্রশ্ন করবে না। আর প্রশ্ন করলে একগোছা বকুনি শুনতে হবে, আর আমাদের পাঠ্য পুস্তকের ভাষাও ছিল এরকম। তাই মন্ত্রণালয়ের কর্তাব্যক্তিরা পদ্ধতি পরিবর্তন করে সৃজনশীল পদ্ধতি চালু করলেন। যে চিন্তায় ছাত্রকেন্দ্রিক শিক্ষার কথা উঠে এসেছিল তা পুরোপুরি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বলে মনে হয় না। আজকের লেখা শিক্ষায় সেই ছাত্র-ছাত্রীদের অধিকারের বিষয় নিয়েই। আমার অভিজ্ঞতার কথাটি বলি, সুইজারল্যান্ডের বাসেল সিটিতে ভাষা শিক্ষা বিষয়ে এক বছরের কোর্সে শিক্ষা নেবার সুযোগ হয়েছিল আমার। চার সেমিস্টারের কোর্সে প্রথম সেমিস্টারের শেষ দিনে আমাদের পাঠ দানের ম্যাডাম আনা ক্লাসে ঢুকেই গুটেন মর্গেন বলে সঙ্গে নিয়ে আসা খামের ভিতর প্রশ্ন আকারে লিখিত ফরমের কাগজগুলো বের করলেন, আর আমাদের প্রায় ২৫ জন ছাত্র-ছাত্রীদেরকে চটপট বিলি করলেন সেগুলো এবং ভালো করে পড়তে বললেন। তারপর বললেন, ‘তোমাদের মতামত দাও’। আমরা দেখলাম, তাতে আছে নানা ধরনের প্রশ্ন। আর সেসবের উত্তর যা আমাদের দেশের এমসিকিউ ধরনের প্রশ্ন। আন্না বললেন, তোমাদের পছন্দসই বিকল্পে তোমরা শুধু টিক লাগাবে। এ কাজটা করার সময় আমার মুখের দিকে তাকাবে না । আমিও তোমাদের কোন কিছু বলব না। ক্লাস শেষ হলে আমার হাতে দিবে না। ফরমসহ খামগুলো একাডেমিক চেয়ারম্যানের নির্ধারিত বক্সে রাখবে। তারপর শিক্ষা উন্নয়ন কমিটি বক্স খুলবে। তিনি সকলকে ধন্যবাদ দিয়ে চলে গেলেন।
প্রশ্নগুলো সব হুবুহু মনে নেই। কিন্তু প্রশ্নগুলো ছিল দশ থেকে বারোটি ভাগে বিভক্ত। প্রথমে শিক্ষক ও সময় সমন্ধে- ক. শিক্ষক ঠিক সময়ে ক্লাসে আসেন? ঠিক সময়ে ক্লাস ছাড়েন? তারপরেরটা পড়ানোর সহায়ক কাজ সমন্ধে। খ. শিক্ষক ঠিক মত বই বিষয়ক পাঠ দান করেন? গ. তোমার পাঠ্যপুস্তকের জ্ঞানমূলক প্রশ্নের উত্তর দেন, না রেগে যান? ঘ. তোমার লিখিত প্রশ্নের উত্তর ঠিক মত দেখেন, না অনুমান নির্ভর দেখেন? ঙ. ভুল উত্তরগুলোর সঠিক বিষয়ে আলোচনা করেন, নাকি করেন না? চ. পাঠ্য বইয়ের কোন বিষয়ে প্রশ্ন করলে বিরক্ত হন, না হন না? এরপর ক্লাসের ভিতর পাঠদানের কৌশল নিয়ে প্রশ্ন ছিল। যেমন, পাঠদানের সময় তার কণ্ঠস্বর স্পষ্ট শুনতে পাও কীনা। তিনি তোমাদের যা পড়িয়েছেন তা কি তোমাদের কাজে লাগে কীনা ইত্যাদি
তার পরের অংশে হ্যাঁ/না এর বাইরে গিয়ে আমাদের বলা হয়েছিল তার উপস্থাপন ও পড়ানোর মানগুলোর মধ্যে একটিতে টিক চিহ্ন দাও- হতাশা জনক/ চলনসই/ ভালো/ বেশ ভালো/ চমৎকার। শেষ অংশে যতটুকু মনে পড়ে, তোমার অন্যান্য শিক্ষকের তুলনায় একে তুমি কোথায় স্থান দিবে? যোগ্য বা অযোগ্য স্থানে?
আমার মতো গ্রাম বাংলার ছেলে গ্রামের স্কুল কলেজের শিক্ষকদের আদর্শ ও সরব পাঠে অভ্যস্ত। কাগজটি পেয়ে একেবারে ঘাবড়ে গেলাম। হাতে নিয়ে কিছু সময় বসে রইলাম। আমার পাশে বসা ক্লাস ফ্রেন্ড লিব্রা আমাকে লক্ষ করে বলল, কি হয়েছে তোমার? ফরমটা পূরণ কর না কেন? তারপর বলল, শোন, এখন ম্যাডাম অন্না আমাদের এই কোর্সের শিক্ষানবিশ লেকচারার হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত। যদি আমাদের রিপোর্ট তার পক্ষে যায় তাহলে সে এই ইউনিভার্সিটিতে পাকাপাকিভাবে লেকচারার হিসেবে নিয়োগ পাবেন। অথবা পড়াশুনা/ লেখালেখি ইত্যাদি করতে হবে। এই হলো এখানকার শিক্ষা পদ্ধতির একটি অংশ। একথা শুনে আমি আর অপেক্ষা না করে তার পক্ষের কথাগুলোতে টিক চিহ্ন দিলাম। একটা কথা না বললেই নয়। আমি তো আমার দেশে এ পদ্ধতি কখনও দেখিনি এবং শিক্ষার্থীর মূল্যায়ন যেভাবে শিক্ষক করেন সেটাই হলো একজন শিক্ষার্থীর এবং শিক্ষকের বড় সার্টিফিকেট। এটা ঠিক যে, আমাদের দেশের শিক্ষকদের মূল্যায়ন এভাবে না হলে ছাত্র-ছাত্রীরা শিক্ষকের মূল্যায়ন চিরকাল করে আসছে তাদের বন্ধুদের সাথে বা পাড়ার বড়দের ও ছোটদের সাথে ঠিক এইভাবে, এই স্যার খুব ভালো, হাসি-খুশি ও আনন্দে আনন্দে পাঠ দান করেন। এই স্যারের ক্লাসটা মিস করা যাবে না। ঠিক তেমনি বলে, অমুক স্যার বড্ড বেশি বোরিং এবং ক্লাসের সময়টা কাটতেই চায় না। অথবা বলে, স্যারের সব কথা বুঝি না। এই ধরনের মন্তব্য হরহামেশা হয়ে থাকে।
যেহেতু আমাদের দেশের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বা প্রশাসনিক কর্মকর্তারা যদি পশ্চিমা দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করার জন্য নিজেরা শুধু বিদেশে ট্রেনিং নেন, আর গ্রাম বাংলায় এই সৃজনশীল ব্যবস্থা চালু করতে চান, তাহলে সম্পূর্ণভাবে কখনও সফল হবে না। তার আগে দরকার পশ্চিমা দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় শিক্ষকদের জন্য উন্নত জীবন ব্যবস্থা বা বেতন কাঠামো। এবং সেই সাথে তৃণমূল পর্যায়ের শিক্ষকদের উপযুক্ত ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা যা সৃজনশীল কাজে সহায়ক হয়। পর্যায়ক্রমে তৃণমূল পর্যায়ের শিক্ষকদের বিদেশের স্কুলগুলোতে বাস্তবিক অবস্থা দেখে ট্রেনিং নেওয়ার ব্যবস্থা নেওয়া কীভাবে তারা ক্লাস নেন। কেননা একজন শিক্ষক কিন্তু অফিসের ফাইলপত্র তৈরি করেন না। অথবা কোন কেরানীর কাজও করেন না। তারা তৈরি করেন ভবিষ্যতে দেশকে নেতৃত্ব দেওয়ার নাগরিকদের যাদের ভিতর রয়েছে অনাগত সম্ভাবনা, দেশ গড়ার স্বপ্ন। তাই একজন শিক্ষক যদি অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল থাকে তবে সৃজনশীল পদ্ধতিগুলো তার ভেতরে জাগ্রত হবে না। বিষয় ভাবনা এই যে, একজন শিক্ষক শুধু শিক্ষাদানে ব্রত নয়, তিনি সমাজের সর্ব শ্রেণির মানুষের তথা মানুষ গড়ার কারিগর। যেমন, একটি শ্রেণিতে একজন ভূমিদস্যুর সন্তান, একজন চোরের সন্তান, একজন ঘুষখোরের সন্তান অথবা একজন ইমানদার মানুষের সন্তান একত্রে পাঠ গ্রহণ করে। তাই শিক্ষক এমনভাবে শিক্ষা দান করেন যাতে সমাজ ব্যবস্থায়, রাষ্ট্র ব্যবস্থায় গড়ে ওঠে সৎ, দেশপ্রেমিক, আদর্শবান, ন্যায়নীতিবান ও জ্ঞানবিজ্ঞানে তেজস্বী মানুষ।
পৃথিবীর যত উন্নত ও সুসভ্য রাষ্ট্র হোক না কেন, তার পিছনে রয়েছে শ্রেষ্ঠ শিক্ষা ব্যবস্থা। তখনই পরিবর্তন হবে একটি রাষ্ট্র, একটি জাতি শিক্ষকের অবস্থান যখন উন্নত হবে। তখনই পারবে ছাত্রছাত্রীরা দেশ গড়তে, জাতি গড়তে যখন ছাত্র-ছাত্রীরা আন্তরিকভাবে শিক্ষকদের ভালোবাসার জায়গায় বসাবে। আমার দেখা, অনেক পদ সৃষ্টি করা হয় তোষামদিতে। কিন্তু সৃজনশীল পদ্ধতিতে তোষামদি নয়, বরং নিজেদের জ্ঞান, নিজেদের বিজ্ঞতায় এবং ছাত্রছাত্রীদের মূল্যায়নে উপযুক্ত স্থানে প্রমোশনে পদোন্নতি হলে সৃষ্টিশীল ও সৃজনশীল শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে উঠবে এদেশে।
ছাত্র-ছাত্রী বা প্রতিষ্ঠানের মতামতে যখন শিক্ষকদের কেউ ১ নম্বর, ২ নম্বর বা ৩ নম্বর হবে, এতে কেউ খুশি হবে কেউ উদাসীন হবে বা কেউ হতাশ হবে। এই মূল্যায়ন দ্বারা বৈষয়িক কোন উপকার হয় না, তবে মূল্যায়নের একটা লাভ হলো যে, তা শিক্ষকদের আত্মসচেতন করবে। আত্মতৃপ্তিতে ঢেকুর তুলে এবং একটা চাকরি পেয়ে সারা জীবনের মতই স্থির হয়ে গেলাম, এবার সুখের সংসার করবো- এই চিন্তা থেকে শিক্ষকরা বের হয়ে আসবে। শিক্ষকরাতো কোন প্রজেক্ট বা আমলাতন্ত্রের কাজের সঙ্গে যুক্ত নয়। তাদের কাজটা হলো একটা ব্রত। বর্তমানে শিক্ষকরা আগের চেয়ে বেশি সচেতন হয়েছেন। নানা ট্রেনিং, সমাবেশ নিজেদের আত্মবিশ^াসী করে তুলেছেন। শিক্ষক যেন সমাজের সর্বস্তরের ছাত্রছাত্রীদের উজ্জীবিত করেন। মেধাই যেন হয় তাদের বড় শক্তি।
তবু শিক্ষকরা ব্যাপকভাবে মেধা সৃষ্টি করার কাজে থাকেন। তারপরেও অনেক সময় ভালো শিক্ষকদের অবমূল্যায়ন করা হয়। দেখতে হবে, শিক্ষকরা যেন ছাত্রছাত্রীদের বিশ^াসে এবং শ্রদ্ধার মধ্যে থাকে। শিক্ষক আর ছাত্রছাত্রীরা কোন পক্ষই পাঠদানকে নিছক শিক্ষার আদান প্রদান বা হিসাব বিজ্ঞানের ভাষায় লেনদেনের পর্যায়ে আনবেন না। পক্ষপাতেও নয়, শাস্তি দানেও নয়। জানি না, এসব কথা কারো কাজে আসবে কীনা। তবে, দেশ আমাকে কতটা বেতন বা সুযোগ সুবিধা দিল সেটা বড় কথা নয়, আমি দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় কতটুকু অবদান রাখলাম, সেটাই হওয়া উচিত বিবেচ্য রিষয়।
লেখক: সিনিয়র শিক্ষক, শ্রীনগর পাইলট স্কুল অ্যান্ড কলেজ, মুন্সিগঞ্জ



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন