ইভিএম-এ ভোট কেন?
আগামী জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম-এ ১৫০ আসনে ভোট গ্রহণের পরিকল্পনার কথা জানিয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার। কাকতালীয় কিনা জানি না, ১৫০ সংখ্যাটা আমাদের এর আগে চিনিয়েছিলেন রকিবুল
রফতানি বহুমুখী করা ছাড়া বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন বৃদ্ধির অন্য কোনো উপায় নেই। আমরা বর্তমানে সীমিত কয়েকটি খাতের পণ্য রফতানি করছি। রফতানি খাতের পণ্য সংখ্যা বৃদ্ধি করতে হবে। নতুন নতুন রফতানি খাত আমাদের জাতীয় অর্থনীতি স¤প্রসারণের স্বার্থে খুবই প্রয়োজন। বর্তমানে তৈরি পোশাক শিল্পের উপর আমরা সম্পূর্ণভাবে নির্ভরশীল। দেশের এখনও ৭৬ শতাংশের অধিক বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হচ্ছে তৈরি পোশাক রফতানির মাধ্যমে। তাই রফতানি বহুমুখী না করতে পারলে আগামীতে দেশ বড় সমস্যায় পড়বে।
জনশক্তি রফতানি আমাদের বর্তমান দ্বিতীয় বৃহত্তম রফতানি খাত। এই খাতেও নানা সমস্যা বিরজমান। বিশেষ করে বিগত কয়েক বছর ধরে মধ্যপ্রাচ্যে মুসলিম দেশসমূহে আমাদের জনশক্তি রফতানি চাহিদা মোতাবেক হচ্ছে না। রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক নানা সমস্যার কারণে জনশক্তি রফতানির গতি বেশ ধীর। বিশেষ করে সৌদি আরব, কুয়েত, কাতার প্রভৃতি দেশে জনশক্তি রফতানি অনেক দিন কম। আমাদের সবচেয়ে বেশি সম্ভাবনাময় দেশ মালয়েশিয়াতেও জনশক্তি রফতানি আশানুরূপ করা সম্ভব হচ্ছে না। এই দেশসমূহে রফতানি হ্রাসের ক্ষেত্রে বাস্তবসম্মত বেশ কিছু কারণ রয়েছে। উক্ত কারণ দ্রæত দূর করা গেলে জনশক্তি রফতানিতে জোয়ার আসবে।
বাংলাদেশের রফতানি আরও বাড়াতে চার ক্ষেত্রে কর্মসূচিভিত্তিক সহযোগিতা দেবে বিশ্বব্যাংক। এগুলো হচ্ছে, নতুন বাজারে প্রবেশে সহায়তা কর্মসূচি, উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির কর্মসূচি, অবকাঠামোগত প্রতিবন্ধকতা দূর করার লক্ষ্যে সহায়তা এবং প্রকল্প বাস্তবায়ন-মনিটরিং ও মূল্যায়ন কর্মসূচি। ‘এক্সপোর্ট কম্পিটিটিভনেস ফর জবস’ শীর্ষক মূল প্রকল্পের মাধ্যমে এ সহায়তা দেবে সংস্থাটি। এটি বাস্তবায়নে মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ৯৪১ কোটি টাকা। এর মধ্যে বিশ্বব্যাংক সহজ শর্তে ঋণ হিসেবে দেবে ৭৯০ কোটি টাকা এবং সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে ব্যয় ধরা হয়েছে ১৫১ কোটি টাকা। ইতোমধ্যেই এ ঋণ প্রস্তাব অনুমোদন দিয়েছে বিশ্বব্যাংক বোর্ড। বর্তমানে প্রকল্পটি জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) বৈঠকে উপস্থাপনের প্রস্তুতি নিচ্ছে পরিকল্পনা কমিশন। এর পরিপ্রেক্ষিতে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) কাছে একটি প্রকল্প ব্রিফ চাওয়া হয়েছে। স¤প্রতি পরিকল্পনা কমিশনকে এ ব্রিফ পাঠিয়েছে ইআরডি। ইআরডি সূত্র জানায়, একনেকে অনুমোদন পেলে চলতি বছর থেকে ২০২৩ সালের জুনের মধ্যে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের দায়িত্ব পালন করবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। এটি বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে তৈরি পোশাক শিল্পের বাইরে রফতানিমুখী চামড়া, পাদুকা, প্লাস্টিক এবং হালকা প্রকৌশল শিল্পে শ্রমিকদের কর্মদক্ষতা বাড়ানো, চট্টগ্রামের মিরসরাই, মুন্সিগঞ্জের কেরানীগঞ্জ, সিরাজদিখান এবং ঢাকার তেজগাঁও ও সাভার এলাকায় বিভিন্ন অবকাঠামো উন্নয়ন করা হবে। ফলে পোশাক খাতের বাইরে অন্য খাতগুলোতে প্রায় ৯০ হাজার কর্মসংস্থান তৈরি হবে বলে আশা করা হচ্ছে। বিশ্বব্যাংকের সহায়ক প্রতিষ্ঠান আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থার (আইডিএ) তহবিল থেকে পাওয়া এ ঋণ ৬ বছরের রেয়াতকালসহ ৩৮ বছরে পরিশোধ করতে হবে। রেয়াতকাল পরবর্তী সময়ে উত্তোলন করা অর্থের শূন্য দশমিক ৭৫ শতাংশ হারে সার্ভিস চার্জ পরিশোধ করতে হবে সরকারকে। গত জুন মাসে ঋণটি অনুমোদনের পর ঢাকায় নিযুক্ত বিশ্বব্যাংকের কান্ট্রি ডিরেক্টর চিমিয়াও ফান বলেছিলেন, চীনের পর বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশি তৈরি পোশাক রফতানি করছে। রফতানি খাতের বহুমুখীকরণের মাধ্যমে বাংলাদেশ তার প্রবৃদ্ধিকে আরও এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে। এ প্রকল্পের টিম লিডার মাইকেল অলিভ এগমান বলেন, প্রকল্পের মাধ্যমে নারীসহ অন্যান্য শ্রমিকদের দক্ষতা বাড়বে। ফলে প্রকল্প শেষ নাগাদ শ্রমিকদের মজুরি প্রায় ৩৪ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পাবে।
নতুন বাজারে প্রবেশে সহায়তা : এ কর্মসূচিটি পরিচালনায় ব্যয় করা হবে ১৫৮ কোটি টাকা। কর্মসূচিটির লক্ষ্য হচ্ছে বাংলাদেশের শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোর আন্তর্জাতিক বাজারে প্রবেশ এবং বৈশ্বিক ভ্যালুচেইনের সঙ্গে সম্পৃক্ত করার জন্য সহায়তা প্রদান। এ কর্মসূচির আওতায় খাতভিত্তিক কারিগরি প্রশিক্ষণ, পরিবেশগত, সামাজিক এবং কোয়ালিটি রেফারেন্স গাইড বই প্রণয়ন, কর্মশালা, বিজনেস প্রমোশন কাউন্সিলের সক্ষমতা বৃদ্ধি, শিল্প প্রতিষ্ঠানের বিদ্যমান অবস্থা ও রফতানি বাজারে প্রবেশের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় সক্ষমতার মধ্যকার ঘাটতি নির্ণয়, এক্সপোর্ট রেডিন্সে ফান্ড গঠন, রফতানি বাজার সম্পর্কে সচেতনতা বাড়ানো এবং মার্কেট ইনটেলিজেন্স ও মার্কেট ব্র্যান্ডিং সংক্রান্ত কাজ করা হবে।
উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি : এ কর্মসূচিটি পরিচালনায় ব্যয় ধরা হয়েছে (জমি ও করসহ) ৪০০ কোটি ৬০ লাখ টাকা। এ অংশের উল্লেখযোগ্য দিক হচ্ছে, চারটি কার্যকর টেকনোলজি সেন্টার প্রতিষ্ঠা করা। এসব সেন্টার আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশের পণ্যের বাজার সৃষ্টিতে কারিগরি ও শ্রম দক্ষতা সংশ্লিষ্ট প্রতিবন্ধকতা দূর করবে। টেকনোলজি সেন্টারগুলো চামড়া ও জুতা শিল্পের ডিজাইন ও অন্যান্য কারিগরি সেবা দেয়া, সাধারণ প্রকৌশল সেবার জন্য টেকনোলজি সেন্টার এবং টেস্টিং এবং ক্যালিব্রেশন সেন্টার হিসেবে কাজ করবে।
অবকাঠামোগত প্রতিবন্ধকতা দূর করার লক্ষ্যে সহায়তা : এ কর্মসূচি বাস্তবায়নে ব্যয় ধরা হয়েছে ৩৩৫ কোটি টাকা। এ অংশের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে আগে উল্লিখিত শিল্পের ক্লাস্টারগুলোতে সুনির্দিষ্ট কিছু ক্ষেত্রে অবকাঠামোগত উন্নয়নে অর্থায়ন করা। যেমন সংযোগ সড়ক, কমন রি-সাইক্লিং ম্যানেজমেন্ট ফ্যাসিলিটি, কোল্ড স্টোরেজ, বাইসাইকেল ও অটোমোবাইল জাতীয় শিল্পের জন্য বিশেষায়িত কমন সার্ভিসেস ফ্যাসিলিটি প্রতিষ্ঠা করা।
প্রকল্প বাস্তবায়ন-মনিটরিং ও মূল্যায়ন খাত : এ অংশ পরিচালনায় ব্যয় ধরা হয়েছে ৩৬ কোটি ৮০ লাখ টাকা। এর আওতায় প্রকল্প বাস্তবায়ন সংশ্লিষ্ট কর্মকান্ডের জন্য অর্থায়ন করা হবে। যার মধ্যে রয়েছে প্রকল্প বাস্তবায়ন ইউনিট, টেকনিক্যাল, সেফগার্ড, মনিটরিং ও মূল্যায়ন ইত্যাদি।
যে সকল বিষয় গুরুত্বপূর্ণ : ১. নতুন বাজারে প্রবেশের সহায়তা কর্মসূচি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পরিকল্পনা। এই সহায়তা কর্মসূচির মধ্যে অনেকগুলি পদক্ষেপের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এই সকল কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা গেলে নতুন নতুন বাজার সৃষ্টি অতি সহজ হবে। মজার কথা হলো, সরকার বেশ ভালো ভালো প্রকল্প গ্রহণ করে। কিন্তু তা বাস্তবায়ন হয় ধীর গতিতে এবং মানহীনভাবে। সরকারকে এই প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য দক্ষ জনশক্তি গঠন করতে হবে। দক্ষ প্রশাসন না হলে প্রকল্প বাস্তবায়ন করা যাবে না। এই প্রকল্পে ব্যয় ধরা হয়েছে ১৫৮ কোটি টাকা। এই বিপুল অর্থ ঠিক মত, স্বচ্ছতার সঙ্গে, দক্ষতার সঙ্গে ব্যয় না হলে প্রকল্প গ্রহণে তেমন কোন সুবিধা রফতানিকারকগণ পাবেন না। এই বারই প্রথম বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে বেশ বড় প্রকল্প গ্রহণ করা হলো। এখন দেখা যাবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের দক্ষতা কেমন রয়েছে। কেমন দক্ষতার সঙ্গে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করতে পারে। প্রকল্প বাস্তবায়নের ওপর নির্ভর করবে ফলাফল।
২. উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি প্রকল্প দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প। এই প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে ৪০০ কোটি ৬০ লক্ষ টাকা। এই বিপুল অঙ্কের প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে চামড়া ও চামড়াজাত শিল্পের বিকাশ অনেক বেশি হবে। তবে এই ক্ষেত্রে তৈরি পোশাক শিল্পের জন্য ফ্যাশন ও ডিজাইন প্রকল্প যুক্ত করা প্রয়োজন। কারণ আগামীতে তৈরি পোশাক শিল্পেরও উত্তরণের জন্য ব্যাক ওয়ার্ড শিল্প স্থাপন করতে হবে। এই জন্য প্রয়োজন আন্তর্জাতিক মানের ফ্যাশন ও ডিজাইন ইন্সটিটিউট। যা এখনো বাংলাদেশে নেই। এইটি বিজিএমইএ ও সরকার যৌথভাবে করা প্রয়োজন।
৩. অবকাঠামোগত প্রতিবন্ধকতা দূরীকরণের লক্ষ্যে সহায়তা প্রকল্প তৃতীয় গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প। এই প্রকল্প খুবই প্রয়োজনীয়, বাংলাদেশে অবকাঠামোগত উন্নয়নের অভাবে দেশি বিদেশি বিনিয়োগ বৃদ্ধি পাচ্ছে না। অবকাঠামোগত প্রতিবন্ধকতা অনেক বেশি। সকল শিল্প খাতে এই সমস্যা বিরাজমান। এই প্রকল্পে ব্যয় ধরা হয়েছে ৩৩৫ কোটি টাকা। কিন্তু এত অল্প অর্থ দিয়ে এই বিশাল অবকাঠামোগত প্রতিবন্ধকতা দূর করা খুবই কঠিন কাজ। এই প্রকল্পের ব্যয় বৃদ্ধি করা প্রয়োজন।
৪. প্রকল্প বাস্তবায়ন মনিটরিং ও মূল্যায়ন খাত নামে দুইটি প্রকল্প হাতে নেয়া হচ্ছে। এই প্রকল্প অন্তত গুরুত্বপূর্ণ। এই প্রকল্পে ব্যয় ধরা হয়েছে ৩৬ কোটি ৮০ লক্ষ টাকা। কিন্তু বিশাল শিল্প খাতের বিকাশের জন্য মনিটরিং ও মূল্যায়ন খাতে এই সামান্য অর্থ কোন রকমের ভূমিকা রাখতে পারবে না বলে মনে হয়। এই খাতে অর্থের পরিমাণ অনেক বেশি বৃদ্ধি করতে হবে। মনিটরিং ও মূল্যায়নের অভাবে আমাদের কোন কোন প্রকল্প গুণগতমান সম্পন্ন হয় না। যে কোন প্রকল্পে দেখা যায়, প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার পূর্বে প্রকল্পটি অক্ষম বা কোন অবদান রাখতে সক্ষম হয় না। তাই প্রকল্প বাস্তবায়নের সমুদয় খরচ জলে চলে যায়।
৫. দুর্নীতি বাংলাদেশ সবচেয়ে বড় সমস্যা। এই বিশাল প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য সকল ক্ষেত্রে দুর্নীতিমুক্ত থাকার দিক নির্দেশনা থাকা প্রয়োজন। দুর্নীতিমুক্তভাবে প্রকল্পগুলি সমাধা করার জন্য বিশেষ নীতিমালা তৈরি করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় প্রকল্প বাস্তবায়ন কাজ শুরু করা প্রয়োজন। এই বিপুল অংকের ৯৪১ কোটি টাকার প্রকল্পসমূহকে বাস্তবায়নের জন্য দুর্নীতিমুক্ত নীতিমালা ছাড়া সম্ভব নয়। গুণগতমান সম্পন্ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে হলে দুর্নীতিমুক্ত হতে হবে। এই জন্য এই সকল প্রকল্পের শীর্ষ কর্মকর্তা থেকে শুরু করে সকল পর্যায়ে কর্মকর্তার স্বচ্ছতা, সততা নিশ্চিত দেয়া প্রয়োজন। কারণ এই ধরনের প্রকল্প বাংলাদেশে এই প্রথম।
লেখক: সাবেক সহসভাপতি এফবিসিসিআই, বিটিএমএ, বিজেএমইএ, প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ইস্টার্ন ইউনিভার্সিটি
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।