ইভিএম-এ ভোট কেন?
আগামী জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম-এ ১৫০ আসনে ভোট গ্রহণের পরিকল্পনার কথা জানিয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার। কাকতালীয় কিনা জানি না, ১৫০ সংখ্যাটা আমাদের এর আগে চিনিয়েছিলেন রকিবুল
স্বাধীন বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে অশনি সংকেতের সূত্রপাত ’৭৫ এর ১৫ আগস্টে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মধ্য দিয়ে সূচিত হয়। তবে মুক্ত ও উদার রাজনীতির আকাশে কালোমেঘ দানা বাঁধে বাকশাল প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। এরপর এর ধারাবাহিকতায় ক্যু, পাল্টা ক্যু-এর মাধ্যমে কখনো স্বৈরশাসন, গণতন্ত্র হত্যা আবার কখনো গণতন্ত্র উদ্ধারের আন্দোলন, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা, প্রহসনের নির্বাচন আবার নিরপেক্ষ সরকারের ভূমিকায় কতিপয়ের বিরাজনীতিকরণের অপপ্রয়াস-এভাবেই হোঁচট খেয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে এগিয়েছে রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক কাঠামো। বাংলাদেশে গণতন্ত্রের এখনো উদার বিকাশ ঘটেনি। অর্থনৈতিক সূচকসহ স্বাবলাম্বনের বহু ক্ষেত্রে প্রভূত উন্নতি হয়েছে বটে কিন্তু পরমতসহিষ্ণুতার ক্ষেত্রটি সংকুচিত রয়ে গেছে। তা স্থির আছে বললেও ভুল হবে বরং এটা প্রত্যহ সংকুচিত হচ্ছে। সর্বশেষ ’১৪ সালের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন দেশ-বিদেশে বিতর্কিত হওয়ায় দেশের গণতান্ত্রিক শুদ্ধাচার তুমুল ধাক্কা খেয়েছে। ১৫৪ আসনের সাংসদরা বিনা প্রতিদ্ব›িদ্বতায় নির্বাচিত হওয়ায় দেশের অভ্যন্তরে গণতান্ত্রিক কাঠামোয় সুষ্ঠু প্রতিযোগিতার দৃষ্টান্ত দুর্লভ হয়েছে। এর ধারাবাহিকতায় ১১তম নির্বাচন কমিশনার তথা রকিব উদ্দিনের নেতৃত্বে দেশে জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ে যতগুলো নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে তার একটাও বিতর্কমুক্ত থাকেনি। সমালোচকরা বলেছেন, বিগত বেশ কিছু নির্বাচনে ভোটের দিনের আগের রাত্রেই ফলাফল নির্ধারিত হয়ে গেছে। কেন্দ্র দখল, বিরোধীদের ভোট কেন্দ্রে প্রবেশে বাধা, আক্রমণ, হতাহতের ঘটনা, ব্যালট পেপার ও বাক্স কেড়ে নেয়ার দৃশ্য নৈমিত্তিক চিত্র ছিল। শুধু দুর্ভাগ্যের ছিল, মিডিয়ায় সেসব নির্বাচন সম্পর্কিত নানা কুকীর্তি প্রকাশিত হওয়ার পরেও প্রধান নির্বাচন কমিশনার তার স্বাভাবসূলভ ভঙ্গিতে দেশবাসীকে জানিয়েছেন, নির্বাচন যথেষ্ট সুষ্ঠু হয়েছে। যে কারণে দেশের সকল নির্বাচন কমিশনের মধ্যে একাদশ নির্বাচন কমিশন ও প্রধান নির্বাচন কমিশনার বহুল বিতর্কিত অধ্যায় হিসেবেই ইতিহাসে ঠাঁই পেয়েছে।
যেসব দেশ গণতন্ত্রের সূতিকাগার হিসেবে খ্যাত এবং গণতান্ত্রিক কাঠামোর পূর্ণতা যেসব রাষ্ট্রে লাভ করেছে সেখানেও পক্ষে-বিপক্ষে কথার লড়াই চলে। কিন্তু যারা অতীতে সরকারে ছিল এবং এখনো দেশের অন্তত এক-তৃতীয়াংশের অধিক মানুষের সমর্থন যাদের আছে, সে দলের দ্বিতীয় শীর্ষ ব্যক্তির ওপর অজ্ঞাত রাজনৈতিক দলের কর্মীদের হামলার ঘটনা এবং বেশ কিছু প্রভাবশালী নেতা আহত হওয়ার ঘটনা নিঃসন্দেহে রাজনৈতিক অঙ্গনের অশনি সংকেত। পার্বত্য অঞ্চলে পাহাড় ধ্বসে বিপর্যস্ত মানুষকে ত্রাণ দিতে গিয়ে বিএনপির মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ সঙ্গীদের গাড়িবহরের ওপর যারাই হামলা করুক, উদার ও গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে এটা সুখকর পরিস্থিতির নিদর্শন প্রতিষ্ঠা করেনি। এ কান্ডে জড়িত অপরাধীদের চিহ্নিত ও শাস্তি নিশ্চিতকরণে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগকে যথেষ্ট আন্তরিক হওয়া উচিত ছিল। এছাড়া বন্যার্তদের ত্রাণ দিতে গিয়ে বিএনপির নেতা-কর্মীদের বাধার সম্মুখীন হওয়া, প্রশাসনিক অনুমতি না পাওয়াও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্য দাবি হতে পারে না। বন্যার্ত, বিপর্যস্ত এবং চাল-চুলোহীন অসহায় মানুষকে সাহায্য করার মাধ্যমে যদি বিএনপি ভোটের রাজনীতিতে তার ভোটারদের অনুকম্পা লাভের আকাঙ্খাও দেখায় তারপরেও বিএনপির এ কাজকে বাধাগ্রস্থ করা, হামলা করা কোন হেতুতেই যৌক্তিক হয়নি। কেননা ভোটারদের জনমত নিজেদের পক্ষে রাাখতে ক্ষমতার বাইরের মানুষের চেয়ে ক্ষমতার ভেতরের মানুষের ক্ষমতা বেশি। যেহেতু তাদের দ্বারা অসহায় মানুষকে সাহায্য করার সুযোগ বেশি তাই বিএনপিকে বাধাগ্রস্থ করে নয় বরং প্রতিযোগিতার মাধ্যমে অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ানোর প্রয়াস যদি পরিলক্ষিত হতো তবে সেটা গণতান্ত্রিক যাত্রাকে মসৃণ পথে পরিচালিত করত। রাষ্ট্রের নানাবিধ সমস্য ও জটিলতা সত্তে¡ও শুধু মানবিকতার কারণে সরকার মায়ানমারে আক্রান্ত লাখ লাখ রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশে আশ্রয় দিয়েছে। এটা ক্ষমতার বাইরে যারা আছে তাদের সাধ্যের বাইরে। কাজেই রোহিঙ্গাদের ব্যথায় মর্মাহত হয়ে যে বাংলাদেশিরা ব্যথা অনুভব করেছে তারা নিশ্চয়ই সরকারের এ সিদ্ধান্তকে সাধুবাদ জানাবে। ক্ষমতার বাইরের কেউ রোহিঙ্গাদের যদি খাদ্য-বস্ত্র দিয়ে সাহায্য করেও তবে সেটা নিশ্চয়ই সরকারের ভূমিকার সামনে বৃহৎ হয়ে প্রকাশ পাবে না। সুতরাং রাজনীতির খাতিরে রাজনীতি, মৌখিক তর্কের দ্বারা জনমত টানার প্রয়াস নিশ্চয়ই অমূলক নয়, কিন্তু হামলার মাধ্যমে রক্তাক্ত করণের দ্বারা যদি কোন পক্ষকে মানুষের কাছে পৌঁছা থেকে বিরত রাখার অপচেষ্টা হয় এবং সরকার সেখানে নিরব ভূমিকা পালন করে তবে সেটা কোনভাবেই সুশাসনের প্রকৃতি নয় বরং এতে আক্রান্তদের জন্য মানুষের অনুকম্পা বাড়ায়, জনপ্রিয় করে।
অজ্ঞাত ব্যক্তি কর্তৃক দৃশ্যমান সরকার বিরোধীদের গুম-খুনের ত্রাস কায়েম হয়েছে। মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় নেমে এসেছে ভীতিকর পরিবেশ। পিতার অপেক্ষায় কাঁদছে সন্তান, স্বামী ও সন্তানের অপেক্ষায় প্রহর গুনছে স্ত্রী ও পিতামাতা। অন্তত যাদের লাশ মিলেছে তারাও মোটামুটি মুক্তি পেয়েছে কিন্তু বছরের পর বছর যাদের কোন হদিস হয়নি তাদের পরিবার ও স্বজনদের প্রত্যেকের প্রতিমুহুর্ত কি বিভীষিকার মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হচ্ছে তা কি রাষ্ট্র উপলব্ধি করতে পারছে? গণতান্ত্রিক পথ ও পদ্ধতিতে ক্ষমতার চক্র পালাবদলের। কাজেই মানুষের জীবন নিয়ে খেলার এমন প্রক্রিয়া যদি কালান্তর জুড়ে বিরাজিত থাকে তবে গণতন্ত্রের বয়স বুড়ো হবে বটে কিন্তু আচরণে সেটা শিশুই রয়ে যাবে। রাষ্ট্র যদি মানুষের জীবন ও সম্পদের নিরাপত্তা প্রদানে ব্যর্থ হয় তবে উন্নয়নের ঝান্ডা উড়িয়ে স্বার্থকতা কোথায়? গুম-খুনের যে সংস্কৃতি চলমান তা রাষ্ট্রকে স্ব উদ্যোগে বন্ধ করতে হবে। রাষ্ট্রের প্রত্যেকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা আবশ্যক। ইতিহাসের অন্যতম ধর্মই হলো ইতিহাস প্রতিশোধ পরায়ণ। সুতরাং রাষ্ট্র যাতে সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক কাঠামোবদ্ধ হতে পারে তেমন মহতী উদ্যোগ কি আমরা রাজনৈতিক পরিমন্ডল থেকে আশা করতে পারি না?
গণতন্ত্রের পথে অগ্রসর হওয়ার জন্য বাংলাদেশের উচিত বিভিন্ন দেশের গণতান্ত্রিক কাঠামো অনুসরণ করা। বিশ্বের বহু রাষ্ট্রে গণতান্ত্রিক উত্থান-পতনের বহু গল্প সৃষ্টি হয়েছে, কিন্তু আমাদের নিকট প্রতিবেশী ভারত ব্যতিক্রম। এখানে গণতন্ত্র বিকশিত হয়েছে শুদ্ধ ভিত্তিতে। রাজনীতিকদের সদিচ্ছা ছাড়া গণতান্ত্রিক কাঠামো শৃঙ্খলাবদ্ধ হতে পারে না। বাংলাদেশের শুরু থেকেই লক্ষ করা গেছে, এখানে যারাই যখন বিরোধীদলে যায় তাদের ওপর বিভিন্ন প্রকৃতির অসংখ্য মামলা রুজু করা হয়। গ্রাম পর্যায়ের কর্মী থেকে সর্বোচ্চ ব্যক্তিটি পর্যন্ত কেউ মামলার প্রকোপ থেকে রক্ষা পায় না। অন্যদিকে আদালতে দোষী সাব্যস্ত হওয়া ও দন্ড ঘোষিত হওয়ার পরেও এখানে মন্ত্রিত্বে বহাল তবিয়তে থাকে। বিশ্বের বুকে এক্ষেত্রে শুধুমাত্র বাংলাদেশই বোধহয় ব্যতিক্রম। ব্যক্তিকেন্দ্রিক নৈতিকতা, জবাবদিহিতামূলক মানসিকতা, দুর্নীতিহীন দেশপ্রেম, ক্ষমতার প্রতি অতিরিক্ত আসক্তি ত্যাগ, সর্বোপরি রাষ্ট্র ও জনগণের থেকে প্রাপ্ত দায়বদ্ধতা পালন ছাড়া সুশাসন প্রতিষ্ঠা হতে পারে না। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে স্বাধীন বিচারবিভাগ ছাড়া আরও কিছু সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান আছে যাদেরকে স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নিতে না দিলে গণতন্ত্র থেকে রাষ্ট্রকে বিচ্যুত হতেই হবে। অথচ বারবার প্রতীয়মান হয়েছে, এসব প্রতিষ্ঠানের কোন সিদ্ধান্ত যখন শাসকশ্রেণির বিরুদ্ধে গেছে তখন রাষ্ট্রের বিভিন্ন বিভাগের মধ্যে টানাপোড়েন সৃষ্টি হয়েছে। তখন যে কেউ অনায়াসে আদালত অবমাননাতুল্য উক্তি করে রক্ষা পেয়েছেন। লাগামহীনভাবে যা ইচ্ছা তা বলে ভীতিকর পরিবেশ সৃষ্টি করে প্রাতিষ্ঠানিক স্বাধীনতাকে দমিয়ে রাখা হয়েছে।
বাংলাদেশ নিঃসন্দেহে অমিত সম্ভাবনার দেশ। অথচ স্বাধীনতার সাড়ে ৪ দশক পাড়ি দিয়েও আমরা কাঙ্খিত গন্তব্যে পৌঁছতে পারিনি। বহুক্ষেত্রে আমাদের উন্নতি ঘটেছে বটে কিন্তু হু হু করে বাড়ছে বেকারত্ব, কমছে বৈদেশিক বিনিয়োগ, ঘটছে অর্থ পাচার, লাগামহীন হয়েছে দুর্নীতি, বিস্তার ঘটেনি উদারতার বরং সংকোচন ঘটেছে পরমতসহিষ্ণুতার। ক্ষমতার মোহ দায়িত্বশীলদেরকে নীতি-নৈতিকহীন করে রাষ্ট্রকে ঠেলে দিয়েছে অনিশ্চয়তা ও অস্থিরতার মুখে। রাষ্ট্রের স্থপতিকে নিয়ে চরম দলীয়করণ, বারবার রাষ্ট্রের জন্ম ইতিহাসের বিকৃতির মাধ্যমে প্রজন্মকে ফেলা হয়েছে ঘোরের মধ্যে। দায়িত্বশীলদের কথা ও কাজের সমন্বয়হীনতায় উদ্ভব হয়েছে বিতর্কের। রাষ্ট্রের বুদ্ধিজীবিদের দলীয়করণের মাধ্যমে স্বীকৃতি-সম্মান প্রদানের প্রবণতা রাষ্ট্রকে পেছনে নিয়ে গেছে। শিক্ষাক্ষেত্রে নৈরাজ্য রুখতে ব্যর্থ হওয়া প্রজন্ম পঙ্গুত্ব বরণের দ¦ারপ্রপান্তে। কাজেই সবকিছু মিলিয়ে রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক কাঠামোর ভাগ্যাকাশে আবারও নতুন করে যে অশনি সংকেতের সাক্ষাৎ মিলছে তাতে সম্ভাবনার চেয়ে শঙ্কার লাভা উদগীরণের প্রবল চাপ। রাষ্ট্রের সকল নাগরিককে তার মৌলিক অধিকারের কর্মাবলী সুচারুরূপে সম্পাদনের সুযোগ দিলে এবং জনগণের ম্যান্ডেড নিয়ে দুর্নীতিহীন রাষ্ট্র কাঠামো নির্মাণ করতে পারলে তবেই কেবল আমরাও উন্নত গণতন্ত্রের সারথী হতে পারবো। রাষ্ট্র পাবে সুশৃঙ্খল পথ চলার সুদৃঢ় ভিত্তি।
লেখক: কলামিস্ট
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।