Inqilab Logo

রোববার ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৭ আশ্বিন ১৪৩১, ১৮ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬ হিজরী

রাষ্ট্রায়াত্ত প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে বাজার ব্যবসায়ীদের হাতে ছেড়ে দেয়া যায় না

এবিসিদ্দিক | প্রকাশের সময় : ১১ সেপ্টেম্বর, ২০১৭, ১২:০০ এএম

একজন সাবেক বাণিজ্য সচিব বলেছেন, ‘চিনি উৎপাদনের জন্য সরকারি চিনি কল রাখার কোন মানে নেই। এসব চিনিকলে স্পিরিট ও অন্যান্য পণ্য উৎপাদনের ব্যবস্থা করা উচিত’। তিনি তার মতো করেই বলেছেন, রাষ্ট্রায়াত্ত প্রতিষ্ঠান রেখে লাভ কী? বলা বাহুল্য, নিত্য প্রয়োজনীয় ভোগ্য পণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণ ব্যবসায়ীদের হাতেই ছেড়ে দেয়ার সুফলতো আমরা দেখতে পাচ্ছি। চিনি, চাল, ডাল, তেল, পেঁয়াজ, আদা, আদা রসুন থেকে শুরু করে যাবতীয় ভোগ্য পণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণতো ব্যবসায়ীরাই করছেন। আর খেসরারত দিচ্ছেন ভোক্তা সাধারণ। চিনি বাজার নিয়ন্ত্রণ করছেন ৫/৬ জন মিল মালিক ও আমদানিকারক। আর আমদানিকৃত ঝক ঝকে সাদা চিনি যে ‘বিষ’ তা এখন গোটা বিশে^র মানুষ জানেন। চিনি কলগুলো বন্ধ করে দিলে গোটা চিনির বাজার ব্যবসায়ীদের একক নিয়ন্ত্রণে চলে যাবে। বেকার হবে সাড়ে ২২ হাজার শ্রমিক কর্মচারী। এছাড়া এই শিল্পের সাথে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত কয়েক লাখ চাষি। চিনি শিল্প হলো কৃষিভিত্তিক ভারি শিল্প। কাজেই সেটাও বিবেচনায় রাখতে হবে। বাজার নিয়ন্ত্রণ শুধু ব্যবসায়ীদের হাতে ছেড়ে দিলেই হবে না, ভোক্তার কথাও ভাবতে হবে। অতি সম্প্রতি দেখেছি চাল কল মালিকরা কীভাবে চালের দাম বাড়িয়ে মুনাফা লুটেছেন বা লুটছেন। এক লিটার সয়াবিন তেলে ৮ থেকে ১২ টাকা, এক কেজি চিনিতে ১০ থেকে ১২ টাকা মুনাফার কথাও জানি। রাষ্ট্রায়াত্ত প্রতিষ্ঠান বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেয়া বা বন্ধ করে দেয়া খুবই সহজ বটে, তবে গড়ে তোলা খুবই কঠিন। এদেশে শত শত রাষ্ট্রায়াত্ত বৃহৎ প্রতিষ্ঠান বন্ধ বা বিক্রি করে দেয়া হয়েছে বিশ^ব্যাংক আর আইএমএফ’র পরামর্শ বা তাগিদে। গড়ে উঠেছে কয়টি? বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস করপোরেশনের(বিটিএমসি’র) ৮৬টি বৃহৎ শিল্পের মধ্যে বর্তমানে চালু আছে মাত্র ৩টি। আর ৮৩টি শিল্পই বিক্রি, বন্ধ এমনকি কয়েকটির অস্থিত্বই বিলীন হয়ে গেছে। ১৯৮২ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ পাট কল করপোরেশনের অধীন বৃহৎ মিলের সংখ্যা ছিল ৮২টি, বর্তমানে চালু আছে ২৬টি। বাংলাদেশ রসায়ন শিল্প করপোরেশনের প্রতিষ্ঠান কতটি ছিল তার সঠিক কোন তথ্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ দিতে পারেননি। তবে একজন কর্তাব্যক্তি বললেন ২৮টির মতো ছিল এখন আছে ১৩টি। বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশনের প্রতিষ্ঠান ছিল ৪৪টি, এখন আছে ১৫টি। বাংলাদেশে এশিয়া মহাদেশ তথা বিশে^র অন্যতম পাটকল ছিল আদমজি। বিশে^র সেরা তেল মিল ছিল কিশোরগঞ্জের কুলিয়ারচরে। অনেক বড় বড় প্রতিষ্ঠান ছিল যেগুলোর কোন চিহ্নিই নেই। বিশ্ব ব্যাংক আর আইএমএফ’র তাগিদে বাংলাদেশ বিরাষ্ট্রীয়করণ শুরু করে। অজুহাত হচ্ছে সেগুলো লোকসানী। এখনও অবশ্য লোকসান দিয়েই যাচ্ছে। আর লোকসানের কারণ মূলতঃ লুটপাট। যেটি স্বাধীনতার পর পরই শুরু হয়েছিল। ১৯৭২-৭৫ সমাজতন্ত্রের নামে বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠানকে জাতীয়করণ করা হলেও আসলে জাতীয়করণকে ব্যবহার করা হয়েছিলো দেশীয় লুটরো ও ব্যাবসায়ী পুঁজির আদিম সঞ্চয়ণে। সে অনেক বড় ইতিহাস। সেই ইতিহাসে আর যাচ্ছি না। রাষ্ট্রায়াত্ত শিল্পের বিরাষ্ট্রীয়করণ শুরু হয় ১৯৯৭ থেকেই। আর ১৯৮১ পর্যন্ত মোট ২৫৫টি রাষ্ট্রায়াত্ত শিল্প প্রতিষ্ঠান বেসরকারিকরণ করা হয়, যার মধ্যে ১১০টি ছিল বৃহৎ আকারের পাবলিক সেক্টর কর্পোরেশান এর অন্তর্ভুক্ত। বাংলাদেশ শিল্পব্যাংক ও শিল্প ঋণ সংস্থা সহ সরকারি ব্যাংকের মাধ্যমে এসময় এসব বেসরকারিকৃত শিল্পের নব্য মালিকদেরকে স্বল্পসুদে ঋণ সরবরাহ করা হয়, সস্তায় কাঁচামাল আমদানী ও বাজার মূল্যের চেয়ে কমে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের সুযোগ, সাত বছরের ট্যাক্স হলিডের সুবিধা দেয়া হয়। কিন্তু এভাবে প্রাপ্ত সুবিধাদি শিল্পে বিনিয়োগের বদলে বিনিয়োগ করা হয় অন্য ব্যাবসা-বাণিজ্য, আমদানী-রপ্তানির কাজে। ফলে ১৯৭৫ থেকে ৮১ সাল পর্যায়ে বাংলাদেশ শিল্প ব্যাংক ও শিল্প ঋণ সংস্থাকর্তৃক বিতরণকৃত ঋণের ৯৫% বেসরকারি খাতে গেলেও, বেসরকারি শিল্পে বিনিয়োগের পরিমাণ তেমন বাড়েনি, কারণ ঋণ পুরোটাই অনুৎপাদনশীল খাতে ব্যবহার হয়েছে। এভাবে ঋণের টাকা অনুৎপাদনশীল খাতে ব্যাবহার করে ঋণগ্রহীতা শিল্পপতিরা কিছুদিনের মধ্যেই ঋণ খেলাপি হিসেবে আবির্ভূত হয় ও নিজেদেরকে দেউলিয়া ঘোষণা করে সব দায় দেনা থেকে রেহাই পেয়ে যায়! (সূত্র: পলিটিকস অব প্রাইভেটাইজেশান ইন বাংলাদেশ, মোবাশ্বের মোনেম, ২০০৬)। এরশাদের আমলে (১৯৮২-১৯৯০) এই ধারা অব্যাহত থাকে এবং ত্বরান্বিত হয়। ১৯৮২ সালের নতুন শিল্পনীতিতে বেসরকারিকরণের উপর আরো জোর দেয়া হয়, মাত্র ৬টি সেক্টর ছাড়া আর সমস্ত সেক্টরে বেসরকারি বিনিয়োগ অবাধ করে দেয়া হয়। দেশীয় পুঁজিপতি ও বিদেশি সংস্থা বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ এর আস্থায় আসার জন্য অবিশ্বাস্য দ্রæত গতিতে বেসরকারিকরণ শুরু হয়। এক বছরের মাথায় ২৭টি টেক্সটাইল মিল ও ৩৩টি পাট কল জলের দরে বেচে দেয়া হয়। এছাড়া ১৬ মাসের মাথায় ক্রেতার পছন্দ অনুযায়ী ২১টি মাঝারি শিল্প বেচে দেয়া হয়। যার ৭৮ ভাগই ছিল লাভজনক এবং বিক্রি করার কিছু দিনের মধ্যেই যার ৮০% উৎপাদন হ্রাস ও আর্থিক ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয়। বিশ্বব্যাংকের দলিল অনুসারে, ১৯৮২ সালের শিল্পনীতি অনুসারে পাট ও টেক্সটাইল মিল ছাড়াও আরো ৪৭৪টি শিল্প ও ২টি সরকারি ব্যাংক বেসরকারিকরণ করা হয় (সূত্র: জুট ইন্ডাস্ট্রি রিহ্যাবিলিটিয়েশান ক্রেডিট- প্রজেক্ট কম্পি¬শান রিপোর্ট, ১৯৯০)। বেসরকরিকৃত শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোর উপর ১৯৮৬ সালে চালানো এক গবেষণায় দেখা যায়, বেসরকারিকরণের পর পাটকলগুলোর উৎপাদনশীলতা রাষ্ট্রীয় খাতে থাকার সময়ের তুলনায় কমেছে, টেক্সটাইল মিলগুলোর গড় উৎপাদন কমেছে ও আর্থিক পরিস্থিতি খারাপ হয়েছে এবং সর্বোপরি মিলগুলোর সম্পদ হ্রাস পেয়েছে, ঋণ বেড়েছে। এ সময়ে কোটিপতি হওয়ার সবচেয়ে সহজ উপায় ছিল বেসরকারি শিল্পের নামে ঋণ নিয়ে ঋণ পরিশোধ না করা। ১৯৯০ সালের জুন মাস নাগাদ বাংলাদেশ শিল্প ব্যাংক ও শিল্প ঋণ সংস্থার কাছে শিল্পপতিদের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ১০৫০ কোটি টাকা। ১৯৯৩ সাল থেকে ২০১০ পর্যন্ত মোট ৭৫টি রাষ্ট্রায়াত্ত প্রতিষ্ঠান বিরাষ্ট্রীয়করণ করা হয়। বাংলাদেশ প্রাইভেটাইজেশান কমিশন ২০১০ সালে বেসরকারিকৃত শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোর বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করার উদ্দেশ্যে একটি সমীক্ষা করে। ‘বেসরকারি শিল্প প্রতিষ্ঠান সম্পর্কিত সমীক্ষা ২০১০’ নামের এই প্রতিবেদন থেকে দেখা যায় ৭৫টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ৩১টি শিল্প প্রতিষ্ঠানকেই বন্ধ পাওয়া গেছে। বাংলাদেশে রাষ্ট্রায়াত্ত বৃহৎ প্রতিষ্ঠান বিরাষ্ট্রীয়করণের নামে যে লুটপাট হয়েছে তা পৃথিবীতে হয়তো নজির বিহীন ঘটনা। আধুনিক বিশ্বে বিরাষ্ট্রীয়করণের পাশাপাশি রাষ্ট্রীয়করণকেও শক্তিশালী করা হচ্ছে। বিশেষ করে আমাদের মত গরিব দেশে ঢালাও ভাবে বিরাষ্ট্রীয়করণ কখনও সুফল বয়ে আনে না। রাষ্ট্রায়াত্ত শিল্প প্রতিষ্ঠান বন্ধ করার ফলে আমদানি নির্ভরতা বাড়ছে, হাজার হাজার মানুষ বেকার হয়েছে, শিল্পের উৎপাদন কমছে, জাতীয় অর্থনীতিতে চাপ বাড়ছে। যেমন- এক সময় ইউরিয়া সার রফতানি করা হতো, এখন আমদানি করতে হচ্ছে। ইউরিয়ার বার্ষিক চাহিদা প্রায় ২৩ লাখ টন, আর উৎপাদন হয় সাড়ে ৮ থেকে ৯ লাখ টন। এখানে উল্লে­খ্য, গ্যাস সংকটের কারণে কারখানাগুলো ঠিক মতো চালানো যাচ্ছে না। আর নতুন কারখানা না হওয়ায় চালু কারখানাগুলোও বন্ধ হওয়ার পথে এগুচ্ছে। চিনি কলগুলোর একই অবস্থা। বার্ষিক চাহিদা প্রায় ২০ লাখ টন, উৎপাদন হচ্ছে ৮০ থেকে ৮৫ হাজার টন, বাকিটা আমদানি করতে হচ্ছে তাও আবার মানব দেহের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর চিনি। বিশ্বের ৬৫টি দেশে পাটজাত পণ্যের ব্যাপক চাহিদা। উৎপাদন কম হওয়ায় চাহিদা অনুযায়ী রফতানি করা যাচ্ছে না। মূলতঃ শিল্পজাত পণ্যের উৎপাদন কম হওয়ায় আমদানি নির্ভরতা বেড়েই চলছে। মোট আমদানি ব্যয় এরই মধ্যে ৪৪ হাজার মিলিয়ন মার্কিন ডলার ছাড়িয়ে গেছে। আভ্যন্তরীণ উৎপাদনে যে সব পণ্যের চাহিদা মেটানো হতো, সেগুলো এখন আমদানি নির্ভর হয়ে পড়েছে। যদিও গোটা সরকারি-বেসরকারিভাবে শিল্পায়নে প্রতিযোগিতা চলছে। 

লেখক: সাংবাদিক



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন