Inqilab Logo

বৃহস্পতিবার, ০৪ জুলাই ২০২৪, ২০ আষাঢ় ১৪৩১, ২৭ যিলহজ ১৪৪৫ হিজরী

মানসম্মত শিক্ষা, তবুও অবহেলিত

মো. ইয়াছিন মজুমদার | প্রকাশের সময় : ১১ সেপ্টেম্বর, ২০১৭, ১২:০০ এএম

বর্তমানে স্কুল, কলেজ, মাদরাসায় সাধারণ বইগুলো একই। দশম শ্রেণি পর্যন্ত বই সরকারিভাবেই সরবরাহ করা হয়। সাধারণ শিক্ষায় ইংরেজি বিষয়ে শিক্ষার্থীরা সাধারণত ফলাফল খারাপ করে থাকে। অপর দিকে মাদরাসা শিক্ষার্থীকে ইংরেজির পাশাপাশি আরবী শিখতে হয়। দু’টি বিদেশি ভাষার মুখোমুখী হওয়ার পরও মাদরাসার ছাত্ররা বরাবরই পাবলিক পরীক্ষায় ফলাফল ভালো করছে। সাধারণ শিক্ষায় বারংবার প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনা ঘটলেও মাদরাসার ক্ষেত্রে তা দেখা য়ায় না। মাদরাসার পাঠ্য বিষয় সাধারণ শিক্ষার তুলনায় বেশি। এইচএসসি বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্রকে ১৩০০ নম্বরের পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে হয়, একই সমমানের মাদরাসা ছাত্রকে ১৭০০ নম্বরের পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে হয়। মাদরাসায় মানসম্মত শিক্ষা দেয়া হচ্ছে, তার বড় প্রমাণ হল বিশ^বিদ্যালয়গুলোর ভর্তি পরীক্ষায় মাদরাসা শিক্ষার্থীদের ভালো করা। বিগত কয়েক বছরের ঢাকা বিশ^ বিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার ফলাফলের দিকে তাকালে দেখা যাবে, অধিকাংশ বছরই মাদরাসার ছাত্র প্রথম স্থানসহ অনেকগুলো শীর্ষ স্থান দখল করেছে। এরপরও মাদরাসার ছাত্ররা যেন প্রতিযোগিতা করতে না পারে তার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ২০০ নম্বর করে বাংলা-ইংরেজি সিলেবাসে থাকার শর্ত করে দেয়। এতদিন মাদরাসায় আরবী প্রাধান্য থাকায় ১০০ নম্বর করে বাংলা ইংরেজি ছিল। ১০০ নম্বর পড়ে মাদরাসার ছাত্ররা ২০০ নম্বর পড়–য়া স্কুল-কলেজ ছাত্রদের থেকে মেধায় এগিয়ে থাকার প্রমাণ দিলেও শর্তারোপের কারণে বাধ্য হয়ে মাদরাসার মূল আরবী শিক্ষা কিছুটা সংকুচিত করে স্কুল-কলেজের ন্যায় ২০০ নম্বর করে বাংলা-ইংরেজি সিলেবাসভুক্ত করা হয়। এরপরও থেমে নেই মাদরাসা শিক্ষার্থীদের অগ্রযাত্রা ২০১৫-১৬ শিক্ষাবর্ষে ভর্তি পরিক্ষার ফলাফলে (পাশের হার ছিল ৯.৯৮) ‘ঘ’ ইউনিটে বিজ্ঞান শাখায় প্রথম হন মাদরাসার ছাত্র আবদুল্লাহ আল মামুন, মানবিক শাখা থেকে প্রথম হন মাদরাসার ছাত্র রিফাত হোসেন। ২০১৬-১৭ শিক্ষাবর্ষে ‘খ’ ইউনিটে প্রথম স্থান অধিকার করে মাদরাসা ছাত্র আবদুল্লাহ মজুমদার। তাছাড়া মেধা তালিকায় স্থান নেয়া সাধারণ শিক্ষার অনেকে এসএসসি পর্যন্ত মাদরাসায় পড়ে কলেজে ভর্তি হয়ে এইচএসসি পাশ করা। ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় মেধাস্থান প্রাপ্তদের গড়ে সকল বোর্ডে ভাগ করে দিলে মাদরাসা বোর্ড পাবে প্রায় ৫ জন, বাকীদের ভাগে গড়ে ১ জন করেও পড়বে না। এভাবে মেধার পরিচয় দেয়ার পরও উচ্চ শিক্ষিত সংকীর্ণমনা কিছু ব্যক্তির কারণে ভর্তিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে মাদরাসার ছাত্ররা বিরূপতার শিকার হচ্ছে। বিভিন্ন সময় সরকার মাদরাসা শিক্ষার ক্ষেত্রে সহযোগিতা ও অবদান রাখলেও বাস্তবতায় সাধারণ শিক্ষায় সরকারের সাহায্যের তুলনায় তা একেবারে নগণ্য। যে কোন ইউনিয়ন পর্যায়ের একটি স্কুলে গিয়ে তাদের সরকার প্রদত্ত অবকাঠামো এবং একই ইউনিয়নের একটি মাদরাসায় গিয়ে তাদের জন্য সরকারের প্রদত্ত অবকাঠামো, উপজেলা বা জেলা পর্যায়ে একটি কলেজের অবকাঠামো ও একই স্থানের সমমানের মাদরাসার অবকাঠামোর দিকে তাকালে তা বুঝতে মোটেও অসুবিধা হবে না। ১৯৯৪ সালে একই পরিপত্রে স্বতন্ত্র প্রাথমিক বিদ্যালয় ও স্বতন্ত্র ইবতেদায়ী মাদরাসা গড়ে ওঠে। বেতন ছিল মাসিক ৫০০ টাকা। ঐ প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোকে প্রথমে বেতন স্কেলের অন্তর্ভুক্ত ও পরবর্তীতে সরকারিকরণ করা হয়েছে। অপর দিকে ইবতেদায়ী মাদরাসা শিক্ষকের বেতন ৫০০ টাকার স্থলে বর্তমান সরকার ১০০০ টাকা করেছে। সরকারের পক্ষ থেকে হয়তো বলা হবে, আমরা স্বতন্ত্র ইবতেদায়ী মাদরাসা শিক্ষকদের বেতন দ্বিগুণ করেছি। কিন্তু সে দ্বিগুণ বেতন একজন শিক্ষকের মাসিক ১০০০ টাকা হওয়া উপহাস ছাড়া আর কিছু কি? তাদের সংযুক্ত ইবতেদায়ীর সমস্কেলে নিলেও ইজ্জত কিছুটা রক্ষা পেত। দেশে হাজার হাজার সরকারি স্কুল-কলেজ রয়েছে অথচ সরকারি মাদরাসা রয়েছে মাত্র ৩টি। বর্তমান সরকার ছয়শতাধিক স্কুল-কলেজকে নতুন করে সরকারিকরণের ঘোষণা দিলেও একটি মাদরাসাকেও সরকারিকরণের ঘোষণা অদ্যাবধি দেয়া হয়নি। চলতি অর্থ বছরের বাজেটে আমার জানা মতে, মাদরাসা ও কারিগরী শিক্ষার জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে পাঁচ হাজার কোটি টাকা। অথচ সাধারণ শিক্ষার জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে বিশ হাজার কোটি টাকা। বাংলাদেশ ছোট রাষ্ট্র, জনসংখ্যার ঘনত্ব বেশি, এদেশে চাকরির বাজার খুবই সীমিত। শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা প্রতি বছরই বৃদ্ধি পাচ্ছে। দেশে কর্মসংস্থানের অভাব থাকায় তারা বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছে। মধ্যপ্রাচ্য আমাদের বিশাল শ্রম বাজার। বৈদেশিক মুদ্রা যা দেশের অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করছে তার সিংহভাগ আসছে মধ্যপ্রাচ্য থেকে। মধ্যপ্রাচ্যের ভাষা আরবী, আরবী জানা ব্যতীত সেখানে গিয়ে ভালো চাকরি ও বেতন পাওয়া কঠিন। ভাষা শিখতে শিখতে ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে যায়। এক্ষেত্রে মাদরাসার ছাত্ররা ব্যতিক্রম, তারা সহজে ভাষা আয়ত্ত করে নেয়। এজন্য আমাদের পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্রের পশ্চিমবঙ্গের অনেক হিন্দু ছেলে মাদরাসায় ভর্তি হয়ে আরবী শিখছে। তারা আরবী ভাষা আয়ত্ত করে মধ্যপ্রাচ্যে গিয়ে চাকরি করছে। এক সময় জঙ্গী বলতে মাদরাসার ছাত্রদের দিকে অভিযোগের আঙ্গুল তোলা হতো। সে অভিযোগ মিথ্যা প্রমাণিত করে মাদরাসা শিক্ষিতরা মসজিদে জুমার খুতবায়, শ্রেণি কক্ষে, বিভিন্ন সভা সমাবেশে, কোরআন ও হাদিসের আলোকে জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে জনগণকে সচেতন করছে। এভাবে মাদরাসা শিক্ষিতরা মেধার ক্ষেত্রে, বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের ক্ষেত্রে, জঙ্গিমুক্ত জাতি গঠনের ক্ষেত্রে অবদান রাখার পরও সাধারণ শিক্ষার তুলনায় সুযোগ সুবিধা কম পাওয়া দুঃখজনক। আশা করি, সরকারিকরণ, অবকাঠামোগত সুবিধা দান, বাজেটে বরাদ্দ বৃদ্ধিসহ মাদরাসা শিক্ষার উন্নয়নে কর্তৃপক্ষ যথাযথ পদক্ষেপ নেবে।
লেখক : অধ্যক্ষ, ফুলগাঁও ফাযিল ডিগ্রি মাদরাসা, লাকসাম, কুমিল্লা



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন