Inqilab Logo

রোববার ১৭ নভেম্বর ২০২৪, ০২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৪ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সাক্ষরতাবিহীন উন্নয়ন নিষ্ফল

আফতাব চৌধুরী | প্রকাশের সময় : ১০ সেপ্টেম্বর, ২০১৭, ১২:০০ এএম

সভ্যতার অগ্রযাত্রায় শিক্ষা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। যে সমাজ বা জাতি শিক্ষায় যত প্রাধান্য দিয়েছে সে সমাজ তথা জাতির তত উন্নয়ন সাধিত হয়েছে। কাজেই উন্নয়নের পূর্বশর্ত শিক্ষা। শিক্ষা মানুষের মনকে প্রশস্ত করে এবং জ্ঞান বৃদ্ধি হয়। শিক্ষিত তথা অক্ষর জ্ঞান সম্পন্ন মানুষই পেরেছে সকল উন্নয়নের সক্রিয় অংশীদার হতে। শিক্ষা ছাড়া অন্যের ভাষা, সংস্কৃতি, অর্থনীতি বুঝা যায় না এবং এসব ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখাও সম্ভব না। অন্যকে জানতে না পারলে নিজের সক্ষমতা সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায় না। আর নিজের সক্ষমতা সম্পর্কে জানতে না পারলে নিজের আত্মপ্রত্যয় বা আত্মবিশ্বাস বিকশিত হয় না। কল্যাণজনক কাজ করতেও শিক্ষার প্রয়োজন রয়েছে। আজকে উন্নয়নে যারা নেতৃত্ব দিচ্ছে তারা একমাত্র শিক্ষিত বলেই তা পারছে। ব্রিটিশদের কথা ভাবলে দেখা যায়, একমাত্র শিক্ষাই তাদের এ বিশ্বকে জয় করতে এবং তাদের প্রভূত্ব বিস্তারে সহায়ক ভূমিকা রাখে। এতে প্রমাণিত হয় শিক্ষা মানুষকে পরিবর্তন করে দিতে পারে, পারে উন্নয়নের শিখরে পৌঁছে দিতে। পারে পরাধীনতার হাত থেকে মুক্ত করতে। সংগত কারণেই বিশ্ব নেতৃবৃন্দ ৬০ এর দশকে অনুধাবন করতে পেরেছিলেন যে, সার্বিক উন্নয়ন সাধন শিক্ষা ছাড়া অসম্ভব। তাই বিশ্বের ৮৮টি দেশের রাষ্ট্র প্রধানের উপস্থিতিতে ১৯৬৭ সালে এক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এর মধ্যে গণজাগরণ সৃষ্টির নিমিত্তে প্রতি বছর আন্তর্জাতিকভাবে সাক্ষরতা দিবস পালন, ২০০০ সালের মধ্যে সবার জন্য শিক্ষা নিশ্চিত; এ কাজে ধনী দেশ দরিদ্র ও উন্নয়নশীল দেশকে প্রয়োজনীয় সহায়তা দানে আশ্বাস প্রদান করার প্রতিশ্রুতি প্রদান করা হয়। যদিও কোন কোন দেশ এ সময়ের মধ্যে সফলকাম হতে পারেনি তথাপি প্রচেষ্টা অব্যাহত আছে। এসব দেশের তালিকায় বাংলাদেশও আছে। পরবর্তীতে এ লক্ষ্য পুনঃনির্ধারণ করে ২০২০ সাল পর্যন্ত বর্ধিত করা হয়েছে। সহস্রাব্দের উন্নয়ন লক্ষ্য বা মিলিনিয়াম গোল নির্ধারণ কালেও শিক্ষাকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। কাজেই সকল পর্যায়ে বিষয়টির গুরুত্ব রয়েছে।
বিশ্বে বর্তমানে একশ কোটিরও বেশি মানুষ নিরক্ষরতার অভিশাপে নিমজ্জিত। এর মধ্যে ৮০ কোটি বয়স্ক এবং ২০ কোটি শিশু এবং এর ৭০ থেকে ৭৫ শতাংশই এশিয়ার দেশ সমূহে। এ চিত্রের আলোকে জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সাংস্কৃতিক সংস্থা (ইউনেস্কো) সারা পৃথিবীতে সবার জন্য শিক্ষা আন্দোলনে একটি অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ করেছে। ইউনেস্কোর উদ্যোগে ১৯৬৫ খ্রিস্টাব্দের ১৯ সেপ্টেম্বর ইরানের তেহরানে সাক্ষরতা সম্পর্কে একটি বিশ্ব সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এ সম্মেলনে মোট ৮৮টি দেশের প্রতিনিধিগণ অংশগ্রহণ করেন। এ সম্মেলনের সিদ্ধান্ত অনুসারে ১৯৬৭ খ্রিস্টাব্দ থেকে প্রতিবছর ৮ সেপ্টেম্বর আর্ন্তজাতিক সাক্ষরতা দিবস হিসেবে উদযাপন করা হচ্ছে। সম্মেলনে আমাদের দেশের প্রতিনিধিও উপস্থিত ছিলেন এবং দলিলে সাক্ষর দিয়ে অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন। তারই পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশে প্রতিবছর দিবসটি সকল পর্যায়ে যথাযথ মর্যাদার সঙ্গে পালন করা হয়।
শিক্ষার প্রসারে জন্য সরকার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। বহুবিধ পদক্ষেপও গ্রহণ করা হয়েছে। ‘শিক্ষা নীতি ২০১৩’ ঘোষণা করা হয়েছে এবং বাস্তবায়ন চলছে। সকল শিশু যেন শিক্ষার সমান সুযোগ পায় সে ব্যাপারে বিভিন্ন পদক্ষেপও গ্রহণ করা হয়েছে। প্রতিবন্ধী শিশুরাও যেন বিদ্যালয়ে গমন ও অধ্যয়ন করতে পারে এ লক্ষ্যে বিশেষ ব্যবস্থাও গ্রহণ করা হয়েছে, স্কুল এলাকার সকল শিশু যেন স্কুলে ভর্তি হয় সে ব্যাপারে কঠোর ব্যবস্থাসহ, প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা, দরিদ্র ও মেধাবী শিক্ষার্থীদের জন্য উপবৃত্তি, স্কুলে টিফিন ইত্যেকার পদক্ষেপ গ্রহণ করায় প্রায় সকল স্কুল গমন উপযোগী শিশুরা বর্তমান ২০১৭ খ্রি. শিক্ষা বর্ষে শিক্ষা কেন্দ্রে তথা স্কুলে ভর্তি হয়েছে। এমনকি ঝরে পড়া শিশুরাও পুনরায় স্কুলে ভর্তি হয়েছে। শিক্ষা প্রসারে এনজিওগুলোরও কাজ করার সুযোগ সৃষ্টি করা হয়েছে। এ প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকলে শিক্ষায় আমাদের দেশ আর পিছিয়ে থাকবে না। বর্তমানে সকল পর্যায়ে শিক্ষার জন্য গণজাগরণ ঘটেছে। এখন দরিদ্র, হতদরিদ্র, পাহাড়ি, জেলে একদিন যাদের নিকট শিক্ষা ছিল অপ্রয়োজনীয় বিষয়, গুরুত্ব ছিল না, যাদের মুখে শোনা যেত শিক্ষিত হয়ে লাভ কী? ছেলেকে শিক্ষা দিলে যে আয় করবে তার চেয়ে এখন বেশি আয় করে। প্রত্যন্ত পাহাড়িদের মুখে শোনা যেত পোয়া (ছেলে) শিক্ষা পেলে তাকে হারাতে হবে, আমাদের শিক্ষার দরকার নেই। আজ ঐ সকল কথার পরিবর্তে শিশুকে কীভাবে শিক্ষা দেওয়া যায় সে কথা ভাবার যেন অন্ত নেই। যে কোনো মূল্যে শিশুর শিক্ষা চাই। অনেক ঝুঁকির মধ্যেও শিশুর ভবিষ্যৎ চিন্তায় পিতা-মাতা শিক্ষা দানের নিমিত্তে অন্যত্র পাঠিয়ে দিতেও কুণ্ঠিত বোধ করেন না। যদিও কোন কোন ক্ষেত্রে শিশু পাচারের ঘটনারও খবর পাওয়া যায়, তথাপি অভিভাবকগণ শিশু শিক্ষার জন্য বদ্ধপরিকর হয়ে পড়েছে। এটা শুভ লক্ষণ। এই ধারা অব্যাহত রাখা একান্ত প্রয়োজন।
শিক্ষার প্রসারতা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে বটে কিন্তু মানসম্মত শিক্ষার ঘাটতি রয়েছে প্রচুর। ঘাটতি রয়েছে সুশিক্ষার। আমরা উপলব্ধি করছি উচ্চ শিক্ষা গ্রহণের পর অনেক শিক্ষিত যুবকরা কর্মজীবনে সফলকাম হতে পারছে না। আবার যারা য্যেগ্যতা বা যেকোনভাবে পদ পেয়েছে তারাও তা ধরে রাখতে পারছে না। বড় পদ পেয়ে অর্থনৈতিক কাজ করছে, ক্ষতি করছে সমাজ তথা দেশের! যার ঘাম জড়ানো অর্থে উচ্চ শিক্ষা পেয়েছে তাদের ঠকানোর প্রবণতা দিন দিন বেড়েই চলছে। নৈতিক শিক্ষার বড্ড অভাব উপলব্ধি করছি। এ অবস্থা থেকে কবে মুক্ত হওয়া যাবে তা সৃষ্টিকর্তা ছাড়া আর কারও জানা নেই। এ অবস্থা পরিবর্তনের জন্য চাই সুশিক্ষা তথা নৈতিক শিক্ষা! মানসম্মত শিক্ষা ছাড়া বিশেষজ্ঞ বা পেশাদার জনবল তৈরি করা অসম্ভব। বর্তমান সরকার ও বেসরকারি পর্যায় মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করার জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে।
সাক্ষরতা বিহীন উন্নয়ন অসম্ভব। সঠিক উন্নয়নবিহীন শান্তিও প্রতিষ্ঠা করা অসম্ভব। আর শান্তির পূর্বশর্ত হল ন্যায্যতা, সাক্ষরতা ছাড়া ন্যায্যতা অচল। কারণ সুশিক্ষিত জনগণবিহীন ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠা অসম্ভব। একজন সুশিক্ষিত ব্যক্তিই মানুষের কথা ভাবতে পারে, তাই মানুষের প্রয়োজন ও অধিকার বিষয়ে চিন্তা করতে পারে। পারে দুঃখী অসহায় মানুষের জন্য কিছু ভূমিকা রাখতে। নিরক্ষর মানুষ অন্ধ মানুষের মতো। একজন অন্ধ আরেকজন অন্ধকে পথ দেখাতে পারে না এবং অন্যকে দেখাতে সহায়তা দিতে পারে না। তাই একজন সাক্ষরবিহীন মানুষ উন্নয়নের স্বপ্ন দেখতে পারে না এবং অন্যকেও দেখাতে পারে না। বিষয়টি অনুধাবন করে বলা হয়- সাক্ষরতাই উন্নয়ন, উন্নয়নই আনবে শান্তি। বর্তমানে বিশ্ব পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করলে বিষয়টি পরিষ্কার বুঝা যায়, মানুষ যতই উন্নয়নের শিখরে পৌঁছেছে ততই শোষণ বাড়ছে। মানুষ হয়ে যাচ্ছে স্বার্থপর। একারণেই এক শ্রেণির মানুষ তাদের মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হ”্ছ।ে দিন দিন অশান্তি ও অস্থিরতা নামক মানসিক রোগ বৃদ্ধি পাচ্ছে। কোথাও যেন শান্তি নেই। এর কারণ অন্যায্যতা নামক ব্যাধি বিশ্বটাকে গ্রাস করে ফেলছে! তাই বর্তমানে এই অশান্ত পৃথিবী হন্য হয়ে শান্তি খুঁজছে। কোথায় পাবে একটু শান্তি? কে তা নিশ্চিত করতে পারবে? ইত্যেকার প্রশ্ন মানুষকে উদ্বিগ্ন করে ফেলছে। এ থেকে মুক্তির উপায় সাক্ষরতা। সাক্ষরতার মাধ্যমেই এর নিষ্পত্তি করা সম্ভব। কারণ সাক্ষরতার মাধ্যমেই মানুষ সুশিক্ষিত হবে, সুশিক্ষিত মানুষই ন্যায্য মানুষ। সুশিক্ষিত মানুষই নৈতিক মানুষ। শিক্ষাই পারে মানুষের মধ্যে মমত্ববোধ সৃষ্টি করতে, পারে মানুষের কল্যাণে আত্মনিয়োগ করতে। কাজেই শিক্ষা ছাড়া উপায় নেই, সাক্ষরতা ছাড়া শান্তি নেই, শান্তি ছাড়া প্রগতি নেই।
শিক্ষা একটি মৌলিক অধিকার যা প্রতিটি নাগরিকের পাওয়ার অধিকার রয়েছে। অপরদিকে সরকারও এ অধিকার নিশ্চিত করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। তবে সরকারেরও সীমাবদ্ধতা রয়েছে। সঙ্গতকারণেই শিক্ষা নিশ্চিত করতে সরকারের সদিচ্ছা থাকলেও অনেক ক্ষেত্রে সময় ও সামর্থ্যরে অভাবে সম্ভব হয়ে উঠে না। তবে সেক্ষেত্রে সচেতন নাগরিকদেরও এগিয়ে আসতে হবে। অগ্রগামী নাগরিকদের দায়িত্ব রয়েছে পশ্চাতগামী নাগরিকদের এগিয়ে নেওয়া। আর অনেক নাগরিক সে দায়িত্ব পালনও করছে বটে তবে তাদের সংখ্যা প্রয়োজনের তুলনায় কম। কাজেই সকল নাগরিকের স্ব স্ব ক্ষেত্র থেকে সরকারের উদ্যোগে সহায়তা করতে হবে। শিক্ষিত নাগরিকরাই পারে উন্নত দেশ উপহার দিতে। কাজেই আমাদের সামর্থ্য অনুসারে ব্যক্তি পর্যায় থেকে শুরু করতে হবে। আমাদের সকলের প্রতিজ্ঞা হোক: দেশ আমার, মাটি আমার, আমিও সরকারের অংশ, আমারও দায়িত্ব এদেশকে নিরক্ষরতার কলঙ্ক থেকে মুক্ত করা।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন