Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

রেলে আমরা কেন এত পিছিয়ে?

সরদার সিরাজ | প্রকাশের সময় : ৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৭, ১২:০০ এএম

ব্রিটিশ ভারতে ট্রেনের যাত্রা শুরু হয় ১৮৫১ সালে। বাংলাদেশে প্রথম ট্রেন চালু হয় কলিকাতা থেকে কুষ্টিয়া পর্যন্ত ক্রমান্বয়ে সমগ্র উপমহাদেশে স¤প্রসারিত হয় ট্রেন। এতে মানুষ ও পণ্য চলাচলে ব্যাপক কল্যাণ হয়। রেলখাত লাভজনক খাতে পরিণত হয়। রেলের আন্তঃ অঞ্চল যোগাযোগ ১৯৪৭ সালে ভারত-পাকিস্তান নামে দুটি পৃথক রাষ্ট্র হওয়ার পরও অব্যাহত ছিল। ১৯৬৫ সালে পাক-ভারতযুদ্ধের পর এটা বন্ধ করে দেয় পাকিস্তান। দুই দেশেই রেলপথ ব্যাপকভাবে স¤প্রসারিত হতে হতে বিশাল আকার ধারণ করে। বিশেষ করে ভারতে। কিন্তু ব্যত্যয় ঘটেছে বাংলাদেশে। স্বাধীনতার পর মোট ২৫,০৮৩ জন নিয়মিত কর্মচারী ও মোট ২৮৭৭.১০ কিমি রুট, ৪,৪৪৮ কিমি লাইনের দৈর্ঘ্য আর ৪৪টি জেলার মধ্যে সংযোগ ছিল। সৈয়দপুরসহ বেশ কয়েকটি স্থানে বড় ধরনের ওয়ার্কশপ ছিল। সৈয়দপুর ওয়ার্কশপে বগি ও খুচরা যন্ত্রাংশ তৈরি ও ইঞ্জিন মেরামত হতো। বর্তমানে তিন ধরনের লাইন রয়েছে: মিটারগেজ, ব্রডগেজ ও মিশ্রগেজ। রেলের পূর্বাঞ্চলের প্রায় পুরোটাই মিটারগেজের। আর পশ্চিমাঞ্চলে মিটারগেজ ও ব্রডগেজ উভয়টিই রয়েছে। যাতায়াতের ক্ষেত্রে সর্বাধিক নিরাপদ, আরামদায়ক ও সাশ্রয়ী হওয়া সত্তে¡ও স্বাধীনতার পর রেলের স¤প্রসারণ হয়নি। বরং সংকুচিত হয়েছে। বর্তমানে রেল লাইনের দৈর্ঘ্য ৪০৯৩ কিমি। আগে ছিল ৪৪৪৮ কিমি। এছাড়া, যাত্রীবাহী এক হাজার ৬৫৬টি কোচের মধ্যে মিটারগেজ ১ হাজার ২১৮টি ও ব্রডগেজ ৪৩৮টি। এর মধ্যে ৫৯২টি মিটার গেজ ও ২৬৬টি ব্রড গেজ বগির আয়ুষ্কাল ফুরিয়েছে। ইঞ্জিন রয়েছে ২৭৮টি। এর মধ্যে মিটারগেজ ইঞ্জিন ১৮৪টি এবং ব্রডগেজ ৯৪টি। ইঞ্জিনের অর্থনৈতিক আয়ুষ্কাল ২০ বছর। ১৯০টি ইঞ্জিনের আয়ুষ্কাল শেষ হয়ে গেছে। রেলের বহরে ৪০ বছরের বেশি পুরনো ইঞ্জিন রয়েছে ৯৩টি ইঞ্জিন। বর্তমানে রেলের অবস্থা খুবই করুণ! লোকবলের অভাব, বহু স্টেশন বন্ধ, ইঞ্জিন ও বগির ঘাটতি, নোংরা পরিবেশ, ব্যাপক দুর্নীতি, অদক্ষতা, অনিয়মিত, চরম নিরাপত্তাহীনতা, ঘনঘন দুর্ঘটনা, ঝুঁকিপূর্ণ পথ, লাভজনক প্রকল্পর পরিবর্তে রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে প্রকল্প গ্রহণ ইত্যাদি। ফলে বিপুল লোকসান হচ্ছে। রেলের মোট ২,৫৪১টি লেভেল ক্রসিংয়ের মধ্যে অনুমোদিত ৭৮০টি। বাকী ১,৭৬১টি অনুমোদনহীন। আবার ৭৮০টি অনুমোদিত। এর মধ্যে মাত্র ২৪২টিতে গেইটকিপার রয়েছে। বাকীগুলো ঝুঁকিপূর্ণ। রেল লাইন সংলগ্ন অবৈধ বাজার ও বসতির অন্ত নেই। ফলে প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটে। বেদখলকৃত জমির পরিমাণ সাড়ে তিন হাজার একরের অধিক। রেলের এই মহাদূর্গতির পাশাপাশি নৌপথ ব্যাপকভাবে হ্রাস পেয়েছে। সে সুযোগে সড়ক পথের চাহিদা বৃদ্ধি পেয়েছে। চাহিদার কারণে কৃষি জমি নষ্ট করে সড়ক নির্মিত হয়েছে। এতে ব্যয়, পরিবেশের ক্ষতি ও দুর্ঘটনা ব্যাপক বৃদ্ধি পেয়েছে। তবুও রেলের স¤প্রসারণ ও লাভজনক করার চেষ্টা করা হয়নি। লোকসান কমানোর জন্য পরপর দুইবার ভাড়া বৃদ্ধি করা হয়েছে। এসব সত্তে¡ও গত অর্থবছরে রেল যাত্রী পরিবহন করেছে সাত কোটি। যা আগের বছরের তুলনায় ৫ শতাংশ বেশি।

প্রতিবেশী ভারতে রেলের বিশাল নেটওয়ার্ক গড়ে উঠেছে। ভারতের রেল সংস্থাটি লাভজনক পর্যায়ে রয়েছে। ভারতের রেল খাত বিশ্বের বৃহত্তম। সেখানে প্রতিদিন ৯ হাজার প্যাসেঞ্জার ট্রেনে ১৮ মিলিয়ন মানুষ যাতায়াত করে। প্রতিদিন অসংখ্য মানুষ কয়েকশত কিমি পথ পাড়ি দিয়ে অফিসে যাতায়াত করে। এই অবস্থায় সেখানে পরীক্ষামূলকভাবে চালু করা হয়েছে সোলার ট্রেন। এটা সফল হলে দেশটিতে রেলখাতে মহাবিপ্লব সাধিত হবে। চীনের রেলের উন্নয়ন মহাবিস্ময়কর। সে দেশে বহুতল ভবনের ভেতর দিয়েও চলে গেছে রেললাইন। ১৯ তলা ভবটের ভেতরে যাত্রী ওঠানামার জন্য বানানো হয়েছে স্টেশনও। চৌংকিং শহরের উচ্চ একটি ভবনে যাতায়াতের জন্য এটা করা হয়েছে। এছাড়া, তারা রেললাইন এবং চালক ছাড়াই চলার ট্রেন তৈরি করেছে। বাস, ট্রাম ও ট্রেনের মিশেলে এটা তৈরি করেছে। গতিবেগ ঘণ্টায় ৭০ কিমি। ট্রেনটিতে রয়েছে ইলেকট্রিক ব্যাটারি; যা চার্জ হওয়ার পর প্রায় ৪০ কিমি চলবে। চীনের রেলের আর একটি বিস্ময়কর উন্নতি হচ্ছে- ঝুলন্ত ট্রেন। যার গতি ঘণ্টায় ৭০ কিমি ও ধারণ ক্ষমতা ৫১০ জন। আকশ পথে পরীক্ষামূলকভাবে শুরু হয়েছে এর ট্রায়াল। সফল হলেই চালু হবে হাইস্পিড স্কাইট্রেনের যাত্রা। আপাতত কুইংদাও শহরেই এটা শুরু হয়েছে। এটা সফল হলে এটিই হবে চীনের সব থেকে দ্রুত গতির রেলপথ। এর ব্যয় কম ও মেইনটেইনও সহজতর। উল্লেখ্য, স্কাইট্রেন প্রথম চালু হয় জার্মানিতে ১৯০১ সালে, তারপর জাপানে। চীনে আভ্যন্তরীণ মোট রেলপথ ১৯,৯৬০ কিমি। চীন শুধু আভ্যন্তরীণভাবেই রেলকে সমৃদ্ধ করেনি। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সাথেও রেলের বিশাল নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছে ও তুলছে। রেলের মাধ্যমে চীনের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে নেপাল। এ বিষয়ে নেপালি প্রধানমন্ত্রী ও চীনা প্রেসিডেন্টের বৈঠকের পর জানানো হয়েছে, নেপালের সঙ্গে রেল যোগাযোগ বাড়াতে শিগগিরই কাজ শুরু করবে চীন। ইতোপূর্বে চীন-তিব্বত রেল লাইন স্থাপিত হয়েছে এবং তা বিভিন্ন স্থানে বিশাল পাহাড় ফুটো করে। এটা বিশ্বের সর্বোচ্চ রেল লাইন-সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে উচ্চতা ৫,০৭২ মিটার। তাই এটি স্কাইট্রেন বলে খ্যাত। এছাড়া, বিশ্বের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ রেলপথ তৈরি করতে চলেছে চীন। এটি কিংঘাই-তিব্বত মালভূমির দক্ষিণ-পূর্ব এলাকা দিয়ে চেংদু-কামদো হয়ে লাসাতে পৌঁছবে। এর দৈর্ঘ্য হবে প্রায় ১৭০০ কিমি। উপরন্তু যুক্তরাজ্য-চীন প্রথম মালবাহী ট্রেন ১২ হাজার কিমি পাড়ি দিয়ে ক’মাস আগে ঈউ নগরীতে পৌঁছেছে। এটি বিশ্বের দ্বিতীয় দীর্ঘতম রেল রুট। ট্রেনটি ১০ এপ্রিল, ২০১৭ লন্ডন থেকে রওয়ানা দিয়ে ফ্রান্স, বেলজিয়াম, জার্মানি, পোল্যান্ড, বেলারুশ, রাশিয়া ও কাজাখস্তানের মধ্য দিয়ে ২০ দিনে ঈউতে পৌঁছে, যা রাশিয়ার জনপ্রিয় ট্রান্স-সাইবেরিয়ান রেলপথটির চেয়েও দীর্ঘ। অবশ্য চীন-মাদ্রিদ রেলপথের চেয়ে প্রায় এক হাজার কিমি ছোট। চীন-রাশিয়া রেল সংযোগ স্থাপন করেছে চীন। অপরদিকে, নেদারল্যান্ডসের সব ট্রেন এখন বায়ুশক্তিতে চলছে গত ১ জানুয়ারি থেকে। এতে প্রতিদিন ৬ লাখ যাত্রী পরিবহন হচ্ছে। সুইজারল্যান্ড বিশাল পাহাড়ের ৩৭ কিমি সুড়ঙ্গ করে রেললাইন চালু করা হয়েছে গত বছর। ফলে পূর্ব ও পশ্চিম ইউরোপের মধ্যে যোগাযোগ সহজতর হয়েছে। বিশ্বের সর্বাধিক গতিসম্পন্ন ট্রেন হচ্ছে জাপানের বুলেট ট্রেন। গতিবেগ ঘণ্টায় ৬০৩ কিমি। ইরান থেকে আন্তর্জাতিক অবরোধ প্রত্যাহারের পর দেশেটি বিভিন্ন খাতের ন্যায় রেলের উন্নয়নে ব্যাপক কর্মসূচী গ্রহণ করেছে। ইরান ও ইতালি উচ্চ গতিসম্পন্ন রেল লাইন প্রতিষ্ঠার বিষয়ে ১২০ কোটি ইউরোর চুক্তি হয়েছে। এটা বাস্তবায়ন হলে আরাক ও কোমের মধ্যে ট্রেন চলাচল শুরু হবে। ইতালির প্রধানমন্ত্রী ইরান সফরে এলে দু’দেশের মধ্যে ৫০০ কোটি ইউরোর রেল চুক্তি হয়। এর আওতায় তেহরান ও হামেদানের মধ্যে উচ্চ গতিসম্পন্ন রেল লাইন বসানো হবে। এছাড়া তেহরান, কোম ও ইস্পাহানের মধ্যে হাই-স্পিড রেল করিডর প্রতিষ্ঠা এবং তেহরান ও তাবরিজের মধ্যকার রেললাইনকে বিদ্যুতায়নের কাজ করবে ইতালি। চীনের সাথে ইরান ১৫০ কোটি ডলারের ঋণ চুক্তি করছে স¤প্রতি। এভাবে ইরান তার রেল ব্যবস্থাকে আধুনিকায়ন ও বিস্তৃত করার জন্য আগামী ১০ বছরে ২৫০০ কোটি ডলার বিনিয়োগ করে ২০২৫ সালের মধ্যে ২৫ হাজার কিমিতে উন্নতি করার টাগের্ট করেছে। বর্তমানে রয়েছে ১৫ হাজার কিমি।
বিশ্বব্যাপী রেল খাত উন্নতর ও ব্যাপক স¤প্রসারিত হচ্ছে। আর আমরা তার বিপরীত মেরুতে অবস্থান করছি। রেলের দুরাবস্থা শুরু হয় স্বাধীনতার পরপরই। বিহারীদের চাকরি হতে একযোগে বিদায় করে দেওয়া হয়। ফলে রেল পরিচালনায় বিঘœ ঘটে। কারণ, রেলের কারিগরি বিভাগে তারাই ছিল বেশি। এছাড়া দেশের সব খাতের মতো রেল খাতেও চরম অরাজকতা শুরু হয়। ফলে শুরু হয় ব্যাপক লোকসান। এই অবস্থায় গত বিএনপি সরকারের আমলে লোকসান কমানোর জন্য দশ হাজার কর্মচারীকে গোল্ডেন হ্যান্ডশেকে বিদায় করা হয়। ফলে জনবলের ব্যাপক ঘাটতি সৃষ্টি হয়। সে কারণে সৃষ্টি হয় নতুন সংকট। সর্বোপরি লোকসান কমিয়ে উন্নয়নের বিষয়েও তেমন গুরুত্ব দেওয়া হয়নি তখন! বর্তমান সরকার ক্ষমতাসীন হওয়ার পর থেকেই রেলের উন্নয়নে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। রেল খাতের উন্নয়নে গত সাত বছরে ৩১ হাজার কোটি টাকা ব্যয় করা হয়েছে। এছাড়া, লোকবলের স্বল্পতা হ্রাস কল্পে ১০ হাজারের বেশি লোক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। আরো লোক নিয়োগ প্রক্রিয়াধীন আছে। উপরন্তু বর্তমানে উন্নয়ন প্রকল্প চলমান আছে ৪৮টি। যার ব্যয় প্রায় ৯৮ হাজার কোটি টাকা। প্রকল্পগুলোর কিছুকিছু বাস্তবায়ন হওয়ার পথে। আর কিছু প্রকল্প অনুমোদন হয়ে আছে। এর আগে ৪০টি প্রকল্পের কাজ শেষ হয়েছে। কিন্তু এতকিছুর পরও রেলের গতি তথা সেবা বাড়েনি। কিন্তু দুই দফা ভাড়া বাড়ানো হয়েছে। তবুও লোকসান অব্যাহত আছে। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে লোকসান হয়েছে ১২২৬ কোটি টাকা। আর গত আট বছরে শুধু পরিচালনাতেই লোকসান হয়েছে ৭৭৫৩ কোটি টাকা। প্রকল্পে বিনিয়োগের হিসাব ধরলে আট বছরে ঘাটতি দাঁড়াবে ৩১ হাজার কোটি টাকা!
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন