Inqilab Logo

রোববার ১৭ নভেম্বর ২০২৪, ০২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৪ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

এক কোটি মানুষের ঈদ আনন্দ ভেসেছে বানের পানিতে

পাচ্ছে না ভিজিএফের চাল

পঞ্চায়েত হাবিব | প্রকাশের সময় : ১ সেপ্টেম্বর, ২০১৭, ১২:০০ এএম

প্রবল বন্যায় সারাদেশের ৩২ জেলার প্রায় পৌনে এক কোটি মানুষের এবার ঈদ আনন্দ নেই বললেই চলে। বাড়িঘর, ফসল, সহায় সম্বল হারিয়ে মানুষ দিশেহারা। অনেকেই এখনও খোলা জায়গায় বাস করছেন। বন্যার ধকল সামলাতেই ব্যস্ত তারা। যা সুখ শান্তি সোউগ বানের পানিত ভাসি গেইছে। বাড়ি-ঘর, আসন-বাসন যাকিছু কষ্ট করি করচি সোউগ গেইছে। এ্যালা কিসের ঈদ, কিসের তাওয়া। আল্লায় সুখ দেয় নাই, কী দিবে বান্দায়? বিলাপ করতে করতে বলছিলেন কুড়িগ্রামের উলিপুর উপজেলার হাতিয়া অনন্তপুর চরের ফুলজান বেওয়া (৫৫)। বন্যায় বাড়িঘর ভেঙে তার সহায় সম্বলহীন পরিবার এখন আশ্রয় নিয়েছে খোলা জায়গায় তাঁবুর নীচে।
ধর্মীয় উৎসব ও নানা সময় অতিদরিদ্রদের সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী ভিজিএফ (ভালনারেবল গ্রুপ ফিডিং) কর্মসূচির আওতায় দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে বিনা মূল্যে ২০ কেজি করে চাল বিতরণ করা হলেও এবার সেই সিদ্ধান্ত বাতিল করা হয়েছে। এ নিয়ে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের মাঝে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। এ দিকে অতিদরিদ্র পরিবার গুলোর জন্য দেয়া ভিজিএফ কর্মসূচির বন্ধ ঘোষনা দিয়েছে সরকার।
প্রবল বন্যায় সারাদেশের ৩২ জেলার প্রায় পৌনে এক কোটি মানুষের ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে তথ্য প্রকাশ করেছে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর। অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. রিয়াজ আহমেদ ইনকিলাবকে বলেন, প্রবল বন্যায় সারাদেশের ২৬ জেলার ৪৮ লাখ মানুষের অনেক ক্ষতি হয়েছে। তবে সরকার এসব মানুষের জন্য এখন পযন্ত ৩০ হাজার মে:টন চাল ও ১০ কোটি টাকা বিতরণ করেছে। গতকাল বৃহস্পতিবার ( আজ) সাড়ে ৫শত মে:টন চাল এবং ২০ লাখ টাকা বিভিন্ন জেলয় বরাদ্দ দেয়া হয়েছে।
জাতীয় দুর্যোগ সাড়াদান সমন্বয় কেন্দ্রের (এনডিআরসিসি) উপ সচিব জি এম আব্দুল কাদের ইনকিলাবকে বলেন, বন্যায় ৩২ জেলায় এ পর্যন্ত ৭৪ লাখ ৮২ হাজার ৬৩৭ জন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর মধ্যে ২০ জেলায় মৃত্যু হয়েছে ১৩২ জনের। অধিদপ্তরের নিয়ন্ত্রণ কক্ষের তথ্য অনুযায়ী, কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, রংপুর, সিলেট, সুনামগঞ্জ, নেত্রকোণা, রাঙামাটি, নীলফামারী, গাইবান্ধা, বগুড়া, সিরাজগঞ্জ, দিনাজপুর, জামালপুর, ঠাকুরগাঁও, পঞ্চগড়, ময়মনসিংহ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, রাজবাড়ী, নওগাঁ, জয়পুরহাট, যশোর, মৌলভীবাজার, ফরিদপুর, টাঙ্গাইল, মানিকগঞ্জ, মাদারীপুর, মুন্সীগঞ্জ, নাটোর, চাঁদপুর, কুমিল্লা, ঢাকা, শেরপুর জেলার বিস্তীর্ণ জনপদ এই দফায় বন্যার কবলে পড়েছে। দেশের ৬৪ জেলার মধ্যে ৩২ জেলায় ২০১টি উপজেলা ও ৫১টি পৌরসভা বন্যা কবলিত হয়েছে। ২ লাখ ৯৬ হাজার ২৭৯ জন এ বন্যায় সর্বস্ব হারিয়েছেন। আরও ৭১ লাখ ৮৬ হাজার ৩৫৮ জন আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। বন্যায় ৭৫ হাজার ৩৩১টি ঘর সম্পূর্ণ এবং ৫ লাখ ৮৬ হাজার ৮২৫টি ঘর আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কুড়িগ্রামে ২৩ জন, লালমনিরহাটে ৬ জন, সুনামগঞ্জে ২ জন, নেত্রকোণায় ৪ জন, নীলফামারীতে ৬ জন, গাইবান্ধায় ১৩ জন, সিরাজগঞ্জে ৬জন, দিনাজপুরে ৩০ জন, জামালপুরে ১৪ জন, ঠাকুরগাঁওয়ে ১ জন, নওগাঁয় ৫ জন, বগুড়ায় ৪ জন, যশোরে ৩ জন, টাঙ্গাইলে ২ জন, শেরপুরে ৩ জন, মৌলভীবাজারে ২ জন, কুমিল্লায় ২ জন, রংপুরে ৩ জন, মানিকগঞ্জে ১ জন ও জয়পুরহাটে ২ জন মিলিয়ে মোট ১৩২ জনের মৃত্যু হয়েছে দুই সপ্তাহে। বানের পানিতে ১০ হাজার ৫৮৩ হেক্টর ফসলি জমি সম্পূর্ণ এবং ৬ লাখ ৫৮৭ হেক্টর জমি আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। দুর্গত জেলাগুলোতে অন্তত ৬২ হাজার ২০৮টি টিউবওয়েল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর জানিয়েছে, ৩২ জেলার বন্যা দুর্গতদের মধ্যে এ পর্যন্ত ৩০ হাজার মে:টন চাল ও ১০ কোটি টাকা বিতরণ করেছে। গতকাল বৃহস্পতিবার ( আজ) সাড়ে ৫শত মে:টন চাল এবং ২০ লাখ টাকা বিভিন্ন জেলয় বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। এছাড়া ৬০ হাজার প্যাকেট শুকনো খাবার বিতরণ করা হয়েছে।
কুড়িগ্রাম জেলা প্রশাসকের হিসাবে জানা যায়, এ বছর কুড়িগ্রামের নয়টি উপজেলার এক লাখেরও বেশি ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, ভিটেবাড়ি হারিয়ে সম্বলহীন হয়েছে দশ হাজারের বেশি পরিবার। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে উলিপুর উপজেলার ১৩টি ইউনিয়ন, কুড়িগ্রাম সদর, চিলমারী ও নাগেশ্বরী উপজেলায়। দ্বিতীয় দফা বন্যায় সহায় সম্বল হারিয়ে সীমাহীন কষ্টে দিন কাটছে সদর উপজেলার জগমোহনের চর ও নন্দদুলালের ভিটা গ্রামের দেড় শতাধিক পরিবারের। জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন অফিস জানায় জেলার নয়টি উপজেলার ৬২টি ইউনিয়নের ৮২০ গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। দুই হাজার ৫১ মেট্রিকটন চাল ও ৭৬ লাখ ৫৫ হাজার টাকা এবং ছয় হাজার প্যাকেট শুকনা খাবার এ পর্যন্ত সরকারিভাবে বিতরণ করা হয়েছে।
আকস্মিক বন্যায় ঘর-দুয়ার, ধান-চাল, জামা-কাপড়, হাঁস-মুরগীসহ সবকিছু বানের জলে ভেসে গেছে। ঘরে খাবার নেই। কোরবানি দেওয়া সামর্থ্যবান অনেকের জন্যও কষ্টকর হয়ে দাঁড়িয়েছে। গত ১২ অগাস্ট থেকে বাঁধের রাস্তায় খোলা স্থানে মানবেতর জীবনযাপন করছেন অননতপুর গ্রামের নজরুল ও মালেক মিয়া। তারা বলেন, তাদের ঘরে খাবার নেই। হাতে কাজ নেই। জামা-কাপড় সব ভেসে গেছে বন্যায়। সন্তানদের সাধ-আহ্লাদ পূরণের কোনো সামর্থ্য নেই তাদের। তাই এবার ঈদ কাটবে আর দশদিনের মতো। সব হারানো থেতরাই তিস্তার চর আমেনিয়া আশা জমিলা বেগম (৩৩) কেবলই কাঁদছিলেন। তিনি বলেন, আল্লাহ হামাক গুলাক বাঁচাও।
সরকারি হিসাব অনুযায়ী-কুড়িগ্রামের ১৬টি নদ-নদীতে প্রায় চার শতাধিক চরে আড়াই লক্ষাধিক মানুষের বসবাস। এ বছর বন্যায় জেলার নয়টি উপজেলার এক লাখ ২৬ হাজার ৬১৬টি ঘরবাড়ি কমবেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সেতু ভেঙ্গে গেছে ২৩টি। পাকা রাস্তা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ২৪ দশমিক ৬২ কিলোমিটার এবং কাঁচা রাস্তা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ১৪০ দশমিক ৫০ কিলোমিটার। গ্রামীণ এবং আন্তঃউপজেলা যোগাযোগ ব্যবস্থা সম্পূর্ণ ভেঙ্গে পড়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত উলিপুর উপজেলার হাতিয়া ইউনিয়নের অনন্তপুর গ্রামের বাবর আলী (৬০) বলেন, আমার চার একর জমির আমন ধান পুরোপুরি নষ্ট হয়ে গেছে। প্রায় দুই সপ্তাহ স্থায়ী বন্যায় ঘরে রাখা চাল, ধানসহ মূল্যবান অনেক সম্পদ নষ্ট হয়ে গেছে। ভেসে গেছে পুকুরের লক্ষাধিক টাকার মাছ। এমন অবস্থায় চার সন্তান নিয়ে চরম কষ্টে দিন পার করছেন। তাই গ্রতিবছর কোরবানি দিলেও এবছর তা সম্ভব হবে না। থেতরাই ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান আইয়ুব আলী সরকার ইনকিলাবকে বলেন, বন্যায় তার ইউনিয়নে পানিবন্দি হয় ৫হাজার মানুষ। ঘর বিধ্বস্ত হয়েছে ৪০৫ জনের। ২৯০টি বাড়ির আংশিক ক্ষতি হয়েছে। চেয়ারম্যান বলেন, এসব মানুষের পক্ষে আনন্দের সঙ্গে ঈদ করা কষ্টকর হবে। এমনকি অবস্থাসম্পন্ন অনেকের পক্ষে কোরবানি দেওয়া সম্ভব হবে না। বন্যার এ ধকল কাটিয়ে উঠতে কয়েক মাস সময় লাগবে ।

 



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ