Inqilab Logo

শুক্রবার ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ০৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২০ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

জমে উঠেছে কোরবানির হাট

বৃষ্টির ভোগান্তিতেই চলছে শেষ সময়ের বেচা-কেনা

| প্রকাশের সময় : ১ সেপ্টেম্বর, ২০১৭, ১২:০০ এএম

স্টাফ রিপোর্টার : আগামীকাল কোরবানির ঈদ। রাজধানীর অস্থায়ী পশুরহাটগুলোতে চলছে শেষ সময়ের বেচা-কেনা। মঙ্গলবারের দুই দফা ও গতকাল বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে ৯টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত একটানা বৃষ্টিতে কাদা, পানি ও পশুর বর্জ্যে একাকার হয়ে কোরবানির হাটে ঢুকারও উপায় নেই। চরম দুর্ভোগ ও ভোগান্তির মধ্যদিয়েই গতকাল হাটগুলোতে ক্রেতা ও দর্শনার্থীর ঢল নেমেছে। হাটগুলোতে দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে ট্রাক ভর্তি কোরবানির পশু আসছে। হাটে হাটে গরু-মহিষ, ছাগল, ভেড়া ও উট কেনা-বেচার ধুম পড়েছে। একইসঙ্গে বেড়েছে মলম, অজ্ঞান ও ছিনতাই চক্রের দৌরাত্ম। তবে মনিটরিং সেল, পুলিশ, র‌্যাব ছাড়াও গোয়েন্দা সংস্থাগুলো রয়েছে তৎপর। ধরাও পড়ছে অপরাধীরা। সংশ্লিষ্ট থানা পুলিশের বিরুদ্ধেও রয়েছে নানা অভিযোগ। এছাড়া ডিসিসির দেওয়া শর্ত মানছে না ইজারদাররা।
ইজারাদাররা সংশ্লিষ্ট হাট এলাকার রাস্তা-ঘাটসহ অলিগলি সব দখল করে নিয়েছে। হাট এলাকার স্থানীয় বাসিন্দারা পড়েছে চরম দুর্ভোগে। বিশেষ করে দক্ষিণ সিটির দনিয়া ও মেরাদিয়া হাট ইজারাদারের বাহিনীর হাতে জিম্মি হয়ে পড়েছে এলাকাবাসী। এ দুই হাট তার নির্ধারিত এলাকা অতিক্রম করে আশেপাশের এলাকার ঘরবাড়ি, দোকানপাঠ ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ বাড়ির বারান্দা পর্যন্ত দখল করে নিয়েছে।
দনিয়া হাট এলাকার গোয়ালবাড়ি মোড়ে কথা হয় এক মুদি দোকানির সাথে। তিনি বলেন, আমার দোকান থেকে অন্তত এক কিলোমিটার দুরে হাটের অনুমতি দেয়া হয়েছে। অথচ তারা গরু উঠাতে উঠাতে এখন আমার দোকান পর্যন্ত বন্ধ করে দিয়েছে। শুধু আমার দোকান নয়, ইজারা দারদের সেচ্ছাচারির জন্য এই এলাকার প্রায় আড়াইশ দোকান বন্ধ হয়েগেছে। ঈদতো সবার জন্যই তারা ব্যবসা করবে আর আমরা ব্যবসা করতে পারবো না। কিছু বলতে গেলে ইজারাদারের লোকজন এসে সাশিয়ে যায়। এ যেন মগের মুল্লুক।
গোপিবাগ ও কমলাপুর হাট এলাকার স্থানীয় এক বাসিন্দ জানান, সিটি কর্পোরেশন প্রতি বছর কোরবানি উপলক্ষে এখানে পশুর হাটের ইজারা দিয়ে থাকে। যে কারণে এই এলাকার প্রধান রাস্তাসহ প্রায় ৩০ থেকে ৩৫টি ছোট-বড় রাস্তা বন্ধ হয়ে যায়। এতে তাদের দুর্ভোগ পোহাতে হয়। এবিষয়ে সরকার-বিরোধীদল কেউই স্থানীয়দের কথা শুনছেনা বলে আক্ষেপ প্রকাশ করেন তিনি।
বনশ্রীর মেরাদিয়া ও আফতাব নগর হাটে গিয়ে দেখা গেছে, পুরো হাটজুড়ে সারিবদ্ধভাবে কোরবানির পশু বেঁধে রাখা হয়েছে। অনেকের কাছে বৃষ্টি প্রতিরোধক ছাউনি নেই। ফলে বৃষ্টি আসার সঙ্গে সঙ্গে আতঙ্কিত হয়ে পড়েন ব্যবসায়ীরা। কেউ কেউ আশেপাশের বিভিন্ন দোকানে গিয়ে মোটা পলিথিন খুঁজতে থাকেন। আবার অনেকে নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় পলিথিন দিয়ে ছাউনি তৈরি করলেও বৃষ্টি আর বাতাসের সঙ্গে তা পেরে উঠছে না। ফলে অধিকাংশ ব্যবসায়ীর পশু বৃষ্টিতে ভিজছে।
একই অবস্থা পোস্তগোলা শ্মশান ঘাট হাটের। এ হাটের ইজারাদার ও স্থানীয় ৪৭ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মাইনুদ্দিন চিশতি বলেন, সকাল থেকে দুপুর আড়াইটা পর্যন্ত টানা বৃষ্টি হয়েছে। এতে হাটে আনা ব্যবসায়ীদের পশু ভিজে গেছে। আমরা সাধ্যমতো চেষ্টা করছি সবখানে ছাউনি তৈরি করে দিতে। এখন হাটে হাজার হাজার গরু আছে, সবার জন্য তো আমাদের পক্ষে এমন ব্যবস্থা করা সম্ভব না।
এ ব্যাপারে মেরাদিয়া হাটের ইজারাদার মোহাম্মদ শরীফ বলেন, হাটে পর্যাপ্ত গরু রয়েছে। বেচা-বিক্রি শুরু হয়েছে। বৃষ্টির কারণে একটু সমস্যা হচ্ছে। আমরা অনেক এলাকায় ছাউনি তৈরি করে দিয়েছি। ব্যবসায়ীরাও অনেকেই নিজ দায়িত্বে বাড়ি থেকে ছাউনি নিয়ে এসেছেন। তবে সিটি কর্পোরেশন থেকে তাদের কোনও সহযোগিতা করা হচ্ছে না বলেও অভিযোগ করেছেন তিনি। নিজ ব্যবস্থাপনায় অনেক ব্যবসায়ী ছাউনি লাগালেও হাটের অধিকাংশ স্থানেই ছাউনি নেই
ওই হাটের ব্যাপারি শরীফুল ইসলাম জানান, খবরে দেখেছি ঈদের সময় বৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা আছে। এখন বৃষ্টি হচ্ছে। বৃষ্টি হলে ক্রেতা কমে যায়। এ কারণে বেশির ভাগ গরু বিক্রি করে দিয়েছি। এখন যে কয়টা আছে, সেগুলোর জন্য পলিথিনের ছাউনি তৈরি করে সেখানে রেখেছি। তারপরও ভিজে গেছে। বৃষ্টি যদি আরও বাড়ে তাহলে বিপদ হতে পারে বলেও মন্তব্য করেন এই গরু ব্যবসায়ী।
ব্যবসায়ীদের অভিযোগের ব্যাপারে জানতে চাইলে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন (ডিএসসিসি)-এর সম্পত্তি কর্মকর্তা শামসুল আলম বলেন, বৃষ্টির কারণে প্রতিটি হাটেই সমস্যা হচ্ছে। আমরা খবর পেয়েছি, ইতোমধ্যে বেশ কিছু হাটে পানি জমে গেছে। হাটের গরুসহ অন্যান্য পশুর নিরাপত্তার দায়িত্ব মূলত হাট ইজারাদারের। বৃষ্টির পানি থেকে পশুকে বাঁচাতে সামিয়ানা টানানোর দায়িত্বও তাদের। এরপরও বড় ধরণের কোনও সমস্যা হলে সিটি কর্পোরেশন নৈতিকভাবে সেগুলো দেখবে। বৃষ্টির কারণে পরিস্থিতি কী দাঁড়ায় তা দেখে পরে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
ডিএসসিসি’র অতিরিক্ত বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা খন্দকার মিল্লাতুল ইসলাম জানান, যে কোনও ধরনের প্রতিকূল পরিস্থিতি এড়ানোর প্রস্তুতি আছে আমাদের। পানিবদ্ধতা নিরসনে নগরের প্রতিটি ওয়ার্ডে কাউন্সিলর ও আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তার নেতৃত্বে ইমার্জেন্সি রেসপন্স টিম তৈরি করা আছে। যেসব স্থানে পানিবদ্ধতা হয় তার সমাধানে কাজ করে এরা। এছাড়া আমাদের একটি অত্যাধুনিক জেড অ্যান্ড সাকার মেশিন আছে। এটা দিয়ে পানিবদ্ধতা নিরসনের কাজ করা হয়।
বিশেষ করে গতকালের বৃষ্টিতে নাকাল অবস্থা কোরবানির পশুহাটের। ব্যবসায়ী ও কোরবানির পশু ভিজে একাকার হয়ে গেছে। এমনিতেই গত কয়েকদিনে হাটে ক্রেতার উপস্থিতি ছিলো কম। তবে ঈদুল আযহার আর মাত্র একদিন বাকি থাকায় গতকাল গরু-ছাগল কিনতে দলবেঁধে পরিবার পরিজন নিয়ে হাটের দিকে ছুটছেন ক্রেতারা।
এবার গরুর দাম সর্বনিম্ন ২৫-৩০ হাজার থেকে শুরু করে ১৬ লাখ টাকা পর্যন্ত দর হাঁকানো হয়েছে। তবে ২৫ হাজার টাকার গরু দেখতে অনেকটা বাছুরের মতো। তার চেয়ে একটু বড় হলেই দাম চাওয়া হচ্ছে ৩৫ হাজার থেকে ৬০ হাজার টাকার মধ্যে।
পছন্দসই গরুর দাম প্রকার ভেদে ৭০ হাজার থেকে লাখ টাকার ওপরে। তবে যে যেমন পারছেন দাম হাঁকাচ্ছেন। আবার আরেকটু উন্নতমানের গরুর দাম চাওয়া হচ্ছে দেড় লাখ থেকে ১৬ লাখ টাকা পর্যন্ত।
গোপিবাগ ও কমলাপুর হাট ঘুরে দেখা যায়, যেদিকে চোখ যায় শুধু গরু আর গরু। আগে রাস্তার দুপাশে এক সারি করে রাখা হলেও এখন তিন সারি রাখা হয়েছে। মূল হাটে গরু আর রাখার জায়গা নেই। এখনো ট্রাকের পর ট্রাক গরু আসছে বিভিন্ন জেলা থেকে। এর সবই দেশী গরু। সকাল ১১ টার দিকে দেখা যায় গরু নামাতে হাটের মধ্যে ট্রাকের দীর্ঘ লাইন পড়ে গেছে।
গতকাল বুধবার সরজমিন গিয়ে রাজধানীর গাবতলী, খিলক্ষেত, গোপীবাগে, মেরাদিয়া বাজার, হাজারিবাগ বেড়িবাধ, জুরাইন শ্মশান ঘাট ও ধুপখোলা মাঠসহ কয়েকটি হাট ঘুরে দেখা যায় এ চিত্র। মালিবাগ থেকে গোপিবাগ ও কমলাপুর অস্থায়ী গরুর হাটে কোবানির গরু কিনতে আসা প্রফেসর আবদুর রহমান বলেন, আমি ৮০ হাজার টাকা বাজেট নিয়ে গরু কিনতে এসেছি। এখনও পছন্দ হয়নি। তবে এ হাটে পর্যাপ্ত গরু এসেছে। তাই পছন্দমতো যার যেমন ইচ্ছা গরু কিনতে পারছে। তিনি বলেন, এবারের কোরবানির হাটে গরুর দামও আমাদের হাতের নাগালে আছে। মুগদাপাড়া থেকে কমলাপুর হাটে কোরবনির পশু কিনতে আসা একজন বেসরকারী ব্যাংক কর্মকর্তা শহিদুল্লাহ হাওলাদার বলেন, এবারের কোরবানির হাটে যথেষ্ট পরিমাণ কোরবানির পশু এসেছে। দামও ক্রেতার হাতের নাগালে আছে বলে তিনি মনে করেন। তিনি বলেন, আমি ৬৫ হাজার টাকা দিয়ে একটি গরু কিনেছি। এ দামে কিনতে পেরে আমি খুশি।
ফরিদপুর থেকে আসা গাবতলী হাটে গরু ব্যবসায়ী বেকন মিয়া জানান, তিনি ৩০টি গরু এনেছিলেন। গতকাল দুপুর পর্যন্ত ২২টি বিক্রি হয়। পাবনা থেকে আসা গরু ব্যবসায়ী মারুফ আহমেদ বলেন, তাঁর ২৫টি গরুর মধ্যে বুধবার দুপুর পর্যন্ত বিক্রি হয় ১৮টি। বেলা ২টার দিকে ওই হাটে কথা হয় খুরশিদ আবদুল্লা নামের একজন ব্যাংক কর্মকর্তার সাথে। তিনি বলেন, সকাল ১১টায় এসেছি। কিন্তু পছন্দের সঙ্গে দাম মিলাতে পারছি না। ব্যবসায়ীরা বেশি দাম হাঁকাচ্ছেন। হাটে উট দেখার মানুষই বেশি। গাবতলী হাটে সারি সারি দাঁড়িয়ে থাকা উটের আশপাশে ক্রেতার চেয়ে দর্শকের ভিড় দেখা গেল। কেউ কেউ মুঠোফোনে ছবি তুলছেন বা ভিডিও করছেন। একেকটি উটের দাম হাঁকা হয় সাত থেকে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত। উট ব্যবসায়ী মোহাম্মদ ছাইদুল হক বলেন, উট কেনার মানুষ কম, দেখার মানুষ বেশি। ১০টি উট এনে গতকাল পর্যন্ত ২২ লাখ টাকায় চারটি বিক্রি করেছি। সব উট বিক্রি হবে বলে আশা করছেন তিনি।
মানিকনগরের বাসিন্দা মোহাম্মদ আবদুল মান্নান এক দিনের ব্যবধানে মেরাদিয়া পশুর হাট থেকে দুটি গরু কিনেছেন। গতকাল একটি গরু কেনেন হাসিলসহ ৭৮ হাজার টাকায়, এক দিন আগে একটি কিনেছিলেন ৫৬ হাজার টাকায়। ছোটটির দামে সন্তুষ্টি থাকলেও বড় গরুটির দাম ৬৫ থেকে ৭০ হাজার টাকা হলে ঠিক ছিল বলে মনে করেন তিনি।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ