Inqilab Logo

শুক্রবার ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৫ আশ্বিন ১৪৩১, ১৬ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬ হিজরী

উচ্চ আদালতের বিবেক কি তখন বন্দী ছিল

প্রধানমন্ত্রীর প্রশ্ন

| প্রকাশের সময় : ৩১ আগস্ট, ২০১৭, ১২:০০ এএম

স্টাফ রিপোর্টার : আওয়ামী লীগ সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের আত্মস্বীকৃত খুনীদের ইমডেমনিটি দিয়ে বিচারের পথ রুদ্ধ করার সময় দেশের আদালতের বিবেক কোথায় ছিল সেই প্রশ্ন তুলেছেন। তিনি বলেছেন, উচ্চ আদালত এখন বিভিন্ন বিষয়ে স্বপ্রণোদিত হয়ে অনেক রায় দেয়। অনেকে অনেক বিষয় নিয়ে উচ্চ আদালতের দ্বারস্থ হয়। কিন্তু বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর এই উচ্চ আদালত কোথায় ছিল? তাদের বিবেক কি তখন বন্দী ছিল?
গতকাল বুধবার বিকালে রাজধানীর বঙ্গবন্ধু সম্মেলন কেন্দ্রে শোকের মাস আগস্ট উপলক্ষে আয়োজিত এক আলোচনা সভায় তিনি এসব কথা বলেন। ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ আওয়ামী লীগ যৌথভাবে এই আলোচনা সভার আয়োজন করে। ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সভাপতি হাজী আবুল হাসনাত আলোচনা সভায় সভাপতিত্ব করেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিভিন্ন দেশ বঙ্গবন্ধুর খুনিদের আশ্রয় দেয়নি। আমি জানি না যারা বাংলাদেশে তখন বিবেকবান ছিলেন হাতেগোনা কয়েকজন ছাড়া বাকিরা তো কোনো কথা বলেননি। বিদেশিদের মতো বিবেক কয়জন দেখিয়েছে?
শেখ হাসিনা বলেন, বেইমান-মুনাফিক মোশতাক বঙ্গবন্ধুকে খুন করে তিন মাসও ক্ষমতায় থাকতে পারেনি। বেইমানরা বেশি দিন থাকতে থাকতে পারে না। মীর জাফর সিরাজ-উদ-দৌলার সঙ্গে বেঈমানি করে টিকতে পারেনি, বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে বেঈমানি করে মোশতাকও টিকতে পারেনি।
আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেন, এটা খুব স্পষ্ট যে, মোশতাকের ডান হাত ছিল জিয়া। কর্নেল ফারুক তার ইন্টারভিউতে স্পষ্ট করে বলেছে। সায়েমকে হটিয়ে জিয়া পরবর্তী সময়ে প্রেসিডেন্ট হন। জিয়া মুক্তিযোদ্ধা সেনা অফিসারদের খুন করেছে। জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় এসে বঙ্গবন্ধু হত্যার পথ রুদ্ধ করে দেন বলেও মন্তব্য করেন শেখ হাসিনা
শেখ হাসিনা বলেন, পৃথিবীর কোন দেশে নেই যে হত্যার বিচার করা যাবে না। কিন্তু আমাদের দেশে সে আইন হয়েছিল। আমরা (শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা) কি এই দেশের নাগরিক নই? আমরা যারা বাবা-মাসহ সবাইকে হারিয়েছি, তাদের হত্যার বিচার চাইতে পারবো না? আজকে অনেকেই একটা হত্যাকান্ড হলেই বিচারের দাবিতে সোচ্চার হন। আমার কাছে আসেন। বিচার চান। তখন ভাবি আমিও তো সব হারিয়েছিলাম। কিন্তু তখন তো আমাদের বিচার চাওয়ার অধিকারটুকুই কেড়ে নেয়া হয়েছিল। একুশ বছর পর আমরা ক্ষমতায় এসে সংসদে ইনডিমনিটি অধ্যাদেশ বাতিল করি। খুনিদের বিচার শুরু করি। কিন্তু রায় কার্যকর করতে পারিনি। দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় এসে সেই খুনিদের বিচার করেছি।
সংবিধান লংঘন করে অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করে জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনীদের বিভিন্ন দূতাবাসে চাকুরি দিয়ে পুরস্কৃত করেছিল। ক‚টনৈতিক মিশনে যাদের চাকরি দেওয়া হলো, তাদের যোগ্যতা কী? তারা অনেক খুন করেছে, জাতির পিতা ও রাষ্ট্রপতিকে হত্যা করেছে, শিশু-নারীকে হত্যা করেছে। এরাই জিয়াউর রহমানের সবচেয়ে যোগ্য ছিল। আমি জানি সেই সময়ে যারা বিবেকবান ছিলেন, যারা বুদ্ধিজীবী ছিলেন, যারা আইনজীবী ছিলেন, তাদের অনেকেই সেই সময় কোন প্রতিবাদ করেনি। হাতে গোনা কয়েকজন প্রতিবাদ করেছিল, কিন্তু এখন যারা অনেক কথা বলেন তারা তোন কোন প্রতিবাদ করেননি।
বঙ্গবন্ধুর খুনিদের জিয়াউর রহমান রক্ষা করেছিলেন জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, খুনিদের বিভিন্ন দূতাবাসে চাকরি দিয়ে জিয়া পুনর্বাসন করেছিলেন। তাদের যোগ্যতা কী? যোগ্যতা হলো তারা খুনি। তারা খুন করে জাতির পিতাকে, শিশুকে, নারীকে।
শেখ হাসিনা বলেন, পঁচাত্তর পরবর্তী সময়ে বঙ্গবন্ধু নামে কেউ ছিল এটাও ভুলিয়ে দেয়ার অপচেষ্টা হয়েছে। টেলিভিশনে বঙ্গবন্ধুর ছবি দেখানো হতো না। অন্যদের সঙ্গে কোথাও বঙ্গবন্ধুর ছবি থাকলে তা ঢেকে রাখা হতো।
বঙ্গবন্ধুর বলিষ্ঠ নেতৃত্বের প্রশংসা করে তার কন্যা বলেন, বঙ্গবন্ধু দেশের মানুষের ভাগ্যের উন্নয়নের জন্য সংগ্রাম করে গেছেন। এদেশের মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করে, স্বাধীনতার চেতনায় উদ্বুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছেন। ফাঁসির মুখেও তিনি নতি স্বীকার করেননি বলে জানান প্রধানমন্ত্রী।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, পঁচাত্তরের পর যারাই ক্ষমতায় এসেছে বাংলাদেশকে পিছিয়ে দিতে চেষ্টা করেছে। কারণ তারা দেশের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করে না। যারা রক্ত দিয়ে স্বাধীনতা এনেছে তারাই ছিল ক্ষমতাসীনদের কাছে উপেক্ষিত। দেশটাকে তারা ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যেতে চেষ্টা করেছে। তিনি বলেন, আত্মস্বীকৃত খুনিদের দূতাবাসে পাঠানোর কারণে পৃথিবীর বহু দেশ তাদেরকে গ্রহণ করেনি। আমি পোলান্ডের কথা জানি, তারা খুনিদের গ্রহণ করেনি, ফিরিয়ে দিয়েছিল, নিষেধ করে বলেছিল- এরা মুজিবকে হত্যা করেছে, তাদেরকে আমরা নিতে পারি না। বিদেশী বন্ধু রাষ্ট্র সেসময় যে বিবেক দেখিয়েছিল, তখন আমাদের দেশের কয়জন বিবেকবান সেই বিবেক দেখিয়েছিলেন?
বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ড পরবর্তী দীর্ঘ ২১ বছর বঙ্গবন্ধুর নাম মুছে ফেলতে এবং দেশের নীতি-আদর্শ ধ্বংস করে ব্যর্থ রাষ্ট্র পরিণত করতে ক্ষমতাসীনদের নানা ষড়যন্ত্র-চক্রান্তের কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করে জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধুর খুনীদের শুধু পুরস্কৃত নয়, কারাগারে আটক সকল যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের হাত থেকে রেহাই দিয়ে রাজনীতিতে পুনর্বাবস, স্বাধীনতাবিরোধীদের প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রি ও উপদেষ্টা বানিয়ে ক্ষমতার অংশীদার করেছিলেন। অথচ তিনি নাকি মুক্তিযুদ্ধের খেতাবধারী মুক্তিযোদ্ধা! মুক্তিযুদ্ধের বিজয় ও স্বাধীনতার ইতিহাসই এই ব্যক্তিটি মুছে ফেলার চেষ্টা করেছিলেন।
আবেগজড়িত কন্ঠে তিনি বলেন, সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর দীর্ঘদিন জিয়াউর রহমান তাদের দু’বোনকে দেশে ফিরতে দেয়নি। আমার অনুপস্থিতিতে আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচন করা হয়। এরপর অনেক বাধা ও ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করে দেশে ফিরলেও ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়কের বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে আমাদের ঢুকতে দেয়া হয়নি। আমরা বাড়ির সামনের রাস্তায় বসে দোয়া-মোনাজাত করেছি। তিনি বলেন, তখন জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধুর বাড়ির পরিবর্তে আমাকে আরেকটি বাড়ি দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু কোন খুনীর কাছে থেকে কোনকিছু নেওয়ার মনোবৃত্তি আমার ছিল না। আমি ঘৃণাভরে সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিলাম।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, জিয়াউর রহমান হত্যাকান্ডের পর তড়িঘরি করে আমাকে বঙ্গবন্ধুর বাড়িটি বুঝে দেয়ার চেষ্টা করা হয়। তখন তাদের ষড়যন্ত্র আমরা বুঝতে পারি। ওই সময়তো জিয়াকে সাধু বানাতে অনেক বিবেকবান মানুষই সোচ্চার ছিলেন। ভাঙ্গা-স্যুটকেস, ছেঁড়াগেঞ্জী ছাড়া জিয়া আর কিছু রেখে যায়নি, আর বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে অনেক সোনা-হীরা-জহরত ছিল এমন অপপ্রচার চালানো হয়েছিল প্রায় ৪০ দিন ধরে। পরে দেশের মানুষ দেখতে পারলো কী? ভাঙ্গা স্যুটকেস আর ছেঁড়া গেঞ্জী যাদুর বাক্স হয়ে গেল। জিয়া পরিবার শত শত কোটি টাকার মালিক হয়ে গেলেন।
প্রধানমন্ত্রী এ সময় বিএনপি-জামায়াত জোটের আন্দোলন ও নির্বাচন বানচালের নামে শত শত মানুষকে পুড়িয়ে হত্যা, নাশকতা, জঙ্গীবাদ ও সন্ত্রাস সৃষ্টির ভয়াল চিত্র দেশবাসীর সামনে তুলে ধরে বলেন, নির্বাচনে যাননি এটা বিএনপি নেত্রীর নিজস্ব রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। আমি তো তাঁকে নির্বাচনে আনতে অনেক চেষ্টা করেছিলাম। ফোন করে বলেছিলাম-যে যে মন্ত্রণালয় চান দিয়ে দেব, তবুও আসুন সবাই মিলে নির্বাচন করি। তিনি নির্বাচনে না এসে জঙ্গী-সন্ত্রাসী স্টাইলে আন্দোলনের নামে অসংখ্য মানুষকে হত্যা করলেন। জীবন্ত মানুষকে পুড়িয়ে হত্যার নোংরা ও হিংস্র কর্মকান্ড করলেন। আসলে এরা (বিএনপি-জামায়াত) মানুষের কল্যাণ করতে পারে না, এরা দেশ ও মানুষের ধ্বংস করতে জানে। জনগণের প্রতিরোধের মুখে অবশ্য খালেদা জিয়া ঘরে ফিরে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন। এখন নির্বাচন যতই এগিয়ে আসছে ততই তাদের নানা অজুহাত শোনা যাচ্ছে।
শেখ হাসিনা বলেন, নির্বাচনে তৃতীয়বারের মতো আমরা ক্ষমতায় আসতে পেরেছি বলেই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু, জেল হত্যাকান্ড, অস্ত্র পাচার ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করতে পেরেছি। বঙ্গবন্ধুর আদর্শ অনুযায়ী নিরলসভাবে দেশ পরিচালনা করছি বলেই বাংলাদেশ আজ সারাবিশ্বের কাছে উন্নয়নের রোল মডেল। পৃথিবীর অনেক দেশের কাছেই উন্নয়নের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এখন বিস্ময়। একটা ভাল কাজ করলেই মনে হয় আব্বা (বঙ্গবন্ধু) তা দেখে খুশি হচ্ছেন, দোয়া করছেন।
ক্ষমতায় থাকতে বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের দুর্নীতি, লুটপাট, অর্থ পাচারসহ এতিমের টাকা আত্মসাতের ঘটনা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, দেশের কল্যাণে নয়, এরা ক্ষমতায় আসেই দুর্নীতি, দুঃশাসন, লুটপাট ও বিদেশে অর্থপাচার করতে। ক্ষমতায় থাকতে বিএনপি নেত্রী এতিমের টাকা মেরে খেয়েছেন। বিদেশে অর্থ পাচারের দায়ে বিদেশের আদালতে বিএনপি নেত্রীর দুই পুত্র দোষী সাব্যস্থ হয়েছে, আমরা তাদের পাচারকৃত কিছু অর্থও ফেরত এনেছি। শুধু তাই নয়, প্রধানমন্ত্রী থাকতেও তিনি জরিমানা দিয়ে দুর্নীতির কালো টাকা সাদা করেছেন।
আলোচনা সভায় আরও বক্তব্য দেন আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ড. আবদুর রাজ্জাক, কর্নেল (অব.) ফারুক খান, খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম, ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া, ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মো. শাহে আলম মুরাদ, ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাদেক খাঁন প্রমুখ। সভা পরিচালনা করেন দক্ষিণের প্রচার সম্পাদক আকতার হোসেন ও উত্তরের উপ-প্রচার সম্পাদক আজিজুল হক রানা।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ