Inqilab Logo

মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১, ২০ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

হজ্জ ও মদীনা শরীফ যিয়ারত

আল্লামা মুজাহিদ উদ্দীন চৌধুরী দুবাগী | প্রকাশের সময় : ২৯ আগস্ট, ২০১৭, ১২:০০ এএম

যারা মদীনা শরীফ গিয়েছেন তারা অতি সৌভাগ্যবান। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর রওজা মোবারক যিয়ারত করা, মসজিদে নববীতে নামায পড়া, বরকতময় নগরীতে অবস্থান করা অতি সওয়াবের কাজ। হজ্জের সময় বিশেষ করে এ সুযোগটি আসে। হজ্জের সফরে হাজীগণ দলে দলে ছুটে যান মদীনায়। হাজী সাহেবগণ যে কয় দিন মদীনা মুনাওয়ারায় অবস্থান করেন প্রতিদিন অন্তত একবার যেয়ারতের চেষ্টা করেন। মুমিনের জীবনে আল্লাহর ঘর যিয়ারত ও প্রিয় হাবীবের রওজার পাশে দাঁড়িয়ে সালাম জানানোর চেয়ে বড় কোনো প্রাপ্তি হতে পারে না। পবিত্র হজ্জ ও উমরা পালনার্থে মক্কা শরীফে গমনকারীদের জন্য হজ্জ ও উমরা সংক্রান্ত কাজগুলো সম্পন্ন করলেই হজ্জ ও উমরা আদায় হয়ে যায়। হজ্জের সফরে মদীনা শরীফ গিয়ে রওজা পাকের যিয়ারত করে পবিত্র এই সফরের পরিপূর্ণতা লাভ হয়। কেউ যদি উমরা ও হজ্জ পালনে রওজা পাকের যিয়ারত না করে, তার হজ্জ ও উমরা আদায় হয়ে গেলেও তার সফরটি থেকে যাবে অসম্পূর্ণ।
প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও সাহাবায়ে কেরামের বরকতময় স্মৃতিবিজড়িত পবিত্র শহর মদীনা। মদীনাবাসী আনসার সাহাবিদের সম্পর্কে আল্লাহ ইরশাদ করেন, ‘যারা মুহাজিরদের আগমনের পূর্বে মদীনায় বসবাস করেছিল এবং বিশ্বাস স্থাপন করেছিল, তারা মুহাজিরদের ভালবাসে, মুহাজিরদেরকে যা দেয়া হয়েছে, তজ্জন্যে তারা অন্তরে ঈর্ষাপোষণ করে না এবং নিজেরা অভাবগ্রস্ত হলেও তাদেরকে অগ্রাধিকার দান করে। যারা মনের কার্পণ্য থেকে মুক্ত, তারাই সফলকাম’ (সুরা : হাশর, আয়াত : ৯)। এই পুণ্যভূমিতেই সবুজ গম্বুজের ছায়ায় রওজা পাকে আছেন সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ মানব, আল্লাহর হাবীব, রাহমাতুল্লিল আ’লামীন হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর রওজা যিয়ারত একজন মুমিনের সারা জীবনের লালিত প্রত্যাশা। রওজা মোবারকে প্রতিটি মুহূর্তে আল্লাহর রহমত এবং বরকত নিয়ে ফেরেস্তাগণ নাযিল হন। এ প্রসঙ্গে হাদীস শরীফে এসেছে, হযরত কা’ব (রা.) বলেন, ‘এমন কোনো ফজর পৃথিবীতে উদিত হয় না যেই ফজরে ৭০ হাজার ফেরেশতা রাসূলের রওজা মোবারকে আসেন না। এরা এসে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের রওজা মোবারককে ঘিরে ফেলেন এবং তারা তাদের পাখাগুলো বিছিয়ে দেন এবং সন্ধ্যা পর্যন্ত নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উপর দুরূদ পড়তে থাকেন। সন্ধ্যা হওয়া মাত্রই তারা ওপরে চলে যান এবং আরও ৭০ হাজার ফেরেশতা অবতরণ করে রওজা মোবারক ঘিরে ফেলেন। তাঁরা তাঁদের পাখাগুলো বিছিয়ে দিয়ে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উপর দুরূদ শরীফ পড়তে থাকেন। এভাবে ৭০ হাজার ফেরেস্তা রাতে এবং ৭০ হাজার ফেরেস্তা দিনে নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উপর দুরূদ শরীফ পাঠ করতে থাকেন। এমনকি যে দিন কিয়ামত হয়ে যাবে সেদিন মাটি ফেটে রাস্তা হয়ে যাবে এবং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ৭০ হাজার ফেরেস্তার মাঝ থেকে বের হবেন, প্রদর্শন করবেন’ (তাযকিয়া, পৃ: ২১৩)।
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘আমাকে এমন এক নগরীতে বসবাসের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, যা মর্যাদায় সব শহরকে ছাড়িয়ে যাবে। মানুষ তাকে ইয়াসরিব বলে। তার নাম হলো মদীনা। তা মন্দ চরিত্রের লোকদের এমনভাবে দূর করে দেবে, যেমন কামারের ভাট্টি লোহার ময়লা দূর করে’ (সহিহ বুখারি, হাদীস : ১৮৭১)। এই মদীনা নগরীর জন্য আল্লাহ’র রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দোয়া করে গেছেন। হযরত আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেন, ‘হে আল্লাহ তুমি মক্কায় যে পরিমাণ বরকত দান করেছ মদীনায় তার দ্বিগুণ কর’ (মুসলিম, হাদীস: ১৩৬৯)। অন্য হাদিসে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘যে ব্যক্তি মদীনার অধিবাসীদের কোনো ক্ষতি সাধন করতে চায়, আল্লাহ তাকে নিশ্চিহ্ন করে দেবেন, যেভাবে লবণ পানির মধ্যে মিশে যায়’ (সহিহ মুসলিম, হাদীস : ১৩৮৬)।
মদীনা থেকেই ঈমানের আলো সারা বিশ্বে বিচ্ছুরিত হয়েছিল। শেষ যুগে মানুষ যখন ঈমান থেকে বিচ্যুত হতে থাকবে, তখন ঈমান তার গৃহে তথা মদীনার দিকে ফিরে আসবে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘ঈমান মদীনার দিকে ফিরে আসবে, যেভাবে সাপ তার গর্তের দিকে ফিরে আসে’ (সহিহ বুখারি, হাদীস: ১৮৭৬)। দাজ্জালের আবির্ভাবে ফিতনা যখন বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়বে, পৃথিবীবাসী ভীত থাকবে। পৃথিবীর সর্বত্র বিচরণ করতে সক্ষম হলেও তখন সে পবিত্র মদীনায় প্রবেশ করতে পারবে না। হাদীস শরীফে আছে, ‘মক্কা ও মদীনা ছাড়া এমন কোনো শহর নেই, যেখানে দাজ্জালের প্রবেশে বিপর্যস্ত করবে না। মক্কা-মদীনার প্রতিটি প্রবেশপথ ফেরেশতারা সারিবদ্ধ হয়ে পাহারা দেবেন। তখন মদীনা তার অধিবাসীদেরসহ তিনবার কেঁপে উঠবে। আর সব কাফির ও মুনাফিক মদীনা ছেড়ে চলে যাবে’ (সহিহ বুখারি, হাদীস : ১৮৮১)।
মক্কার ন্যায় মদীনায়ও হারাম শরীফ আছে। এই ব্যাপারে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘ইব্রাহীম আলাইহিস সাল্লাম মক্কাকে সম্মানিত করে একে হারাম করেছেন। আর আমি মদীনাকে, এর দুই প্রান্তের মধ্যবর্তী স্থানকে যথাযোগ্যভাবে সম্মানিত করে হারাম ঘোষণা করলাম। অতঃপর এখানে রক্তপাত কিংবা যুদ্ধের জন্য অস্ত্র বহন করা যাবে না এবং পশুর খাদ্য ব্যতীত এর কোন গাছের পাতা ঝাড়াও চলবে না’ (মুসলিম, হাদীস: ১৩৭৪)। মদীনার প্রতি রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর গভীর ভালোবাসা ছিল, হযরত আয়েশা (রা.) বলেন, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘হে আল্লাহ! তুমি মদীনাকে আমাদের কাছে এমনই প্রিয় করে দাও, যেমনি প্রিয় করেছ মক্কাকে। বরং তার চেয়েও বেশি প্রিয় করে দাও’ (সহিহ বুখারি, হাদীস: ৬৩৭২)। হযরত আনাস ইবনে মালিক রাদিআল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘মসজিদে নববীতে যদি এক নামায পড়ে তবেও পঞ্চাশ হাজার নামাযের সওয়াব পাবে। এবং যদি ক্বাবা শরীফে এক নামায পড়ে তবে এক লাখ নামাযের সওয়াব পাবে’ (ইবনে মাজা, ১৪৭৮)। মসজিদে নববীতে একাদিক্রমে ৪০ ওয়াক্ত নামায জামাতের সঙ্গে পড়ার ফজিলত সম্পর্কে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘যে ব্যক্তি আমার মসজিদে চল্লিশ ওয়াক্ত নামায আদায় করেছে আর কোনো নামায কাজা করেনি, সে নিফাক (মুনাফেকি) আর দোজখের আযাব থেকে নাজাত পাবে’ (মুসনাদে আহমদ, হাদীস : ১২৫৮৩; আত-তারগিব ওয়াত-তারহিব)।
পবিত্র মদীনা মুনাওয়ারাহ যিয়ারত করা ও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর ওসীলা নিয়ে আল্লাহর কাছে দোয়া করার জন্য পবিত্র কুরআনে সুস্পষ্ট ইঙ্গিত রয়েছে। পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হচ্ছে, ‘যখন তারা নিজেদের উপর অত্যাচার করবে, তারা আপনার নিকট আসবে, আল্লাহ তা’য়ালার নিকট মাগফিরাত তলব করবে এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামও তাদের জন্য মাগফিরাত তলব করবেন, তখন নিশ্চয়ই আল্লাহ তা’য়ালা তাদের তওবা কবুল করবেন এবং করুণা প্রদর্শন করবেন’ (সূরা নিসা: আয়াত- ৬৪)। এ আয়াতে বলা হয়েছে, যখনই যেকোন যুগের কোন মুসলিম পাপ করার পর তাঁর কাছে আসবে তার তাওবা আল্লাহ কবুল করবেন, যদি মহান রসূলও তার জন্য ক্ষমা চান। এতে বুঝা যায়, মহানবী (স.) যেয়ারতকারীকে দেখেন, শোনেন, জানেন এবং তার জন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমা চান, তার জন্য দোয়া করেন। এজন্যই তাকে বলা হয় জীবিত নবী। এক হাদীসে তো তা আরও স্পষ্টভাবে আছে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘আমার দুনিয়ার জীবন তোমাদের জন্য কল্যাণকর এবং আমার ওফাতও তোমাদের জন্য কল্যাণকর, তোমাদের আমল আমার নিকট উপস্থাপিত হয়। ভালো দেখলে তো আল্লাহর শোকর করি, খারাপ দেখলে তোমাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করি’; এ হাদীসটি সহীহ, (হাইসাম :মাজমা’, ৯:২৪, বায্যার, সুয়ূতী: আল খাসায়েস ২:২৮১)।
পবিত্র মদীনা মুনাওয়ারাহ যিয়ারতের ফজিলত সম্পর্কে অগণিত হাদীস রয়েছে, রাসুলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘যে আমার রওজা যিয়ারত করল, তার জন্য আমার শাফায়াত/সুপারিশ ওয়াজিব হয়ে গেল’ (আসান ফিকহ, পৃষ্ঠা ২৫০, দারাকুতনী ২/২৭৮, জামে ছগীর পৃ. ১৭১, শিফাউস সিকাম পৃ. ২, ওফাউল ওফা পৃ. ৩৯৪, ইলমুল ফিকহ, বায়হাকী)। এ হাদিসের ব্যাখ্যায় আল্লামা ইবনে হাজার মক্কী (রহ.) লিখেছেন, উপরোল্লিখিত হাদীসটিতে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর যিয়ারত জীবদ্দশায় ও পরবর্তী জীবনে উভয়টিকেই বোঝানো হয়েছে। তদ্রুপ যিয়ারতকারী কাছের হোক কিংবা দূরের, পুরুষ হোক বা মহিলা সবাইকে বোঝানো হয়েছে (হাশিয়া আলাল ঈজাহ ৪৮১)।
নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরও বলেন, ‘যে হজ্জ করল, কিন্তু আমার রওজা যিয়ারত করল না, সে আমার প্রতি জুলুম বা অন্যায় আচরণ করল’ (তিরমিজি, শিফাউল সিকাম পৃ. ২৭, ওফাউল ওফা ২য় খন্ড ৩৯৮ পৃ., ইলাউম সুনান-১০ খন্ড, ৩৩২ পৃষ্ঠা, দার কুতনী ও ইবনে আদী)। আল্লামা ইবন হাজার আসকালানী (রহ.) বলেছেন এটি মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর পক্ষ থেকে সতর্কবাণী। এ কারণেই ইমাম সুবকী বলেছেন, মহানবীর যেয়ারত সুন্নতে মুয়াক্কাদাহ্ হওয়ার ব্যাপারে মুসলিম মিল্লাতের ঐকমত্য বা ইজমা হয়েছে (ফাতাওয়া শামী ৪ : ৫৪-৫৫ ও লাইলুল আওতার ৫:১০৪)। মদীনা শরীফ যাওয়ার একমাত্র উদ্দেশ্যই হবে রওজা পাকের যিয়ারত। হাদীস ও ফিকাহ গ্রন্থগুলোতে এ বিষয়ে নির্দেশনা রয়েছে। মদীনায় যাওয়া নিছক কোনো ভ্রমণ নয়, বরং তা একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। আর তা হতে হবে রওজা পাকের যিয়ারতের নিয়তেই। দুনিয়ার রওজাসমূহের মধ্যে সর্বোত্তম ও সবচেয়ে বেশি যিয়ারতের উপযুক্ত স্থান হলো রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর রওজা। তাই এর উদ্দেশে সফর করাও উত্তম। এ কথার ওপর পূর্বাপর সব উলামায়ে কেরামের ঐকমত্য রয়েছে (ওয়াফাউল ওয়াফা : ৪/১৮৮)। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) বর্ণিত একটি হাদীসে আছে নবী (স.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি আমার ওফাতের পর হজ্জ করবে অতঃপর আমার কবর যিয়ারত করবে, সে যেন জীবিতাবস্থায় আমার সাথে সাক্ষাৎ করল’ (মেশকাত, বায়হাকী, সুনানে দারাকুতনি, হাদীস : ২৬৯৪, শুআবুল ঈমান, হাদীস : ৩৮৫৫) ইমাম জাহাবি রহ.-এর মতে, হাদীসটির সূত্র ভালো (জাইয়্যেদ), (ওয়াফাউল ওয়াফা : ৪/১৭১)। পবিত্র মদীনা মুনাওয়ারাহ জিয়ারতের ফজিলত সম্পর্কে আরো একটি হাদীসে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি স্বেচ্ছায় আমার যিয়ারত করবে, সে কিয়ামতের দিন আমার প্রতিবেশী হিসেবে থাকবে, আর সে দিন আমি তার জন্য শাফায়াত করব’ (শুআবুল ঈমান, হাদীস : ৩৮৫৬, ওফাউল ওফা- ২য় খন্ড-৯৯ পৃষ্ঠা, শিফাউল সিকাম পৃ. ২৭, জামে সগীর পৃ. ১৭১, মুয়ালিম দারুল হিজরাত পৃ. ১০২)। হযরত ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে মারফূ সূত্রে বর্ণিত, ‘যে ব্যক্তি মক্কায় হজ্জ করলো অতঃপর আমার মসজিদের উদ্দেশ্য রওয়ানা করল। তার আমলনামায় দুটি মাকবুল হজ্জের সওয়াব লিখে দেয়া হবে’ (দাইলামী - ওফাউল ওফা ২য় খন্ড, ৪০১ পৃষ্ঠা, জযবুল কুলুব পৃ. ১৯৪)।
হুজুর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘মদীনা শরীফ আমার ঘর, আর আমার কবরও মদীনা শরীফই হবে। তাই প্রত্যেক মানুষের উচিৎ এর যিয়ারত করা’ (মেশকাত শরীফ)। হযরত আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘যে আমার কবরের সামনে এসে দুরূদ পড়লো আমি নিজ কানে তার দুরূদ শরীফ শুনতে পাই। আর যে আমার প্রতি দূর থেকে দুরূদ পাঠ করলো আমাকে তা পৌঁছানো হয়’ (শুয়াবুল ঈমান লিল বায়হাকী, পৃ. ১৫৮৩, কিতাবুস সওয়াব, আবু হাইয়ান ইবনু আবিশ শায়খ ইছফাহানী, ফাতহুল বারী ৬/৬০৫, আল-কাওলুল বাদী পৃ. ১৬০)। হযরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, নিশ্চয়ই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘কেউ আমাকে সালাম দিলে আল্লাহ আমার মধ্যে রূহ ফিরিয়ে দেন এবং আমি সালামকারীকে সালামের উত্তর দেই’ (আবু দাউদ, হাদীস: ২০৪১)।
মদীনা শরীফের প্রবেশের পূর্বেই এই মনোভাব দৃঢ়ভাবে ধারণ করতে হবে যেন কোন বেআদবী না হয়ে যায়। পবিত্র রওজা শরীফ যিয়ারত করার সময় রওজা শরীফের দিকে মুখ করে দাঁড়ানো সুন্নত’ (ফতহুল কাদির, ৩য় খÐ)। এটাই ইমাম আবু হানিফা, ইমাম শাফেয়ী (র.) ইমাম মালিক (র.) ও অধিকাংশ ওলামার মত। শুধু রওজা শরীফ নয়; বরং যে কোন কবর যিয়ারতকালে যিয়ারতকারীর চেহারা মুর্দার চেহারার দিকে রেখে সালাম দেয়া মুস্তাহাব এবং দোয়ার সময়ও কবরের দিকে অনুরূপভাবে মুখ করে দাঁড়াতে হবে। সকল মুসলমানেরই আমল (মিশকাত শরীফের শরাহ)। রওজা শরীফকে পিছনে রেখে মুনাজাত করা বেয়াদবী। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘যারা আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলকে কষ্ট দেয় আল্লাহ অবশ্যই তাদেরকে দুনিয়া ও আখেরাতে লানত করেন এবং তিনি তাদের জন্যে অবমাননাকর শাস্তি প্রস্তুত রেখেছেন’ (সূরা আহযাব: আয়াত-৫৭)। রাসূলের সাথে যদি কেউ বেয়াদবি করে তার জীবনের সমস্ত আমল বরবাদ হয়ে যাবে। আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন, ‘মুমিনগণ! তোমরা নবীর কন্ঠস্বরের উপর তোমাদের কন্ঠস্বর উঁচু করো না এবং তোমরা একে অপরের সাথে যেরূপ উঁচুস্বরে কথা বল, তাঁর সাথে সেরূপ উঁচুস্বরে কথা বলো না। এতে তোমাদের কর্ম নিস্ফল হয়ে যাবে এবং তোমরা টেরও পাবে না’ (সূরা হুজুরাত: আয়াত-২)।
অনেকে বলেন, যেয়ারত হজ্জের অংশ নয়। যেয়ারত না করলেও ফরজ হজ্জ আদায় হয়ে যাবে। যারা পবিত্র রওযা শরীফ যিয়ারতে নিরুৎসাহিত করে তাদের উদ্দেশ্যে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এই হাদীস পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘যে হজ্জ করল, কিন্তু আমার রওজা যিয়ারত করল না, সে আমার প্রতি জুলুম বা অন্যায় আচরণ করল’। কুরান ও হাদীসের এত প্রমাণ যিয়ারতের পক্ষে থাকা সত্তে¡ও যিয়ারতে নিরুত্সাহিতকারীগণ একটি হাদীস উল্লেখ করে থাকেন, ‘তিনটি মসজিদ ছাড়া অন্য কোন মসজিদের উদ্দেশ্যে সফর করা যাবে না’। এ কথার অর্থ: সর্বকালের শ্রেষ্ঠ আলেমগণ বুঝেছেন যে, কাছের মসজিদ ছেড়ে অন্য মসজিদে যাওয়া। মূলত উক্ত হাদীস দ্বারা কখনই পবিত্র রওযা শরীফ, মাযার শরীফ যিয়ারতের উদ্দেশ্যে সফর করা নিষেধ প্রমাণিত হয় না। কারণ উক্ত হাদীস পবিত্র রওযা শরীফ, মাযার শরীফ সম্পর্কিত নয়; বরং মসজিদ সম্পর্কিত। যদি থাকতো তবে হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কখনোই বদর ও উহুদের শহীদানদের মাযার শরীফ যিয়ারতের উদ্দেশ্যে প্রতি বছর সফর করতেন না। হজ্জের সফরে পবিত্র মদীনা মুনাওয়ারাহ যিয়ারত করার জন্য ওলামায়ে কেরামগণ অত্যাধিক গুরুত্ব আরোপ করেছেন। ‘মাআরিফুছছুনান’ নামক কিতাবের মধ্যে আছে, আল্লাহর নৈকট্য লাভের এক বড় মাধ্যম হলো রাসূল (স.)-এর রওজা শরীফ যিয়ারত করা এবং এর উদ্দেশ্যে সফর করা। আল ওফা নামক কিতাবের মধ্যে রয়েছে, হানাফী মাজহাবের ওলামায়ে কেরাম বলেছেন, রাসূল (স.) এর রওজা শরীফ যিয়ারত মর্যাদার দিক দিয়ে ওয়াজিবের নিকটবর্তী। অনুরূপভাবে মালিকী ও হাম্বলী-মাজহাবের ওলামায়ে কেরাম স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন। শাহ আব্দুল হক মুহাদ্দীছে দেহলভী (র.) তাঁর জযবুল কুলুব নামক কিতাবে লিখেছেন, রাসূল (স.)-এর রওজা শরীফ যিয়ারত করা সুন্নত। এটা ইজমা দ্বারা ছাবিত হয়েছে।
হজ্জ করে রওজা মোবারক যিয়ারত না করে চলে আসা প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সাথে চরম ধৃষ্ঠতা ছাড়া কিছুই নয়। পবিত্র মদীনা মুনাওয়ারাহর জিয়ারতের গুরুত্ব বর্ণনা করতে গিয়ে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি সামর্থ্য রাখে সে ব্যক্তি যেন মৃত্যু পর্যন্ত মদীনায় অবস্থান করে। যে ব্যক্তিই মদীনায় মারা যাবে তার জন্য আমি নিশ্চয়ই সুপারিশ করবো’ (তিরমিজি, হাদীস : ৩৯১৭)। তাইতো খাঁটি নবী প্রেমিকগণ মদীনায় মৃত্যু বরণের জন্য দোয়া করতেন। হযরত ওমর (রা.) দোয়া করেছিলেন, ‘হে আল্লাহ আমাকে তোমার রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর শহর মদীনায় মৃত্যুমুখে পতিত কর’ (বুখারী)। আল্লাহপাক তার দোয়া কবুল করে ছিলেন। এভাবে ইমাম মালিক (রা.) সহ অগণিত নবী প্রেমিকের নাম নবী প্রেমের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লিপিবদ্ধ রয়েছে। ইমাম মালিক (রা.) সারা জীবনই মদীনায় কাটিয়েছিলেন। কেবলমাত্র ফরজ হজ্জ আদায় করণার্থে এক বছর মক্কা শরীফ গিয়েছিলেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর মহব্বতে আর কখনও মদীনা ত্যাগ করেন নি। মুসলিম শরীফের ব্যাখ্যাকার আল্লামা নববী (রহ.) লিখেছেন, হজ্জ ও উমরাহকারীগণ মক্কা শরীফ থেকে প্রত্যাবর্তনকালে রওজাপাকের জিয়ারতের উদ্দেশ্যে মদীনা শরীফের সফর করবে। কেননা এটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত এবং সফলতার সর্বোত্তম প্রচেষ্টা, (আল ঈজাহ, ৪৪৭)।
মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ করতে হলে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে ভালোবাসতেই হবে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর প্রতি মহব্বত ব্যতীত কেউই পূর্ণ মুমিন হতে পারবে না (বুখারী)। একারণেই হজ্জের সফরে পবিত্র মদীনা মুনাওয়ারাহ যিয়ারত করার জন্য ওলামায়ে কেরামগণ অত্যাধিক গুরুত্ব আরোপ করেছেন। আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে তার হাবীবের দীদার ও তাঁর রওজা শরীফ যিয়ারত এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর পরিশুদ্ধ ভালবাসা অর্জনের তাওফীক দিন।
লেখক : বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ ও বহু গ্রন্থ প্রণেতা



 

Show all comments
  • Azizul ১৬ মে, ২০১৮, ৭:৩৪ এএম says : 0
    এখানে আপনি আপনার মন্তব্য করতে পারেন
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ