Inqilab Logo

বুধবার, ২৯ মে ২০২৪, ১৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ২০ জিলক্বদ ১৪৪৫ হিজরী

ব্যাংকের লালবাতি ঠেকাতে সরকার মূলধনের যোগান দেয় অর্থমন্ত্রী

যথাসময়ে দেউলিয়া আইন ও মার্জার আইন

অর্থনৈতিক রিপোর্টার : | প্রকাশের সময় : ২৭ আগস্ট, ২০১৭, ১২:০০ এএম

বেসিক ব্যাংকে প্রকাশ্য দিবালোকে ডাকাতি হয়েছে কোনো ব্যবস্থা নিতে পারিনি -ড. আব্দুর রাজ্জাক


অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত বলেছেন, একটি ব্যাংকে যেন লালবাতি না জ্বলে সে জন্য সরকার মূলধনের যোগান দেয়। একটি ব্যাংক খারাপ হলে পুরো অর্থনীতিতে প্রভাব ফেলে। তবে যথাসময়ে দেউলিয়া আইন ও মার্জার (একীভূতকরণ) আইন করা হবে জানান অর্থমন্ত্রী। তিনি বলেন, শিল্পপ্রতিষ্ঠায় ১০০ কোটি টাকা প্রয়োজন হলে গ্রাহককে দেওয়া হয় মাত্র ২০ কোটি টাকা। ব্যাংকের সব কর্মকর্তাদের সিদ্ধান্তগ্রহণকারী হতে হবে। কোন কেরানী ব্যাংকে দরকার নেই। গতকাল শনিবার রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে ‘রাষ্ট্র মালিকানাধীন ব্যাংকের অবস্থা পর্যালোচনা : চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার উপায়’ শীর্ষক কর্মশালায় প্রধান অতিথি’র বক্তব্যে তিনি এ সব কথা বলেন। অর্থমন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ এ কর্মশালার আয়োজন করে। আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সিনিয়র সচিব মো. ইউনুসুর রহমানের সভাপতিত্বে এতে অন্যদের মধ্যে অর্থমন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি ড. আব্দুর রাজ্জাক, অর্থ ও পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী এমএ মান্নান, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবির, অর্থবিভাগের সিনিয়র সচিব হেদায়েতুল্লাহ আল মামুন, বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর এসকে সুর চৌধুরী ও এসএম মনিরুজ্জামান, রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ৮ ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালকরা বক্তব্য রাখেন। এতে ব্যাংকগুলোর আর্থিক সূচক ও চলমান কর্মকান্ড নিয়ে মুল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সিনিয়র সচিব মো. ইউনুসুর রহমান।
অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেন, সমগ্র ব্যাংকিং খাতে খেলাপী ঋণ মাত্র ১০ থেকে ১১ শতাংশ। সেখানে সরকারি ব্যাংকের ২৭ শতাংশ। এতে আমার লজ্জা লাগে। খেলাপী ঋণ কমিয়ে আনতে হবে। অবলোপনের মাধ্যমে যেসব খেলাপী ঋণ ব্যালান্সশিট থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে তা আদায়ের দায়িত্ব ব্যাংকের। খেলাপী ঋণের সংস্কৃতি বহুদিনের। শুরুতে খেলাপী ঋণের জন্য ব্যাংকারদের দোষ ছিল না। ডলারের বিনিময় মূল্য নির্ধারন জটিলতায় ১৯৭২ সালের পর কিছু খেলাপী ঋণ তৈরি হয়।
তিনি বলেন, এখন খেলাপী ঋণ বৃদ্ধির জন্য ব্যাংকাররাই দায়ী। ঋণ দেওয়ার পরই ব্যাংকাররা চান গ্রাহক খেলাপী হয়ে যাক। এতে গ্রাহককে কব্জায় আনা যাবে। শিল্পপতিদের মেয়াদী ঋন দেওয়া হয়। কিন্তু চলতি মূলধনের ক্ষেত্রে জামানত নিয়ে জটিলতা সৃষ্টি করা হয়। শিল্পপ্রতিষ্ঠায় ১০০ কোটি টাকা প্রয়োজন হলে গ্রাহককে দেওয়া হয় মাত্র ২০ কোটি টাকা। এটি করার ক্ষেত্রে সচেতন হতে হবে।
অর্থমন্ত্রী বলেন, মূলধন পর্যাপ্ততা ব্যাংকের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। একটি ব্যাংকে যেন লালবাতি না জ্বলে এজন্য সরকার মূলধনের যোগান দেয়। একটি ব্যাংক খারাপ হলে পুরো অর্থনীতিতে প্রভাব ফেলে। তিনি বলেন, ব্যাংকের সব কর্মকর্তাদের সিদ্ধান্তগ্রহণকারী হতে হবে। কোন কেরানী ব্যাংকে দরকার নেই। কর্মকর্তাদের দক্ষতা বৃদ্ধি করতে পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। অর্থমন্ত্রী বলেন, কেওয়াইসি ব্যাংকের ক্ষেত্রে খুব গুরুত্বপূর্ণ। কিন্ত বড় বড় গ্রাহকের সঙ্গে সরকারি ব্যাংকের কর্মকর্তাদের সঙ্গে সম্পর্ক কম। ঋণ প্রস্তাব আরও উন্নত হতে হবে। এটি কিভাবে করা যায় সেই সুপারিশ দেন। তিনি বলেন, ১৫ বছর ধরে এটি কথা বলে আসছি মার্জার হবে। কিন্ত এজন্য আইন দরকার। দেউলিয়া আইন ও মার্জার আইন করা হবে। আমেরিকার ৪ হাজার ব্যাংক ছিল। এখন মার্জার হয়ে অনেক কমে গেছে। আমাদের দেশেও যথাসময়ে মার্জার হবে। আমরা প্রস্তুত আছি।
অর্থমন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি ড. আব্দুর রাজ্জাক বলেন, বেসিক ব্যাংকে ভয়াবহ জালিয়াতি হয়েছে। একজন চেয়ারম্যান বোর্ড মেমো ছাড়াই ঋণ দিয়েছেন। একাউন্ট খোলার দুদিনের মাথায় তার নামে ঋণ পাস করিয়ে টাকা দিয়েছেন। অন্য ব্যাংকের দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত কর্মকর্তা নিয়োগ দিয়ে তার মাধ্যমে হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ বিতরণ করেছেন। কিন্তু তার বিরুদ্ধে আমরা কোন ব্যবস্থা নিতে পারিনি। প্রমাণসহ সব কাগজ দুদকে পাঠানো হয়েছে। কিন্তু দুদক কোন ব্যবস্থা নেয়নি। এমনকি স্থায়ী কমিটির কোন মিটিংয়ে দুদকের কর্মকর্তাদের ডাকলেও তারা আসেননি। বেসিক ব্যাংকে প্রকাশ্য দিবালোকে ডাকাতি হয়েছে। এখনও মাত্র ৭১ জন গ্রাহকের কাছে ২৯ হাজার কোটি টাকা আটকা রয়েছে। তিনি বলেন, ব্যাংকগুলোক ভালো করতে হলে এ্যাকশন প্লান করতে হবে। সেটি বাস্তবায়ন করতে হবে। এ জন্য রাজনৈতিক ইচ্ছা সবচেয়ে বড় কথা।
অর্থ ও পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী এম এ মান্নান বলেন, ‘দুর্নীতি আছে। তবে রাষ্ট্র মালিকানাধীন ব্যাংকে দুর্নীতির তুলনায় অপচয় বেশি। ব্যক্তিগত অপচয়, প্রাতিষ্ঠানিকি অপচয় ও ঐতিহ্যগত অপচয় হয়েছে। এটি বন্ধ করতে হবে। একই সঙ্গে ‘বাংলাদেশ ব্যাংককে সর্বোচ্চ ক্ষমতা দেয়া উচিত ব্যাংকগুলো নিয়ন্ত্রণে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংক ডিভিশন ও বাংলাদেশ ব্যাংকের কাজে ওভারলেপিং হচ্ছে। কাজে নানান সমস্যা দেখা দিচ্ছে।’
এম এ মান্নান বলেন ব্যাংকগুলো পর্যবেক্ষক নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে কোন সময়সীমা ছাড়া। এটি হতে পারেনা। অবশ্যই সময় নির্ধারণ করে দিতে হবে। একই সঙ্গে যাদেরকে পরিচালক করা হচ্ছে তাদেরকেও প্রশিক্ষণ এবং সরকারি ব্যাংকে প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ানোর তাগিদ দেন তিনি।
মূল প্রবন্ধে মো. ইউনুসুর রহমান বলেন, ব্যাংকিং খাতের মোট ৯ হাজার ৭২০টি শাখার মধ্যে ৫ হাজার ১২০টি শাখা বা ৫৩ শতাংশই সরকারি ব্যাংকগুলোর। ব্যাংকের খাতের মোট আমানতের ৩১ ভাগ এবং ঋণের ২২ভাগ সরকারি ব্যাংকগুলোর। আইন অনুযায়ী ব্যাংকগুলোকে ১০ শতাংশ হারে মুলধন সংরক্ষণ বাধ্যতামূলক হলেও সরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর রয়েছে ৭ শতাংশ। এর বিশেষায়িত ব্যাংকের মূলধন ঋণাত্মক ৩৩ শতাংশ। গত চার বছরে মূলধনের যোগান দিতে রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে ৯ হাজার ৬৪০ কোটি ভর্তুকি দেওয়া হয়েছে। সার্বিকভাবে খেলাপী ঋণ ১০ শতাংশ হলেও সরকারি ব্যাংকে তা ২৭ শতাংশ।
রূপালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আতাউর রহমান প্রধান বলেন, ঋণ আদায়ের ক্ষেত্রে মামলার নিষ্পত্তিতে অনেক সময় লেগে যায়। ১৯৮০ সালে মামলা করেও সেই টাকা আদায় করা যায়নি। একটি কোম্পানির ৮-১০ পরিচালক থাকলে তারা সবাই একের পর এক রিট করেন। এতে টাকা আটকে যায়।
বিমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কতৃপক্ষের (আইডিআরএ) সদস্য গকুল চাঁদ দাস বলেন, ২০০৭ সালে ১৫ নভেম্বর সরকারি ব্যাংকগুলোকে করপোরেট করার পর থেকেই অর্ধপতন শুরু। পরিচালনা পরিষদ স্বাধীন হওয়ার পর থেকেই অর্ধপতনের দিকে যাচ্ছে। সরকারি ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে অর্থমন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ব্যাংকের মধ্যে দূরত্ব রয়েছে।
তিনি বলেন, ব্যাংকিং খাত নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ ব্যাংক সঠিকভাবে কাজ করেনি। হলমার্ক ঘটনা জানার পরও বাংলাদেশ ব্যাংক নিশ্চুপ ছিল। মেয়াদ শেষ হবার মাত্র ৮ দিন আগে সোনালী ব্যাংকের পরিষদ ভাঙ্গার সুপারিশ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। পরিষদ ভাঙ্গার ক্ষমতা অগণতান্ত্রিক। এটি বাতিল করত হবে। গকুল চাঁদ দাস বলেন, খেলাপী ঋণ কমাতে ঋণ আদায় বাড়াতে হবে। এজন্য ব্যবস্থাপনা পরিচালকসহ শীর্ষ কর্মকর্তাদের টার্গেট ঠিক করে দিতে হবে। ব্যর্থ হলে বেতন কাটতে হবে। খেলাপী থেকে যে পরিমান আদায় হবে ঠিক সেই পরিমান ঋণ দিতে হবে। এতগুলো ব্যাংকের দরকার নেই। রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংককে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের সঙ্গে অতি দ্রæত একীভ‚ত করতে হবে। এরপর বিডিবিএল, বেসিক ও রুপালী ব্যাংক মিলিয়ে একটি এবং অগ্রণী ও জনতা ব্যাংক মিলিয়ে আরেকটি ব্যাংক করতে হবে।
বেসিক ব্যাংকের চেয়ারম্যান আলাউদ্দিন এ মজিদ বলেন, ব্যাংকের দুর্নীতির জন্য ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ ঘটনায় পরিষদ ও শীর্ষ ম্যানেজমেন্ট দায়ী। সরকারের উচিত দেখেশুনে নিয়োগ দেওয়া। প্রয়োজনে বছরের পর বছর না রেখে খারাপ হলে ২ থেকে ৬ মাসের মধ্যে বাদ দিতে হবে। ঋণ বিতরণ ও আদায়ের ক্ষেত্রে দুদকের কর্মকান্ড বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাদেরকে ব্যাংকের স্বার্থ দেখে কাজ করতে হবে। ৩ জন গ্রাহককে আটক করলে ১৫ জন পালিয়ে যায়। এতে ব্যাংক ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
বিআইবিএমের মহাপরিচালক তৌফিক আহমেদ চৌধুরী বলেন, সরকার চাইলে ব্যাংকগুলো ঘুরে দাঁড়াবে। সবার আগে জানতে হবে সরকার চায় কিনা? ভারত সরকার চেয়েছে সেদেশের ব্যাংকগুলো ঘুরে দাঁড়িয়েছে। এজন্য সরকারের রাজনৈতিক ইচ্ছা লাগবে। এছাড়াও বক্তব্য রাখেন জনতা ব্যাংকের চেয়ারম্যান শেখ মো. ওয়াহিদুজ্জামান, অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান ড. জায়েদ বখত্, ব্যবস্থাপনা পরিচালক শামস-উল ইসলাম, পরিচালক সাংবাদিক কাশেম হুমায়ুন, বিমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষের (আইডিআরএ) চেয়াম্যান সাবেক সচিব শফিকুর রহমান পাটোয়ারি, মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটির ভাইস চেয়ারম্যান অমলেন্দু মুখার্জী, দুর্নীতি দমন কমিশনের সচিব শামসুল আরেফিন, বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সভাপতি ড. জামাল উদ্দিন আহমেদ, এফবিসিসিআই’র পরিচালক আবুল কাশেম প্রমুখ। ###



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: অর্থমন্ত্রী


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ