Inqilab Logo

মঙ্গলবার, ০৯ জুলাই ২০২৪, ২৫ আষাঢ় ১৪৩১, ০২ মুহাররম ১৪৪৬ হিজরী

হকারদের দখলে রাজধানীর ফুটপাত

একদিকে পাহারাদার অন্যদিকে দখল

সায়ীদ আবদুল মালিক | প্রকাশের সময় : ২৩ আগস্ট, ২০১৭, ১২:০০ এএম

ফের হকারদের দখলে চলে গেছে রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ এলাকা গুলিস্তান, পল্টন ও মতিঝিলের সড়ক ও ফুটপাত। ফুটপাত দখল মুক্ত রাখার জন্য সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত স্বেচ্ছাসেবক নিয়োগ করেও তা দখল মুক্ত রাখা যাচ্ছে না। অনেক ক্ষেত্রে স্বেচ্ছাসেকবরাই এই দখল প্রক্রিয়ার ক্ষেত্রে সহযোগিতা করছে বলেও অভিযোগ উঠেছে। দক্ষিণের মেয়র সাঈদ খোকন হাকার উচ্ছেদের বিষয়ে শক্ত অবস্থানে থাকার পরও শেষ পর্যন্ত হকারদের দমিয়ে রাখতে পারেনি। এক ইঞ্চি জায়গা ছাড় না দিতে মেয়রের হুঁশিয়ারিও টিকল না। গুলিস্তানের ফুটপাত ও সড়ক দখল করে হকারদের বসার সেই চিত্র আবার অনেকটা আগের অবস্থানে ফিরে এসেছে। মেয়র তার নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী গুলিস্তান, মতিঝিল ও পার্শ্ববর্তী এলাকাগুলোসহ নিউ মার্কেটের ফুটপাত অবৈধ দখলমুক্ত করে দিলকুশা, নবাবপুর রোড, মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল সংলগ্ন, সেগুনবাগিচা ও বায়তুর মোকাররম মসজিদ এলাকায় পাঁচটি হলিডে মার্কেট চালু করেছেন। এ ছাড়া পুনর্বাসনের লক্ষ্যে হকারদের তালিকা করে দেশে-বিদেশে কর্মসংস্থানের জন্য পরিচয়পত্র প্রবর্তনের কার্যক্রম গ্রহণ করেছেন। কিন্তু বাস্তবতা সম্পূর্ণ ভিন্ন।
ডিএসসিসির প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তা কামরুল ইসলাম চৌধুরী ইনকিলাবকে বলেন, পর্যাপ্ত পুলিশ ফোর্স না পাওয়ার কারণে আমরা নিয়মিত হকার উচ্ছেদের কাজ করতে পারছি না।
তিনি বলেন, ঈদ উপলক্ষে জনগণের নির্ভিঘেœ পথ চলার জন্য রাস্তায় যেন হাকার বসতে না পারে আমরা সে দিকে সতর্ক নজর রেখেছি। তবে বর্তমানে বাংলাদেশ ও অস্ট্রেলিয়ার খেলার জন্য প্লেয়ারদের নিরাপত্তা দিতে পলিশের অতিরিক্ত ব্যস্ততার কারণে আমাদের নিয়মিত উচ্ছেদ অভিযান আপদত বন্ধ আছে। দু’য়েক দিনের মধ্যে ফুটপাতের হাকার উচ্ছেদ অভিযান আবার চালানো হবে বলে তিনি জানান। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গুলিস্তান, পল্টন, বায়তুল মোকাররম এলাকার উচ্ছেদকৃত ফুটপাত দখলমুক্ত রাখতে যে পাহারাদার নিয়োগ করা হয়েছে, তারাই এখন ফুটপাত দখলের সুযোগ করে দিচ্ছেন। বিনিময়ে তারা হকারদের কাছ থেকে মোটা অংকের চাঁদা নিচ্ছে বলেও বিস্তর অভিযোগ রয়েছে। এতে ডিএসসিসি মেয়রের ফুটপাত দখলমুক্ত করে পথচারীদের চলাচলে উন্মুক্ত করে দেয়ার উদ্যোগ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। তবে এসব অভিযোগ সম্পর্কে অবগত নয় সিটি কর্পোরেশন। এ বিষয়ে জানতে চাইলে ডিএসসিসির প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তা কামরুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, স্বেচ্ছাসেবকরা ফুটপাত দখলমুক্ত রাখতে মারও খেয়েছে কয়েক দফায়। তবে দুই-একজন এমন দুষ্ট কেউ যদি থেকে থাকে অবশ্যই তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
গতকাল মঙ্গলবার সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, মেয়র মোহাম্মদ হানিফ ফ্লাইওভারের প্রবেশ মুখ থেকে গুলিস্তানের বঙ্গবন্ধু স্কোয়ার হয়ে গোলাপশাহ মাজার পর্যন্ত সড়কের দু’ধারে অসংখ্য হকার বসেছেন। অনেকে নতুন করে ছাউনী বানাচ্ছেন। গুলিস্তান কমপ্লেক্স থেকে গোলাপশাহ মাজার পর্যন্ত সড়কের অর্ধেক চলে গেছে হকারদের দখলে। সড়কের এ অংশ বন্ধ করে কাপড়, জুতা, ফলসহ নানা পণ্যের বাজার বানানো হয়েছে। পাতাল সড়ক বলে পরিচিত গুলিস্তান আন্ডারপাসের প্রবেশপথ বেলা একটায় বন্ধ দেখা গেছে। এ কারণে সেখান দিয়ে কোনও পথচারী চলাচল করতে পারেননি।
আলাপকালে নাসির উদ্দিন নামের এক হকার বলেন, বহু বছর ধরে গুলিস্তানের ফুটপাত-সড়কে ফল বিক্রি করি। এ জন্য প্রতিদিন চাঁদা দিতে হয়। এখানে না বসলে বসবো কোথায়? কাকে চাঁদা দেন জানতে চাইলে তিনি কোনও মন্তব্য করেননি। তিনি বলেন, অভিযানের সময় তার কিছু মাল ক্ষতি হয়েছে। বাকিগুলো নিয়ে নিরাপদ স্থানে সরে যেতে পেরেছিলেন। গুলিস্তানের ফুটপাত ও সড়ক দখল হলেও পুলিশকে কিছু বলতে বা তৎপরতা চালাতে দেখা যায়নি। বরং পুলিশ নিরাপদ স্থানে দাঁড়িয়ে থাকে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক পুলিশ সদস্য বলেন, এই প্রশ্ন পুলিশকে না করে রাজনৈতিক নেতাদের করুন। গুলিস্তানের ফুটপাতে ব্যবসা করেন মোহাম্মদ মোশারফ বলেন, আমাগো বসার জায়গা দেক, তাইলেই আমরা উইঠ্যা যামু। যতদিন না এইডা দিতে পারবেন ততদিন এইখানেই বমু। এইখানে বই অনেক বছর থেকে, হুট কইরা কইলেই উইঠা যাইতে হইব- প্রশ্ন তার।
ডিএসসিসি সূত্র জানায়, সকাল ৯টা থেকে বিকাল পর্যন্ত চারটি গ্রুপে বিভক্ত হয়ে ৯২ জন স্বেচ্ছাসেবক গুলিস্তান, পল্টন, বায়তুল মোকাররম ও মতিঝিল এলাকায় কাজ করছেন। জানুয়ারি মাসের শেষ দিকে সংস্থাটির সম্পত্তি বিভাগের এক অফিস আদেশে ৫২ জন স্বেচ্ছাসেবক নিয়োগ দেয়া হয়। পরে স্বেচ্ছাসেবকের সংখ্যা বাড়িয়ে ৯২ জন করা হয়। উচ্ছেদের পর পুনরায় দখল হওয়া থেকে ফুটপাত মুক্ত রাখতে এ উদ্যোগ নেয়া হয়। প্রাথমিকভাবে ডিএসসিসির সম্পত্তি বিভাগ থেকে জারি করা এক অফিস আদেশে প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তা মোহাম্মদ কামরুল ইসলাম চৌধুরী বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের ৪০ জন পরিচ্ছন্ন কর্মীকে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে দায়িত্ব পালনের নির্দেশ দেন। এরপর প্রয়োজনের তাগিদে আরও ৪০ জন পরিচ্ছন্ন কর্মীকে এই বাহিনীতে যোগ করা হয়। বর্তমানে প্রতিটি গ্রæপে ২০ জন স্বেচ্ছাসেবক কাজ করেন। তাদের সমন্বয় করার জন্য সম্পত্তি বিভাগের চারজন সর্ভেয়ার ও দুজন করে চেনম্যান রয়েছেন। মতিঝিল ব্যাংকপাড়া থেকে দৈনিক বাংলা মোড় হয়ে পল্টন পর্যন্ত, জিরো পয়েন্ট, জিপিও এবং বায়তুল মোকাররম, বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউ থেকে বিআরটিসি বাসস্ট্যান্ড (সুন্দরবন মার্কেট) এবং নবাবপুর মোড় থেকে বায়তুল মোকাররম মসজিদের দক্ষিণ গেট, দিলকুশা বাণিজ্যিক এলাকা ও বঙ্গভবনের উত্তর পাশ এবং গোলাপশাহ মাজার হতে বঙ্গবন্ধু স্কয়ার পাতাল মার্কেট এলাকাকে চার ভাগে ভাগ করে তাদের দায়িত্ব দেয়া হয়।
সরেজমিনে সংশ্লিষ্ট এলাকা ঘুরে অনেক জায়গায় ফুটপাতের হকার ও ডিএসসিসির স্বেচ্ছাসেবকদের খোশগল্পে মেতে থাকতে দেখা যায়। আবার ডিএসসিসির কর্মকর্তারা পরিদর্শনে আসার আগেই এসব স্বেচ্ছাসেকরাই হকারদের খবর দিয়ে সরিয়ে দেন। গতকাল মঙ্গলবার বেলা ১১টা ও দুপুর ২টায় রাজধানীর গুলিস্তান, পল্টন, বায়তুল মোকাররম ও মতিঝিল এলাকায় ফুটপাত দখল করে প্রকাশ্যেই হকারদের ব্যবসা করতে দেখা যায়। এ সময় গুলিস্তান হল মার্কেটের বিপরীত পাশের ফুটপাতে বসেই দুজন পাহারাদারকে হকারদের সাথে খোশগল্প করতে দেখা যায়। গত সপ্তাহ খানেক ধরে পল্টন, বায়তুল মোকাররম, মতিঝিল ও গুলিস্তান এলাকায় একই চিত্র দেখা গেছে।
জানা গেছে, লাইনম্যানদের বিরুদ্ধে সিটি কর্পোরেশনের মামলা ও গ্রেপ্তারের পরে তাদের চাঁদাবাজি বন্ধ হয়ে যায়। ফুটপাত দখলমুক্ত রাখতে এসব স্বেচ্ছাসেবকদের দায়িত্ব দেয়া হয়। আর এ সুযোগে ডিএসসিসির এসব স্বেচ্ছাসেবকরা হকারদের কাছ থেকে চাঁদা নিয়ে ফুটপাতে ব্যবসা করার সুযোগ করে দিচ্ছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন সংশ্লিষ্ট স্বেচ্ছাসেবকরা। সাংবাদিক পরিচয় গোপন রেখে তাদের কাছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে কয়েকজন বলেন, মাঝেমধ্যে হকাররা একটু ছাড় দিতে অনুরোধ করেন। তাদের বউ বাচ্চা আছে। দু’বেলা দু’মুঠো ভাতের জোগাড় করতে আকুতি জানান তারা। তখন কিছু কিছু ক্ষেত্রে তাদের একটু ছাড় দেয়া হয়। এ ছাড়া তারা (স্বেচ্ছাসেবক) সারাক্ষণ ফুটপাত দখলমুক্ত রাখতে কাজ করেন ।
প্রসঙ্গত, সংশ্লিষ্ট এলাকায় পথচারীদের চলাচলের জন্য রাস্তার দুই পাশের ফুটপাত দখল করে দীর্ঘদিন ধরে অবৈধভাবে ব্যবসায় করে আসছেন হকাররা। সিটি কর্পোরেশন বেশ কয়েকবার উচ্ছেদ অভিযান চালালেও আবার বেদখল হয়ে যায় এসব ফুটপাত। বিভিন্ন সময় উচ্ছেদের সময় হামলা ও সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটেছে। হকার ও লাইনম্যান নামধারী চাঁদাবাজদের হামলার শিকারও হয়েছেন নগর ভবনের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। হকারদের বোঝাতে সিটি কর্পোরেশনের পক্ষ থেকে হকার নেতাদের সঙ্গে একাধিক বৈঠক, মতবিনিময়সহ বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয়া হয়। পুনর্বাসনের জন্য হকারদের তালিকা তৈরি, হলিডে মার্কেট চালু এবং নির্দিষ্ট সময়ে ফুটপাতে হকার বসতে দেয়াসহ বিভিন্ন সিদ্ধান্ত নেয় সংস্থাটি।



 

Show all comments
  • Pritom Mojumder ২৩ আগস্ট, ২০১৭, ১১:২৯ এএম says : 0
    বললেও লাভ নেই।স্বাধীন হবার পর থেকে অপরিকল্পিত নগরায়ণ সব সমস্যার মূল কারণ।।।
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: হকার


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ