Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

রাজধানীতে কোরবানি হাট বসানো নিয়ে চলছে তুলকালাম কান্ড

| প্রকাশের সময় : ২২ আগস্ট, ২০১৭, ১২:০০ এএম

সায়ীদ আবদুল মালিক : ‘হাট! হাট! হাট! বিরাট গরু ছাগলের হাট। ঐতিহাসিক গোলাপবাগ মাঠ, ঢাকা’-এমনসব কথা লিখে ব্যানার পোস্টার করে প্রচার-প্রচারণা চালাচ্ছেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের (ডিএসসিসি) ৪৯ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও বিএনপি নেতা আলহজ¦ বাদল সরদারের নেতৃত্বাধীন একটি সিন্ডিকেট। এখানেই থেমে নেই, বাঁশ-খুঁটিও স্থাপনের কাজ শুরু করেছেন তারা। অবাক হলেও সত্য, এ হাটের অনুমোদন দূরের থাক, দরপত্রও আহবান করেনি ডিএসসিসি কর্তৃপক্ষ। অবৈধ এ হাটের প্রচারপত্রে ইজারাদার হিসেবে আবুল কালাম আজাদের নাম ব্যবহার করা হয়েছে। ওইসব প্রচারপত্রে আরও বলা হয়েছে, এ হাটে ঈদের দিন পর্যন্ত গরু-ছাগল বিক্রি হবে। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী নিরাপত্তা দেবে, পানি-বিদ্যুৎ, থাকা-খাওয়া-গোসল, গরু উঠা-নামা এবং গাড়ি পার্কিংসহ সকল ধরনের সুযোগ-সুবিধা রয়েছে। এছাড়াও প্রচারপত্রে হাজী মোহাম্মদ শহিদুল্লাহ, হাজী শহিদুল ইসলাম মিয়ন এবং মোহাম্মদ মোসলেহ উদ্দিন আহমেদের নাম ব্যবহার করা হয়েছে। স্থানীয় কাউন্সিলর ব্যতিত অন্যরা স্থানীয় আওয়ামীলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত রয়েছেন বলে জানা গেছে।
আসন্ন ঈদুল আজহা উপলক্ষে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় অবৈধ পশুহাট বসানোর পাঁয়তারা চলছে। স্থানীয় সরকারদলীয় নেতাকর্মী ও ওয়ার্ড কাউন্সিলররা এ অপতৎপরতা চালাচ্ছেন বলে জানা গেছে। এতে বৈধ হাটগুলোতে প্রভাব পড়তে পারে। এ ছাড়া জুরাইনে হাট বসানোকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষের পরিবেশ তৈরি হয়েছে।
জানা যায়, ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন (ডিএসসিসি) এ বছর ১৩টি অস্থায়ী কোরবানির পশুহাট বসানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এর মধ্যে ৯টি হাটের দরপত্র মূল্যায়ন সম্পন্ন করে ইজারাদার চ‚ড়ান্ত করা হয়েছে। বাকি চারটি হাটের তৃতীয় দফা পুনঃদরপত্রের টেন্ডার বাক্স খোলা হয়েছে গতকাল সোমবার বিকালে। কিন্তু কোন হাটেরই ন্যূনতম দর মিলেনি। এই অবস্থায় সরকারি হাট-বাজার ব্যবস্থাপনা নীতিমালা অনুযায়ী মন্ত্রণালয়ের সুপারিশের জন্য পাঠানোর উদ্যোগ গ্রহণ করেছে ডিএসসিসি কর্তৃপক্ষ। বিদ্যমান সর্বোচ্চ দামে মন্ত্রণালয় হাট ইজারার অনুমোদন দিলে হাটগুলো বসবে, নইলে বসবে না। কিন্তু এই অবস্থায় এ চারটি পশু হাট বসানোর প্রস্তুতিমূলক কার্যক্রম শুরু করেছে হাট ইজারার পাওয়ার প্রত্যাশী প্রার্থীরা।
গোলাপবাগ বাঁশ পট্টিতে অবৈধ হাট বসানোর বিষয়ে জানতে চাইলে স্থানীয় কাউন্সিলর আলহাজ¦ বাদল সরদার ইনকিলাবকে বলেন, হাটটি অনুমোদনের জন্য ডিএসসিসিতে আবেদন করা হয়েছে। যতটুকু জেনেছি বরাদ্দ দেয়া হতে পারে। এ কারণে আমরা প্রস্তুতিমূলক কার্যক্রম শুরু করেছি। শেষ সময়ে বরাদ্দ দেয়া হলে প্রচার ও হাট গোছানোর কাজ করা সম্ভব হবে না। তবে যদি অনুমোদন না পান তাহলে সবকিছু গুটিয়ে নেবেন বলে জানান। একজন কাউন্সিলর হয়েও এমন কাজ করা যায় কিনা, এমন প্রশ্নের জবাবে বলেন, ভাই, আপনার কাছে অনুরোধ এ ব্যাপারে কিছু লিখেন না।
ইজারাদার হিসেবে পোস্টার ছাপানো আবুল কালাম আজাদ ইনকিলাবকে বলেন, আমরা হাট ইজারা পাইনি, এটা সত্য। তবে শেষমুহুর্তে পেতেও পারি। এজন্য প্রস্তুতি নিয়ে রাখছি। তবে না পেলে হাট বসাবো না।
শুধু গোলাপবাগ মাঠ নয়, ডিএসসিসির বিভিন্ন এলাকায় এমন অর্ধশত ছোট-বড় হাট বসানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে স্থানীয় কাউন্সিলরদের নেতৃত্বে সরকারদলীয়রা। বিষয়গুলো ডিএসসিসির নজরে আসলেও তারা না দেখার ভ্যান করে চলেছেন।
পোস্তগোলা শিল্পাঞ্চলের অভ্যন্তরীণ সড়ক এবং খালি স্থানে অবৈধ কোরবানি পশুর হাট বসানোর প্রস্তুতি নিচ্ছেন স্থানীয় আওয়ামীলীগের নেতাকর্মিরা। খোঁজখবরে জানা গেছে, এ অবৈধ হাট বসানোর নেতৃত্বে রয়েছেন কদমতলী থানা আওয়ামীলীগের সভাপতি ও ডিএসসিসির ৫২ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর মোহাম্মদ নাসিম, কদমতলী থানা স্বেচ্ছাসেবকলীগের সাধারণ সম্পাদক কাজী সোহেল ও ৫৪ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক শরিফ মোহাম্মদ আলমগীর। সরেজমিনে দেখা গেছে, পোস্তগোলা শিল্পাঞ্চল বিভিন্ন পয়েন্ট ব্যানার, ফেস্টুন টাঙ্গিয়ে প্রচারণা চালানো হচ্ছে। বাঁশ-খুঁটিও বসানোর কার্যক্রম শুরু করা হয়েছে।
এ বিষয়ে কাজী সোহেল বলেন, ৫২ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলরের নেতৃত্বে হাট বসানো হচ্ছে বলে আমাকে জানানো হয়েছে। আমাকে কোন দায়িত্ব দেয়া হলে আমি পালন করবো। আর কাউন্সিলর যে হাটের সঙ্গে জড়িত রয়েছেন, সেটা অবৈধ হতে পারে না। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ৫২ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর মোহাম্মদ নাসিম নিজের সংশ্লিষ্টতার কথা অস্বীকার করেন।
ডিএসসিসি এবার ব্রাদার্স ইউনিয়ন বালুর মাঠ সংলগ্ন খালি জায়গায় অস্থায়ী হাট বসানোর প্রস্তুতি নিয়েছে। তিনদফা দরপত্র আহবান করেও ন্যূনতম দর পায়নি ডিএসসিসি। এ কারণে হাটটির ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় (এলজিআরডি) মন্ত্রণলায়ে পাঠানোর উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন ডিএসসিসি কর্তৃপক্ষ। এলজিআরডি মন্ত্রণালয় এব্যাপারে ইতিবাচক বা নেতিবাচক দুই ধরনের সিদ্ধান্তই আসতে পারে। তবে ওই হাটের প্রত্যাশি ইজারাদারের লোকজন ইতিমধ্যে হাট বসানোর প্রস্তুতি কার্যক্রম শুরু করেছে। গেট তৈরির কাজ সম্পন্ন, বাঁশ-খুঁটিও লাগানো হচ্ছে। এসব অবৈধ কার্যক্রম বন্ধে তৎপরতা নেই ডিএসসিসির। এ ব্যাপারে স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর সুলতান আহমেদ বলেন, আমার এলাকায় অবৈধ হাট বসানোর কোন সুযোগ নেই। ডিএসসিসি অনুমোদন না দিলে ব্রাদার্স ইউনিয়নের হাট বসবে না। এছাড়াও তিনদফা দরপত্র আহবান করেও ন্যূনতম দর মিলেনি-কমলাপুর স্টেডিয়ামের আশপাশের এলাকা, আরমানিটোলা খেলার মাঠ এবং সাদেক হোসেন খোকা মাঠসংলগ্ন ধোলাইখাল ট্রাক টার্মিনাল ও সংলগ্ন খালি জায়গা। সরেজমিনে ঘুরে এবং খোঁজ খবরে জানা যায়, এ তিন হাট বসানোর প্রস্তুতিমূলক কার্যক্রম চলমান রয়েছে।
এরবাইরেও গ্রিণরোড সরকারি স্ট্রাফ কোয়াটারের ২ নম্বর ভবনের সামনের মাঠ, ডেমরা রোড সংলগ্ন মৃধাবাড়ি মাঠ, কামরাঙ্গীরচর, হাজারীবাগ, লালবাগ এলাকার বিভিন্ন উন্মুক্ত জায়গা ও বেড়ীবাধের আশপাশের এলাকাসহ ডিএসসিসি এলাকার বিভিন্ন পয়েন্টে অর্ধশত হাট বসানোর প্রস্তুতিমূলক কার্যক্রম পরিচালনা করছে স্থানীয় কাউন্সিলর ও সরকারদলীয় নেতাকর্মিরা।
এ প্রসঙ্গে ডিএসসিসির প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তা মোহাম্মদ কামরুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, যেসব হাটের এখনো ইজারা চ‚ড়ান্ত হয়নি, সেসব হাটে যারা প্রস্তুতিমূলক কার্যক্রম চালাচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। প্রয়োজনে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করে তাদেরকে উচ্ছেদ করা হবে। ডিএসসিসির বিভিন্ন এলাকা থেকে আমাদের কাছে ৫০টি হাট বসানোর আবেদন এসেছে। ওইসব এলাকায় অবৈধ হাট বসানোর আশঙ্কা রয়েছে। সেই স্পটগুলো মনিটরিং করে ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।
এ প্রসঙ্গে ডিএসসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা খান মোহাম্মদ বিলাল বলেন, ডিএসসিসি এলাকায় কোন অবৈধ হাট বসতে দেয়া হবে না। কিছু এলাকায় অবৈধ হাট বসানোর প্রস্তুতিমূলক কার্যক্রম চলছে বলে শুনেছি। সেসব এলাকায় উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করে অবৈধ হাট উচ্ছেদ করা হবে।
ডিএসসিসি এ বছর টেন্ডারের মাধ্যমে কদমতলির শ্যামপুর বালুর মাঠ এবং পোস্তগোলা শশ্মান ঘাট সংলগ্ন খালি জায়গায় দু’টি হাট ইজারা সম্পন্ন করেছে। শ্যামপুর মাঠ এক কোটি ৩৩ লাখ টাকা এবং পোস্তগোলা শশ্মানঘাট সংলগ্ন খালি জায়গার হাট ৩৫ লাখ ১৫ হাজার টাকায় ইজারা দেয়া হয়েছে। এলাকাবাসী অভিযোগ করেছেন, এ দু’টি হাটের মাঝখানে ও খুব নিকটবর্তী জুরাইন বালুর মাঠে টেন্ডার প্রক্রিয়া ছাড়াই অবৈধভাবে আরেকটি কোরবানির পশুরহাট বসানোর পাঁয়তারা করছেন স্থানীয় আওয়ামীলীগের নেতাকর্মিরা।
জানা যায়, জুরাইন রেলগেট সংলগ্ন বালুর মাঠ নামে যে জায়গাটিতে হাট বসানোর চেষ্টা চলছে সেখানে কোনো মাঠই নেই। এখানে ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম হাসপাতাল আর দেড় শতাধিক দোকানপাট রয়েছে। এখানে হাট বসলে মূল রাস্তা ছাড়া গরু ছাগল রাখার তেমন বড় কোনো জায়গা নেই। ফলে এখানে পশুহাট বসালে জনগণের চিকিৎসাব্যবস্থায় ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব পড়ার পাশাপাশি স্থানীয় ব্যবসায়ীরাও ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। এমনকি এখানে হাট বসালে বড় ধরনের সংঘর্ষের আশঙ্কা করা হচ্ছে।
স্থানীয়রা জানান, জুরাইনের এ এলাকাটি ৫৪ নম্বর ওয়ার্ড এলাকায়। এ ব্যাপারে ওই ওয়ার্ডের কাউন্সিলর হাজী মোঃ মাসুদও কিছু জানেন না। তিনি বর্তমানে হজ পালনে সৌদি আরব রয়েছেন।
এ ব্যাপারে শ্যামপুর বালুর মাঠের ইজারাদার মাসুক রহমান বলেন, আমরা বৈধভাবে টেন্ডারে অংশ নিয়ে ভ্যাটসহ এক কোটি ৬৮ লাখ টাকা দিয়ে হাটটি ইজারা নিয়েছি। কিন্তু এ হাটের মাত্র আধা কিলোমিটার দূরে জুরাইন বালুর মাঠে আরেকটি হাট বসানোর চেষ্টা হচ্ছে। পোস্তগোলা হাটটিও জুরাইন বালুর মাঠের খুব কাছাকাছি। এতে আমরা ব্যবসায়িকভাবে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হবো। বিষয়টি সিটি কর্পোরেশনের মেয়রের দৃষ্টি দেয়া উচিত।
এ বিষয়ে স্থানীয় সংসদ সদস্য সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা বলেন, জুরাইনে বালুর মাঠে হাট বসাতে একটি স্বার্থান্বেষী মহল অপতৎপরতা চালাচ্ছে। কিন্তু এখানে বালুর মাঠের কোনো অস্তিত্বই নেই। এখানে হাট হলে তা রাস্তার ওপর বসবে। এতে জনস্বার্থ চরম বিঘœ ঘটবে। এ কারণে এখানে হাট বসানোর কোনো সুযোগ নেই। তা ছাড়া এ হাটের সিটি কর্পোরেশনের কোনো অনুমোদন নেই জানিয়ে তিনি বলেন, আমি এ ব্যাপারে মেয়রের সাথেও কথা বলেছি। তিনি জানিয়েছেন, জুরাইনে কোনো হাটের ইজারা হয়নি। এখানে কোনো পশুহাট বসবে না।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ