ইভিএম-এ ভোট কেন?
আগামী জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম-এ ১৫০ আসনে ভোট গ্রহণের পরিকল্পনার কথা জানিয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার। কাকতালীয় কিনা জানি না, ১৫০ সংখ্যাটা আমাদের এর আগে চিনিয়েছিলেন রকিবুল
মহিউদ্দিন খান মোহন : আন্দোলনে ব্যর্থতার জন্য বিএনপি নেতৃবৃন্দের পদত্যাগ করা উচিত বলে মন্তব্য করেছেন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। গত ৪ আগস্ট বাংলা একাডেমি মিলনায়তনে ছাত্রলীগের এক আলোচনা সভায় বক্তৃতাকালে বিএনপিকে ইঙ্গিত করে তিনি বলেছেন, ‘গত আট বছরে আট মাসের জন্যও তারা রাস্তা গরম করতে পারেন নি। বিএনপি বারবার আন্দোলনের ডাক দেয়, কিন্তু মরাগাঙ্গে জোয়ার আসে না। এই মরা গাঙ্গে জোয়ার কবে আসবে কেউ জানে না। এই ব্যর্থতার জন্য আপনাদের টপ টু বটম সবার পদত্যাগ করা উচিত।’ ওবায়দুল কাদের আরো বলেছেন, এদের শক্তি দিন দিন কমে যাচ্ছে। চেয়ারম্যান দেশের বাইরে, ভাইস-চেয়ারম্যান বিদেশে। কবে আসবে কেউ জানেন না। টেমস নদীর পাড়ে বসে বসে চোরাগলি খুঁজছেন, কোন গলি দিয়ে ক্ষমতায় যাওয়া যায়। (সূত্র: দৈনিক ইনকিলাব, ৫, আগস্ট, ২০১৭)।
শুধু এবারই নয়, বিএনপিকে উদ্দেশ করে এ ধরনের টিটকারিমূলক কথা ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ এর আগেও বলেছেন। ‘আন্দোলন করার মুরোদ বিএনপির নেই’, ‘বিএনপি নেতারা আন্দোলনের ডাক দিয়ে ঘরে বসে থাকেন’, ‘আওয়ামী লীগের কাছ থেকে বিএনপিকে আন্দোলন শিখতে হবে’ ইত্যাদি কথা আওয়ামী লীগের বিভিন্ন স্তরের নেতা এবং সরকারের মন্ত্রীদের মুখ থেকে ইতোপূর্বে দেশবাসী শুনেছে। বিএনপির আন্দোলনের ব্যর্থতা নিয়ে আওয়ামী লীগ নেতাদের এসব কথাবার্তা জনমনে কৌতূহল সৃষ্টি করেছে সঙ্গত কারণেই। তাদের প্রশ্ন, যেখানে বিএনপির ব্যর্থতায় আওয়ামী লীগের উল্লসিত হওয়ার কথা, সেখানে আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ এক ধরনের মনোবেদনাই যেন অনুভব করছেন। তাহলে কি ধরে নিতে হবে যে, তারা বিএনপির আন্দোলনগুলোর সাফল্য কামনা করেছিলেন?
না, তেমনটি মনে করার কোনো কারণ নেই, যে আওয়ামী লীগ নেতারা বিএনপির আন্দোলনের সাফল্য কামনা করবেন। বরং বিএনপির আন্দোলনকে কীভাবে ব্যর্থ করে দেয়া যায়, কীভাবে তাদেরকে সাংগঠনিকভাবে পর্যুদস্ত করা যায়, আওয়ামী লীগ ও তার সরকার দিবানিশি সে চেষ্টাতেই রত। গণতন্ত্রের সব মূল্যবোধকে পদদলিত করে, সাংবিধানিক রীতি-নীতিকে উপেক্ষা করে বিএনপির রাজনৈতিক অধিকারকে সরকার অত্যন্ত ন্যাক্কারজনকভাবে খর্ব করে চলেছে। দলটিকে কোনো সভা-সমাবেশে করতে দেয়া হয় না, এমন কি সদস্য সংগ্রহের মতো নীরিহ কর্মসূচিতেও পুলিশ বাধা সৃষ্টি করে চলেছে। সরকার এবং শাসক দল যদি এভাবে একটি রাজনৈতিক দলের কর্মকান্ডে বাধা দেয়, তাহলে সে দলটির পক্ষে কোনো কর্মসূচি সফল করা সম্ভব কি?
সন্দেহ নেই গত আট বছরে একটি আন্দোলন কর্মসূচিও বিএনপি সফল করতে পারেনি। কেন পারেনি সে প্রশ্ন অবান্তর। সরকারের জুলুম-নির্যাতন আর কৌশলের সাথে এঁটে উঠতে পারেনি বিএনপি। বারবার মার খেয়েছে সরকারের কূটচালের কাছে। পাশাপাশি আন্দোলনের কৌশল নির্ধারণ, রাজপথে সরকার ও সরকারি দলকে মোকাবেলা করতে চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছে। তাই আজ বিএনপি সরকারি দলের নেতা-মন্ত্রীদের ব্যঙ্গ-কটাক্ষের শিকার হচ্ছে দুঃখজনকভাবে। অথচ এমনটি হওয়ার কথা ছিল না। আওয়ামী লীগের কাছে বিএনপি এখন ঠাট্টা-মশকরা-উপহাসের পাত্র! অথচ জনপ্রিয়তার কথা চিন্তা করলে এ দলটিকে আওয়ামী লীগের ভয় পাবার কথা। কিন্তু কেন এমন হচ্ছে? এ কথার সোজাসাপ্টা কোনো জবাব হয়তো নেই।
এটা ঠিক, বর্তমান সরকার যেভাবে বিরোধী দল বিশেষ করে বিএনপির ওপর নির্যাতন চালাচ্ছে, অতীতে এমনটি দেখা যায়নি। কেউ কেউ এও বলেন যে, বর্তমান সরকারের জুলুম-নির্যাতন শেখ মুজিব সরকারের আমলকেও ছাড়িয়ে গেছে। জেল-জুলুম, আটক-গ্রেফতার, সভা কিংবা মিছিলে হামলার ঘটনা অতীতেও ঘটেছে আমাদের দেশে। কিন্তু বিরোধী দল রাস্তায় নামলেই পুলিশ কিংবা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সরাসরি গুলি করে দেয়ার ঘটনা আগে ঘটেনি। সে সাথে চলছে ধারাবাহিক গুম। বিরোধী দলের স্থানীয় পর্যায়ের নেতাকর্মীরাই এসব গুমের শিকার হচ্ছে বেশি। কাউকে ধরে নিয়ে গেলে সে আর জীবিত ফিরে আসে না। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে রাতের অন্ধকারে যাকে তুলে নেয়া হয়, একদিন বা দুদিন পরে তার লাশ পাওয়া যায়। এমন বিভীষিকাময় পরিবেশ আর কখনো ছিল না। একটি সরকার যখন ক্ষমতা হারানোর ভয়ে দিগবিদ্বিক জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়ে অথবা ক্ষমতায় টিকে থাকা সম্বন্ধে অতিমাত্রায় আত্মশ্বিাসী হয়ে ওঠে, তখনই তারা এমন বেপরোয়া আচরণ করতে পারে।
তবে, ক্ষমতাসীনরা যেটাই ভেবে থাকুক না কেন, সত্য হলো তাদের পায়ের তলা থেকে মাটি অনেকটাই সরে গেছে। বিশেষত সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করে দেয়া সুপ্রিমকোর্টের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের পর বিএনপিতে যেমন এক ধরনের আশাবাদ সৃষ্টি হয়েছে, তেমনি ক্ষমতাসীন মহলে দুশ্চিন্তার ছাপ দেখা যাচ্ছে। এ রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে বিএনপি সরকারের পদত্যাগ দাবি করেছে। দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর গত ৩ আগস্ট এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, ‘বর্তমান সরকার জোর করে অবৈধভাবে এখনো ক্ষমতায় আছে। ষোড়শ সংশোধনী বাতিল বিষয়ে আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায়ের পর যা প্রকাশিত হয়েছে, তা যে কোনো সভ্য দেশ হলে সরকার পদত্যাগ করতো। (দৈনিক ইনকিলাব, ৪, আগস্ট, ২০১৭)।
যাহোক, শুরুর প্রসঙ্গে ফিরে যাই। আওয়ামী লীগ নেতারা বিএনপির আন্দোলন করার সক্ষমতা নিয়ে যত হাসি-ঠাট্টাই করুন না কেন, তারা যে বিএনপিকেই ভয় পান সেটা কিন্তু মাঝেমধ্যে নিজেরাই স্বীকার করেন। যেমন সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের সাহেব এ বছর ৮ জানুয়ারি রাজধানীর তেজগাঁও কলোনী মাঠে দলের এক কর্মীসভায় নেতাকর্মীদের উদ্দেশে বলেছিলেন, ‘বিএনপিকে দুর্বল দল মনে করে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে আত্মতুষ্টিতে ভুগলে ভুল করবেন। আন্দোলনে তারা ব্যর্থ হতে পারে, কিন্তু সমর্থনের দিক দিয়ে কম নয়। সম্প্রতি নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে পরাজিত হলেও তারা ভোট কম পায়নি।’ (যুগান্তর, ৯ জানুয়ারি, ২০১৭)।
বস্তুতঃ ওবায়দুল কাদেরের এ বক্তব্যে বাস্তব অবস্থার যথার্থ উপলব্ধির প্রতিফলন ঘটেছে বলেই মনে হয়। রাজপথের আন্দোলনে বিএনপি আপাত দৃষ্টিতে ব্যর্থ হলেও মাঠে তাদের জনসমর্থন যে কম নয়, সেটা অস্বীকার করার উপায় নেই। বরং সরকারের সীমাহীন জুলুম-নির্যাতন এ দলটির প্রতি সাধারণ মানুষের সহানুভূতি আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে। সুতরাং, আন্দোলনে বিএনপির ব্যর্থতা নিয়ে টীকা-টিপন্নি না কেটে বাস্তবতাকে হৃদয়ঙ্গম করাই হবে বুদ্ধিমানরে কাজ।
লেখক: সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।