Inqilab Logo

শুক্রবার ০১ নভেম্বর ২০২৪, ১৬ কার্তিক ১৪৩১, ২৮ রবিউস সানী ১৪৪৬ হিজরি

ইসলামে হজ্জের গুরুত্ব ও ফজিলত

নি ব ন্ধ

| প্রকাশের সময় : ১৩ আগস্ট, ২০১৭, ১২:০০ এএম

আল্লামা মুজাহিদ উদ্দীন চৌধুরী দুবাগী
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ‘যে ব্যক্তি বাইতুল্লাহর তাওয়াফ করে এবং দুই রাকাত নামায আদায় করে সে একটি গোলাম আজাদ করার সওয়াব পাবে’ (ইবনে মাজাহ, হাদিস : ২৯৫৬)। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওসাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘বাইতুল্লাহর তাওয়াফ হচ্ছে নামাযের মতো। তবে এতে তোমরা কথা বলতে পার। সুতরাং এ সময় যে কথা বলবে সে যেন শুধু উত্তম কথাই বলে’ (তিরমিযী, হাদিস : ৯৬০)। আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেন, ‘নিশ্চয়ই সাফা-মারওয়া আল্লাহর দু’টি নিদর্শন’ (সূরা বাকারা, আয়াত: ১২৮)। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওসাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘সাফা-মারওয়ায় তোমারা সাঈ কর। তা তো ৭০ জন দাস মুক্ত করার সমতুল্য’ (ইবনে হিব্বান, হাদিস : ১৮৮৭, বাযযার/কাশফুল আসতার, হাদিস : ১০৮২)। হযরত আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওসাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘আল্লাহ তা’আলা ফেরেশতাদের সাথে আহলে আরাফাকে নিয়ে গর্ব করেন এবং বলেন, আমার এসব বান্দাদের দেখো, কেমন এলোমেলো চুলে, ধূলি মলিন হয়ে আমার নিকট এসেছে’ (মুসনাদে আহমদ ২/২২৪; ইবনে হিব্বান, হাদিস : ৩৮৫২)। হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রা.) বলেন, ‘নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞেস করা হল, কোন হজ্জ সর্বোত্তম? তিনি বললেন, যে হজ্জে উচ্চস্বরে তালবিয়া পাঠ করা হয় এবং কুরবানী করা হয়’ (সুনানে তিরমিযী, হাদিস : ৮২৭; সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস : ২৯২৪; সহীহ ইবনে খুযাইমা, হাদিস : ২৬৩১; মুসতাদরাকে হাকেম, হাদিস : ১৬৯৭; সুনানে দারিমী, হাদিস : ৮১৫১; মুসনাদে বাযযার, হাদিস : ৭১; মুসনাদে আবু ইয়ালা, হাদিস : ১১৭)। হজ্জের সবচেয়ে বরকতময় দিন হলো আরাফার দিন। আরাফার দিন সমবেত হাজীদের জীবনের পাপগুলি তিনি ক্ষমা করেন। আরাফার দিন দুপুর থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত আরাফার মাঠে অবস্থান করে আল্লাহর যিকির ও দু’আয় কাটানোই মূলত হজ্জ। হযরত আয়েশা (রা.) বলেন, রাসূলুল্লাহ সাললাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘আরাফার দিন এতো সংখ্যক মানুষকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দেন যা অন্য কোনো দিন দেন না। এদিন আল্লাহ্ তা’আলা নিকটবর্তী হন ও আরাফার ময়দানে অবস্থানরত হাজীদেরকে নিয়ে তিনি ফেরেশতাদের সাথে গর্ব করেন ও বলেন, ওরা কী চায়?’ (মুসলিম, হাদিস : ১৩৪৮; ইবনে মাজাহ, হাদিস : ৩০১৪)।
হযরত আবু হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাললাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি হজ্জের উদ্দেশ্যে বের হল, অতঃপর মৃত্যু বরণ করল, কিয়ামত পর্যন্ত তার হজ্জের সওয়াব লেখা হবে। আর যে ব্যক্তি উমরার উদ্দেশ্যে বের হল, আর সে অবস্থায় তার মৃত্যু হল কিয়ামত পর্যন্ত তার জন্য উমরার সওয়াব, লেখা হবে। যে ব্যক্তি জিহাদের উদ্দেশ্যে বের হল, এবং তাতে তার মৃত্যু হল, কিয়ামত পর্যন্ত তার জন্য জিহাদের সওয়াব লেখা হবে’ (মুসনাদে আবু ইয়ালা, হাদিস : ৬৩৫৭; তবারানী আউসাত, হাদিস : ৫৪৮০; মাজমাউয যাওয়ায়েদ, হাদিস : ৫২৭৪)। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত। জনৈক মুহরিম ব্যক্তিকে তার সওয়ারি ভূপাতিত করলে তার মৃত্যু হয়। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওসাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘তোমরা তাকে বরই পাতার পানি দ্বারা গোসল দাও এবং তার দু’টি কাপড়েই তাকে কাফন পরাও। তবে তার মাথা ও চেহারা ঢেকো না। কেননা, কিয়ামত দিবসে সে তালবিয়া পাঠ করা অবস্থায় উত্থিত হবে’ (মুসলিম, হাদিস : ১২০৬)।
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওসাল্লাম রাওয়াহা নামক স্থানে, কিছু লোকের সাথে মিলিত হলে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তোমরা কারা? তারা বলল, মুসলিম। এরপর তারা জিজ্ঞাসা করল, আপনি কে? তিনি বললেন, আল্লাহর রাসূল। তখন তাঁর নিকট একজন মহিলা, একটি ছোট শিশুর দিকে ইশারা করে বলল, এর জন্য কি হজ্জ আছে? তিনি বললেন, হ্যাঁ, আর তোমার জন্য রয়েছে এর প্রতিদান’ (মুসলিম, হাদিস : ৭৯৪)। হযরত রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘হাশরের ময়দানে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন হাজরে আসওয়াদকে এ অবস্থায় উঠাবেন যে, তাঁর দু’টি চোখ থাকবে সে দেখবে এবং তাঁর মুখ হবে সে কথা বলবে, সে তাঁর মুখ দিয়ে ঐসমস্ত লোকদের ব্যাপারে সাক্ষ্য দিবে যারা ঈমান, ইয়াকিন ও ইখলাসের সাথে হাজরে আসওয়াদে চুমু খেয়েছে’ (তিরমিযী, হাদিস: ৯৬১)। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘হাজরে আসওয়াদ যখন জান্নাত থেকে নাযিল হয়েছিলো তখন সেটা ছিল দুধের চেয়েও ধবধবে সাদা, তারপর আদম সন্তানগণের পাপ সেই পাথরকে কালো বানিয়ে ফেলেছে’ (তিরমিযী, হাদিস : ৮৭৭)।
হজ্জ মুসলমানদের দুনিয়া ও আখিরাতে সম্মান ও ইজ্জতের আসন দান করে, সৌভাগ্যের দরজা খুলে দেয় প্রকৃত হাজীর জীবনে। হাদিসে হজ্জ যাত্রীদের আল্লাহর মেহমান হিসাবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণনা করেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওসাল্লাম বলেছেন, ‘তিনটি দল আল্লাহর মেহমান; আল্লাহর পথে জিহাদকারী, হজ্জকারী ও উমরাহ পালনকারী’ (নাসায়ী, হাদিস : ২৬২৫) । হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ‘যখন তুমি কোন হাজীর সাক্ষাৎ পাবে তাকে সালাম দিবে, মুসাফাহা করবে আর তাকে অনুরোধ জানাবে, তিনি যেন তোমার জন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমা চান তার ঘরে প্রবেশের পূর্বেই। কারণ তিনি ক্ষমাপ্রাপ্ত ব্যক্তি। এজন্য হাজি যার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করবেন আল্লাহ তা’আলা তাকে ক্ষমা করে দিবেন’ (মিশকাত, হাদিস : ২০৩৯, আহমাদ, হাদিস: ৫৩৭১)। রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো ইরশাদ করেন, ‘হাজিগণের সুপারিশে আল্লাহ তা’আলা চারশত পরিবারকে ক্ষমা করবেন’ (তারগীব, তিবরানি-মা’আরেফ)। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরও বলেন, ‘হজ্জ ও ওমরা পালনকারীরা হচ্ছে আল্লাহর দাওয়াতি মেহমান। অতএব তারা যদি তাঁর কাছে দোয়া করে, তিনি তা কবুল করেন এবং যদি তাঁর কাছে ক্ষমা চায়, তিনি তাদের ক্ষমা করে দেন।’ (ইবনে মাজাহ, হাদিস : ৩০০৪)।
হজ্জ শুধুই ইবাদত নয়, বিশ্বভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠায় এর গুরুত্ব ও তাৎপর্য ব্যাপক। হজ্জের সময় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মানুষ পবিত্র মক্কা নগরীতে একত্রিত হয়। ভাষা-বর্ণের ভিন্নতা, সাংস্কৃতিক-জাতীয় পরিচয়ের পার্থক্য ও ভৌগোলিক দূরত্ব থাকা সত্তে¡ও বিশ্ব মুসলিমের ভ্রাতৃত্ববোধ জাগ্রত এবং সুসংহত হয় পবিত্র হজ্জ উদযাপনে। বিশ্ব মুসলিমের পারস্পরিক দুঃখ-অভাব, অভিযোগ-সমস্যা সম্পর্কে অবগত হওয়া ও তার সমাধানের সুযোগ হয় পবিত্র হজ্জের বিশ্ব সম্মিলনে। সকলেরই লক্ষ্য বিশ্ব মানবের প্রথম উপাসনা কেন্দ্র কাবার জেয়ারত, সবার মুখে একই ভাষার একটি মাত্র বাক্য ‘লাব্বায়েক আল্লাহুম্মা লাব্বায়েক’ যার বাংলা অর্থ, হাজির হয়েছি ওগো আল্লাহ! হাজির হয়েছি! এসেছি, তোমার ডাকে সাড়া দেওয়ার জন্য এসেছি। আমার সকল কিছু তোমার কাছে সমর্পণ করতে এসেছি। হজ্জ এর মধ্য দিয়ে আল্লাহ্ প্রমাণ করেন তাঁর কোন বান্দা সম্পদ ও শরীরের ত্যাগ ও কষ্ট স্বীকার করে তা আদায় করে। সামর্থ্যবান প্রত্যেক মুসলমান নারী-পুরুষের উপর পবিত্র হজ্জকে ফরয করা হয়েছে। এজন্য সামর্থ্যবান মুসলমানের জন্য কোন প্রকার অজুহাত ও ওযর বাদ দিয়ে ফরয হজ্জ সমাপনে দ্রুত করা উচিত। আর ছেলেমেয়ের বিবাহ, বাড়ি নির্মাণ, কারখানা ও ফ্যাক্টরি প্রতিষ্ঠা ও অন্যান্য পার্থিব কাজের বাহানায় এ ফরয আদায়ের ব্যাপারে বিলম্ব করা উচিত নয়। কেননা ভবিষ্যৎ অবস্থা ও পরিস্থিতি এবং মানুষের নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস কবে বন্ধ হয়ে যাবে এটা কারো জানা নেই । মহান পালনকর্তার সান্নিধ্য ও সন্তোষ লাভের অন্যতম একটি মাধ্যম হচ্ছে হজ্জ। বিশ্ব মুসলমানদের মহা মিলন কেন্দ্র হচ্ছে হজ্জ।
হজ্জের গুরুত্ব অনস্বীকার্য। হজ্জ পালনের মাধ্যমে অতীতের গোনাহকে মাফ করানো সম্ভব হয়। তবে হজ্জে যাবার পূর্বে অবশ্যই সকলের নিয়তকে ছহিহ করে নিতে হবে। নিয়ত বিশুদ্ধ না হলে সারা জীবন হজ্জ করেও কোন লাভ হবে না। লোক দেখানো, সুনাম-সুখ্যাতি, হাজী উপাধী লাভ ইত্যাদি যে কোনো দুনিয়াবী স্বার্থ ও উদ্দেশ্য থেকে এই আমলকে মুক্ত রাখা অতি জরুরি এবং হারাম মালের টাকা দিয়ে হজ্জ করলে কবুল হবে না। অতএব আমাদের সকলের উচিত মহান রবের সন্তষ্টি অর্জনের নিয়তেই কেবল হজ্জ করা। আল্লাহ আমাদের সবাইকে বিশুদ্ধ নিয়তে সঠিক মাসলা জেনে ফরয হজ্জ আদায় এবং বেশি বেশি উমরাহ পালন করার তৌফিক দান করুন।
লেখক : বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ ও বহু গ্রন্থ প্রণেতা



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন