Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

স্বাধীনতায় অনন্য ভূমিকার জন্যই খুনিরা বঙ্গমাতাকে নির্মমভাবে হত্যা করে -প্রধানমন্ত্রী

| প্রকাশের সময় : ৯ আগস্ট, ২০১৭, ১২:০০ এএম

স্টাফ রিপোর্টার : প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ১৫ আগষ্টের খুনীরা মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে বঙ্গমাতার অবদান সম্পর্কে জানতো, তাই তাকেও নির্মমভাবে হত্যা করেছে। তিনি বলেন, আমার মনে হয়, ঘাতকের দল জানতো এদেশের স্বাধীনতার পেছনে আমার মায়ের অবদান। তাই আমার মায়ের ওপরও তাদের আক্রোশ ছিল। তিনি আরও বলেন, শেখ ফজিলাতুন্নেছার মত একজন নারীকে জীবনসঙ্গী হিসেবে পেয়েছিলেন বলেই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার সংগ্রামী জীবনে সাফল্য পেয়েছিলেন।
গতকাল মঙ্গলবার সকালে রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের ৮৭ তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষ্যে মহিলা ও শিশু মন্ত্রণালয় আয়োজিত অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন। প্রধানমন্ত্রী ১৫ আগস্ট শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। মায়ের জন্মবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য সব সময় নিজের মায়ের ত্যাগ স্বীকারের কথা স্মরণ করেন।
বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে থেমে থেমে শেখ হাসিনা বলেন, মায়ের মতো একটা সাথী পেয়েছিলেন বলেই কিন্তু আব্বা সংগ্রাম করে সফলতা অর্জন করতে পেরেছিলেন। তিনি বলেন, ঘাতকের দল আমার মায়ের ওপর যেভাবে গুলি চালিয়েছে সেটা কখনও ভাবতেও পারিনি। আর একটা বাড়িতে শুধু নয়, তিনটা বাড়িতে একসাথে আক্রমণ করেছে। তিনি বলেন, আসলে আমার আব্বা মায়ের মতন একজন সাথী পেয়েছিলেন বলেই কিন্তু তিনি তার সংগ্রাম করে সফলতা অর্জন করতে পেরেছিলেন। জীবনের সব আশা আকাঙ্খা বিসর্জন দিয়ে, সব ভোগ বিলাস বিসর্জন দিয়ে আমার বাবার পাশে থেকে এদেশের মানুষকে স্বাধীনতা দিয়ে গেছেন, আমার মা।
তিনি বলেন, বাবার পাশে থেকে মা যদি ত্যাগ স্বীকার না করতেন তাহলে হয়তো আজকে আমরা স্বাধীনতা অর্জন করতে পারতাম না।
স্কুল কলেজের প্রথাগত শিক্ষা অর্জন করতে না পারলেও বেগম মুজিব স্বশিক্ষিত ছিলেন উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমার মায়ের পড়াশোনার প্রতি আগ্রহ ছিল, নিজে নিজে পড়াশোনা করতেন। আব্বা যখন আসতেন মায়ের জন্য বই নিয়ে আসতেন। পড়ার এবং শেখার অত্যন্ত আগ্রহ ছিল যেকারণেই-সবসময় বই পড়াটা আমাদের একটা অভ্যাসই ছিল। পড়ার বইয়ের পাশাপাশি গল্পের বই পড়া-এটা আমাদের বাসাতে একটা প্রথাই ছিল এবং এ বিষয়ে আমার মায়ের সব থেকে বেশি আগ্রহ ছিল।
বঙ্গমাতা সম্পর্কে শেখ হাসিনা বলেন, তার সম্পর্কে মানুষ খুব সামান্যই জানে। তিনি অত্যন্ত সাদাসিধে ও প্রচার বিমুখ ছিলেন। তাই বঙ্গমাতার অবদান লোকচক্ষুর আড়ালেই থেকে গেছে। তিনি বলেন, বেগম মুজিব খুব অল্প বয়সে মা-বাবাকে হারান। আমার দাদা-দাদীর কাছে বেড়ে ওঠার সময় অল্প বয়সে তার মধ্যে সাহস, বিচক্ষণতা ও দূরদর্শিতা গড়ে উঠেছিল।
বঙ্গমাতাকে প্রধানমন্ত্রী স্বামী-সংসার অন্তঃপ্রাণ বাঙালি নারী এবং শোষিত-নিপীড়িত জনসাধারণকে মুক্তির চেতনায় জাগিয়ে তোলার সংগ্রামে স্বামীর পাশে থাকা সহযোদ্ধা আখ্যায়িত করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আম্মা অনেক গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে আব্বাকে সহায়তা করতেন। বাবার প্রতিকাজেই মা প্রতিবন্ধক নয়, সহায়ক ছিলেন। তিনি কখনও ব্যক্তিগত-পারিবারিক সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের দিকে তাকাননি। আমরা সন্তানরা বঞ্চিত হয়েছি এবং আম্মাকেই সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে। তিনি আক্ষেপের সুরে বলেন, বাবাকে কখনও টানা দু’বছরও আমাদের মাঝে পাইনি।
ছয় দফা প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, পাকিস্তান আওয়ামী লীগের যারা নেতা ছিলেন, তারা পশ্চিম পাকিস্তান থেকে এখানে এলেন। আমাদের এখানেও কিছু বড় বড় নেতা তারা ছয় দফা বাদ দিয়ে আট দফা গ্রহণ করার জন্য চাপ দিতে থাকলেন। আওয়ামী লীগের অনেক নেতা এসে আমার মাকে বোঝাতে চেষ্টা করতেন যে ছয় দফা দিয়ে কী হবে? আট দফা হলেই ছয় দফার চাহিদা পূরণ হবে। আমরা মায়ের একটাই কথা ছিল, ‘ছয় দফা তো, ছয় দফাই’।
আওয়ামী লীগের মাঠ পর্যায়ের নেতাকর্মী ও অধিকাংশ নেতা সে সময় ছয় দফার পক্ষে থাকলেও কয়েকজন বড় নেতা আট দফার পক্ষে ছিলেন। তখনকার বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গেও এ নিয়ে সেই ‘বড় নেতাদের’ মতপার্থক্য তৈরি হয়েছিল বলেও জানান তিনি। বলেন, আমাদের তখন অনেক নেতা বলতেন, ‘তুমি কিচ্ছু বোঝো না, আজকে আট দফাই করতে হবে’।
আম্মার উৎসাহেই জাতির পিতা ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ লিখেছিলেন জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, জাতির এক সন্ধিক্ষণে বেগম মুজিবের একটি সিদ্ধান্ত বঙালিকে মুক্তির সংগ্রামে এগিয়ে যাওয়ার পথ দেখিয়েছিল। তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধুকে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় প্যারোলে মুক্তি নিতে চাপ দেয়া হয়। মাকে ভয় দেখানো হয়েছিল-‘পাকিস্তানীদের শর্ত না মানলে তিনি বিধবা হবেন’। কিন্তু মা কোন শর্তে মুক্তিতে রাজী হননি। আব্বাও প্যারোলে মুক্তির প্রস্তাব প্রত্যাখান করেন। শেষ পর্যন্ত গণঅভ্যুত্থানে পাকিস্তান সরকার আব্বাকে নিঃশর্ত মুক্তি দিতে বাধ্য হয়।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাস আম্মার যে মনোবল দেখেছি, তা ছিল কল্পনাতীত। স্বামীকে পাকিস্তানীরা ধরে নিয়ে গেছে। দুই ছেলে রণাঙ্গনে যুদ্ধ করছে। তিন সন্তানসহ তিনি গৃহবন্দী। যোগাযোগ একেবারে বিচ্ছিন্ন কিন্তু আম্মা মনোবল হারাননি। অসীম সাহস এবং ধৈর্য্য নিয়ে আম্মা সেই পরিস্থিতি মোকাবিলা করেন। তিনি আল্লাহকে স্মরণ করতেন। মুক্তিযুদ্ধকালে বন্দী অবস্থায় আম্মা অধিকাংশ সময় হাতে তসবিহ পড়তেন।
ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণও তারই অণুপ্রেরণায় বঙ্গবন্ধু নিজের মন থেকে উৎসারিত করেছিলেন বলেও প্রধানমন্ত্রী উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, ঘাতকচক্র ভীত ছিল, বঙ্গবন্ধুর পরিবারের কেউ বেঁচে থাকলে বাংলাদেশের মানুষ আবার ঘুরে দাঁড়াবে। তাই খুনীরা গৃহবধু, অন্তঃসত্ত¡া মা, শিশু কাউকে বাঁচতে দেয়নি।
তিনি বলেন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নস্যাৎ করতে জাতির পিতাকে স্বপরিবারে হত্যা করা হয়। তারপর ঘাতকরা দেশটাকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার উল্টোরথে চড়িয়ে দেয়। দেশবিরোধী সেই ষড়যন্ত্র এখনও অব্যাহত আছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমার মা কোনদিন কিছু চাননি। আমার বাবা মন্ত্রী ছিলেন, এমপি ছিলেন, এমএলএ ছিলেন। জাতীয় পরিষদে অংশ গ্রহণ করতে তাকে প্রায়ই করাচিতে যেতে হত। আমার মা কিন্তু কোনদিন পশ্চিম পাকিস্তানে যাননি, যেতেও চাননি। এ দেশের স্বাধীনতার জন্য সব সময় তিনি ছিলেন দৃঢ়চেতা। যা পৃথিবীতে বিরল। বঙ্গমাতার আত্মার মাগফিরাত কামনা করে সকলের কাছে তার জন্য দোয়া কামনা করেন তার কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা
মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী মেহের আফরোজ চুমকির সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথির বক্তৃতা করেন নারী ও শিশু মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির চেয়ারম্যান রেবেকা মোমেন। ফজিলাতুন্নেছা বাপ্পী অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন এবং জাতীয় মহিলা সংস্থার চেয়ারম্যান মমতাজ বেগম মূল প্রবন্ধের ওপর আলোচনায় অংশ নেন। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সচিব নাসিমা বেগম অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তৃতা করেন। অনুষ্ঠানে বঙ্গমাতার জীবন ও কর্মের ওপর একটি প্রামাণ্য চিত্র প্রদর্শিত হয়।
বঙ্গমাতার জন্মদিন পালিত
বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠন ও আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের শ্রদ্ধা-ভালবাসায় পালিত হয়েছে বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছার ৮৭তম জন্মবার্ষিকী। জন্মদিন উপলক্ষে গতকাল মঙ্গলবার জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সহধর্মিনী বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের সমাধিতে পুষ্পার্ঘ্য অপর্ণের মধ্যদিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করেছে আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী বিভিন্ন সংগঠনের নেতৃবৃন্দ। বনানী কবরস্থানে তার সমাধিতে সকালে দলের নেতাকর্মীরা শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। এছাড়াও সেখানে মরহুমার রুহের মাগফেরাত কামনা করে কোরআনখানি, মিলাদ ও দোয়া মাহফিলের আয়োজন করা হয়।
এ সময় উপস্থিত ছিলেন আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য তোফায়েল আহমেদ, সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ, এ্যাডভোকেট জাহাঙ্গীর কবির নানক ও আব্দুর রহমান, সাংগঠনিক সম্পাদক আহমদ হোসেন, খালিদ মাহমুদ চৌধুরী ও এনামুল হক শামীম, তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক এ্যাড. আফজাল হোসেন, ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক সুজিত রায় নন্দি, ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শাহে আলম মুরাদসহ নেতাকর্মীরা।
১৯৩০ সালের এইদিনে গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গিপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন ফজিলাতুন্নেছা। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট কালরাতে তিনি বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের হাতে নির্মমভাবে মৃত্যুবরণ করেন।
আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে শ্রদ্ধা নিবেদনের পরে ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগ উত্তর ও দক্ষিণ, আওয়ামী যুবলীগ, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ, আওয়ামী স্বেছাসেবকলীগ, যুব মহিলা লীগ, কৃষক লীগ, মহিলা আওয়ামী লীগ, জাতীয় শ্রমিক লীগ, তাঁতীলীগ বঙ্গমাতার সমাধিতে পুষ্পমাল্য অর্পণ করে।
এছাড়াও যুবলীগ ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগ, ছাত্রলীগ মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ, ঢাকা জেলা মহিলা আওয়ামী লীগ, বঙ্গমাতা পরিষদ, বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক জোটসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠন বঙ্গমাতার সমাধিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানায়।



 

Show all comments
  • বাহদুর ৯ আগস্ট, ২০১৭, ২:৩১ এএম says : 0
    আল্লাহ তাকে জান্নাতবাসী করুক
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: প্রধানমন্ত্রী


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ