Inqilab Logo

বুধবার, ২৬ জুন ২০২৪, ১২ আষাঢ় ১৪৩১, ১৯ যিলহজ ১৪৪৫ হিজরী

বন্যা ও নদীভাঙনে বাড়ছে ক্ষয়ক্ষতি

| প্রকাশের সময় : ১ আগস্ট, ২০১৭, ১২:০০ এএম

মো. এনামুল হক খান : আমরা জানি, বাংলাদেশে জালের মতো ছড়িয়ে আছে নদী-নালা, খাল-বিল। এগুলোর তলদেশ ভরাট হয়েছে। চর পড়ে পতিত হয়েছে, আধমরা অবস্থায়। এদের রক্ষার পদক্ষেপ না নিয়ে সর্বনাশ করা হয়েছে। ফলে বর্ষাকালে বন্যা নামের দুর্যোগ আসে। মানুষের জীবনকে দুর্বিষহ করে তোলে। কয়েক দিন বৃষ্টি হলেই দেশে বন্যা দেখা দেয়। এবার অল্প বৃষ্টিতে এবং উজানের ঢলে কিছু জেলায় বন্যা হলেও নিকট অতীতে বেশি পরিমাণে বন্যা হয়েছে; বিশেষ করে ১৯৮৭, ১৯৮৮, ১৯৯৮, ২০০৪, ২০০৫ এবং ২০০৭ সালে। বহু ক্ষয়-ক্ষতি হয়েছে দেশের। বন্যা থেকে রক্ষার জন্য বিগত সময়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে। নদ-নদী, খাল-বিলের গভীরতা বৃদ্ধির বিষয়ে শুধু সিদ্ধান্ত নিলেই চলবে না, বাস্তবায়নে কঠোরতা অবলম্বন দরকার।
গোমতী একসময় খুবই খর¯্রােতা নদী ছিল। প্রতি বর্ষায় নদীর দুই দিকের মানুষই বেশ ক্ষয়ক্ষতির শিকার হতো। ক্ষতি করত কুমিল্লা শহরকেও। এ নদীর কিছু স্থানে বাঁক কেটে সোজা করে দেয়া হয়েছে। দুই তীরে উঁচু বাঁধ দেয়া হয়েছে। এখন আর বন্যায় গোমতী ক্ষতিগ্রস্ত করে না মানুষের বাড়িঘর, তলিয়ে যায় না ফসল, তরি-তরকারী। অবশ্য ইরিগেশন প্রকল্পটি মার খাচ্ছে নদী ড্রেজিং না করার কারণে। এই নদীকে জুরুরি ড্রেজিংয়ের আওতায় এনে, ¯্রােতধারা ঠিক রাখতে দাউদকান্দি অংশে মেঘনা-গোমতীর সংযোগ স্থানটি গভীর করা প্রয়োজন। এলাকায় ছড়িয়ে থাকা খালগুলো খনন করা প্রয়োজন। আরো প্রয়োজন গোমতী নদীতে পর্যটনের ব্যবস্থা করা, ইঞ্জিন চালিত নৌকার ব্যবস্থা রাখা। আর দুই তীরে ফুলের বাগান তৈরি করা। এতে এলাকাটি নান্দনিক হয়ে উঠবে। আর প্রয়োজন ইরিগেশনের সুফল আনতে রাবার ড্যামের ব্যবস্থা করা। দেশের অন্যান্য নদ-নদীতেও নিতে হবে অনুরূপ ব্যবস্থা, করতে হবে নদী শাসন। দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার পরেই নজর দিতে হবে নদী রক্ষার দিকে। নতুবা দেশের প্রকৃতিতে ঘটবে মহাবিপর্যয়। ব্যক্তি মালিকানাধীন পুকুরগুলোর গভীরতা বৃদ্ধির দায়িত্ব দিতে হবে পুকুর মালিকদের। আর খাল-বিল, নদী-নালার গভীরতা বৃদ্ধির দায়িত্ব নিতে হবে সংশ্লিষ্ট দপ্তরের। এগুলো হচ্ছে পানির অন্যতম আধার। পানিকে পুরাতন ভূমি নকশা মোতাবেক তার নিজের জায়গায় স্থান করে দেয়ার দায়িত্ব আমাদের। নির্ধারিত জায়গায় তাকে স্থান দিতে না পারলে সে আমার বাড়ি-ঘর দখল করবে- এটাই স্বাভাবিক।
তথ্য মতে, বর্ষাকালে নদী প্রবাহের ৭ শতাংশ আসে বৃষ্টির পানি থেকে। ব্রহ্মপুত্র দিয়ে আসে ৫১ শতাংশ, গঙ্গার মাধ্যমে আসে ২৮ শতাংশ, মেঘনার মাধ্যমে আসে ১৪ শতাংশ। মোট কথা বর্ষাকালে পানির ৯৩ শতাংশ আসে সীমান্তের ওপার থেকে। এই পানি নদ-নদীতে ঠাঁই পায় না বলে ফসলের জমি, বাড়ি-ঘরে আঘাত হানে, সবকিছু ভাসিয়ে দেয়। দেশের নদ-নদীর নাব্যতা নেই বলে এমনটা হচ্ছে। আবার এদের সাথে যুক্ত হয়েছে গভীরতা হারানো শত শত খাল-বিল, এসব খাল-বিল ভরাট হয়ে গেছে। শুধু তাই নয় হাকালুকি হাওর, চলনবিলের মতো অসংখ্য হাওর, বিল আমরা অযতœ অবহেলায় নিঃশেষ করতে চলেছি। এ বিল দখল করে বাড়িঘর নির্মাণ করছি। হাওর-বাওরগুলো প্রকৃতির সৃষ্টি। প্রকৃতিকে বাধা দেয়া অন্যায়। ফলে বিরূপ প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। প্রকৃতি অন্যায়ের শোধ নিচ্ছে। এর সাথে আরো যে বিষয়টি যুক্ত হচ্ছে তা হচ্ছে নির্বিচারে পাহাড় ও টিলা কর্তন, গাছ-পালা নিধন। ফলে দেশের উপর পড়ছে পরিবেশের বিরূপ প্রভাব। এ থেকে উত্তরণের জন্য প্রয়োজন সকলের সচেতনতা আর দেশের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বন্যা থেকে রক্ষায় নিতে হবে বাস্তবধর্মী পদক্ষেপ।
এই পদক্ষেপের অন্যতম হচ্ছে নদ-নদীর গভীরতা বৃদ্ধির পাশাপাশি নকশা মোতাবেক শুকনো মৌসুমে দুইতীর উঁচু করে বেঁধে পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে আনা। যে নদীগুলো অব্যাহতভাবে মানুষের বাড়ি-ঘর-জমি ধ্বংস করে প্রস্থে প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে তাকে চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেয়া। দরকার যাদের বসত বাড়ি, জায়গা-জমি ভেঙ্গে নদীতে বিলীন হয়েছে তাদের তা ফিরিয়ে দেয়া। নদীর দেশে নৌপথকে প্রাধান্য দেয়ার বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ। কারণ নৌপথ, সড়ক পথের চাইতে অনেক আরামদায়ক। মালামাল পরিবহন ও ভ্রমণে খরচ অনেক কম। নৌপথের উন্নয়নে এগিয়ে যাওয়া ছাড়া গত্যন্তর নেই। বিগত দিনে নৌপথকে অবহেলা করেছি বলে নদীতে চর পড়েছে, ভরাট হয়েছে, নদী আজ খালে পরিণত হওয়ার উপক্রম। ফলে প্রাকৃতিক মৎস্য সম্পদ ধবংস হওয়ার পথে। গ্রীষ্মকালে কয়েকটা নদী ছাড়া সবগুলোই প্রায় শুকিয়ে যায়। মাছ থাকার জায়গা কোথায়! পানির অভাবে দেশের মানুষ আরো একটি সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে তাহলো, ইরিগেশনে পর্যাপ্ত পানি না পাওয়া। গ্রীষ্মকালে নদীতে পানি না থাকা মানে খাল-বিলে পানি না থাকা। ফলে এর প্রভাব পরে পরিবেশে। তাই দেশকে রক্ষা করতে হলে নৌপথকে রক্ষা করা প্রয়োজন। লঞ্চ, স্টিমার সার্ভিস চালু করা প্রয়োজন। মালামাল পরিবহনে সাশ্রয়ী পথটিকে গুরত্ব দেয়া প্রয়োজন। তবেই হবে নদ-নদীর সংস্কার কাজটি সহজতর। আরো যে কাজটি দরকার তাহলো, নদীকে বিজ্ঞানভিত্তিক শাসনের মাধ্যমে নদীর গভীরতা বৃদ্ধির কাজটি গুরুত্বের সাথে হাতে নেয়া। এই কাজটি বর্ষার স্রোতে করা সহজ। দেশে যে স্বল্প সংখ্যক ড্রেজার রয়েছে এগুলোর মাধ্যমে অব্যাহত ড্রেজিং কার্যক্রম চালিয়ে যেতে হবে। বর্ষাকালে নদীর তলায় পানির স্রোতের মধ্যে ঘেঁটে দিতে হবে, চর অপসারণের ব্যবস্থা নিতে হবে। প্রথমে এই কাজটি পদ্মা, মেঘনা, যমুনার মতো মূল নদীগুলোতে শুরু করতে হবে। পরবর্তীতে অন্যান্য নদীতে। এর জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যক ড্রেজার সংগ্রহ দরকার হবে।
নদী ড্রেজিংয়ের পাশাপাশি দেশের খাল-বিল খননের কাজটিও জরুরি। কারণ পানি আসে পানি যায়, এই গতানুগতিক ধারার পরিবর্তন দরকার। দেশের স্বার্থে খাল-বিল, নদী-নালার পানিকে পরিকল্পিত ব্যবহারে উদ্যোগ নেয়া দরকার। তৈরি করতে হবে প্রয়োজন অনুযায়ী ¯øুইস গেইট, রাবার ড্যাম। আরো যে কাজটি করা প্রয়োজন তাহলো, নদীর বাঁক কেটে সোজা করা। এতে পানির প্রবাহে বাধা হ্রাস পাবে। ক্ষয়-ক্ষতির পরিমাণ কমবে। মানুষের দঃখ-দুর্দশা কমবে। যাতায়াত ব্যবস্থার উন্নতি হবে বেকারত্ব হ্রাসপাবে। দেশে ফসল উৎপাদন বাড়বে। ইরিগেশনের জন্য পানি প্রাপ্তি সহজ হবে। দেশ বন্যার আক্রমণ থেকে রক্ষা পাবে, অর্থনৈতিকভাবে সুদৃঢ় হবে।
লেখক: প্রকৌশলী, বিশিষ্ট সংগঠক ও কলাম লেখক



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন