Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

পানির আতঙ্কে চট্টগ্রামবাসী

| প্রকাশের সময় : ২৯ জুলাই, ২০১৭, ১২:০০ এএম

বৃষ্টি ও জোয়ার যোগ হলেই মারাত্মক পানিবদ্ধতা : পরিকল্পিত শহর রক্ষা বাঁধের তাগিদ বিশেষজ্ঞদের
শফিউল আলম : ‘পানিই জীবন পানিই মরণ’। এই কথাটার মর্ম চাটগাঁর ৬০ লাখ নগরবাসী হাঁড়ে হাঁড়ে টের পাচ্ছেন কয়েক বছর ধরে। উঁচু-নিচু সমতল পাহাড়-টিলা নদ-নদী সাগর হ্রদ উপত্যকায় ঘেরা চট্টগ্রাম। গরমকালে উঁচু এলাকায় খাবার পানির দুঃসহ কষ্ট। আবার লোনার আগ্রাসন বেড়ে যাবার ফলে বন্দরনগরীর উপকূলীয় অন্তত তিন ভাগের একভাগ এলাকায় সারাবছরই মানুষকে লবণাক্ত পানি পান করতে হয়। সুপেয় পানি মিলে না। আর ঘোর বর্ষা ও দুর্যোগের মৌসুমে পানিই ‘বিপদ’ হয়ে দেখা দেয়। জোয়ার আর বৃষ্টির পানি যখন যোগ হয় তখনই মহানগরীর বিশাল এলাকা ডুবে যায় হাঁটু থেকে কোমর সমান কোথাও একবুক পানির নিচে। বঙ্গোপসাগর ও কর্ণফুলী নদী-ঘেঁষা চট্টগ্রাম হচ্ছে ভৌগোলিকভাবেই একটি জোয়ার-ভাটার প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন নগরী। কিন্তু মোহনায় কর্ণফুলী ভরাট এবং অর্ধশতাধিক খাল, ছরা, নালা-নর্দমা বেদখল ভরাট ও দূষণের কারণে ১২০ বর্গমাইল আয়তনের এই মহানগরীতে বৃষ্টির পানি নামার পথ রুদ্ধ হয়ে গেছে। দিনে-রাতে দুই বার প্রাকৃতিক নিয়মে জোয়ার আসে, তবে ভাটার সময়ও পানি আটকে থাকে শহরের অনেক জায়গায়। টলটলে পানি নয়; ভারী বৃষ্টিতে নগরীর ছিন্নভিন্ন পাহাড়-টিলাগুলো বেয়ে ঢলের সাথে কাদা-পানি ও অসহ্য দুর্গন্ধময় ময়লা-আবর্জনা ছড়িয়ে পড়ে বসতঘর দোকান-পাট হাট-বাজার গুদাম আড়ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান মসজিদ হাসপাতাল রাস্তাঘাট অফিস সবখানেই। গত কয়েক বছর যাবত দেখা যাচ্ছে, শুধু ভরা বর্ষাকালেই নয় প্রাক-বর্ষায় এবং বর্ষাত্তোর সময়েও বছরের ৪ থেকে ৬ মাস জোয়ার-ভাটায় ডুব-ভাসি করছে চট্টগ্রামের ‘নাভি’ আগ্রাবাদসহ বিশাল এলাকা। সেখানে জীবনযাত্রার চিত্র পাল্টে গেছে হরেক রকমের ভোগান্তির কারণে। বাধ্য হয়েই অনেকে বাসাবাড়ি ছেড়ে অন্যত্র চলে যাচ্ছেন।
গতকালসহ (শুক্রবার) তিন দিনে চট্টগ্রামে ছিল টানা ঝলমলে রোদ। তা সত্তে¡ও আগ্রাবাদ, হালিশহর, পোর্ট কলোনি, বাকলিয়া, খাতুনগঞ্জ, চান্দগাঁওসহ অনেক এলাকা দুপুরের পর জোয়ারের পানিতে হাঁটু অবধি তলিয়ে যায়। ছুটির দিনটিতে মানুষের প্রয়োজনীয় কাজে আসা-যাওয়া, বিনোদন এবং জুমার নামাজে মুসল্লিদের যাতায়াতে অশেষ দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে। এখন মধ্য-আষাঢ় মাস। মাসের বাকি অর্ধেকটাসহ আগামী ভাদ্র মাস পর্যন্ত পঞ্জিকার ঋতুচক্রে এবং মৌসুমি বায়ুর রুটিনে ঘোর বর্ষাকাল শেষ হয়নি। আবহাওয়া বিভাগ জানায়, এ মাস ও আগস্টে মৌসুমি বায়ু সক্রিয় থাকবে। বঙ্গোপসাগরে বর্ষারোহী একাধিক মৌসুমি নি¤œচাপ সৃষ্টিরও পূর্বাভাস দেয়া হয়েছে। এ অবস্থায় ‘পানি’ এই মুহূর্তে চট্টগ্রামবাসীর কাছে আতঙ্কের বিষয়েই পরিণত হয়েছে। কেননা কখন আবারও বর্ষণ ও জোয়ার একত্রিত হয়ে ভাসিয়ে তোলে মহানগরী। গত ২৪ জুলাই পর্যন্ত পূর্ববর্তী টানা ৩-৪ দিনের চট্টগ্রামে প্রবল বর্ষণের সাথে অমাবস্যর ‘জো’র প্রভাব যুক্ত হয়ে নগরীর বিস্তীর্ণ এলাকা ডুবে যায়।
গত তিন দিনে চট্টগ্রামে বর্ষণ না হলেও সেই জোয়ারে ও বর্ষণে প্লাবিত এলাকাগুলো থেকে পানি নেমে যাবার পর থেকে বাড়িঘর, দোকান, গুদাম, মার্কেট, শো-রুমগুলোর কাদা-পানি, বালি-মাটি ও জঞ্জাল সাফ করতে গিয়েই গতকাল পর্যন্ত হাজারো মানুষ হয়রান পেরেশান। এ বছর বর্ষা মৌসুম শুরুর আগে এবং চলমান ভরা মৌসুমে জোয়ার ও বৃষ্টিতে প্লাবিত হয়ে বিনষ্ট নিত্যপণ্য ও শিল্পের কাঁচামালের আর্থিক ক্ষতি ৫শ’ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে বলে ব্যবসায়ী নেতারা জানান। বেশক’টি বেসরকারি আইসিডিতেও পণ্যসামগ্রী সয়লাব হয় কাদা-পানিতে। সবচেয়ে ব্যাপক ক্ষতি হয় দেশের প্রধান পাইকারি ও ইন্ডেন্টিং বাজার চাক্তাই খাতুনগঞ্জ আছদগঞ্জে। যা সেখানে ২৯ এপ্রিল’৯১-এর সাইক্লোনেও হয়নি। চিটাগাং চেম্বার ও খাতুনগঞ্জের ব্যবসায়ী সংগঠনের নেতারা ইতোমধ্যে পানিসম্পদ মন্ত্রীর কাছে দ্রæত সমাধান চেয়েছেন। চাক্তাই খালের আমূল সংস্কার ও কর্ণফুলী মোহনায় নাব্যতা বৃদ্ধিতে ক্যাপিটাল ড্রেজিংসহ তারা সরকারের কাছে গতবছর থেকে ৭ দফা দাবি জানিয়ে আসছেন। ব্যবসায়ী, শিল্পপতি, চাটগাঁর সাধারণ মানুষ সবাই বলছেন, সিটি কর্পোরেশন, চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ), চট্টগ্রাম ওয়াসাসহ সেবাদানকারী সকল সরকারি সংস্থাকে সমন্বিত পরিকল্পনা সহকারে পানিবদ্ধতার ক্রনিক সমস্যা নিরসন করতে হবে। অন্যথায় চট্টগ্রাম বসবাসের আরও অযোগ্য হয়ে পড়বে। শিল্পায়ন, দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ, ব্যবসা-বাণিজ্য এমনকি সিংহভাগ রাজস্ব আহরণও মুখ থুবড়ে পড়বে।
বিশেষজ্ঞরা চান শহর রক্ষা বাঁধ
চট্টগ্রাম মহানগরীর ঘন ঘন ডুবে যাওয়া এবং লাখ লাখ মানুষের সীমাহীন ভোগান্তির শেষ হবে কী উপায়ে? এ প্রসঙ্গে জানতে চাওয়া হলে সাদার্ন ইউনিভার্সিটির প্রো-ভিসি আইইইবি চট্টগ্রামের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক এম আলী আশরাফ গতকাল ইনকিলাবকে বলেন, পরিকল্পিতভাবে শহর রক্ষা বাঁধ নির্মাণ করতে হবে। যথেষ্ট উঁচু করে সেই বাঁধ হতে হবে বাঁধ-সড়ক তথা মেরিন ড্রাইভওয়ে কাম এমব্যাঙ্কমেন্ট। সেখানে পর্যাপ্ত সংখ্যক ¯øুইচ গেইট থাকতে হবে, যাতে জোয়ার-ভাটার পানির স্বাভাবিক নিয়মে আসা-যাওয়া হতে পারে। এ বিষয়ে সরকার একটি উদ্যোগ গ্রহণ করেছে বলে জানান তিনি। তবে এর পাশাপাশি মহানগরী বৃষ্টি ও জোয়ারের পানিতে হঠাৎ ডুবে যাওয়া এবং দীর্ঘ সময় ধরে পানিবদ্ধতার সঙ্কট নিরসনের জন্য দু’টি পরামর্শ দিয়েছেন এই নগর বিশেষজ্ঞ। এক. মহানগরীর বেদখলকৃত ও হারিয়ে যাওয়া সকল খাল-ছরা ভূমির দলিল-ম্যাপ-খতিয়ান ইত্যাদি অনুসারেই পুনরুদ্ধারের জন্য অনতিবিলম্বে কঠোর পদক্ষেপ নিয়ে সংস্কার করতে হবে। তাহলে বৃষ্টি আর জোয়ারের পানি প্রকৃতির আপন নিয়মেই সাগরের দিকে নিষ্কাশিত হবে। দুই. পরিকল্পিত বাঁধ-সড়কের কাছাকাছি পর্যাপ্ত সংখ্যক জলাধার, পুকুর, ঢোবা রাখতে হবে। বেদখলে হারিয়ে যাওয়া নগরীর জলাশয়গুলো উদ্ধার ও সংস্কার করতে হবে। তাহলে সামুদ্রিক জোয়ারের পানি শহরের উপকূলীয় এলাকাগুলো অতিক্রম করে আসার আগেই কিংবা পাহাড়-টিলা বেয়ে পানি নেমে পানি জমে থাকার জন্য জলাধার গড়ে উঠবে। ওই দু’টি ব্যবস্থায় নদী, খাল-ছরা, নালা-নর্দমা ও জলাশয়ের মাধ্যমে চট্টগ্রাম নগরীর পানি ধারণ এবং বহনের ক্ষমতা বেড়ে যাবে বলে তিনি উল্লেখ করেন।
চট্টগ্রামে স্থায়ী ও মজবুত শহর রক্ষা বাঁধের গুরুত্ব প্রসঙ্গে বিশিষ্ট নগর পরিকল্পনাবিদ স্থপতি আশিক ইমরান গতকাল ইনকিলাবকে জানান, স্থায়ী শহর রক্ষা বাঁধ অবশ্যই প্রয়োজন যেহেতু চট্টগ্রাম হচ্ছে সমুদ্র উপকূলবর্তী নগর। এখন স্থায়ী বাঁধ না থাকায় নিয়মিত জোয়ারে দুইবার চট্টগ্রাম নগরীর বিরাট অংশ প্লাবিত হচ্ছে। টেকসই উঁচু শহর প্রতিরক্ষা বাঁধ নির্মাণ করে সঙ্গে পর্যাপ্ত সংখ্যক ¯øুইচ গেইট ও পাম্প আউটের ব্যবস্থা রাখতে হবে। নগরীতে বিদ্যমান ড্রেনেজ ব্যবস্থা বর্তমানে অকার্যকর। একে ঢেলে সাজাতে হবে, যা সময়ের দাবি। স্থায়ী শহর রক্ষা বাঁধ ও ড্রেনেজ ব্যবস্থার সংস্কারের জন্য সেবাদানকারী সংস্থা, বিভাগসমূহ ও বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ের উপর গুরুত্ব দিয়েছেন তিনি। জলবায়ু পরিবর্তনে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে যাচ্ছে উল্লেখ করে স্থপতি আশিক ইমরান বলেন, একে প্রযুক্তি দিয়ে মোকাবিলা করতে হবে। শহরকে তো আর পরিত্যক্ত করা যাবে না।
এদিকে অর্ধশতাধিক পাড়া ও বাণিজ্যিক এলাকা নিয়ে গঠিত নগরীর মধ্যাঞ্চলে আগ্রাবাদ এবং এর কাছাকাছি পশ্চিম ও দক্ষিণে বিস্তৃত হালিশহর, পতেঙ্গা, কাটগড়, পাহাড়তলী, সাগরিকা, কাট্টলী থেকে শুরু করে পূর্বে বাকলিয়া, চকবাজার, চাক্তাই খাতুনগঞ্জ আছদগঞ্জ, মোহরা, চান্দগাঁও ইত্যাদি এলাকায় জোয়ারের পানিতে সৃষ্ট পানিবদ্ধতা স্থায়ী সমস্যায় রূপ নিয়েছে। এ কারণে লাখ লাখ মানুষের অসহনীয় দুর্ভোগই যেন নিয়তি। এই এলাকায় অবস্থিত দেশের প্রথম ইপিজেড পানিবদ্ধতার হুমকির মুখে রয়েছে। তাছাড়া গার্মেন্টসহ কয়েক শ’ বিভিন্ন ধরনের শিল্প-কারখানা, চট্টগ্রাম বন্দরের পরিপূরক স্থাপনা, ব্যবসা-বাণিজ্য খাতের প্রতিষ্ঠান রয়েছে পানিবদ্ধতার কবলে। যেভাবে জোয়ার ও পানিবদ্ধতা বিস্তার লাভ করছে তাতে পতেঙ্গাসহ আরও বিস্তীর্ণ এলাকা ডুবতে পারে এমনটি শঙ্কা নগর বিশেষজ্ঞদের। সেসব এলাকায় প্রতিষ্ঠিত রয়েছে দেশের প্রধান জ্বালানি তেলের স্থাপনা, শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, অফডক, বিভিন্ন প্রতিরক্ষা স্থাপনা ও চট্টগ্রাম বন্দরের বিভিন্ন প্রকল্প ও পর্যটনকেন্দ্র। ইতোমধ্যে খাতুনগঞ্জ থেকে আগ্রাবাদ হালিশহর পর্যন্ত বিভিন্ন এলাকায় মানুষজন তাদের বসতঘর, দোকান-পাট, গুদাম, শো-রুম, কারখানায় জোয়ার ও বর্ষণের তোড়ে ক্ষয়ক্ষতি এড়াতে নিচতলায় ও গেইটে উঁচু করে দেয়ালের মতো বাঁধ নির্মাণ করেছে। তবুও শেষ রক্ষা হচ্ছে না।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ