Inqilab Logo

বুধবার, ০৩ জুলাই ২০২৪, ১৯ আষাঢ় ১৪৩১, ২৬ যিলহজ ১৪৪৫ হিজরী

পরীক্ষা ছাড়াই ভ্যাকসিন বাজারজাত

| প্রকাশের সময় : ২৯ জুলাই, ২০১৭, ১২:০০ এএম

অ্যানিমেল টেষ্টের ল্যাব নেই ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের; অর্থ বরাদ্দ থাকলেও জমি নেই : দেশীয় প্রতিষ্ঠানের প্রস্তুতকৃত ভ্যাকসিন থাইল্যান্ড ও ভারত থেকে পরীক্ষা করাতে হয়
হাসান সোহেল : অ্যানিমেল টেস্ট বা প্রাণির দেহের উপর পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়াই দেশে বাজারজাত হচ্ছে আমদানিকৃত নানা ধরণের ভ্যাকসিন। মানুষ বুঝে হোক আর না বুঝে হোক প্রতিনিয়তই এসব ভ্যাকসিন ব্যবহার করছে। প্রতিষেধক হিসেবে সুস্থ মানুষের শরীরে এটা ব্যবহার করলেও দেশে পরীক্ষা-নিরীক্ষার সুযোগ না থাকায় নানা ধরণের স্বাস্থ্য ঝুঁকি থাকছে। এদিকে এসব ভ্যাকসিন ব্যবহারে প্রয়োজনীয় ‘অ্যানিমেল টেস্টের ব্যবস্থা বা ল্যাব’ নিয়ন্ত্রক সংস্থা ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের নেই। এ কারণে দেশীয় ভ্যাকসিন প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলোও তাদের ভ্যাকসিন থাইল্যান্ড অথবা ভারত থেকে পরীক্ষা করাচ্ছে। এতে দীর্ঘসূত্রিতা এবং বড় অঙ্কের টাকা চলে যাচ্ছে বিদেশে। পাশপাশি বিদেশী ওষুধের ওপর নির্ভরশীলতাও বেড়ে যাচ্ছে এবং রোগীদের গুনতে হচ্ছে অতিরিক্ত অর্থ। ওষুধ প্রশাসন অধিদফতর বলছে, দেশেই ভ্যাকসিন পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য ইতোমধ্যে পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। একই সঙ্গে অর্থ বরাদ্দ আছে। তবে দায়িত্বপ্রাপ্তরা জমির অভাবের অজুহাত দেখিয়ে পরীক্ষাগার নির্মাণ করা সম্ভব হচ্ছে না বলে জানাচ্ছেন।
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, টিকাদান (ভ্যাকসিন) সুস্থ ব্যক্তির শরীরে সুনির্দিষ্ট জীবাণুর বিরুদ্ধে ভবিষ্যতে অনুরূপ জীবাণু থেকে সম্ভাব্য সংক্রমণ রোধের একটি প্রতিষেধকমূলক ব্যবস্থা। শুধু কাগজপত্রের উপর নির্ভরশীল না হয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর শতভাগ নিশ্চিত হয়ে ভ্যাকসিন ব্যবহার করা উচিত। অন্যথায় এসব ভ্যাকসিন ব্যবহারে মানব দেহে নানা ধরণের বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। তবে চোরাচালান ছাড়া সরকারি আমদানিকৃত ভ্যাকসিনের সকল পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেই দেশে আনা হয় বলে জানালেন স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক প্রফেসর ডা. আবুল কালাম আজাদ।
দেশের অনুন্নত স্বাস্থ্য ব্যবস্থা, অপর্যাপ্ত পয়ঃনিষ্কাশন, দূষিত বায়ূ ও খাবার পানি, অতিরিক্ত জনসংখ্যা, অপুষ্টি ও অন্যান্য কারনে কিছু রোগ লেগেই আছে। সাধারণ একজন মানুষের পক্ষে উন্নত দেশে উদ্ভাবিত টিকাগ্রহণ যথেষ্ট ব্যয়সাধ্য ও অসম্ভবও বটে। তাই অনেক সময় বাজারে যে সব ভ্যাকসিন পাওয়া যায় বাধ্য হয়ে সেসব ব্যবহার করতে হচ্ছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশের বাজারে দীর্ঘদিন ধরে নানা ধরণের ভ্যাকসিন ব্যবহার হয়ে আসছে। অত্যন্ত ব্যয়বহুল, উন্নত প্রযুক্তির বিষয় এবং উন্নয়নশীল দেশের সাধ্যাতীত হওয়ায় এসব ভ্যাকসিন ব্যবহারে সংশ্লিষ্ট আমদানীকারকদের উপরই নির্ভর করতে হচ্ছে দেশের মানুষের। এ ক্ষেত্রে কেউ নকল, মানহীন ও ভেজাল ভ্যাকসিন আমদানি করতে পারে। এসব অসাধু ব্যবসায়ীরা ভ‚য়া কাগজপত্র তৈরি করে তা বাজারজাতকরণেরও অনুমোদন করিয়ে নিতে পারে। যা স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত ঝুঁকির।
ওষুধ প্রশাসন অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের চতুর্থ অপারেশনাল প্লানের (২০১৭-২০২২) আওতায় ন্যাশনাল ড্রাগ টেস্টিং ল্যাবরেটরীর অধীনে ভ্যাকসিন পরীক্ষাগার তৈরির কাজ হাতে নেয়া হয়েছে। এ জন্য অ্যানিমেল হাউজ তৈরিতে ৭ কোটি টাকা এবং ল্যাবরেটরীর সরঞ্জামের জন্য ৩ কোটি ৮ লাখ টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। তবে অ্যানিমেল হাউজ ও পরীক্ষাগার তৈরির মতো জমি ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের নেই।
সূত্র মতে, বর্তমানে দেশে ভ্যাকসিন তৈরি করার কাজ হাতে নিয়েছে ইনসেপ্টা ফার্মাসিউটিক্যালস, পপুলার ফার্মাসিউটিক্যালস এবং বিকন ফার্মাসিউটিক্যালস। এই ৩টি প্রতিষ্ঠানটি কিছু ভ্যাকসিন তৈরি করছে। এছাড়া গøাস্কোস্মিথক্লাইন (জিএসকে), সানোফি অ্যাভেনটিস ও জনতা নামে ৩টি প্রতিষ্ঠান ভ্যাকসিন আমদানি করছে।
ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের সহকারি পরিচালক মো. সালাউদ্দিন জানান, ভ্যাকসিন পরীক্ষার সকল কেমিক্যাল টেস্টের ব্যবস্থা তাদের রয়েছে। তবে অ্যানিমেল টেস্টের ব্যবস্থা এখনো তৈরি হয়নি। এ ব্যাপারে একটি প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে। সেটি সম্পন্ন হলে দেশেই অ্যানিমেল টেস্ট করা সম্ভব হবে। তবে আপাতত ছোট পরিসরে ড্রাগ টেস্টিং ল্যাবরেটরির একটি কক্ষে টেস্ট করার ব্যবস্থা চলছে। আগামী ২/৩মাসের মধ্যেই ভ্যাকসিনের অ্যানিমেল টেস্ট করা সম্ভব হবে। এছাড়া সরকারিভাবে আমদানিকৃত প্রত্যেকটি ভ্যাকসিনই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রি কোয়ালিফিকেশন সার্টিফিকেট দেখে আনা হয়। তাই ওইসব ভ্যাকসিনের অ্যানিমেল টেস্ট করাতে হয় না। তবে দেশে প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানের ভ্যাকসিনগুলো থাইল্যান্ড এবং ভারত থেকে পরীক্ষা করা হয় বলে উল্লেখ করেন মো. সালাউদ্দিন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওষুধ প্রযুক্তি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. আবুল কালাম লুৎফুল কবির বলেন, ভ্যাকসিন উৎপাদন একটি জটিল প্রক্রিয়া। ভ্যাকসিন মূলতঃ বিদেশ থেকে আমদানি করে দেশের চাহিদা পূরণ করা হচ্ছে। যদিও দেশের কয়েকটি প্রতিষ্ঠান এখন ভ্যাকসিন উৎপাদন করছে।
তবে সব ধরণের ভ্যাকসিন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে শতভাগ নিশ্চিত হয়ে মানবদেহের জন্য ব্যবহার করা উচিত। কারণ ভ্যাকসিন নকল ও নি¤œমানের হতে পারে। পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে নিশ্চিত হয়েই ব্যবহার করতে হবে। এ জন্য সব ধরণের সক্ষমতা গড়ে তুলতে ওষুধ প্রশাসনকে ঢেলে সাজাতে হবে। একই সঙ্গে প্রয়োজনে আমদানি করা ভ্যাকসিন পাশ্ববর্তী দেশ ভারত, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, অস্ট্রেলিয়া অথবা ইউরোপের যে কোন দেশ থেকে পরীক্ষা করে নেয়া উচিত।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচারক প্রফেসর ডা. মো. আবুল কালাম আজাদ বলেন, সরকারিভাবে ব্যববহৃত সকল ভ্যাকসিন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রি-কোয়ালিফিকেশন সার্টিফিকেট দেখেই আনা হয়। এক্ষেত্রে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে শতভাগ মান সম্মত ওষুধই আনা হয়। তিনি বলেন, যদি চোরাচালানের মাধ্যমে ভ্যাকসিন আসে তাহলে নি¤œমানের আসতে পারে। যার সুযোগ খুবই কম বলে উল্লেখ করেন তিনি। তবে ন্যাশনাল ড্রাগ টেস্টিং ল্যাবরেটরির অধীনে ভ্যাকসিন পরীক্ষাগার তৈরির কাজ হাতে নেয়া হয়েছে। এটি নির্মিত হলে ভবিষ্যতে সমস্যায় পড়তে হবে না। ডা. আবুল কালাম আজাদ জানান, ৬টি টিকা দিয়ে ১৯৭৯ সালে বাংলাদেশে শুরু হওয়া ইপিআই কার্যক্রমে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নতুন টিকা সংযোজন করা হয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় ২০১৫ সালে টিকার সংখ্যা ১১টিতে উন্নীত হয় যা ২০১৮ সালে ১৩টিতে উন্নীত করার পরিকল্পনা রয়েছে। দেশের কয়েকটি প্রতিষ্ঠান কয়েকটি ভ্যাকসিন তৈরিও করছে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ